মেরী ‘ইলমী ও মুতালা‘আতী যিন্দেগী
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
আমার আরো সৌভাগ্য যে, ইলমে হাদীসে আমি উস্তাদ হিসেবে পেয়েছি মাওলানা হায়দার হাসান খান ছাহেব-এর মতো ব্যক্তিত্ব, যিনি মাওলানা গোলাম আলী ছাহেব লাহোরী, মাওলানা লুৎফুল্লাহ ছাহেব কোয়েলী, মাওলানা আহমদ হাসান ছাহেব কানপুরী এবং শায়খুল ইসলাম শায়খ হুসাইন ইয়ামানীর শাগরিদ এবং হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর ‘মুজায’ (খলীফা)। আর এ সৌভাগ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল যে বিষয়টি তা এই যে, যখন আমার হাদীসের তালীম শুরু হল তখন দ্বিতীয় কোনো বিষয় এ তালীমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। শুধু হাদীসের সবক আর মাওলানার সোহবত। আর ছিল দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার তালাবা, নদওয়া-গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ আর মাওলানার নির্বাচিত গ্রন্থরাজি।
মাওলানা রহ.-এর পাঠদান-পদ্ধতিতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যার কারণে ‘ফনে’র রুচি এবং (যোগ্যতা ও তাওফীক অনুপাতে) প্রায়োগিক যোগ্যতাও হাসিল হত। তাঁর তালীম ছিল সম্পূর্ণ বিশ্লেষণধর্মী ও মুহাদ্দিসসুলভ। মাযহাবে হানাফী সম্পর্কে মাওলানার পূর্ণ আস্থা ছিল এবং তিনি এর শক্তিমান উপস্থাপক ছিলেন। তবে তাঁর দরসে-হাদীস হত মুহাদ্দিসানা রীতিতে। নকদে হাদীস, উসূলে হাদীস এবং রিজাল শাস্ত্রের নীতিমালা-নির্ভর আলোচনা ছিল তাঁর দরসের বৈশিষ্ট্য। হিন্দুস্তানী রীতির তুলনায় ইয়ামানী পাঠ-রীতির এবং শাওকানীর রচনাশৈলীর প্রভাব তার দরসে অধিক দৃশ্যমান ছিল। শাওকানীর বিশেষ রচনাভঙ্গির একটি দৃষ্টান্ত হল তার ‘নায়লুল আওতার’ গ্রন্থটি।
মুহাদ্দিসদের মধ্যে বিশেষভাবে মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আলউযীর, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আলআমীর এবং আল্লামা মাকবুলীর রচনাবলি আর উসূলে হাদীসের কিছু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ছিল তার নির্বাচিত উৎসগ্রন্থ। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘তানকীহুল আনযার’ ও ‘তাওযীহুল আফকার’-এর হস্তলিখিত পান্ডুলিপি। অন্যান্য গ্রন্থাদির তুলনায় আল্লামা ইবনুত তুরকুমানীকৃত ‘আলজাওহারুন নাকী’ ও ইমাম যায়লায়ীকৃত ‘নাসবুর রায়া’ থেকে অধিক সাহায্য নিতেন। সহীহ হাদীসের জওয়াবে সহীহ হাদীস পেশ করতেন। জওয়াবের অন্যান্য উপাদানগুলো হত ‘নকদে হাদীসে’র স্বীকৃত নীতিমালা এবং আলোচ্য বিষয়ের ইজতিহাদী বিশ্লেষণ।
আরেকটি বিষয় এই ছিল যে, তাঁর দরস ছিল অনুশীলনমূলক। উস্তাদের হাত ধরে তালিবে ইলমও কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হত। বিভিন্ন গ্রন্থের উদ্ধৃতি, মাযাহিবের দলীল- প্রমাণ, রিজাল বিষয়ক আলোচনা মাওলানা বের করাতেন তালিবে ইলমদের মাধ্যমে। এভাবে তাদেরকে রচনা ও গবেষণায় অভ্যস্ত করে তুলতেন। (আল্লাহ তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন)
হাদীস পঠনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক উপকৃত হয়েছি ইমাম নববী রহ.কৃত ‘শরহে মুসলিম’ থেকে। একজন প্রাথমিক পর্যায়ের তালিবে ইলমের জন্য এ গ্রন্থ হতে পারে একজন ভালো উস্তাদ। হাদীসের ভাষ্যগ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করা এবং তাতে চিন্তা করার অভ্যাস এ গ্রন্থ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
‘ফাতহুল বারী’ অধ্যয়নের সুযোগ হয়েছে তাদরীসের সময়। সে সময় হাফেয ইবনে হাজার রহ.-এর বিস্তৃত জ্ঞানদৃষ্টি, শাস্ত্রীয় বুৎপত্তি এবং এ শাস্ত্রের বিশাল বিস্তৃত কুতুবখানার মাঝে তার অবাধ বিচরণের ক্ষমতা দৃষ্টে হতবাক হয়েছি। তাঁর এ গ্রন্থ মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান-সাধনার এমন এক দৃষ্টান্ত, যার তুলনা অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় রচনাসম্ভারে পাওয়া যায় না। এই কিতাব অধ্যয়নের সময় অনেক স্থানে এমন মনে হয় যে, শরীরের শিরা-উপশিরায় আনন্দের লহর প্রবাহিত হচ্ছে।
কলব ও হৃদয়কে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে আবু দাউদের ‘কিতাবুল আদইয়া’ এবং তিরমিযীর ‘কিতাবুয যুহদ’।
এ সময় ‘ইহইয়াউল উলূম’ পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল এবং তা অন্তরে বিজলীর মতো আছর করছিল। তবে এ অধ্যয়ন বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এর পিছনে ভাই ছাহেবের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির অবদান ছিল। তাঁর দৃষ্টিতে এই অধ্যয়ন দীর্ঘস্থায়ী হলে চিন্তা ও রুচিতে কিছু কিছু প্রান্তিকতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
১৯৩০ ঈসায়ী সনে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় আরবী সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে তাশরীফ আনেন আরবী ভাষাবিদ ও গবেষক মারাকেশী আলিম আল্লামা তাকী উদ্দীন হেলালী। শায়খ খলীল আরবের পরামর্শে ভাই ছাহেব তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সাহচর্য না পেলে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের মৌলিক ও প্রাথমিক অনেক বিষয় এবং ভাষা শিক্ষাদানের অনেক তত্ত্ব ও মূলনীতি দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেত। আর অনারবতা ও উর্দূভাষিতার প্রভাব থেকে পূর্ণ মুক্তি কখনো নসীব হত না। তাঁকে যদি না দেখতাম তাহলে হিজরী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর আরবী ভাষাকে মৃত ও প্রাচীন গ্রন্থাদির ভাষা বলেই বিবেচনা করতাম। এই এক ব্যক্তির মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছিল সালাফের সতর্কতা ও ইলমী পরহেযগারী (অর্থাৎ কোনো বিষয়ে ভালোভাবে জানা না থাকলে নিসংকোচে ‘লা আদরী’ বলতে সক্ষম হওয়া) দূর প্রাচ্যের বিশেষত আহলে শানকীত-এর স্মৃতিশক্তি, আহলে লুগাত-এর ইতকান, নাহববিদদের পরিপক্কতা আর সাহিত্যিকদের সুমিষ্টতা। যখন কথা বলতেন তখন যেন মুখ থেকে মুক্তা ঝরত। প্রতিটি বাক্য স্নিগ্ধতায় ও লালিত্যে মানোত্তীর্ণ। কেউ যদি ইচ্ছে করে, এগুলো দিয়ে মালা গেঁথে কোনো সাহিত্যগ্রন্থের শোভাবর্দ্ধন করবে তবে এতে আপত্তির কিছু থাকে না। একমাত্র তাঁকেই দেখেছি যার যবানে জীবন্ত হয়ে উঠত ‘আগানী’র ভাষা আর জাহিযের কলম। যা লিখতেন তা-ই বলতেন। আর যা বলতেন সেটাই ছিল দৈনন্দিন জীবনের জীবন্ত আরবী ভাষা।
হেলালী সাহেবের কাছে গদ্য ও পদ্য দুটোই পড়েছি। তবে অধিক উপকৃত হয়েছি তাঁর সোহবত ও মজলিস থেকে এবং সফরে তাঁর সাহচর্য পেয়ে। তাঁর নিকট থেকেই দুটি তত্ত্ব প্রথম আমি জানতে পারি। একটি এই যে, ‘ভাষা’ ও ‘সাহিত্য’ দুটো ভিন্ন বিষয়। ভাষা হল বুনিয়াদ, আর সেই বুনিয়াদের উপর নির্মিত কারুকার্যখচিত সুরম্য প্রাসাদটি হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্য আবেগ-অনুভূতির উন্নত ও পরিশীলিত প্রকাশ, যা পরিণতি লাভ করে চিন্তার উন্নতি ও সমাজ-সংস্কৃতির অগ্রসরতার মাধ্যমে।
ভাষার পঠন-পাঠন আগে, সাহিত্যের অনুশীলন তার পরে। অতএব ভাষাকে আয়ত্ব না করে সাহিত্য-সাধনায় অবতীর্ণ হওয়া পন্ডশ্রম।
হিন্দুস্তানে আরবী ‘ভাষা’ শেখানোর জন্য ‘সাহিত্যে’র পাঠ দেওয়া হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষার বুনিয়াদ স্থাপিত হওয়ার আগেই এটা হয়ে থাকে বলে এতে কোনো সুফল আসে না।
হেলালী সাহেব বলতেন, ‘হারীরী’ ‘মুতানাববী’ ও ‘হামাসা’ হচ্ছে আরবী সাহিত্যের উচ্চাঙ্গের নমুনা, যা আরব দেশগুলোতে ভাষাশিক্ষার দীর্ঘ মেহনতের পর নেসাবে আসে। যারা আরবী সাহিত্যে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে চায় তারা এগুলো পড়ে থাকে। অথচ হিন্দুস্তানে এগুলোই হচ্ছে আরবী সাহিত্যের সম্পূর্ণ জমা-খরচ। এই অধ্যয়নের আগে একটি জীবন্ত ভাষা হিসেবে আরবী ভাষা পড়া জরুরি।
তাঁর আরো প্রস্তাব ছিল, ভাষা পড়া উচিত স্বভাষী মানুষের ভাষার মতো, অনুবাদের সাহায্য ছাড়া। এ বিষয়ে তিনি দারুল উলূমে ধারাবাহিক বক্তৃতা করেছেন এবং তার বক্তব্য দলীল দ্বারা প্রমাণ করেছেন।
দ্বিতীয় যে বিষয় তার সংস্পর্শে এসে বুঝতে পেরেছি তা এই যে, ‘ছরফ’ ও ‘নাহব’ হচ্ছে ভাষার গঠনরীতি। এটা ভাষা শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়। ভাষার কিছু সঞ্চয় যদি না গড়ে ওঠে তাহলে ‘ছরফ’ ও ‘নাহব’ অনুশীলন অর্থহীন। ‘শব্দ’ ও ‘বাক্যে’র ভান্ডার হচ্ছে স্থাপনার ইট-সুরকি। আর নাহবের কায়েদা কানুন হল স্থাপত্যশিল্পের নীতিমালা। যদি ইট-সুরকিরই যোগান না থাকে তাহলে উন্নত থেকে উন্নততর স্থাপত্যকৌশল আয়ত্ব করা পশুশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।
হেলালী সাহেবের কাছ থেকে এ বিষয়টাও জেনেছি যে, আরবী ভাষার উত্তম নমূনা হল ইসলামী ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ এবং আববাসী যুগের সাহিত্যিকদের তাকাল্লুফবিহীন রচনাবলি। এজন তিনি ইবনে কুতায়বার ‘আলইমামাতু ওয়াসসিয়াসাহ’, ইবনুল মুকাফ্ফা-এর ‘কালীলা ওয়া দিমনা’, আবুল ফারাজ আসপাহানীর ‘কিতাবুল আগানী’ এবং জাহিযের বিভিন্ন পুস্তিকা সুপারিশ করেছিলেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)