অ ব মা ন না : হাফেজ্জী হুজুর রহ.কে বলা হল যুদ্ধাপরাধী!
বর্তমানে এ দেশ পরিচালনা করছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাদের প্রধান কাজ ও লক্ষ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা সোপর্দ করে দিয়ে বিদায় গ্রহণ। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের রুটিন কাজগুলোও তারা করে যাবেন- এই ছিল নিয়ম ও কথা। কিন্তু এবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনটিই ছিল এমন একটি পরিবেশে যে, তাতে আরো কিছু এজেন্ডা যুক্ত হয়ে যায়। দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, ভোটার ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড প্রণয়নসহ এ ধরনের কিছু কাজেও তারা হাত দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনকে ঢেলে সাজান। এভাবে তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেহেতু বলেছেন, তারা আগামী নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুণগত পরিবর্তন আনছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছেন তাই অতি উৎসাহী একটি মহল দুর্নীতি, নির্বাচন ইত্যাদিকে পাশ কাটিয়ে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ নামে নতুন একটি এজেন্ডা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন। দেশে বিরাজমান খাদ্যের চড়া মূল্য, চাল, ডাল, চিনি, তেলের সংকটকে বেমালুম ভুলে গিয়ে এরা দেশ গরম করে তুলতে চাইছেন ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ প্রসঙ্গটি নিয়ে।
যে মহলটি এ এজেন্ডাটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কোনো অবদান ও অবস্থান নেই। তারা সম্প্রতি বলেছিলেন, ধর্মভিত্তিক বা ধর্মীয় দাবি নিয়ে এদেশে কোনো রাজনীতি করা যাবে না। বিভিন্ন ধর্মীয় মহলের প্রতিক্রিয়ায় এ দাবি থেকে তারা এখন কিছুটা সরে এসেছেন কিংবা নীরব হয়ে আছেন। পরবর্তীতে ’৭১এর
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বয়কটের নামে তারা কণ্ঠ আবারো জোরালো করেছেন। এর সঙ্গে ইদানীং দেশের একটি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলও সুর মিলিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সঙ্গে প্রাক সংলাপে তারা এসব দাবি পুনঃ উচ্চারণও করেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, এসব দাবির গোড়ায় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম ও প্রকাশ্য তৎপরতা থাকলেও সহযোগী আরো কোনো কোনো সংস্থা একাজে মদদ দিয়ে ময়দান গরম করার মতো উপাত্ত বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। সম্প্রতি ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ নামের একটি সংস্থা ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সে তালিকায় চিহ্নিত-অচিহ্নিত, প্রমাণিত-অপ্রমাণিত কজন যুদ্ধাপরাধীর নাম রয়েছে আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু তালিকাটিতে একটি নাম দেখে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ হতবাক হয়ে গেছেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেম হযরত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হজুর রহ.কেও ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ডা. এম এ হাসান নামের এক ব্যক্তি ওই কমিটির পক্ষ থেকে একাজটি করেছেন। জাতির সবচেয়ে বরেণ্য ও সর্বমহলে শ্রদ্ধাভাজন এ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে এভাবে হেয় করার পেছনে জাতীয় কোনো শুভ উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে বলে কেউ মনে করছেন না। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, যে দলটির সঙ্গে মিলেমিশে এক সময় (‘৯৪-৯৫) সনে আন্দোলন করেছিল, পাশে বসে কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করেছিল, ১/১১ এর পর কায়দা করে তাদের বিপাকে ফেলার জন্যই এ দাবি ও মহড়া শুরু হয়েছে এবং বিষয়টি কদাকার হলেও নিছক একটি রাজনৈতিক গেম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে থলের মধ্যে অনেক বেড়াল তারা গোপন করে রেখেছেন। ভারতীয় এক জেনারেল এ দেশে বেড়াতে এসেও তাদের ‘যু্দ্ধাপরাধীদের বিচার’ দাবিতে কিছু প্রকাশ্য উস্কানি দিয়ে গেছেন। এ দেশের ইসলামসেবী কোনো বরেণ্য মানুষের চরিত্রহননের চেষ্টায় এখন আর তাদের মাঝে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ নামে ’৭১ সনে নীরব ছিলেন, অসহায় মানুষের জানমাল বাঁচিয়েছেন এমন কোনো আলেম-উলামা ও বরেণ্য ইসলামী চরিত্রকে তারা হেয় করতে ছাড়বেন না। তাই এটিকে কেবল কোনো রাজনৈতিক খেলা বলে আর চিহ্নিত করা যায় না। এটি হচ্ছে জাতির জন্য অবমাননাকর, জাতিবিভাজক একটি বিনাশী কালচারের মহড়া।
নানা হিসেবে অনুকূল সময় পেয়ে বিদেশী ডকট্রিনে (কারো কারো মতে) এ ধরনের জাতিধ্বংসী খেলায় যারা নিয়োজিত তাদের চেহারা ও মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমাদের কোনো ভাই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মারা পড়লে (যা প্রতি মাসেই দু’একবার ঘটছে) তাদের চেহারায় কোনো কালো ছাপ পড়ে কি না, ফারাক্কার পানি অস্ত্রের আঘাতে আমাদের শত শত মাইলের জনপদ উজাড় হয়ে গেলে তাদের ঠোঁট ভেদ করে কোনো কথা বের হয় কি না,
আমাদের সমুদ্রে, আমাদের সীমানার তালপট্টিতে কোনো দেশের জাহাজ আগ্রাসী তৎপরতায় নোঙর করলে তারা কোনো কথা বলতে সাহস পায় কি না; এ ছাড়াও আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাহায্যে সশস্ত্র উপজাতীয়দের পক্ষ থেকে পরিচালিত বাঙালী নিধন (শান্তিচুক্তি পূর্ব ও পরের কালে) নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা হয় কি না, সর্বোপরি ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর বন্দী পাকবাহিনীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যে দেশটি বন্দীবিনিময়সহ বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করে কি না। তাহলেই তাদের চিনতে পারবেন।
এই সব চেনা-অচেনা চরিত্রের লোকদের ৩৭বছর পর ঢোল বাজিয়ে ‘যুদ্ধাপরাধী’ খুঁজতে চাওয়ার মানেই স্বজাতি, স্বধর্ম ও স্বসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা কালচারের জন্ম দেয়ার ফাউল কসরৎ করা। তাদের তালিকায় হযরত হাফেজ্জী হুজুরের মতো নির্বিরোধ, সাধক আল্লাহওয়ালার নাম দেখে এ ছাড়া অন্য কোনো শোভন কথা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না। সূতার টানে নাচা কিছু পক্ককেশ এজেন্টদের কথায় কান দেয়া এ সরকারের কাজ তো হতে পারেই না। এদের কায়-কসরৎ বাড়তে দিলেও জাতিগত নানা সমস্যার উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।