‘নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮’ : সত্যিই কি নারীর উন্নয়নের নীতি?
ফারসী ভাষায় একটি কথা আছে- ‘খিশ্তে আওয়াল চুঁ নেহাদ মি’মার কজ, তা ছুরাইয়া মী রাওয়াদ দীওয়রে কজ।’ অর্থাৎ মিস্তিরি যদি দেয়ালের প্রথম ইটটি বাঁকা করে বসায় তাহলে সে দেয়াল আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও বাঁকাই থাকে। কথাটা সত্য। বিশেষ করে বর্তমান ‘বুদ্ধিবৃত্তি’র পরম বিকাশের যুগে এ সত্যটা একেবারে দিনের আলোর মতো প্রকাশিত। চিন্তা-ভাবনা, নীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে এমন বাঁকা-ইট-বসানো মিস্তিরির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে নাকি অনেক ফায়দা। সবচেয়ে বড় ফায়েদা হল, এতে ‘গুরু’র আশির্বাদ পাওয়া যায়।
আসল কথায় আসি, কিছুদিন আগে আমাদের দেশে ঘোষিত হয়েছে ‘নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮’। দেশের উলামা-মাশায়েখ, দ্বীনদার ও সচেতন মুসলিম জনগণ বলেছেন, নারী-উন্নয়নের নামে এগুলো হচ্ছে বিদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়ন। নীতিমালার কয়েকটি দফা সুস্পষ্ট কুরআন-বিরোধী হওয়ায় তারা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা এবং আইন ও ধর্ম উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন যে, ‘কুরআন-সুন্নাহ’ বিরোধী কোনো আইন তাদের মাধ্যমে প্রণীত হবে না।
নারী উন্নয়ন নীতিমালা যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন যে, এটা এদেশীয় কোনো ফর্মুলা নয়, সরাসরি পাশ্চাত্য থেকে আমদানীকৃত। অথচ পাশ্চাত্যের এ ফর্মুলা খোদ পাশ্চাত্যের নীতিবান বিশেষজ্ঞদের কাছেই প্রত্যাখ্যাত।
নারী উন্নয়নের শ্লোগানের মূলে নারী-পুরুষে সমতার যে, ‘আধুনিক’ ধারণা বিদ্যমান, পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ-গবেষকদের সিদ্ধান্ত হল, এটা দর্শন হিসেবে যতটা ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যের দিক থেকে ঠিক ততটাই আগ্রাসী। আর ফলাফল-বিচারে রীতিমতো রোমহর্ষক ও মর্মান্তিক।
পৃথিবীর ইতিহাসে নারী জাতির উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে কিন্তু, সভ্যতা ও অগ্রগতির নামে পাশ্চাত্য যে ভাবে নারীকে পণ্যে পরিণত করেছে তার কোনো নজীর কোথাও পাওয়া যায় না।
নারী-পুরুষে সমতার বাণী ইসলামই সর্বপ্রথম মানবজাতিকে শুনিয়েছে। শুধু নারী-পুরুষের কেন, সমাজের সকল শ্রেণীর মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আওয়াজ ইসলামই প্রথম উচ্চকিত করেছে। তবে সমতার নামে নারী-পুরুষের মনোদৈহিক এবং যোগ্যতা ও প্রতিভাগত বিশিষ্টতাকে অস্বীকার করার যে প্রবণতা প্রাশ্চাত্য দর্শন বহন করে ইসলাম তা সমর্থন করে না। এই অবাস্তব সমতাবাদীরা নারীকে তাঁর নিজস্ব পরিমন্ডল থেকে উঠিয়ে এনে পুরুষের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে দিয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত নারীগণ যে লাঞ্ছনাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বলাবাহুল্য, এমন নির্দয় কৌতুক তথাকথিত নারী উন্নয়নের দাবিদারদের পক্ষেই করা সম্ভব।
নারী, উন্নয়নের ‘সুতিকাগার’ আমেরিকা বৃটেনের নারীরা কেমন আছেন- এ বিষয়ে একটি জরিপ চালানো যেতে পারে। এতে পরিষ্কার হবে যে, ‘নারী উন্নয়ন’ শীর্ষক এ আন্দোলনের ফল ফলেছে কোন কোন ক্ষেত্রে। যদি বলা হয়, সেলসগার্ল-মডেলগার্ল, নায়িকা-গায়িকা, রিসেপশনিষ্ট-প্রাইভেট সেক্রেটারি এবং এ জাতের আরো যে ক্ষেত্রগুলো রয়েছে তাতেই এ উন্নয়ননীতি ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে, তবে কি ভুল বলা হবে?
বস্তত পুঁজিবাদী চিন্তাধারা পুরুষকে যেমন উপার্জনের মেশিনের একটি যন্ত্রাংশ বিবেচনা করে তদ্রূপ নারীকেও। পুরুষের ঘাম আর নারীর রূপ দুটোই এব্যবস্থায় পণ্য হিসেবে বিবেচিত। অধিকার, মর্যাদা, উন্নয়ন ও প্রগতি এসব বিষয় শব্দের ফুলঝুড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরআনের ভাষায়-
اِنْ هِیَ اِلَّاۤ اَسْمَآءٌ سَمَّیْتُمُوْهَاۤ اَنْتُمْ وَ اٰبَآؤُكُمْ
‘এগুলো কিছু অসার শব্দমালা, যেগুলো তোমাদের ও তোমাদের পিতৃ পুরুষদের আবিষ্কার।’
আজ দেশের আলিম-ওলামা দ্বীনদার শ্রেণী যেমন সোচ্চার হয়েছেন কুরআন বিরোধী নীতিমালার প্রতিবাদে, যদি পাশ্চাত্যের এ আগ্রাসন রুখতে হয় তাহলে সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অপরিহার্য। পাশাপাশি বাস্তব জীবনেও কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা কর্তব্য যে, ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায় নারী কীরূপ মর্যাদা ও অধিকার লাভ করে থাকেন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন।