আমি এবং আমিত্বের রূপ
পৃথিবীতে ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দ দু’টির ব্যবহার যতো বেশি হয়, হয়তো আর কোন শব্দের ব্যবহার এতো বেশি হয় না। আপনার আদরের শিশুকে জিজ্ঞাসা করুন, এ বাড়িটি কার? সে উত্তর দেবে আমার। এই বালিশটি কার? সে উত্তরে বলবে আমার। পত্রিকায় শত গুরুত্বপূর্ণ লেখা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সর্বপ্রথম আপনার নজর পড়বে আপনার লেখাটির প্রতি। এবং বার বার ঐ লেখাটি
পড়তেও আপনার মন চাইবে। কারণ কি? আপনারই তো লেখা, আপনার মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসা সেই লেখাই তো, যা আপনার হাত দিয়েই লিখেছেন। এখন ছাপার অক্ষরে দেখে বার বার পড়তে মন চাইছে কেন? উত্তর মনে হয় একটাই, আর তাহলো, লেখাটি আপনার, এ জন্যই। এতেও কাজ করছে সেই ‘আমার’।
মানুষ আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি। এ কথাটা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি। তবে কি কি কাজে আমাদের এই প্রতিনিধিত্ব, তা মনে হয় বিশদভাবে আমরা অনেকেই জানি না। আল্লাহর অনেকগুলো গুণাবলি আছে, তার মধ্যে কিছু গুণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমরা সকলেই আদিষ্ট। যেমন আল্লাহ রায্যাক বা রিযিকদাতা। আমাদের প্রতিও হুকুম রয়েছে গরিব-দুঃখীদের খোঁজ-খবর করে অভুক্তকে অন্ন দেয়ার ব্যাপারে আমরা যেন সচেষ্ট হই। আল্লাহ রাহমান বা দয়ালু। আমাদের প্রতিও হুকুম দেয়া আছে, আমরা যেন আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শন করি। এমনিভাবে আল্লাহর অনেক সিফাত বা গুণাবলির ব্যাপারে আমাদেরকে খলীফা বা প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন এবং আল্লাহ চান যে আমাদের মাধ্যমে আল্লাহর ঐ সকল গুণাবলির প্রকাশ ঘটুক। পক্ষান্তরে আল্লাহর আরো কিছু সিফাত বা গুণাবলি রয়েছে, যা আমাদের মধ্যে থাকাটা তিনি চান না। যেমন আল মুতাকাবিবর, আল্লাহর একটি সিফাত বা গুণ। বড়াই করা তাঁকেই শোভা পায়। এ ব্যাপারে বান্দার কোন প্রতিনিধিত্ব নেই; বান্দাকে বিপরীতটা করার জন্যই আদেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ বিনয়ী হওয়ার জন্যই আদেশ রয়েছে। এ জন্যই হাদীসে কুদসীতে ‘আল কিবরিয়াউ রেদা-য়ী, অর্থাৎ বড়ায়ী আমার চাদর, একথা বলা হয়েছে। যে অহংকার করবে, সে যেন আল্লাহর চাদর নিয়েই টানা হেঁচড়া করবে। তাই বান্দার জন্য অহংকার করা শোভা পায় না। অহংকার শুধু তাঁকেই শোভা পায়, যিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং কারো মুখাপেক্ষী নন। আমরা সবাই তাঁর মেহেরবানীতেই সৃষ্ট এবং তাঁর কাছে মুহূর্তে মুহূর্তে মোহতাজ। আমাদের অহংকার করা বেকুবী ছাড়া আর কিছুই নয়।
মহান রাববুল আলামীন তাঁর আমি ও আমিত্বের প্রকাশ ঘটাবার জন্য মানুসসহ কুল মাখলুকাতকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়ার কারণে তার মধ্যেও এই আমি ও আমিত্বের প্রকাশ ঘটাবার অদম্য ইচ্ছা বা কামনা বিদ্যমান দেখা যায়। অথচ যেক্ষেত্রে আমি ও আমিত্বের দ্বারা অহংকার ও গর্ব প্রকাশ পায়, সেক্ষেত্রে আমি ও আমিত্বের ব্যবহার অবৈধ। তাই সুফিয়ায়ে কেরাম রিয়াজত-মুজাহাদার মাধ্যমে স্বীয় মুরিদকে আমি ও আমিত্ব থেকে শূন্য করে ফেলেন। তাঁরা বলেন, আনাকে (আমিত্ব)কে ফানা কর। এমনকি স্বীয় আমিত্বকে খোদার আমিত্বে বিলীন করে দেন। তখন একজন সালেক বা মুরিদ নিজের আমিত্বকে, নিজের অস্তিত্বকেও আল্লাহর সামনে লীন করে দেন। আর একে আধ্যাত্মিক পরিভাষায় ফানাফিল্লাহ বলা হয়। মানুষ যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে, আবারও মৃত্যুর মাধ্যমে অনস্তিত্বে চলে যাবে, তাই মাঝখানের এই অস্তিত্বকে অস্তিত্বই বলা যায় না। ফানী বলা যায়।
পক্ষান্তরে আল্লাহ যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করেননি; বরং তিনি সব সময় অস্তিত্বে আছেন এবং থাকবেনও, তাই একমাত্র তিনিই অস্তিত্বের আসল রূপ বা হাকীকত। আর তিনিই একমাত্র বাকী (আলবাকী)। যাঁরা সাধনার মাধ্যমে নিজের আমিত্ব এবং অস্তিত্বকে ঐ চিরস্থায়ী হাইয়ুন-কাইয়ুম আল্লাহর সামনে বিলীন করে দিয়ে ফানা ফিল্লাহর মাকাম অর্জন করতে সক্ষম হন তাঁরা তাঁদের এই ফানা হওয়ার সাধনার মধ্য দিয়ে বাকা বিল্লাহর মাকামও পেয়ে যান। বিশ্বকবি আল্লামা ইকবাল মরহুম এই আমিত্বের ওপর অনেকগুলো দর্শনদীপ্ত কবিতা লিখেছেন। তাতে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, নিজের খুদী বা আমিত্বকে সাবলিলভাবে প্রকাশ করা উচিত। খুদী বা আমিত্বকে একেবারে বাদ দেয়া যেমন যাবে না, তেমনি খুদীর ওপর গর্ব বা অহংকারও করা যাবে না। নিজের খুদী বা আমিত্বের পরিচয় লাভ করা প্রতিটি মানুষের জন্যই জরুরী। তাই কোন বুযুর্গ বলেছেন, ‘মান আরাফা নাফ্সাহু ফাকাদ আরাফা রাববাহু’। অর্থাৎ যে নিজের অস্তিত্ব বা নিজকে চিনেছে, সে অবশ্য তার রব বা প্রতিপালককেও চিনতে সক্ষম হবে।
তাই বলছিলাম, সবখানে যেন আমরা আমি আমি ও আমার আমার না করি। কেননা, আমি নিজেও তো আমার নই, আমিও তো মহান আল্লাহর। আমি নিজেই যখন আমার নই, অন্য বস্ত্ত আমার কি করে হবে? #