পরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্ত্ততি ছাড়া কোনো বড় কাজ সম্ভব হয় না
সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই উপরের নীতিটি সত্য। তবে কেউ যদি কোনো বিষয়ে এমন কোনো মৌলিক গ্রন্থ রচনা করার ইচ্ছা করেন, যা সে বিষয়ে জটিলতাগুলোর সমাধান দিবে, শূন্যতাগুলো পূরণ করবে এবং আলোচনা প্রয়োজন কিন্তু অনালোচিত এমন বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে আলোচনা করবে, তাহলে তার জন্য উপরোক্ত নীতি অনুসরণের বিকল্প নেই।
মুহাক্কিক গ্রন্থকারদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাদের রচনাবলি অধ্যয়ন করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের বিশিষ্ট কোনো গ্রন্থের নিয়মিত রচনাকাল এক দু’বছর হলেও তারা এর পরিকল্পনা করেছেন ছাত্রজীবনেই, কিংবা অধ্যাপনা-জীবনের প্রথম দিকে। এরপর বিভিন্ন কাজের মধ্যে এবং সাধারণ অধ্যয়নের মধ্যে এ গ্রন্থের জন্য তথ্যসংগ্রহ অব্যাহত রেখেছেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অসংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদি থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্যসংগ্রহের পন্থা এটাই যে, সাধারণ অধ্যয়ন এবং বিভিন্ন বিষয়ের অধ্যয়নের মধ্যে পরিকল্পনার কথা মনে রাখা এবং সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পেলে তা নোট করে সংশ্লিষ্ট খামে বা প্যাকেটে ভরে রাখা কিংবা নির্দিষ্ট ডায়েরিতে নোট করে রাখা। এ কাজের জন্য প্রয়োজন হয় স্বভাবগত ধীশক্তি এবং সজাগ মস্তিষ্ক। তবে চর্চা ও অভ্যাস করতে থাকলে এ বৈশিষ্ট্যগুলোও উন্নতি করতে থাকে।
এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মুসান্নিফ ও তাদের তাসনীফ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে একটি বড় প্রবন্ধ তৈরি হবে। আমার প্রিয় তালিবে ইলম ভাইরা শুধু যদি শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ রহ.-এর তাসানীফ: ‘ছাফাহাত মিন ছাবরিল উলামা’ ‘কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা’ এবং ‘আররাফউ ওয়াত তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত তা’দীল’-এর টীকাগুলো লক্ষ করেন এবং এগুলোর প্রথম সংস্করণ ও সর্বশেষ সংস্করণের মধ্যে তুলনা করেন তাহলে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, একটি সমৃদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কাজের জন্য কত বছরব্যাপী তথ্যসংগ্রহ প্রয়োজন হয় এবং অসংশ্লিষ্ট স্থান থেকে কীভাবে তথ্য শিকার করতে হয়।
একদিন উলূমুল হাদীসের দরসে তালিবে ইলমদের সামনে বিষয়টি আলোচনা করছিলাম এবং উদাহরণস্বরূপ ইবনে আসাকির দামেশকী রহ. (৪৯৯-৫৭১ হি.) রচিত ‘তারীখে দামেশক’-এর কথা উল্লেখ করেছিলাম, যা বড় বড় আশি খন্ডে মুদ্রিত হয়েছে। এ গ্রন্থ সম্পর্কে একজন মন্তব্য করেছেন যে, ‘নিশ্চয় গ্রন্থকার এর জন্য প্রস্ত্ততি আরম্ভ করেছেন শৈশবে বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই। তা না হলে গ্রন্থরচনার বয়সে উপনীত হওয়ার পর থেকে প্রস্ত্ততি নেওয়া শুরু হলে এ বিশাল কর্ম সম্পাদন করা তার পক্ষে সম্ভব হত না।’ কিন্তু মন্তব্যকারীর নাম আমার মনে আসছিল না, মনে হচ্ছিল, তিনি তকী উদ্দীন সুবকী হবেন। পরে আমাদের এক তালেবে ইল্ম ভাই ‘কীমাতুয যামান’-এর মাধ্যমে ‘ওয়াফায়াতুল আ’য়ান’ থেকে ইবনে খাল্লিকান রহ.-এর বক্তব্য বের করলেন। তিনি তার শায়খ হাফেয যকীউদ্দীন মুনযিরী (৬৫৬ হি.) থেকে উদ্ধৃতি করেছেন-
ما أظن هذا الرجل إلا عزم على وضع هذا التاريخ من يوم عقل على نفسه، وشرع في الجمع من ذلك الوقت وإلا فالعمر يقصر عن أن يجمع فيه الإنسان مثل هذا الكتاب بعد الاشتغال والتنبه.
এরপর ইবনে খাল্লিকান রহ. মন্তব্য করেছেন-
ولقد قال الحق، ومن وقف عليه عرف حقيقة هذا القول ...
-ওয়াফায়াতুল আয়ান ৩/২৭০-২৭১
বস্ত্তত কোনো বিষয়ে সমৃদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কাজ করার জন্য পূর্বপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করা অপরিহার্য।
একবার মাওলানা যফর আহমদ উছমানী রহ. (১৩১০হি.-১৩৯৪হি.) হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ. (.....-১৩৪৬ হি.)-এর কাছে আরজ করেছিলেন, ইলমে ফিকহে কীভাবে পারদর্শিতা অর্জন করা যায়? তিনি উত্তরে বলেন, (আজকালের সাধারণ) মুফতীদের রীতি হল, প্রশ্ন আসার পর কিতাবপত্র ঘাঁটাঘাটি করে থাকে। এতে কাজ হয় না এবং উত্তরে ভুল ভ্রান্তি হয়ে যায়। কেননা, সে সময় তাড়াতাড়ি কিতাবের কোনো এক জায়গা সামনে রেখে জওয়াব লিখে দেয় অথচ অন্য স্থানের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, এ মাসআলায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে, যার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে প্রশ্নোক্ত বিষয়ের সমাধান ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয়।’ -ফাতাওয়া খলীলিয়্যাহ ১/৫৩
আহা! আমাদের তালিবে ইলম ভাইরা যদি বুদ্ধি-বিবেচনা হওয়ার পর, কিংবা অন্তত ছাত্রজীবনের মাঝামাঝি পর্যায় থেকেই আসাতিযায়ে কেরামের পরামর্শক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ইলমী বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নিতেন এবং দরসী ও গায়রে দরসী মুতালাআর মধ্যে সেসব বিষয়ে তথ্যসংগ্রহে মশগুল থাকতেন। আসলে চিন্তা ও পরিকল্পনা নোট করা ছাড়া এবং সূচিবদ্ধ নিয়মে কাজ করা ছাড়া তালিবে ইলম জীবন সম্পূর্ণ ফলপ্রসূ হয় না।
আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
সহায়ক ও পরিপূরক অধ্যয়ন : গ্রন্থ নির্বাচনের একটি মানদন্ড থাকা উচিত
কিছুদিন আগে দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণ একজন তালিবে ইলমের সঙ্গে একটি আরবী শব্দ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তিনি তখন এক মুন্সী সাহেবের অভিধানের উদ্ধৃতি দিলেন। আমি অবাক হয়ে রইলাম যে, একজন মাওলানা, আর তার কাছে মুন্সীর অভিধান!
তার এ অবস্থা দেখে আল্লামা আব্দুল হাই কাত্তানী রহ.-এর একটি কথা আমার মনে পড়ে গেল। ‘ফিহরিসুল ফাহারিস’ কিতাবে ইমামুল লুগাহ ফী আছরিহী মাজদুদ্দীন ফায়রোযাবদীর তরজমায় তিনি লিখেছেন, ‘হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৭৭৪ হি.- ৮৫২ হি.) ‘ফাতহুল বারী’র এক স্থানে কোনো শব্দের আলোচনায় মাজদুদ্দীন ফায়রোযাবাদীর ‘আল কামূসুল মুহীত’-এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এর উপর বদরুদ্দীন আইনী রহ. (৭৬২ হি.- ৮৫৫ হি.) ‘উমদাতুল কারী’তে এই বলে আপত্তি করেন যে-
إن ما ذكره يحتاج إلى نسبته إلى أحد من أئمة اللغة المعتمد عليهم.
অর্থাৎ আইনী রহ. ফায়রোযাবাদী ও তার ‘আলকামূস’-এর উদ্ধৃতিও যথেষ্ট মনে করেননি।
কাত্তানী রাহ. বলেন, এবার আমাদের যুগের লোকদের অবস্থা লক্ষ করুন। তারা ‘আলমুনজিদ’ ও ‘আকরাবুল মাওয়ারিদ’-এর ব্যাখ্যা দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে, যেন এগুলো তাদের কাছে ওহীকৃত ইলম। অথচ শুধু সময়ের দিকটা বিবেচনা করলেও এরা আমাদের চেয়ে অতটা আগের নন যতটা ফায়রোযাবাদী ইবনে হাজার ও আইনী থেকে।’ -ফিহরিসুল ফাহারিস ২/৯০৯-৯১০
তালিবে ইলমদের দরসী কাজের জন্য বিভিন্ন্ সহায়ক গ্রন্থের প্রয়োজন হয়। আর পরিপূরক অধ্যয়নের নিয়ম থাকলে তো আরও কিতাবের প্রয়োজন হয়। আজকাল এ দু’ধরনের কিতাব নির্বাচনের ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় না।
এ বিষয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা ব্যাপক হচ্ছে। অথচ সহায়ক ও পরিপূরক অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও কিতাব নির্বাচনের মানদন্ড সামনে থাকা উচিত। সেই মানদন্ড কী হবে- এ বিষয়ে এ মুহূর্তে আলোচনা করছি না। এখন শুধু এটুকু বলছি যে, যদি নিজের অধ্যয়ন সেই মানদন্ডে উত্তীর্ণ কিংবা কাছাকাছি রাখতে হয় তাহলে নিজস্ব বিবেচনার উপর নির্ভর না করে আসাতিযায়ে কেরাম, বিশেষত নিজের তালীমী মুরুববীর মাশায়ারা অনুযায়ী কিতাব নির্বাচন করা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন এবং ইলমী সফরের প্রতি কদমে আমাদের রাহনুমায়ী করুন।