বাইতুল্লাহর মুসাফির-৮
মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কিন্তু আল্লাহ যখন সাহায্য করেন, বান্দা তখন সঠিক পথ অনুসরণ এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। ফলে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও, যখন সামনে কোন পথ খোলা থাকে না, কীভাবে যেন পথ খুলে যায় এবং বান্দার কাজ হয়ে যায়। কাজ তো হয় পর্দার আড়ালে গায়বের ইশারায়, কিন্তু বান্দা পড়ে যায় বুদ্ধি-কৌশলের ধাঁধায়। দৃষ্টি তার চলে যায় নিজের যোগ্যতা ও কর্মকুশলতার দিকে। একবারও সে ভাবে না যে, অনেক সহজ এবং অনুকূল অবস্থায়ও তো তার বুদ্ধি-কৌশল বহুবার ব্যর্থ হয়েছে! অবশ্য প্রকৃত সত্য যাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় তারা লুটিয়ে পড়ে সিজদায় এবং বিগলিত হয় কৃতজ্ঞতায়। তবে আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন-
‘আমার বান্দাদের মাঝে কৃতজ্ঞ খুব অল্পই আছে।’
যাই হোক, আল্লাহ আমাকে সাহায্য করলেন, আমি ভাবলাম, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ হবে সময়ের অপচয়, অথচ আমার জন্য সবচে’ বড় সংকট তখন সময়। ঘড়ির কাঁটা পার হয়ে গেছে দশটা পনের। কাল বিলম্ব না করে আমি ছুটে গেলাম ইরাকী দূতাবাসে। ওখানে আমার পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা ছিলো। মাননীয় রাষ্টদূত সব শুনে মৃদু হেসে বললেন, এটা কোন সমস্যা হলো! দেখো, এক্ষুণি তোমার কাজ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি রিসিভার তুলে সউদী রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামীদ আলখাতীবের সঙ্গে কথা বললেন এবং কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করলেন।
মাননীয় রাষ্ট্রদূত নিজের ব্যক্তিগত কার্ডের উল্টো পিঠে স্বাক্ষর করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আশা করি, এবার সেখানে কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না; তবে আমি বুঝতে পারি না, এসব ক্ষেত্রে তোমরা ‘ওদের’ চেয়ে পিছিয়ে কেন?
পিছিয়ে থাকার কারণ এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু আমার কি তখন কিছু বলার এবং শোনার সময়! তাই প্রসঙ্গ এড়িয়ে আমি তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে উঠতে চাইলাম। কিন্তু তিনি আমাকে হাত ধরে বসালেন। আমি অবাক হলাম এবং কিছুটা উৎকণ্ঠা বোধ করলাম সময়-সংকটের কথা ভেবে।
কিন্তু আমি জানতাম না, আমার জন্য তখন অপেক্ষা করছে একটি মধুর বিস্ময়। আসলে এমনই হয়। বান্দাকে আল্লাহ যখন দয়া করেন তখন করতেই থাকেন। বান্দা চায় সামন্য কৃপা দৃষ্টি, অথচ শুরু হয় রহমতের বৃষ্টি! প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা, তারপর মুষলধারে! সে বৃষ্টিধারায় বান্দা স্নাত হয় এবং সুসিক্ত হয়। বান্দা আপাদমস্তক ভিজতে থাকে এবং ভিজতে ভিজতে ...., কিন্তু রহমতের মেঘ সরে না এবং দানের বর্ষণ থামে না। বান্দা যত দুর্বল হয় রহমতের জোশ তত প্রবল হয়! দানের ভান্ডারে গোনাহগার বান্দার অধিকার যেন আরো বেশী! কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, প্রতিনিয়ত আমরা দান গ্রহণ করি, কিন্তু দাতাকে স্মরণ করি না এবং জীবনের অঙ্গনে তাঁকে বরণ করি না। পরম দয়ালু দাতা তবু দানের ভান্ডার বন্ধ করেন না। তিনি আশা করেন, জীবনের কোন এক শুভলগ্নে হয়ত বান্দা তাঁর কাছে ফিরে আসবে এবং কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে বলবে, ‘অনেক বিলম্ব করেছি, তবু হে আল্লাহ, আমি ফিরে এসেছি!’
প্রিয় পাঠক! আবেগের ঢেউ হয়ত আমাকে কিছুটা দূরে নিয়ে গেছে। আমি বলছিলাম, আমার জন্য তখন অপেক্ষা করছিলো একটি মধুর বিস্ময়। মাননীয় রাষ্ট্রদূত বললেন, আমি অবাক হয়েছি, হাফেজ্জী হুযূরের সফরসঙ্গীদের তালিকায় তোমার নাম না দেখে। তুমি এসেছো, ভালোই হলো। এক কাজ করো, হজের পর তুমিও আমাদের বাগদাদ দেখে আসো।
আমি মৃদু হেসে বললাম, বাগদাদ শুধু তোমাদের! তাহলে সুদূর বাংলাদেশের বাসিন্দা হয়েও কেন শৈশব থেকে বাগদাদকে ভালোবাসলাম! কেন কারবালার জন্য এত কাঁদলাম!
তিনি কিছুটা অপ্রস্ত্তত হয়ে বললেন, ‘আফওয়ান’!
মাননীয় রাষ্ট্রদূতের এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব আমার কাছে মনে হলো, আল্লাহর পক্ষ হতে আরেকটি নেয়ামত। কারণ বাগদাদের সফর সম্ভব হলে হজের পরও হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ছোহবত লাভের সৌভাগ্য হবে। আমি খুশির সাথে রাজি হলাম এবং এজন্য পুনরায় তাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম।
তিনি বললেন, তুমি একজন ভালো ইনসান। অল্পকে তুমি অনেক মনে করো। এটা ভালো গুণ। আমার বয়স তোমার দ্বিগুণ; আমি তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা করি।
তিনি আরো বললেন, আমি বাগদাদে এবং জিদ্দায় যোগাযোগ করছি। (মাওলানা) মুহিউদ্দীন খান আমাদের জিদ্দা দূতাবাস থেকে তোমার ভিসার ব্যবস্থা করবেন।
আবার ছুটলাম ‘রাজকীয়’ সউদী দূতাবাসের উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাঁটা তখন এগারটা ত্রিশে। হে আল্লাহ, তুমি তাওফীক দিলে আমি শুধু দৌড়ঝাঁপ করতে পারি। দরজা খোলা তো তোমার কাজ! সৌভাগ্য তো আসে তোমার নির্দেশে তোমার কুদরতের পথ ধরে, বান্দার চেষ্টা-তাদবীরে নয়। জানি না, আমার তাকদীরে তুমি কী রেখেছো; তবে তোমার ইচ্ছার কাছে আমি আত্মসমর্পণ করছি হে আল্লাহ!
আমি তাদবীর করবো এবং তাকদীরকে কবুল করে নেবো; মজবূর হয়ে নয়, খুশী হয়ে।
রাজকীয় দূতাবাসের সামনে দন্ডায়মান ‘রাজকীয় প্রহরী’ এবার সদয় হলেন এবং ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। সেখানে দেখলাম, মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেব (হযরত হাফেজ্জী হুযূরের প্রিয়ভাজন খলীফা) অসহায় অবস্থায় বসে আছেন। বুঝতে অসুবিধা হলো না, তিনি কী পরিস্থিতির সম্মুখীন।
ভিসার দায়িত্বে নিয়োজিত সহকারী অফিসার বাঙ্গালী। চেহারা থেকেই আমাদের উভয়ের ‘পরিচয়’ পরিষ্কার। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন ইকামাতে দ্বীন ...।
দুঃখ হলো; ক্রোধ যে হলো না তাও নয়, কিন্তু আমার তখন একমাত্র লক্ষ্য বাইতুল্লাহর সফরের ছাড়পত্র, পর্যটনের পরিভাষায় যার নাম ভিসা! সুতরাং হে মহামান্য রাজকর্মচারী! তোমার তাচ্ছিল্য তো তুচ্ছ বিষয়, পা দু’টো যদি এগিয়ে দাও, আমি তা চুম্বন করবো, তবু দয়া করে মসজিদুল হারামের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িও না। একটু সহযোগিতা করো; আল্লাহ তোমার মঙ্গল করবেন।
ইরাকী রাষ্ট্রদূতের স্বাক্ষরযুক্ত কার্ডটি ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলাম এবং যথাসাধ্য বিনয় ও নম্রতার সাথে আমার উদ্দেশ্য বললাম। এর মধ্যে তার ফোন বেজে উঠলো এবং তিনি রিসিভার তুলেই তটস্থ হলেন। রিসিভার নামিয়ে তিনি বেশ সমীহ প্রকাশ করে বললেন, মাননীয় রাষ্ট্রদূত আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেবকে বললাম, আপনার পাসপোর্ট দিন। পাসপোর্ট দু’টো নিয়ে উপরে গেলাম। রাষ্ট্রদূতের বিশাল ও জমকালো দফতর। আগে কখনো আসা হয়নি। ইরান, ইরাক, লিবিয়া এবং আরব আমিরাতের দূতাবাসে আমি গিয়েছি; আকাশ-পাতাল পার্থক্য, হওয়ারই কথা। এটা রাজার দূতাবাস; এখানে সবকিছু রাজকীয়!
সালাম ও কুশল বিনিময় হলো। মাননীয় রাষ্ট্রদূত আরবীয় ঐতিহ্য অনুসারে যথেষ্ট সৌজন্যের পরিচয় দিলেন। তিনি জানতে চাইলেন, এখানে কী সমস্যা হয়েছিলো, যার কারণে আমাকে ইরাকী ‘ছাফীরের’ শরণাপন্ন হতে হলো?
আমি বললাম, দেখুন; আমার হাতে সময় অত্যন্ত কম। ঠিক দু’টোয় আমার ফ্লাইট। দয়া করে এই দু’টো পাসপোর্টে ভিসার ব্যবস্থা করে দিন। আমি এখনই রওয়ানা হতে চাই। অন্য বিষয়, সুযোগ হলে অন্য সময় আলোচনা করা যাবে।
বাঙ্গালী অফিসার ভদ্রলোককে তলব করে আনা হলো এবং আল্লাহর রহমতে দশমিনিটে ভিসা হয়ে গেলো। যখন হয়, এভাবেই হয়; যখন হয় না তখন কোনভাবেই হয় না। ‘তোমার দানে কেউ বাধা দিতে পারে না, আর তুমি বাধা দিলে কেউ দিতে পারে না।’
দূতাবাস থেকে যখন বের হলাম, ঘড়ি তখন বারোটা পার হয়ে এগিয়ে গেছে কিছু দূর। মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেবের ফ্লাইট আগামীকাল। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁর বড়ত্বের পরিচয় দিলেন। আমি বললাম, আপনার একটু খিদমতের সুযোগ হলো; এটা আমার সৌভাগ্য। আশা করি, আল্লাহর ঘরে দেখা হবে।
বাচ্চাকোলে এক ভিখারিণী সামনে এসে হাত পেতে দাঁড়ালো। হায়, তখন যদি আমার তাওফীক থাকতো! মাত্র দশটি টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে আমি আমার আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলাম। দশটাকাতেই ভিখারিণী এত খুশী হলো এবং এত দু‘আ দিলো যে, আমি অভিভূত হলাম। সব সময় দেখেছি; দানে ভিখারীরা আমাদের চেয়ে বড়। আমরা দান করি সামান্য পয়সা, তারা দান করে কৃতজ্ঞতা-সিক্ত অসামান্য দু‘আ। গরীবের দু‘আ আমাদের জীবনকে সুখী-সমৃদ্ধ করতে পারে, যদি আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে তা গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু আমার মনে হয়, গরীবের মুখ থেকে উচ্চারিত প্রার্থনাকে আমরা ততটা গুরুত্ব দেই না এবং সাদরে গ্রহণ করি না।
আনন্দে কৃতজ্ঞতায় উদ্ভাসিত ঐ ভিখারিণীর চেহারাটি আমার আজো মনে পড়ে, এমনকি তার কোলের কঙ্কালসার বাচ্চাটির অবাক চাহনিও! আমার সেদিন মনে হয়েছিলো, সে বুঝতে পেরেছে, তার মা কত খুশী হয়েছে! তার চোখের অবাক দৃষ্টি সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছিলো।
জানতে বড় ইচ্ছে করে, এই পাষাণ পৃথিবীতে অসহায় ঐ ভিখারিণী মা কি তার কোলের সন্তানকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পেরেছে? এরা মা হয়; এদেরও বুকে থাকে মায়ের মন এবং মাতৃমমতা। সন্তানকে এরা মায়া-মমতা দিতে পারে, বুকের উত্তাপ দিতে পারে, একজন সুখী মায়ের মতই। কিন্তু দিতে পারে না ক্ষুধার অন্ন, জীবনের নিরাপত্তা এবং বেঁচে থাকার অবলম্বন; শিক্ষা তো অনেক দূরের কথা। তবু এরা মা! এবং আমার মায়ের মতই মা! এদেরও পায়ের নীচে থাকে সন্তানের জান্নাত! সন্তানের জন্য এদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ কি পৃথিবীর আর কোন মায়ের চেয়ে কম! কীভাবে তাহলে ভিখারিণী মাকে আমরা তার
সন্তানের সামনে অসম্মান করি! নাকি নিজেদের কাছে নিজেরাই আমরা অসম্মানিত হই! এমন মর্মান্তিক দৃশ্য আমি অনেক দেখেছি। দরজায় দাঁড়িয়ে ভিখারিণী মা নিজের জন্য নয়, ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য চেয়েছে দু’লোকমা ভাত, আর পেয়েছে নির্মম আঘাত। দুঃখে লাঞ্ছনায় তার চোখ ফেটে এসেছে জল, আর কোলের সন্তান চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেছে, থাক মা কাইন্দো না! এমন দৃশ্য আমি দেখেছি, একবার নয়, অনেক বার। প্রিয় পাঠক, হয়ত দেখেছো তুমিও। ভিখারিণী মাকে যদি ইচ্ছে হয় খালি হাতে ফিরিয়ে দিও, কিন্তু সন্তানের সামনে লাঞ্ছিত করো না। এটা কিন্তু আসমানে জমা হয় এবং একসময় নেমে আসে।
এই যে ভিখারিণী মা আমার সামনে হাত পেতে দাঁড়ালো, কে এর জন্য দায়ী? সমাজ ও সামাজিক বৈষম্য? অর্থব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শোষণ? ব্যক্তি হিসাবে কিছু দায় কি আমার উপরো বর্তায় না? মাতৃত্বের এ অসহায়ত্ব কত বার কতভাবেই তো দেখেছি, কিন্তু আমি কি চেষ্টা করেছি অন্তত একজন মাকে তার মাতৃত্বের অসহায়ত্ব থেকে উদ্ধার করার? শুধু হজ করা, শুধু আল্লাহর ঘরে যাওয়া কি যথেষ্ট?
বিগত যুগের এমন ঘটনা তো কিতাবে পড়েছি, আল্লাহর নেক বান্দা এক ক্ষুধার্ত পরিবারকে হজের পাথেয় দান করে মাঝ পথ থেকে ফিরে এসেছেন, অথচ ঐ বছর তারই ওছিলায় নাকি সকলের হজ কবুল হয়েছে!
সন্তানকোলে ভিখারিণী মা ততক্ষণে চলে গেছে অনেক দূরে। আমি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে প্রতিজ্ঞা করলাম, অন্তত একজন অসহায় মাকে আমি তার লাঞ্ছনার জীবন থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবো। এতটুকু সাধ্য মনে হয় আমার আছে। এটাই হবে আমার আল্লাহর ঘরে যাওয়ার তাওফীক লাভের শোকরানা।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে হুঁশ হলো। অন্য সময় যেমন হোক, এখন সময় আমার জন্য সবচে’ মূল্যবান; একটি মিনিট যেন একটি হীরকখন্ড! তবু মনে হলো, ইরাকের মাননীয় রাষ্ট্রদূতকে সুসংবাদটুকু না দিয়ে এবং ধন্যবাদ না জানিয়ে চলে যাওয়াটা সঙ্গত হবে না। পরে দেখা গেলো, এই কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন সেদিন আমারই উপকার করেছিলো।
একটা রিকশা নিয়ে গেলাম ইরাকী দূতাবাসে। মাননীয় রাষ্ট্রদূত তখন বের হওয়ার জন্য গাড়ীতে উঠছেন। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আল্লাহর রহমতে, তারপর তোমার ওছিলায় আমি ভিসা পেয়ে গেছি। তিনি খুশী হলেন। ঘড়ি দেখে বললেন, সময় তো খুব কম। দু’টোর সময় ফ্লাইট বলছিলে না! চলো তোমাকে বিমানবন্দরে নামিয়ে দেবো। এই সাহায্যটুকুর সত্যি তখন খুব প্রয়োজন ছিলো। এটা ছিলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দুনিয়াতে প্রথম পুরস্কার, অথচ শুধু আখেরাতের জন্যই আমাদের এটা করা উচিত।
বিমানবন্দরে প্রবেশের মুখে দেখি, সামনের বাসে পিছনের আসনে আমার বন্ধু মাওলানা ইসমাঈল বরিশালী এবং পাহাড়পুরী হুযূর। ইসমাঈল বরিশালী পিছনে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেলেন। ‘আকলমন্দ’কে হাতের ইশারায় সুসংবাদ জানালাম। সম্ভবত তিনি পাহাড়পুরী হুযূরকে বললেন। হুযূর হাসিমুখে পিছনে ফিরে হাতের ইশারায় জানালেন, ‘আল্লাহর শোকর’!
মাননীয় রাষ্ট্রদূত মৃদু হেসে বললেন, তোমার বন্ধুরা তোমার সৌভাগ্যে খুব খুশী! আমি বললাম, এ জন্য সবার আগে তোমাকে ‘জাযাকাল্লাহ’।
দূর থেকে দেখলাম, আমার প্রিয় ভাই বশির - এখন সে অনেক বড়, তখন ছিলো অনেক ছোট- ব্রিফকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে, আর অস্থিরভাবে বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। মাননীয় রাষ্ট্রদূতকে বললাম, ঐ দেখো, আমার ছোট ভাই আমার জন্য কেমন অস্থির! আমার মা-বাবা তোমার জন্য অনেক দু‘আ করবেন। ঘরে এখন তারা আমার খবর জানার জন্য ছটফট করছেন।
রাষ্ট্রদূতেরা কূটনীতির জগতের বাসিন্দা। আপাদমস্তক তারা কূটনীতির ধাতু দিয়ে গড়া। তাদেরকে বলা হয় আবেগমুক্ত মানুষ। কিন্তু ইরাকী রাষ্ট্রদূত সেদিন আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। আমার জীবনে এই প্রথম কোন রাষ্ট্রদূতের চোখে অশ্রু দেখার সুযোগ হলো। আমার বড় ভালো লাগলো। এ সফরনামা যখন লিখছি, তার দেশ তখন হিংস্র শ্বাপদের বিচরণভূমি। তিনি কি বেঁচে আছেন! আমার মা-বাবার দু‘আ কি এই বিপদের দিনে তাকে ছায়া দিতে পেরেছে!
আমার মুখের হাসি থেকেই বশিরের সব বুঝে নেয়ার কথা, তবু সে ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, কী খবার বড় ভাই সাব? ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের এ অন্তরঙ্গ ব্যগ্রতা আমার খুব ভালো লাগলো। হয়ত সে জানে না, আমি আজো তার জন্য দু‘আ করি, সেদিন আমার জন্য তার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য।
তাকে সুসংবাদ জানালাম। সে বললো, আপনি বের হয়ে আসার পর আম্মা কেঁদে কেঁদে অনেক দু‘আ করেছেন।
বশিরকে বললাম, সবাই মিলে আম্মার দিকে খেয়াল রেখো। আম্মাকে, আববাকে আমার সালাম বলো। আর বলো, তাদের দু‘আর ওছিলায় আল্লাহ সবকিছু আসান করে দিয়েছেন।
মাননীয় রাষ্ট্রদূত শেষ মুহূর্তে যে আখলাক ও সৌজন্যের পরিচয় দিলেন তার কোন তুলনা নেই। গাড়ী থেকে নেমে আমাকে আলিঙ্গন করলেন। একশ ডলার আমার হাতে দিয়ে বললেন-
...
এটা একজন মুসলমান ভাইয়ের পক্ষ হতে আল্লাহর ঘরে খরচ করার জন্য।
আমি শুকরিয়ার সাথে তার হাদিয়া গ্রহণ করলাম। এর পর আর কোন দিন তার সাথে আমার দেখা হয়নি; কোন খবরও পাইনি। হে আমার মুসলিম ভাই! তুমি যেখানেই থাকো, আল্লাহ তোমাকে নিরাপদ রাখুন।
দু‘আ চেয়ে মুছাফাহার জন্য পাহাড়পুরী হুযুরের দিকে হাত বাড়ালাম। মুছাফাহার পরিবর্তে তিনি আমাকে বুকে নিলেন, আর বললেন, আপনাকে অনেক কষ্ট দেয়া কথা বলেছি, আল্লাহর ঘরে গিয়ে আমার কথা মনে থাকবে তো!
আবেগ তখন আমাকে ভিতর থেকে দলিত মথিত করছিলো। হৃদয়ের প্রতিটি অণু তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত ছিলো। অনেক কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু শুধু বলতে পারলাম, জাযাকাল্লাহ। ।
আমি তো তাঁর ইহসানের কোন বদলা দিতে পারবো না, আল্লাহ দেবেন, আমার পক্ষ হতে। তিনি আমার প্রতি আরো ইহসান করেছেন, তখন হজের পর এই সফরনামা লিখতে না দিয়ে এবং আজ এতদিন পর লেখার অনুমতি দিয়ে। আমার মাথার উপর তাঁর ছায়া যেন আরো দীর্ঘ হয়।
বিমানবন্দরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মাওলানা আতাউল্লাহ, হাজী সিরাজুদ্দৌলা এবং হাবীবুর রহমান তিতাস তাদের সামান দিয়ে দিয়েছেন এবং ভিতরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাকে দেখে মাওলানা তো অবাক এবং কিছুক্ষণ নির্বাক! বিস্ময়ের ঘোর যখন কাটলো, বে-ইখতিয়ার আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, কিসমত হয়ত শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গ ত্যাগ করেছে। যদি সঙ্গ ত্যাগ করতো, কিসমতকে দোষ দেয়া যেতো না। কারণ পদে পদে কিসমতকে আমি চিনতে ভুল করেছি। তবু কিসমত আমার প্রতি বিমুখ হয়নি, টেনে টেনে আমাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে; সামনে আল্লাহর ইচ্ছা!
প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমরা ভিতরে যাওয়ামাত্র বিমানে আরোহণের ঘোষণা হলো। তখন যুহরের সময়। আমরা চার পাঁচজন জামাতের সাথে কছর পড়ে বিমানের উদ্দেশ্যে বাসে করে রওয়ানা হলাম।
বিমানের সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে মনের যে অবস্থা হলো তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আনন্দের, পুলকের, শিহরণের সবক’টি শব্দ একত্র হয়েও আমার তখনকার বিগলিত হৃদয়ের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারবে না। প্রয়োজনই বা কী! হৃদয় যার সৃষ্টি, হৃদয়ের আনন্দ যার দান, হৃদয়ের সব অনুভূতি তো তাঁরই জন্য নিবেদিত, আর হৃদয়ের কোন কিছু তাঁর কাছে অপ্রকাশিত নয়।
কয়েক দিন আগে গভীর রাতে যেখানে দাঁড়িয়ে হযরত হাফেজ্জী হুযূরের বিমানে আরোহণ এবং তারাভরা আকাশে বিমানের উড্ডয়ন দেখেছিলাম, আর আকাশের মহাশূন্যতার দিকে তাকিয়ে মিনতি জানিয়েছিলাম সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছেন পাহাড়পুরী হুযূর। আমি হাত নাড়লাম, তিনিও। শোকর ও কৃতজ্ঞতার প্রশান্তি তখন আমার সারা অন্তর জুড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম, হে আল্লাহ, তুমি কী না করো! তুমি কী না করতে পারো! সবই তোমার কুদরতের কারিশমা হে আল্লাহ!
বিমান আকাশে উড়লো, আমিও ডানা মেলে উড়াল দিলাম কল্পনার আকাশে এবং চলে গেলাম জিদ্দা বিমানবন্দরে বিমানের অনেক আগে। সেখান থেকে মরুভূমির দীর্ঘ পথ এবং পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম সোনার মদীনায়, অনেক স্বপ্ন দেখার পর এই সেদিন যেখানে হাযির হয়েছিলাম মাত্র একদিনের সৌভাগ্য নিয়ে। ছোট্ট সময়ের সামান্য স্মৃতি, কিন্তু সেই স্মৃতির মধুর অনুভূতি এখনো জাগরূক আমার অন্তরে।
আকাশপথ পাড়ি দিতে দিতে আমি বিভোর ছিলাম মদীনার স্বপ্নে। কবি যেন আমারই হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করেছেন এভাবে-
‘হৃদয়ের অঙ্গনে প্রেমের প্রদীপ জ্বেলে/ দুরূদের তাছবী পড়ে ছাল্লি আলা বলে/ হে শাহে মাদীনা, আসছি আমি তোমার দুয়ারে/ পথে মৃত্যু হলে হে প্রাণ, তুমি গিয়ে সালাম বলো তাঁরে।’
আমার কল্পনার মধুর সুরঝঙ্কার হঠাৎ ছিন্ন হলো এবং আমি জেগে উঠলাম মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেবের ডাকে। তিনি জানতে চাইলেন, এত অল্প সময়ে কীভাবে ভিসার ইনতিযাম হলো? আমি কিছুটা লজ্জিত হলাম। আসলে নিজে থেকেই আমার বলা উচিত ছিলো তাকে। আগগোড়া ঘটনা বললাম। তিনি বিস্ময়াভিভূত হলেন এবং বললেন, কুদরতের এর চেয়ে প্রকাশ্য নমুনা আর কী হতে পারে! আল্লাহর শোকর, আল্লাহ আপনাকে এনেছেন। আপনার বিষয়ে আমি অনেক কষ্টের মধ্যে ছিলাম। আমার দিলের তামান্না ছিলো, আপনার সফরের কোন একটা ইন্তিযাম যেন হয়ে যায়।
বিমানের জানালাপথে নীচে তাকিয়ে এমন অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্য দেখতে পেলাম, যা এখনো আমার চোখে ভাসে। পরে যত বার আল্লাহর ঘরের সফর হয়েছে, সে দৃশ্যটি আমি দেখার চেষ্টা করেছি, দেখতে পাইনি। বিমান হয়ত এক পথে চলাচল করে না, কিংবা অন্যকিছু। আরবসাগরের কোল ঘেষে একটি পাহাড়ের ঢালু নেমে গেছে এবং চলে গেছে সাগরের ভিতরে বেশ কিছু দূর, অাঁকা-বাঁকা হয়ে, যেন নিপুণ কোন শিল্পীর হাতে গড়া। বিমান থেকে আমি অনেক সৌন্দর্য দেখেছি আকাশের এবং পৃথিবীর। কিন্তু আমার হৃদয়ে ঐ সৌন্দর্যের আবেদন ছিলো অন্য রকম। সৃষ্টির সৌন্দর্য স্রষ্টার নৈকট্য এমনভাবে অনুভব করাতে পারে, আমার জানা ছিলো না। যতক্ষণ দেখা যায়, আমি তাকিয়েই ছিলাম অভিভূত হয়ে। বিমানের গতিবেগ এত, কিন্তু মনে হয় কত ধীর! একটি দৃশ্য দেখা যায় অনেক সময় ধরে। এটাও বড় অদ্ভূত।
জিদ্দা এসে গেছে। একটু পরেই বিমান অবতরণ করবে, ঘোষণা হলো এবং আসনের ফিতা বাঁধার অনুরোধ জানানো হলো।
রাতের আকাশ থেকে জিদ্দার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পেলাম। বিশাল বিস্তৃত শহর, যেন আলোর মালা পরিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পথে গাড়িগুলো দেখা যায় না, শুধু দেখা যায় আলোর চলাচল।
আলোঝলমল জিদ্দা দেখে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। এই সেদিন রাতের আকাশেই তো আমি জিদ্দার ভূমি ত্যাগ করেছিলাম! সেদিনের কান্না আমার আল্লাহ আমাকে আজ আলোর হাসিরূপে ফিরিয়ে দিয়েছেন! সেদিনও জিদ্দা শহরে আলো ছিলো, কিন্তু উজ্জ্বলতা ছিলো না। আজ জিদ্দার আলো কত সমুজ্জ্বল! সবকিছুর আগে আল্লাহর প্রশংসা, সবকিছুর পরেও আল্লাহর প্রশংসা।
বিমান জিদ্দার মাটি স্পর্শ করলো আমাদের ঘড়ির হিসাবে রাত বারটায়। আছর ও মাগরিব আমরা বিমানেই পড়েছি দু’জন দু’জন করে জামাতে এবং দাঁড়িয়ে। অনেকে বিমান সেবকদের বাধা উপেক্ষা করে অযুর পানিতে টয়লেট সয়লাব করে ফেলেছেন। এটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। আমি তায়াম্মুম করেছিলাম।
বিমানের দরজা খোলা হলো। সিঁড়ির পাটাতনে এসে দাঁড়ালাম, যেমন দাঁড়িয়েছিলাম রামাযানের সফরে এমনি এক রাতে! সমগ্র দেহে এবং অন্তরে অনুভব করলাম হিজায ভূমির মৃদুমন্দ বায়ুর স্নিগ্ধ পরশ। হিজাযের সেই পবিত্র ঘ্রাণ আবার আমাকে মোহিত করলো; সেই ঘ্রাণ যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। এবং হৃদয় যার যত উন্মুখ, যত ব্যাকুল ও সমর্পিত, সে তা তত গভীরভাবে অনুভব করতে পারে। আল্লাহর আশিক ও দিওয়ানা বান্দা যারা তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন। তারা তো হিজাযভূমির ঘ্রাণ তেমনই অনুভব করেন যেমন আমরা ফুলের সুবাস এবং আতরের ঘ্রাণ অনুভব করি। তাদের আনেক কাহিনী আমি পড়েছি কিতাবের পাতায়, তবে একটি জীবন্ত উদাহরণ দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে এবার এই গোনাহগার চোখ দু’টোর। এমন আশিক ইনসান এবং ইশকের এমন নমুনা শুধু চোখের দেখা দেখতে পাওয়াও বড় সৌভাগ্য। সেই মানুষটির কথা এবং তার কিছু সময়ের সঙ্গলাভের ঈমানোদ্দীপক ঘটনা এখানে লিখতে আমার বড় লোভ হয়, কিন্তু আমার সফরনামা যে হয়ে চলেছে সফরের চেয়ে দীর্ঘ! বহু আগে কোন এক কিতাবে পড়েছিলাম একটি ফারসি কবিতা, যার মর্ম-
‘হিজাযভূমিতে কেন আমার এ মস্তি ও ফুর্তি?/ কারণ তোমরা যা পাও বছরার গোলাবে এবং হরিণের নাভিতে/ আমি তা পাই হিজাযের বাতাসে/ তুমি বিশ্বাস না করো, তাতে কী আসে যায়, বন্ধু!’
আমার মনে হয়েছে, পারস্যের কবি আমার দেখা এই মানুষটির কথাই বলেছেন তার কবিতায়।
রামাযানের সফরে আমি এসেছিলাম আবুধাবি থেকে সউদিয়ার বিমানে। তখন নেমেছিলাম জিদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখানে অন্যান্য দেশের বিমানের জন্য রয়েছে সাধারণ টার্মিনাল, আর রাজকীয় সউদী এয়ার লাইন্সের জন্য স্বতন্ত্র টার্মিনাল। রাতের আলোতে সেই রাজকীয় টার্মিনালকে আমার মনে হয়েছিলো স্বপ্নপুরী।
হজমৌসুমে হাজীদের আগমনের জন্য তৈরী করা হয়েছে বিশাল হজ্বটার্মিনাল। আকাশে বিমান থেকে মনে হয়েছিলো যেন ছোট ছোট সারিবদ্ধ অনেক তাঁবু। পুরো টার্মিনালের ছাদের নকশা করা হয়েছে বেদুঈন আরবের তাঁবুর মত করে। মরুভূমির পরিবেশে এ স্থাপত্যনকশা সত্যি অপূর্ব।
বিমান থেকে নেমে বাসে উঠলাম। বিমান থেমেছে মূল টার্মিনাল থেকে অনেক দূরে, দু’ কিলোমিটারের কম হবে না। পুরো বিমানবন্দর আয়তনে এত বিশাল যে, আমাদের রাজধানী ঢাকা শহর অনায়াসে তার ভিতরে এসে যায়। বাস অনেক্ষণ ধরে চলতে চলতে হজ্বটার্মিনাল ভবনের সামনে এসে থামলো। আমাদেরকে এক বিরাট হল ঘরে নেয়া হলো। আমাদের পৌঁছার পর পরই আরেক দেশের, সম্ভবত ইন্দোনেশিয়ার হাজীদের আরেকটি দল এসে হাজির। অত বড় হলঘরে যেন তিল ধারণের স্থান নেই। কোন কোন হাজী বিলম্বের কারণে সমালোচনা শুরু করলেন। আমি অবশ্য বেশ উপভোগ করছিলাম হাজীদের এই বিরাট লোকারণ্য; এরা সবাই আল্লাহর ঘরের মেহমান! আশিক ইবরাহিমের ডাকে ছুটে আসা আশিকান! এখানে এই ছোট্ট ছাদের নীচে হাজারের মজমা যদি হয় এত ‘খোশমানযার’ তাহলে কেমন হবে আরাফার খোলা ময়দানে লাখ লাখ হাজীর জমায়েত-দৃশ্য! আমার নছীবে আছে তো আরাফার ময়দান! লাববাইক লাববাইকের আযান!
অযু ইস্তিনজা থেকে ফারিগ হতে বেশ সময় লাগলো এবং কষ্ট হলো। মানুষের এই একটি দুর্বলতা আমাকে খুব লজ্জিত করে। তবে আজ এ কষ্টকে কষ্ট মনে হলো না; এ লজ্জাকেও মনে হলো না লজ্জা। আল্লাহর ঘরের মেহমান হয়ে হজের সফরে এসে এতটুকু যদি হাসিমুখে বরণ করতে না পারি তাহলে কেন আর ঘর ছেড়ে আসা! কেন তবে আল্লাহর ঘরের মেহমান হওয়া! পবিত্র ভূমিতে অবতরণ করেই যদি আমার মুখে শুরু হয়ে যায় সমালোচনা এবং বিরক্তির প্রকাশ তাহলে আমি কি আর নিজেকে পরিচয় দিতে পারি বাইতুল্লাহর আশিক এবং মাদীনার দিওয়ানা বলে! তবে যারা ব্যবস্থাপনায় আছেন তাদের মনে হয় বিষয়টি আরো গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।
এর মধ্যে ঘটে গেলো এমন একটি দুর্ঘটনা, যা আমাদের বাংলাদেশী হাজীদের জন্য ছিলো চরম লজ্জার ও কলঙ্কের। হাজীর পরিচয় নিয়ে আসা একলোকের সামানে পাওয়া গেলো নিষিদ্ধ কিছু বস্ত্ত। ফলে হাজীদের সামান তল্লাশিতে আরোপ করা হলো অসম্ভব কড়াকড়ি, যা শুনেছি এর আগে কখনো হয় নি। আমরা নিজেরাই টেনে আনলাম নিজেদের লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগ।
গভীর রাত হয়ে গেলো ভিতর থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরে আসতে।
বিমান থেকে যে তাঁবুর দৃশ্য দেখেছিলাম, এবার দেখলাম তাঁবুর ভিতর থেকে। হজটার্মিনালকে আমার মনে হয় বলা উচিত হজ-তাঁবু, বা হাজীতাঁবু । আরববেদুঈনদের মরুভূমির তাঁবুজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা তো আমার নেই; শুধু কিছু তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করেছি আরবী সাহিত্য এবং আরব জাহেলিয়াতের কবিতা থেকে, বিশেষত ইমরাউল কায়স থেকে। কিন্তু আধুনিক স্থাপত্যের অবদান এই তাঁবুর নীচে কাটানো একটিমাত্র রাতও যেন আমাকে বেদুঈন আরবের মরুর তাঁবুজীবনের আবহ এবং অনুভব দান করলো। বাংলা কবিতায় পড়েছি, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরববেদুঈন’! সত্যি সত্যি আমার তখন মন কেমন করছিলো বেদুঈনদের মরুভূমির তাঁবুজীবনের প্রতি অজানা এক আকর্ষণে! ভাবছিলাম, অন্তত কিছুদিনের জন্যও কি বাস করা যায় না মরুভূমির তাঁবুতে! শুনেছি, আধুনিক নগরজীবনের আরাম আয়েশে অভ্যস্ত অভিজাত আরবরা এখনো মাঝে মধ্যে মরুভূমিতে চলে যান এবং তাঁবুর জীবন উপভোগ করেন।
হাজার হাজার হাজী শুয়ে বসে অপেক্ষা করছেন মক্কা শরীফে, কিংবা মদীনা শরীফে রওয়ানা হওয়ার। সবারই দেহে অবয়বে রয়েছে দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি ও অবসাদ, কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠছে তাদের ভিতরের ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা। অন্তত কিছু মানুষ তো ছিলো এমন যেন তারা পিপাসায় ছটফট করছে, একটু দূরেই রয়েছে শীতল পানির ঝরণা, কিন্তু তাকে আটকে রেখে বলা হচ্ছে, আরো ছবর করো হে মুসাফির!
যারা মক্কা শরীফ যাবেন তারা নিজ নিজ দেশ থেকে, বা বিমান থেকে ইহরাম বেঁধে নিয়েছেন। আমাদের মত যারা মদীনা শরীফ যাবেন তারা এখনো ইহরাম মুক্ত রয়েছেন। তারা ইহরাম বাঁধবেন হজের পূর্বে মদীনা শরীফ থেকে রওয়ানা হওয়ার সময়। আমরা আগে মদীনা শরীফ যাচ্ছি, কারণ হযরত হাফেজ্জী হুযূর ইরান থেকে মদীনা শরীফ আসবেন, তারপর মক্কা শরীফ যাবেন। সবকিছু যদি নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী হয়ে থাকে তাহলে হযরত হাফেজ্জী হুযূর তাঁর কাফেলাসহ গতকালই মদীনা শরীফ পৌঁছে গেছেন। হযরতের সঙ্গে প্রথম দেখার মুহূর্তটি কেমন হবে, ভাবতে গিয়ে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠলো। হযরতের নারাযি দূর হবে তো? আমাকে দেখে হযরত খুশী হবেন তো?
তিন ঘণ্টার মত ঘুম হলো, যাকে বলে গভীর ঘুম। ফজরের প্রায় শেষ সময় উঠলাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি,সফরের সব ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়ে গেছে। শরীর-মন এখন সজীব সতেজ, নতুন সফরের জন্য পূর্ণ প্রস্ত্তত।
এখানে টয়লেটব্যবস্থা, আরবীতে যাকে বলে ‘দাওরাতুল মিয়াহ’ বেশ ভালো। কিছু দূর পর পর দশটি টয়লেটের একটি ইউনিট, সঙ্গে অযুর ব্যবস্থা। পুরুষদের আলাদা এবং মহিলাদের আলাদা ইউনিট। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকায় ভিড় নেই। ভিতরে তল্লাশির স্থানে হাজী ছাহেবদের দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে হয়। সেখানকার টয়লেটব্যবস্থা যদি বর্তমানের অন্তত দ্বিগুণ হতো তাহলে পবিত্র ভূমিতে আগমনের প্রথম মুহূর্তে হাজী ছাহেবদের যে কষ্টটা হয় তা অনেকাংশে লাঘব হতো। হাজী ছাহেবরাও পবিত্র ভূমিতে এসেই অপ্রতুল ব্যবস্থার সমালোচনা এবং একে অন্যের প্রতি অসৌজন্য প্রকাশের যে গোনাহ করে থাকেন তা থেকে বেঁচে যেতেন।
ইতমিনানের সাথে অযু-ইসতিন্জা থেকে ফারিগ হয়ে বা-জামাত নামায আদায় করলাম। মশওয়ারা হলো, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নাস্তার পর আমরা মদীনা শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব আমাকেও বিশ্রাম নিতে বললেন এবং এমনভাবে বললেন, যাতে মধুর শাসন ছিলো। শাসনে যদি মধুরতা থাকে তাহলে হৃদয়ে তা কত যে আনন্দের অনুভূতি আনে সে কথা তুমি বুঝতে পারবে যদি কখনো কেউ তোমাকে এমন মধুর শাসন করে থাকে। কিন্তু সংসারে এ পদার্থ এখন বড় দুর্লভ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘জোয়ান বয়সে বিশ্রামের কী প্রয়োজন! আমি তো দিনের ঘুম কাকে বলে জানি না, এমনকি লাগাতার রাত জাগার পরও আল্লাহর রহমতে শরীর আমার সচল থাকে। আম্মা-আববা তো আমাকে রীতিমত পাহারা দিয়ে এবং হ্যারিকেনের আলো সরিয়ে ঘুম পাড়াতেন, এখনো তাই করেন। আমি চারদিকে কাপড় টানিয়ে রাখি, যাতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলো বাইরে না যায়। এসম্পর্কে মজার মজার অনেক গল্প আছে। এই যে চশমা দেখছেন, এটা কিন্তু চাঁদের আলোতে বই পড়ার ফল।
তিনি বললেন, আপনার অবস্থা আমার জানা আছে, কিন্তু এটা ঠিক নয়, ‘নেযামের’ সাথে কাজ করলে অনেক দিন কাজ করতে পারবেন। স্বাস্থ্য বিরাট নেয়ামত; এটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার। যৌবনের ঢল গড়িয়ে যেতে খুব বেশী সময় লাগে না। আজ থেকে বিশবছর পর হয়ত আপনার কথাগুলো আপনারই কাছ স্বপ্নের মত মনে হবে। তখন হয়ত আমার কথা মনে পড়বে এবং আফসোস হবে।
পঁচিশ বছর পর এ সফরনামা যখন লিখছি, তার কথা মনে পড়ছে এবং আফসোস হচ্ছে। শরীর এখন আমার কথা শোনে না, আমাকেই শুনতে হয় তার কথা। সুতরাং আমাকে যা বলা হয়েছিলো, অন্যকে আমি এখন তাই বলি।
আমি আমাদের অবস্থানক্ষেত্র চিহ্ণিত করে - খুঁটিতে এবং টয়লেটের ইউনিটগুলোতে নাম্বার থাকায় কাজটা সহজ ছিলো - হজ্বতাঁবুর বাইরে বের হলাম। এখন যত কঠিন এবং হাজীদের গতিবিধি যত নিয়ন্ত্রিত পঁচিশ বছর আগে এমন ছিলো না; বলতে গেলে তেমন কোন বিধিনিষেধই ছিলো না। দোষ কিন্তু সিংহভাগ আমাদের, আর কিছুটা সউদীদের মোটা দেমাগের। আসলে সবসময় সবখানে আগে অপরাধ ঘটে, তারপর আইন আসে এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়।
হাঁটতে হাঁটতে আমি বেশ দূরে চলে এলাম। একপাশে সারি সারি খেজুরগাছ ছিলো, অন্যপাশে ছিলো ঝাউগাছের সারি এবং সবুজ ঘাসের গালিচা; তাতে পরিবেশ হয়েছিলো অত্যন্ত মনোরম। কিছু দূর পর পর এভাবে যেন সবুজ দ্বীপ সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের দেশের ‘সবুজ’ হলো প্রকৃতির দান। সব সৌন্দর্য সেখানে সবার অগোচরে তৈরী হয়। আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে, ভূমি থেকে সবুজ অঙ্কুরিত হয়। মানুষের যত্ন-পরিচর্যার তেমন প্রয়োজন পড়ে না; প্রকৃতিরই সযত্ন ছোঁয়ায় সারা দেশ সবুজ হয়ে যায়। সেখানে মানুষ বরং সবুজের শত্রু। মানুষ সেখানে বৃক্ষ নিধন করে এবং সবুজ বনানী ধ্বংস করে।
কিন্তু এখানে পরিবেশ অন্যরকম। এখানে মরুভূমির কোলে সবুজের স্নিগ্ধতা সৃষ্টির জন্য যে বিপুল উদ্যোগ আয়োজন এবং যে বিপুল অর্থব্যয়ের প্রয়োজন তা না দেখলে বোঝা যায় না। প্রতিটি গাছের গোড়ায় রয়েছে নলের ব্যবস্থা। তা থেকে পানি সরবরাহ করতে হয় মরুভূমির দগ্ধ আবহাওয়ায় সবুজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সম্ভবত এখানের মাটিও অন্যখান থেকে আনা, যেমন রামাযানের সফরে জিদ্দা শহরে দেখেছিলাম।
একটু পরে সূর্যোদয় হলো। হয়েছে আরো আগে, তবে দূরের পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে কিছুটা সময় লেগেছে। হিজাযভূমিতে নতুন দিনের প্রথম সূর্যোদয় আমাকে যেন নতুন জীবনের শুভ সংবাদ জানালো। মদীনা শরীফের সফর শুরুর পূর্বমুহূর্তে শুক্রবারের এ সূর্যোদয় আমার হৃদয়ের অনুভবে অন্যরকম এক পবিত্রতা এনে দিলো। মনে মনে কামনা করলাম, আলোর দিকে আমার এ সফর যেন সার্থক হয়। আবার যখন দেশের মাটিতে ফিরে যাবো, ঠিক এই পথ দিয়ে, দেশের মাটিতে ফিরে তো যেতেই হয়, তখন যেন আজকের সূর্যের মত আলোকিত এক জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারি। আমার জীবনের অবসান যেন হয় নূরের শহর মদীনার যিয়ারত করে করে এবং মদীনার স্বপ্ন দেখে দেখে । দেহ আমার যেখানেই থাকুক হৃদয় যেন বাস করে সবুজ গম্বুজের শহরে।
একটি মাইক্রোবাসে আমরা উঠলাম রীতিমত দরদস্ত্তর করে। এটা আমার ভালো লাগলো না। আল্লাহর নবীর শহরে যাওয়ার পথে, কী ক্ষতি হতো যদি আমার পাঁচটি রিয়াল বেশী খরচ হতো! এ সফর কি পৃথিবীর আর দশটি সফরের মত! হয়ত ভাড়া বেশী চাওয়া হয়েছে, হয়ত এটা অসঙ্গত। কিন্তু মদীনার সফর সারা জীবনে কার ভাগ্যে ক’বার জোটে! দরদস্ত্তর করার জন্য তো পড়ে আছে আরো বহু শহর! আরো বহু সফর! এখানে বিভিন্ন যুক্তি আসতে পারে; পাথেয় সল্পতার কথা উঠতে পারে। আমার নিজেরও পাথেয় ছিলো সামান্য। তবু প্রায় ঝগড়ার রূপ ধারণ করা এ দরকষাকষি আমার ভালো লাগেনি।
গাড়ীতে যাত্রী পনের ষোলজন। আমরা চারজন; বাকিরা অপরিচিত হলেও বাংলাদেশের, নোয়াখালি এবং সিলেটের, দু’জন বরিশালের। আলোর শহরের উদ্দেশ্যে কয়েক ঘণ্টার যাত্রাপথে আশ্চর্য এক আলোকিত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো আমাদের, যা পরবর্তী আর কোন সফরে হয়নি। মানুষ এবং মানুষের মন সবকিছুরই বড় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে।
মহিলাযাত্রী ছিলো দু’তিনজন। একজনকে মনে হলো বেশ অভিজাত ও সুশীলা। স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ, যা সব সময় আমার ভালো লাগে। সঙ্গের পুরুষটিকে তিনি গাড়ীর চালকের সঙ্গে উত্তপ্ত কথা বলতে নিষেধ করছিলেন। আমার ভালো লাগলো যে, উপরে যে অনুভূতির কথা বললাম তা রয়েছে আরো কিছু হৃদয়ে। বড় আবেগ দিয়ে বলা তার একথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে, ‘সারা জীবন তো অনেক কামিয়েছো, যেতে দাও না কিছু। কোথায় চলেছো সেটা একবার ভাবো!’
ভদ্র মহিলা বড় মূল্যবান কথা বলেছেন। আমাদের আচরণ এবং উচ্চারণ প্রমাণ করে যে, আমরা ভুলে যাই, কোন্ সফরে, কোন্ শহরে আমরা চলেছি।
গাড়ী রওয়ানা হওয়ার পর বেশ কিছু সময় পার হলো নির্ঝামেলায়। এসি চালু ছিলো; শীতল বাতাস বেশ আনন্দদায়ক ছিলো। প্রথমে এসিটা বন্ধ হলো এবং জানালা খুলে দেয়া হলো। সূর্য ততক্ষণে বেশ তেতে উঠেছে এবং বাসটাকেও তাতিয়ে তুলেছে। এসি সচল থাকলে বাইরের গরম হাওয়া রোধ করে ভিতরের শীতল বাতাস উপভোগ করা যেতো। এ নিয়ে এক দফা কথা কাটাকাটি হলো, তারপর বিভিন্ন মন্তব্য, কোনটা গাড়ীর চালকের উদ্দেশ্যে, কোনটা সউদী সরকারকে লক্ষ্য করে, আর কোনটা ...। তাতে গরম হাওয়া এবং বেদুঈন চালকের মেজায ঠান্ডা তো হলোই না, উল্টো গাড়ীর ইন্জিনটা বিগড়ে গেলো। হয়ত যিনি এ গাড়ী এবং আমাদের জীবনের গাড়ী নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর পছন্দ হয় নি, হাবীবের দেশের যাত্রীদের আচরণ। তাই আমাদের কিঞ্চিৎ পরিশোধনের ব্যবস্থা তিনি করলেন আগুনঝরা রোদের মাঝে পথে কিছু সময় থামিয়ে রেখে। সেটা বোঝা গেলো এভাবে যে, এরপর সবার মাথা বেশ ঠান্ডা হয়ে গেলো। সেই ভদ্রমহিলা সঙ্গের পুরুষটিকে বললেন, নাও এবার বসে বসে এসির বাতাস খাও। এতক্ষণ তো গরম হলেও কিছুটা বাতাস ছিলো, এখন গরমে সেদ্ধ হও। দুরূদ পড়া নেই, শুধু শুধু ঝগড়া!
একতরফা ঝগড়াটা বেশ উপভোগ করলাম। আরো আনন্দ হলো যখন ভদ্রপুরুষটি আস্তে আস্তে দুরূদ পড়া শুরু করলেন। নারী যদি ইচ্ছে করে, তাহলে কুশলতার সঙ্গে সকল বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে পুরুষকে সে সঠিক পথে চালিত করতে পারে। কারণ মাতৃত্ব হলো নারীর মূল প্রকৃতি; তারা মায়ের জাত। অবশ্য নারীজাতির ‘আদর্শ শিক্ষা’ ছাড়া এ মহৎ ভুমিকা পালন এবং মানবতার উৎকর্ষ সাধন কিছুতেই সম্ভব নয়।
অনেক চেষ্টার পর গাড়ী সচল হলো, কিন্তু আবার দু’একজন যাত্রীর মন বিকল হলো। তাদের ধারণা, চালক ইচ্ছে করে এসি বন্ধ রেখেছে ভাড়া কমানোর কারণে। গাড়ীর চালক বাংলা তো বোঝে না, তবে অনুমান করে নিলো যে, তাকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে। আরব বেদুঈন সব সহ্য করতে পারে, মিথ্যার অভিযোগ সহ্য করতে পারে না। মিথ্যা তো আবু সুফিয়ানও বলতে পারে নি রোমের বাদশার দরবারে, শুধু এ লজ্জার কারণে যে, লোকে বলবে, দেখো, আবু সুফিয়ান সরদার হয়েও মিথ্যা বলে! সে যুগের আরবচরিত্র কিছু না কিছু এযুগেও বিদ্যমান রয়েছে। একসময় যারা উটের চালক ছিলো তাদেরই বংশধর এই বেদুঈন চালক তাই ক্রোধে প্রায় আত্মহারা।
গাড়ী চলছে পূর্ণ গতিতে, তর্ক-বচসা চলছে আরো জোর গতিতে এবং এসব ক্ষেত্রে বাংলাভাষা যেমন হয়, বাইতুল্লাহর মুসাফির এবং মদীনার যাত্রীদের মুখে যা একেবারে বেমানান।
এমন সময় এক বৃদ্ধযাত্রী, আমার ধারণা, গরমে তারই কষ্ট হওয়ার কথা সব থেকে বেশী, তিনি সবাইকে শান্ত করলেন এই বলে, ভাই, একটু চিন্তা করেন, আপনারা কোথায় চলেছেন। দুনিয়ার গরম যদি সহ্য না হয় আখেরাতের গরম কেমনে সহ্য হবে! .....।
এবং আশ্চর্য! ঐ বৃদ্ধের কথায়, যাকে খুব শিক্ষিত বলেও মনে হয়নি, সবাই শান্ত হয়ে গেলো। আসলে তার মুখের প্রতিটি শব্দে ছিলো হৃদয়ের স্পর্শ, তাই সকল হৃদয়কে তা স্পর্শ করলো।
তিনি উচ্চ স্বরে দুরূদ পড়া শুরু করলেন, আমরা সবাই তাকে অনুসরণ করে দুরূদে মশগুল হলাম। পুরো বাসের পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে গেলো। আমাদের সবার মনের অবস্থাও পরিবর্তিত হলো।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, মরুভূমিতে শাব্দিক অর্থেই যেন আগুন ঝরছে। দূর থেকেই অনুমান করলাম, বালুগুলো এখন কী পরিমাণ তপ্ত! যেন বাংলাভাষার খৈফোটা বালু! সেই আগুনঝরা রোদেও দেখতে পেলাম একপাল মেষ এবং এক রাখাল।
দূরের পাহাড়শ্রেণী ধূধূ ঝাপসা দেখা যায়। আমাদের গাড়ীর পথ কখনো মরুভূমির মধ্য দিয়ে, কখনো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। কখনো বা পথ তৈরী হয়েছে পাহাড় কেটে মাঝখান দিয়ে। দু’দিকে কাটা খাড়া পাহাড় দেখলে গা ছমছম করে। বিরাট বিরাট পাথরখন্ড পাহাড়ের গায়ে এমন আলগাভাবে লেগে রয়েছে, যেন একটু নাড়া দিলেই গাড়ীর উপর এসে পড়বে এবং যাত্রীশুদ্ধ গাড়ী ছাতু হয়ে যাবে।
আমি অবাক হয়ে ভাবছি, মসৃণ পথে দ্রুতগামী গাড়ীতে আমাদের এত আরামের সফর, তাতেই এমন অসহ্য অবস্থা! তাহলে একশ দু’শ বছর আগে, তিন চারশ বছর আগে, যখন কোন রাস্তা ছিলো না, ছিলো শুধু মরুসাগর- বালু, পাথর এবং মরুজাহাজ, তখন কী অবস্থা হতো! তখন বাইতুল্লাহর এবং মদীনার কাফেলা কীভাবে এ দীর্ঘ কঠিন পথ পাড়ি দিতো?! মরুভূমির বাসিন্দা যারা তাদের কথা না হয় ভিন্ন; পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন আবহাওয়ার মানুষ যখন এখানে হাজির হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে মরুভূমির লু হাওয়ার মাঝে তখন তারা কীভাবে সফর করতো?! কীভাবে তা সম্ভব হতো?! আর কিছু নয়, এটা হলো ইশক ও মুহববতের কারিশমা! এটা হলো প্রেম ও ভালোবাসার রহস্যলীলা! মদীনার প্রেম এবং বাইতুল্লাহর ইশক আল্লাহর বান্দাদের এমনই মাতোয়ারা করে রাখতো যে, পথের কোন কষ্টই তাদের কাছে কষ্ট মনে হতো না। চলার পথে উটের দোলা এবং তাদের হৃদয়ে প্রেমের দোলা একাকার হয়ে যেতো। তারা ইশকের দরিয়ায় ডুবে যেতো, আর ইশকের জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যেতো কষ্টের সব খড়কুটো। যুগের যত পরিবর্তন হচ্ছে, সময়ের ব্যবধান যত বেড়ে চলেছে ইশকের দরিয়ায় ততই যেন ভাটার টান ধরেছে। ফলে ছোট ছোট কষ্টও এখন বড় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবনা আমার ভিতরে যেন ইশক ও মুহাববাতের নতুন মাদকতা সৃষ্টি করলো। আমি আবেগ উদ্দীপনার সঙ্গে দুরূদ পড়তে লাগলাম। আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মদ ..., ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
সারা জীবন দুরূদ পড়েছি এবং আল্লাহর রহমতে কিছু না কিছু স্বাদও পেয়েছি, কিন্তু আজকের দুরূদের স্বাদ ও লজ্জত যেন অন্য রকম। কারণ দুরূদ পড়ে পড়ে আমরা যতই এগিয়ে চলেছি ততই প্রিয়তম ও তাঁর প্রিয় ভূমি নিকটবর্তী হয়ে চলেছে। প্রিয়তমের সান্নিধ্যে গমনের পথে প্রিয়তমের নাম জপার স্বাদই যে আলাদা! বুলবুলির কণ্ঠ এত মধুর কেন লাগে, ভেবে অবাক হয়েছেন আমাদের বাংলাদেশের কবি, তারপর কবি যেন নিজের ভিতর থেকেই পেয়ে গেছেন এ রহস্যের সমাধান। তাই বুলবুলিকে তিনি জিজ্ঞাসা করছেন, হে বুলবুলি, তুমি কি কখনো মুহম্মদের নাম জপেছিলে! সেজন্যই কি তোমার কণ্ঠ এত মধুর লাগে!
এতদিন মনে হয়েছে; এ কবি-কল্পনা, কিন্তু আজ হৃদয়ঙ্গম হলো, এ চিরসত্য। মুহম্মদ নাম যে যত বেশী জপবে, অর্থাৎ যত বেশী দুরূদ পড়বে তার কণ্ঠ তত মধুর হবে, তার হৃদয় তত পবিত্র হবে এবং তার আত্মা তত পরিশুদ্ধ হবে। ছাল্লাল্লাহু আলা মুহম্মদ, ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম - আল্লাহ মুহম্মদকে শান্তি দান করুন; তাঁর প্রতি আল্লাহর সালাম।
দুরূদ তো আল্লাহর এত প্রিয় যে, স্বয়ং আল্লাহ আপন শান মোতাবেক তাঁর হাবীবের উপর দুরূদ পড়েন এবং দুরূদ পড়েন আল্লাহর আদেশে তাঁর ফিরেশতাগণও। তারপর এ দু’টি সুবাদ উল্লেখ করে আল্লাহ মুমিনদের আদেশ করে বলছেন, তোমরাও তাঁর প্রতি ছালাত ও সালাম পাঠ করো।
সুতরাং মুমিন যখন দুরূদ পাঠ করে তখন প্রথমত ফিরেশতাদের সাথে সাদৃশ্যের মাধ্যমে তাদের জড়দেহ নূরানী সত্তায় পরিণত হয় এবং এই নূরানিয়াতের কল্যাণে তারা আল্লাহর নূরকে ধারণ করার উপযোগী হয় এবং ঐশী সত্তার পরম সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হয়। নবীর প্রতি দুরূদ আমি পড়ি আমারই হৃদয় ও আত্মার চাহিদার কারণে। আমি নিজে নূরানিয়াত হাছিলের উদ্দেশ্যে।
আগেও দুরূদের স্বাদ পেয়েছি, কিন্তু দুরূদের এমন মর্ম-উপলদ্ধি হৃদয়ে কখনো উদ্ভাসিত হয়নি এবং এমন নূরানিয়াত অনুভূত হয়নি। তাই মদীনা যতই নিকটবর্তী হচ্ছে দুরূদ আমার হৃদয়সমুদ্রে ততই যেন ইশক ও প্রেমের নব নব তরঙ্গ এবং নতুন নতুন মউজ সৃষ্টি করছে।
যখনই তুমি কল্পনা করবে মদীনা, দেখতে পাবে খেজুরবাগান এবং খেজুরগাছের ছায়া! কিন্তু এখন আর কল্পনা নয়, চোখের সামনে দেখতে পেলাম সেই খেজুরবাগান এবং তার স্নিগ্ধ ছায়া। তখন সর্বসত্তায় যেন এক নতুন পুলককম্পন সৃষ্টি হলো। মাওলানা আতাউল্লাহ এমন মনমোহন সুরে দরূদ পড়তে লাগলেন, যা কল্পনা করলে এখনো যেন আমার কানে মধুবর্ষণ হয়। ছাল্লাল্লাহু আলা মুহম্মদ, ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পুলকে শিহরণে কম্পনে আত্মহারা হয়ে আমিও গেয়ে উঠলাম ছন্দের কোন পরোয়া না করে-
খেজুর বাগান, তুমি মদীনার খেজুর বাগান/ তুচ্ছ তোমার কাছে বছরার গোলাব বাগান।
রাস্তার দু’পাশে শুধু খেজুরবাগান। গাছে গাছে থোকা থোকা খেজুর। সে বড় অপূর্ব দৃশ্য! এজন্যই হয়ত কবিদের কবিতায় খেজুরবাগানের ছায়া ও সৌন্দর্যের কথা এত বারবার এসেছে।
মদীনার যিয়ারাত-সৌভাগ্য এর আগেও যারা লাভ করেছেন তারা তো একসঙ্গে আনন্দধ্বনি করে উঠলেন, মদীনা এসে গেছে! মদীনা! ঐ যে দেখো হাবীবের শহর মদীনা! নতুন আবেগে নতুন জাযবায়, নতুন স্বাদে ও লায্যাতে সুমধুর সুরে সকলে গেয়ে উঠলো-
আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহম্মদ! ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমি নিজের ভাব ও ভাবনা ভুলে গিয়ে বারবার ডুবে যাচ্ছিলাম মাওলানার সেই করুণ স্বর ও মধুর সুরের তরঙ্গে। আমি স্পষ্ট অনুভব করছিলাম, কণ্ঠের এ সুরতরঙ্গ আসলে হৃদয়ের প্রেম-তরঙ্গেরই প্রতিধ্বনি। প্রিয় পাঠক, এখানে আমি সেই না‘তের দু’টি চরণ শুধু তোমাকে শোনাতে পারি, কিন্তু সেই সুরতরঙ্গ কীভাবে শোনাবো যাতে প্রতিফলিত হয়েছিলো হৃদয়ের প্রেম-তরঙ্গ! আচ্ছা, শুধু শব্দগুলোই শোনো-
......
আকণ্ঠ পিলাও মোরে নবীপ্রেমের শরাব সাকী!/ এই শরাবের জামে ডুবে থাকতে ভালো লাগে/
মরণ যদি হয়, হয় যেন তাঁর পাক কদমে/ এখন যে প্রেমে তাঁর বেঁচে থাকতেই ভালো লাগে!
রামাযানের সফরে আমি প্রবেশ করেছিলাম রাতের আলোকসাজে সজ্জিত মদীনায়। তখন সারা শহর ছিলো শান্ত নিঝুম। রাস্তা ছিলো প্রায় নির্জন। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই; সবাই যেন ঘুমিয়ে আছে মধুর কোন স্বপ্ন দেখার জন্য, আর ফিরেশতারা যেন গোটা শহরকে ঢেকে রেখেছেন নূরের ডানা বিছিয়ে! দূর থেকে দেখা মসজিদুন্-নবীর আলোকিত মিনারগুলো যেন হাবীবের ঘুমন্ত শহরের অতন্দ্র প্রহরী! জাগরণের মাঝেও আমি যেন চলে গিয়েছি স্বপ্নের জগতে!
মাত্র দু’মাস পর আমার মেহেরবান আল্লাহ আবার আমাকে এনেছেন তাঁর হাবীবের পাক মদীনায়। এবার আমি প্রবেশ করছি দিনের সূর্যকরো- জ্জ্বল মদীনায়। দূর থেকে মসজিদুন-নবীর মিনারগুলোকে মনে হলো.. কী যে মনে হলো তা ঠিক বুঝিয়ে বলার শব্দ আমার জানা নেই। মনে হলো আকাশের সঙ্গে এই মিনারগুলোর একটা যেন বন্ধন আছে, আলোর বন্ধন। মিনারের চূড়া থেকে আকাশ পর্যন্ত একটি যেন আলোকরেখা বিরাজমান। মদীনা এখন জনস্রোতে মুখরিত। মানুষের ঢল মসজিদুন-নবীর অভিমুখে, জুমার জামা‘আতে শামিল হওয়ার জন্য। চারদিকে শুধু দুরূদের মৃদু মধুর গুঞ্জন, আর কোন শব্দ নেই। মদীনা হলো সারা পৃথিবীর সবচে’ কম শব্দের, সবচে’ শান্ত এবং প্রশান্ত শহর। বিচার ও যুক্তিতর্কই যাদের সত্য লাভের একমাত্র পথ তারা ভেবে দেখো, এ রহস্যের পাও কি না কোন কূলকিনারা!
সেদিন রাতের মদীনায় প্রবেশ করে আমি দেখেছিলাম মদীনার আলোক-সৌন্দর্য এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম; আজ দিনের মদীনায় প্রবেশ করে দেখতে পেলাম সৌন্দর্যের আলোকময়তা এবং আজ আমি অভিভূত হলাম। আলোর সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্যের আলো, দু’টোই প্রেমিক হৃদয়কে সিক্ত, স্নাত ও বিধৌত করে।
মদীনা শরীফে হযরত হাফেজ্জী হুযূর চানমিয়া সওদাগরের মুসাফিরখানায় ওঠবেন, আমাদের জানা ছিলো, কিন্তু জানা ছিলো না, সেটা কোথায়? বাস আমাদেরকে যেখানে নামিয়েছে সেখান থেকে তা কত দূর? তবে মসজিদে নববী ছিলো একেবারে নিকটে। সবুজ গম্বুজ দেখা যায় না, কিন্তু মিনার দেখা যায়। ব্যাকুল হৃদয়ের দাবী তো হলো, এখনই উড়ে চলে যাও ডানা মেলে! এখনই সবুজের পরশ গ্রহণ করো প্রাণভরে! কিন্তু নবীপ্রেমের যে রয়েছে স্বতন্ত্র রীতি ও নীতি! ইশকে রাসূলের যে রয়েছে নিজস্ব আদাব ও ‘আন্দায’। কবির ভাষায়-
এখানের আদাব আলাদা, এখানের আন্দায নিরালা/ এখানে ধীরে ধীরে পান করো বন্ধু শরাবের পেয়ালা।
বর্ণিত আছে, নবীর যামানায় দূরের এক কাফেলা এসেছে মদীনায়, নবীর যিয়ারাত ও দিদার-সৌভাগ্য লাভের জন্য। কাফেলা মসজিদের কাছে আসামাত্র সবাই যেন হয়ে গেলো বেকাবু বেকারার! উটের লাগাম ছেড়ে, সামানপত্র ফেলে সবাই ছুটে গেলো মসজিদের দিকে। যেন মধুর প্রতিযোগিতা, কে কার আগে লাভ করতে পারে নবীর যিয়ারাত এবং রাসূলের দিদার।
কাফেলার একজন শুধু ভিন্ন। তিনি নিজের এবং অন্য সকলের উটগুলো বেঁধে সামানের হেফাযত সেরে গোসল করলেন, পাকসাফ লেবাস পরলেন, খোশবু মাখলেন; তারপর ধীর শান্ত পদক্ষপে মসজিদে হাজির হলেন। তাঁরও কলবে ইশকের মউজ ছিলো, তাঁরও হৃদয়ে প্রেমের তরঙ্গ ছিলো। নবীর যিয়ারাত ও দিদারের জন্য তিনিও বে-কারার ছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যাকুলতা ও চঞ্চলতার উপর ছিলো স্থিরতা ও প্রশান্তির সর্বসুন্দর এক আবরণ। আদর্শ প্রেমিকের ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা হলো অন্তরে, বাইরে দেখতে পাবে তুমি নিস্তরঙ্গ প্রশান্তি। আল্লাহর নবী এ দৃশ্য দেখছিলেন, তাঁর খুব ভালো লাগলো। তিনি তাঁকে সাধুবাদ জানিয়ে বললেন, তোমার মাঝে দু’টি গুণ রয়েছে যা আল্লাহর খুব প্রিয়; ধীরস্থিরতা এবং গভীর প্রশান্ততা।
রাসূলের আদর্শ প্রেমিক হওয়ার দাবী করবো আমরা, সুন্নতের খেলাফ যাদের জীবনধারা! তবে আদর্শ প্রেমিকের অনুকরণও যে সৌভাগ্য লাভের কারণ! তাই ব্যাকুল চঞ্চল মনকে সংযত করে আগে আমরা মুসাফিরখানা খুঁজে বের করলাম, সামানপত্র রেখে ‘অযু-গোসল’ করলাম। তাতে ভিতরের শুচিতা অর্জিত হলো কি হলো না, বাইরের অপরিচ্ছন্নতা
অন্তত দূর হলো। নতুন লেবাস পরে খোশবু ব্যবহার করলাম। তাতে অন্তর সুরভিত হলো কি হলো না, বাইরের দুর্গন্ধ অন্তত দূর হলো।
এবার আমরা রওয়ানা হলাম ধীর শান্ত পদক্ষেপে আল্লাহর নবীর মসজিদের পানে। দৃশ্যত মসজিদ ভিতরে-বাইরে পরিপূর্ণ, কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে জায়গা ছিলো কিছু। আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট না দিয়ে এবং আশেকানে রাসূলের বিরক্তির কারণ না হয়ে, আর পরে যারা আসবে তাদের সুবিধার নিয়ত করে যদ্দুর পারা যায় এগিয়ে গেলাম এবং খোতবা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লাম।
মদীনাতুর রাসূলে এবং মসজিদে নববীতে শোনা আমার জীবনের প্রথম খোতবা! কীভাবে বলবো, কোন ভাষায় প্রকাশ করবো আমার তখনকার অনুভব-অনুভূতি! শুধু বলতে পারি, খোতবার শব্দগুলো যেন নূরের ঝিরঝির বৃষ্টি হয়ে আমাদের উপর বর্ষিত হতে লাগলো। এ খোতবা তো যুগপরম্পরায় সে মহান খোতবারই অনুকরণ এবং অনুরণন, যা চৌদ্দশ বছর আগে এই মসজিদের ‘শাহানশাহ’ তাঁর ছাহাবা কেরামের উদ্দেশ্যে প্রদান করতেন। আমার মনে হলো, দুই খোতবার মাঝে সময়ের ব্যবধান আছে, কিন্তু সময়ের প্রাচীর নেই। তাই যত ক্ষীণ ধারায় হোক আজকের খোতবার মাঝেও প্রবাহিত রয়েছে সেই খোতবার নূরের ফোয়ারা। তবে হৃদয় যার যতটুকু উন্মুক্ত এবং অনুভব যার যতটুকু পরিশুদ্ধ সে ততটুকু লাভ করবে সেই নূরের সংস্পর্শ। সময়ের ব্যবধান যত বাড়ুক, তার অনুভবের জগতে সময়ের দূরত্ব ততই কমে আসবে। কলব যদি হয় জোনায়দ-জিলানীর, জাযবা যদি হয় রূমী-তাবরীযীর এবং রূহানিয়াত যদি হয় সারহিন্দী-গাঙ্গোহীর তাহলে তো তোমার মনে হতে পারে, এ কোন্ কণ্ঠ! এ কার কণ্ঠস্বর! মসজিদে নববীর খতীব যখন বললেন-
......
তখন আমার অন্তরে আশ্চর্য এক ভাবের উদয় হলো। অদ্ভুত এক তন্ময়তা যেন আমার সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। তাকওয়া অবলম্বন করার, আল্লাহর ভয় দ্বারা জীবনকে পরিচালিত করার আহবান এ মসজিদ থেকে আজই কি প্রথম?! এ মসজিদের শ্রোতারা একশ বছর আগে কি শুনেনি এ আহবান?! এ কণ্ঠস্বর?! পাঁচশ বছর আগে?! হাজার বছর আগে?! চৌদ্দশ বছর আগে?! হিজরতের প্রথম বছরে?!
হে আল্লাহ! তোমার নবীর মসজিদের খোতবায় মুত্তাকী হওয়ার, চৌদ্দশ বছরের পরম্পরাধন্য যে আহবান আজ ধ্বনিত হলো তা অন্তরে গ্রহণ করার তাওফীক দাও, আমাদেরকে, এ মসজিদের সকল হাযিরানকে। জীবনের প্রতি পদে, প্রতি পদক্ষেপে তোমাকে যেন ভয় করে চলি। দিনের আলোতে যেন ভয় করি; রাতের অন্ধকারেও যেন ভয় করি। লোকচক্ষুর সামনে যেন ভয় করি, লোকচক্ষুর আড়ালেও যেন ভয় করি।
খোতবা শেষ হলো, তবে রয়ে গেলো খোতবার তন্ময়তা। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেলো জামা‘আত। মসজিদে নববীর মুছল্লায় জীবনের প্রথম জুমু‘আর জামা‘আত! ভিতরের আনন্দ যেন উপচে পড়ে নিজের সৌভাগ্যে নিজেই মুগ্ধ হয়ে! ভিতর থেকে কান্না যেন ভেঙ্গে পড়ে সৌভাগ্য ধরে রাখার অযোগ্যতার কথা ভেবে! তবে সান্ত্বনা এই যে, দান করে দান ফিরিয়ে নেবেন, এ দাতা তো সেই দাতা নন! ইনি তো পরম দাতা! পরম দয়ালু!! চিরদয়াবান!!!
সিজদায় গিয়ে মনে হলো, এ মাথা আর তোলবো না! সারা জীবন পড়ে থাকবো সিজদায়! কিন্তু আমার উপর যে মাওলার আদেশ, মনের অনুসরণ করো না, ইমামের ইকতিদা করো! সুতরাং ইমামের ‘আল্লাহু আকবার’ অনুসরণ করে আমি মাথা তুললাম এবং আবার সিজদায় গেলাম।
আবার সিজদা, আবার সিজদা। কী শান্তি! কী প্রশান্তি!! শীতলতার কী আশ্চর্য অনুভূতি!!!
আমার মাথা সিজদায় যে ভূমি স্পর্শ করছে, যুগে যুগে কত পুণ্যাত্মার পদস্পর্শে সে ভূমি ধন্য হয়েছে! কপালে এই সিজদার দাগ নিয়ে যদি হাযির হতে পারি হে আল্লাহ, রোযহাশরে তোমার দরবারে!
নামায শেষে আমি বসে আছি আমার মাঝে সমাহিত হয়ে। ঘটনাগুলো একের পর এক কীভাবে ঘটে গেলো! কোন উপায় ছিলো না, উপকরণ ছিলো না, কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানি হলো; রামাযানের পবিত্র মাসে আল্লাহ হজ্বের সফরে আনলেন। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়! কিন্তু আমি আমার সৌভাগ্য ধরে রাখতে পারলাম না। আল্লাহর ঘরে আসার পর আল্লাহর ঘরে আমার থাকা হলো না। তবু আসমান থেকে রহমতের বৃষ্টিবর্ষণ বন্ধ হলো না। তাই তো না-লাকায়েক বান্দা এখন আবার হাবীবের শহরে!
তবু আকাশ থেকে করুণার শিশির বর্ষণ বন্ধ হলো না। তাই তো পাপী উম্মতি এখন আবার নবীর মসজিদে!
গতকাল আমি কি জানতাম, আজ কী হবে? এখন কি আমি জানি, আগামীকাল কী ঘটবে? কখন আমার মৃত্যু হবে? হজ্বের শেষ পর্যন্ত আমি কি বেঁচে থাকবো? আমার কি হজ্ব নছীব হবে? আমি জানি না, আল্লাহ জানেন। তবে আল্লাহর রহমতের কাছে আমি আশা করি।
এরই নাম তাকদীর! এর বেশী আমি জানি না, কোন মানুষ জানে না। মানুষের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। সসীম জ্ঞানের মানুষ অসীম জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহর তাকদীর বোঝবে কীভাবে? বুঝতে চায় কোন্ সাহসে? আমি শুধু জানি, আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর রহমতের উপর নির্ভরশীল। আমার কর্তব্য শুধু আল্লাহর রহমত ভিক্ষা করা এবং আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা।
এই সব ভাবতে ভাবতে আমি সামনের দিকে তাকালাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম তাকদীরের কারিশমা! কয়েক কাতার সামনে হযরত হাফিজ্জী হুযূর! সুবহানাল্লাহ! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লাগলো। মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবকে দেখতে পেলাম, তিনিও আমাকে দেখলেন এবং অবাক হলেন। আমাদের মনে তখন কী কী ভাবের উদয় হলো তা কী করে বলবো! তার মনের কথা তো আমি জানি না; আমার মনের কথা যতটুকু জানি তা প্রকাশ করার ভাষা যে জানি না!
সম্ভবত তিনি হযরতকে আমার কথা বললেন। হযরত পিছনে ফিরে তাকালেন এবং উঠে দাঁড়ালেন। সে সময় তাঁর চেহারায় আনন্দের যে উদ্ভাস এবং তাঁর চোখের দৃষ্টিতে মমতার যে ঝিলিক দেখেছিলাম তা এখনো, এত বছর পরো স্পষ্ট আমি দেখতে পাই।
আমার বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি; দেখি হযরত এগিয়ে আসছেন। আমি দ্রুত উঠলাম এবং ছুটে গেলাম। হযরত দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে তাঁর আলিঙ্গনে গ্রহণ করলেন। আমি ঝাঁপ দিলাম তাঁর বুকে এবং সমর্পিত হলাম তাঁর আলিঙ্গনে। বুকের সঙ্গে বুক যখন লেগে থাকে তখন কী হয় আমি জানি না। আমার তখন কী হলো আমি বলতে পারি না। শুধু অনুভব করলাম হযরতের বুকের স্পন্দন আমার বুক দিয়ে। আমি কাঁপছিলাম, আমি কাঁদছিলাম; চোখ থেকে আমার অশ্রু ঝরছিলো। হযরত আমাকে বুকে ধরে রেখেছিলেন। সাহস করে অন্য রকমও বলতে পারি।, আর যদি আল্লাহর বড়ত্ব ছাড়া সবকিছু ভুলে যেতে পারি তাহলে বলতে পারি ‘দু’টি বুক পরস্পরকে ধরে রেখেছিলো, একটি বুক কিছু দেয়ার জন্য! একটি বুক কিছু নেয়ার জন্য!’
মোমের মত গলে গলে আমার
অস্তিত্ব যেন বিলীন হয়ে চলেছিলো! আমি জানি না, কিসের মাঝে! কারণ মসজিদ ছিলো আল্লাহর নবীর, আর বুকের আলিঙ্গন ছিলো নায়েবে নবীর। এ আলিঙ্গন তো শুরু বা শেষ নয়! এ বুক তো অন্য কোন বুকের আলিঙ্গন গ্রহণ করেছিলো! এবং সে বুক অন্য বুকের! এ বুকের আলিঙ্গন যদি আমাকে সময়ের পিছনে নিয়ে যায়! আমার চোখের দৃষ্টি থেকে যদি বর্তমানকে মুছে দেয়! সময়ের প্রাচীর ভেঙ্গে অতীতের রাজপথ ধরে আমি যদি চলে যাই দূরে বহু দূরে! এ আলিঙ্গনের মাঝে আমি যদি পেয়ে যাই সুদূর অতীতের অন্য কোন আলিঙ্গনের কিছু সুবাস! কিছু আভাস!
আলিঙ্গন কি শুধু শব্দ! নেই কি এর কোন মর্ম! কী ছিলো এবং কেন ছিলো প্রথম আলিঙ্গন! পরবর্তী আলিঙ্গন!! যুগ যুগের আলিঙ্গন!!! মসজিদুন-নবীর পবিত্র পরিবেশে আজকের আলিঙ্গন!
এসকল ভাবনায় সত্যি সত্যি তখন আমি আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। সূর্যের আলোতে ধূলিকণা ঝিলমিল করে, আমিও ঝিলমিল করে উঠেছিলাম।
হযরত যে কথাটা প্রথম উচ্চারণ করলেন তা হলো, ‘আখের আ-হী গায়ে তুম!’ শেষ পর্যন্ত এসেছো তাহলে! আল্লাহ এনেছেন তাহলে তোমাকে!
হযরত আরো বললেন, তুমি যখন ফিরে গেলে, আমার দিলে তখন অনেক ‘ছাদমা’ হয়েছিলো। আমি অনেক পেরেশান ছিলাম, আজ আমার দিল ঠান্ডা হয়েছে।
কীভাবে যেন আমার মুখ থেকে বের হয়ে গেলো, হযরত! আপনার বুকের ‘ঠান্ডক’ আমি অনুভব করতে পারছি।
হযরত শুধু হাসলেন। বহুদিন পর, অনেক অস্থির প্রতীক্ষার পর হযরতের মুখে আজ দেখতে পেলাম সেই মমতাসিক্ত হাসি!
এত দিন পর, বহু দহনযন্ত্রণা ভোগ করার পর আজ আল্লাহর নবীর মসজিদে হযরতের মুখে শুনতে পেলাম আমার প্রতি সম্বোধন। আমার তপ্ত হৃদয় আজ শান্ত শীতল হলো।
মসজিদে নববীতে হযরত সবসময় যেখানে বসেন সেখানে এসে বসলেন। সবুজ গম্বুজের দিকে তাকালেন, তাকিয়ে থাকলেন এবং পূর্ণ আত্মসমাহিত হয়ে গেলেন। সবুজ গম্বুজ তাহলে এভাবে দেখতে হয়! হযরতের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম। রামাযানের সফরে এখানে বসেই তাকিয়েছিলাম সবুজ গম্বুজের দিকে। সেটা ছিলো নিঃসঙ্গ অবলোকন। আজ হলো আশিকে নবীর প্রেমদৃষ্টিকে অনুসরণ করে সঙ্গধন্য অবলোকন। আজ সবুজ গম্বুজের অবলোকন, আল্লাহর কসম, ছিলো অন্যরকম! দিলের ভিতরে যেন পয়দা হলো নতুন মউজ, নতুন ঢেউ, নতুন তরঙ্গ। আমরা ভুলে যাই, প্রেমের জগতে অনুসরণই প্রেমকে প্রাণ দান করে। কবি কী বলেন!-
লায়লা! হায়, লায়লা!! নেই তো আমার কোন অবলম্বন/ আছে শুধু তোমার চিহ্ল এবং পদচিহ্ণের অনুসরণ!
হযরত জিজ্ঞাসা করলেন, যিয়ারাত করেছো? বললাম, হযরত! আপনি যখন যিয়ারাত করবেন, আপনার পিছনে পিছনে করবো।
হযরত খুশী হলেন। ইতিমধ্যে মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব এসে গেলেন। আমি আগেই হযরতকে তার আসার কথা বলেছিলাম। কিছুক্ষণ পর হযরত বললেন, এখন একটু আসান হতে পারে, আল্লাহর নাম নিয়ে চলো।
হযরতের পিছনে পিছনে আমরা রওয়ানা হলাম পরম সৌভাগ্য অর্জনের পথে।
যুগে যুগে আল্লাহর অলীগণ, আল্লাহর নবীর আশিকগণ দরবারে নববীতে হাযির হয়েছেন এবং দুরূদ ও সালামের নাযরানা পেশ করেছেন। তাঁদের বিভিন্ন হালাত, বিভিন্ন বিস্ময়কর ঘটনা কিতাবে পড়েছি এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাতে আমাদেরও প্রেমহীন হৃদয়ে নবীপ্রেমের পরশ লেগেছে। আমাদেরও দিলে তামান্ন জেগেছে যিয়ারাতে নবীর। আমাদেরও হৃদয় আকুল হয়েছে, ব্যাকুল হয়েছে রওযা শরীফে হাযির হওয়ার, দুরূদ ও সালামের নাযরানা পেশ করার। হযরতের যবানেও শুনেছি আকাবিরীনে উম্মতের বিভিন্ন ঘটনা। এমনকি হযরত নিজেরও যিয়ারাতের হালাত আমাদের শুনিয়েছেন বিভিন্ন সময়।
কিতাবে পড়েছি, হযরতের মুখে শুনেছি, চোখে দেখিনি; আজ দেখলাম; দেখে ধন্য হলাম। কী দেখলাম তা কীভাবে বলবো?! শব্দ দিয়ে কি হৃদয়ের অনুভব অনুভূতির জীবন্ত ছবি তুলে আনা যায়!
রাওযাতুর রাসূল অভিমুখী আশিকানে রাসূলের নূরানী কাফেলায় শামিল হলেন হযরত হাফেজ্জী হুযূর এবং তাঁর পিছনে পিছনে ...
ধীর পদক্ষেপে পূর্ণ আত্মসমাহিত অবস্থায় তিনি এগিয়ে চলেছেন এবং আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন অন্য এবং ভিন্ন। আমি যদি বলতে না পারি তাহলে তা আমার অনুভবের দৈন্য এবং আমার কলমের অক্ষমতা। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন ইশকে রাসূল ও নবীপ্রেমের নতুন নতুন রূপ ও সৌন্দর্যের প্রকাশ। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক একটি ধাপ, প্রেমের এবং নিবেদনের সুউচ্চ শিখরে আরোহণের, কিংবা গভীর তলদেশে অবতরণের। একসময় মনে হলো, আমার সামনে যে শুভ্র অস্তিত্ব, আমি তাঁকে চিনি না। তিনি অন্য যুগের, অন্য জগতের। তিনি বর্তমানের নন, তিনি অতীতের এবং সুদূর অতীতের।
(চলবে, ইনশাআল্লাহ)