বাইতুল্লাহর মুসাফির-৯
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কিতাবের পাতায় বিভিন্ন যুগের বহু আশিকানে রাসূলের বিস্ময়কর অসংখ্য কাহিনী আমি পড়েছি, যা প্রেমহীন হৃদয়েও সৃষ্টি করে নবী-প্রেমের তরঙ্গ-জোয়ার। তবে এত দিন ভেবেছি, এগুলো সব অতীতের কাহিনী। কিন্তু আজ মনে হলো, অতীত যেন আবার ফিরে এসেছে এবং সকল আশিকানে রাসূলের তাজাল্লিয়াতে ইশক ও প্রেমজ্যোতির্ময়তা আমাদের হযরতের মাঝে উদ্ভাসিত হয়েছে। নবীপ্রেমের সুরভিত উদ্যানে একটি শুভ্র-সুন্দর ফুল যেন ফুটে আছে সকল ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভ নিয়ে!
সে পবিত্র প্রেমময় রূপ কীভাবে আমি তুলে ধরবো কাগজের পাতায়! তা যে শুধু অবলোকন এবং অনুধাবন করার বিষয়, ভাষা ও শব্দের সীমাবদ্ধতায় ধারণ করার বিষয় নয়।
আমার অন্তরে তখন একটাই ছিলো সান্ত্বনা; হয়ত হৃদয় আমার নবীপ্রেমের সামান্য আলোকস্পর্শ থেকেও বঞ্চিত, কিন্তু আমি তো এখন যুগের শ্রেষ্ঠ নবীপ্রেমিকের সান্নিধ্যপ্রভায় উদ্ভাসিত! এও কি কম সৌভাগ্যের আমাদের মত দুর্ভাগাদের জন্য!
আমি তখন হযরতের একেবারে সংলগ্ন ছিলাম এবং সত্যি সত্যি তাঁর দেহসত্তা থেকে অন্যরকম একটি খোশবু ও সুবাস অনুভব করছিলাম; ইশকে রাসূলের খোশবু এবং নবীপ্রেমের সুবাস। সেই সুবাসে আমিও যেন কিছুটা সুবাসিত হলাম। তাতে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য আমিও যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলাম; এমন মানুষ যে ভালোবাসতে জানে না, কিন্তু ভালোবাসতে চায় এবং ভালোবাসার ‘অর্ঘ্য’ নিবেদন করতে চায়! এমন মানুষ যার কলবে নেই ইশকের হাকীকত এবং
মুহাববাতের মারেফাত, তবু সে পেশ করতে চায় ইশক ও
মুহাববাতের নাযরানা!
আশিকানের ঢল এগিয়ে চলেছে তরঙ্গের পর তরঙ্গ হয়ে দুরূদ ও সালামের সুমধুর গুঞ্জন তুলে। আহ! অবশেষে এসে গেলো পরম সৌভাগ্যের মুহূর্ত! মা আমিনার এতীম দুলাল শুয়ে আছেন যে কবরে আমাদের হযরত দাঁড়ালেন তার সামনে। দাঁড়ালেন এমন আদবের সাথে, এমন বিগলিতভাবে যেন .. যেন তিনি সেই হাদীছের বাস্তব রূপ, যাতে আল্লাহর নবী ইরশাদ করেছেন-
‘আমার মৃত্যুর পর যে আমার কবর যিয়ারাত করলো সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারাত করলো।’
সৌভাগ্যের সেই সোনালী মুহূর্তটি আমি কখনো ভোলবো না, যা জীবনে একবারই এসেছিলো; আর কখনো আসবে না। আমার দু’ কানে যেন মধু বর্ষিত হলো; আমি শুনতে পেলাম হযরতের কম্পিত কণ্ঠস্বর-
আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!
কী ছিলো হযরতের ছালাত ও সালাম নিবেদনের সেই কাঁপা কাঁপা আওয়াযে! আমার অন্তরে কিসের কম্পন সৃষ্টি হলো! কিসের তরঙ্গ অনুভূত হলো! কেমন যেন এক সম্মোহিত অবস্থার মাঝে আমিও উচ্চারণ করলাম-
আছ-ছালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!
জীবন যেন আজ সার্থক হলো! সালাম নিবেদন যেন কবুলিয়াতের আশ্বাস লাভ করলো। কারণ ইশকের ‘আতর’ যদিও ছিলো না আমার কাছে, কিন্তু একজন ‘আত্তার’-এর
সান্নিধ্য ছিলো।
আশিকানের তরঙ্গ-স্রোত এখানে এমন তীব্র যে, মুহূর্তের বেশী দাঁড়ানো সম্ভব নয় কোনক্রমে। কিন্তু আমাদের হযরত স্থির প্রশান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। আশ্চর্য! একটি আলোর প্রাচীর যেন তাঁকে বেষ্টন করে ছিলো। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসে এবং তাঁকে স্পর্শ না করেই পার হয়ে যায়। তিনি তখন পূর্ণ আত্মসমাহিত।
পিছনের প্রচন্ড চাপে আমার বুক লেগে ছিলো হযরতের পিঠের সঙ্গে। এ সংলগ্নতার কিছু অনুভব অনুভূতি লিখতে গিয়েও কলমকে সংযত করলাম। কারণ কিছু জিনিস থাকে, যা একান্তভাবে নিজের জন্য রেখে দিতে হয়।
রওযা শরীফের মোকামে হযরত তখন হৃদয়ের কী ভাব নিবেদন করলেন এবং ইশক ও
মুহাববাতের কী নাযরানা পেশ করলেন তা তো আমার জানা নেই।
বিগলিত হৃদয়ের অশ্রুধারাকে আশ্রয় করে আল্লাহর কাছে কী তিনি চাইলেন এবং কী তিনি পেলেন তাও আমার জানা নেই। আমি শুধু নিবেদন করলাম-
‘হে আল্লাহ! আমার না আছে ইশক, না আছে আদাবে ইশক। কিন্তু হে আল্লাহ! এই গোনাহগার বান্দার বুক লেগে আছে তোমার পেয়ারা বান্দার সঙ্গে। এইটুকু তুমি কবুল করো হে আল্লাহ!
ধীরে ধীরে হযরত সরে এলেন একটু ডানে। সালাম পেশ করলেন প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রা)-এর খেদমতে-
আস্-সালামু আলাইকা ...
তারপর আরেকটু ডানে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা)-এর বরাবরে-
আস্-সালামু আলাইকা ...
বাবে জিবরীল দিয়ে হযরত যখন বের হলেন তাঁর মুখমন্ডলের আলোক উদ্ভাস, যা অন্তত দেখার সৌভাগ্য যদি হয় কারো, সে ভাবতে পারে নিজেকে ধন্য।
একদিন যিয়ারাতের পর হযরতকে মনে হলো খুব খোশদিল। আমি সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত! যখন আপনি দুরূদ ও সালাম পেশ করেন তখন আপনার দিলে কী হালাত ও কাইফিয়াত পয়দা হয়?
হযরত বললেন, আরে মিয়াঁ! তখন তো হালাত ও কাইফিয়াতের কোন অনুভবই দিলে থাকে না।
‘তব তো দিল হী রুখসত হো যাতা হায় সীনে সে!’
(দিল তো তখন রুখসত হয়ে যায় সিনার ভিতর থেকে)
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত! এটা কি সত্য যে, আল্লাহর কোন কোন বান্দা যখন দুরূদ ও সালাম পেশ করেন তখন তার জাওয়াব শুনতে পান রওযা শরীফ থেকে?
হযরত বললেন, এমন অনেক ঘটনা কিতাবে আছে। এমন কি আল্লাহর খাছ বান্দা যারা, দুরূদ ও সালাম পেশ করার সময় ইশক ও মুহাববাতের এমন এক উঁচা মাকামে তারা পৌঁছে যান যে, তাদের তখন হাকীকী যিয়ারাতও নছীব হয়ে যায়।
এরপর হযরত বললেন, কিন্তু মিয়াঁ! এসব চিন্তায় লিপ্ত হওয়া ঠিক না। আসল কর্তব্য হলো যিয়ারাতের যাবতীয় আদব রক্ষা করা এবং দিলের মধ্যে আযমত ও মুহাববাতের ভাব পয়দা করা। তাহলেই যিয়ারাতের হাকীকী ফায়দা ও রূহানিয়াত হাছিল হবে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত! আপনার জীবনের প্রথম
যিয়ারাতের কথা কি মনে আছে?
তিনি বললেন, মিয়াঁ! প্রত্যেক যিয়ারাতকেই মনে হয় জীবনের প্রথম যিয়ারাত। আসল কথা হলো, ইশক ও মুহাববাতের না ইবতেদা আছে, না ইনতিহা। আছে শুধু তরক্কীর নতুন নতুন মাকাম। আর প্রত্যেক মাকামে পৌঁছে মনে হবে, এখান থেকেই শুরু, আগের সবকিছু যেন কিছুই ছিলো না।
আরেকটা কথা জিজ্ঞাসা করার খুব ইচ্ছা ছিলো, হযরত কখনো রওযা শরীফ থেকে সালামের জাওয়াব পেয়েছেন কি না, কিন্তু সাহস হলো না; যদি হযরত নারায হন। যদি বলেন, অপ্রয়োজনীয়
চিন্তা ছেড়ে আসল কাজে মশগুল থাকো।
একদিন রাতে মসজিদুন-নবী থেকে ফিরে আসার পর হযরতের আরামের ইনতেযাম করা হচ্ছিলো, তখন হযরত আমাকে ডেকে বললেন, মওলবী আবু তাহের, সকালে আমাকে জান্নাতুল বাকীতে
যিয়ারাতের জন্য নিয়ে যেতে পারবেন?
এটা ছিলো ছোট থেকে ছোট এবং ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রের সাথে হযরতের কথা বলার খাছ ‘আন্দায’, যার সাথে কম বেশী আমরা সবাই পরিচিত ছিলাম। অন্যসময় যেমন তেমনি পুরো সফরে দেখেছি, হযরত সবার সঙ্গে এভাবেই কথা বলতেন, যেন আমরা হযরতের সঙ্গে নই, বরং হযরত আমাদের সঙ্গে। এই ‘আদা ও আন্দায’ নিজের জীবনেও অনুসরণ করার বড় ইচ্ছে হয়, পারি না। এটা পারা যায় না, নিজের ভিতরের ‘আমি’কে বিসর্জন দেয়া ছাড়া।
তাহাজ্জুদের সময় হযরত আমাদের ডেকে ডেকে তুললেন। অনেক কষ্টে চোখ মেলে উঠে বসলাম। বিছানো মুছল্লা দেখে বুঝলাম, খুব কম সময় হযরত বিছানায় ছিলেন। আমাদেরকে জাগিয়ে আবার তিনি মুছল্লায় দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি খুব কাছে থেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে হযরতের নামায পড়া দেখতে থাকলাম, নামায পড়া তো নয় যেন গোপন অভিসারে মিলিত হওয়া। হযরত সালাম ফিরিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে এমন আদরের একটি শব্দ বললেন যে, আমি আনন্দে আত্মহারা হলাম।
হযরতকে এভাবে এত নিকট থেকে আর কখনো দেখিনি। আসলে সফর এবং বিশেষ করে হজ্বের সফর অনেক বড় নেয়ামত। এ সময় সবার মাঝে অন্যরকম একটা নৈকট্য থাকে। অনেক বড়কেও তখন অনেক কাছের মনে হয়; যেন ইচ্ছে করলেই ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। পুরো সফরে হযরতের যে নিকট সান্নিধ্য পেয়েছি এবং তাঁকে যত কাছের মনে হয়েছে, আগে বা পরে কখনো এমন মনে হয়নি। তবিয়তের মাঝে কোন জালাল ছিলো না, ছিলো শুধু জামাল আর জামাল। ইচ্ছে হতো কাছে যাই, আরো কাছে যাই। মাঝে মাঝে এমন সব আব্দারও করে বসতাম, অন্যসময় যা কল্পনা করাও সম্ভব ছিলো না। আরো আনন্দের কথা, কখনো কখনো হযরতও আমার কাছে ‘আব্দার’ করতেন ঠিক শিশুর মত। নিজেকে তখন মনে হতো বড় ভাগ্যবান। হায়, জীবনের এমন সুখ ও সৌভাগ্যের দিনগুলো স্মরণ করেই হয়ত বলা হয়- ‘সাকাল্লাহু তিলকাল আইয়াম’ (জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে হে আল্লাহ! তুমি শিশিরসিক্ত করে রাখো)
হে আল্লাহ! তুমি আমার জীবনের এই সব দিন-রাত নিয়ে নাও; শুধু ফিরিয়ে দাও হজ্বের সফরে তোমার এই বান্দার সান্নিধ্যের অল্পক’টি দিন-রাত, নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করবো।
হায়, বড় মধুর দিনগুলো যেন শুকনো পাতা হয়ে ঝরে গেলো জীবন-বৃক্ষ থেকে; তার কিছুটাও যদি থেকে যায় আমলনামায় তো আলহামদু লিল্লাহ!
তাহাজ্জুদের আযানের বেশ আগে আমরা তিনচারজন হযরতের সঙ্গে রওয়ানা হলাম। বলা উচিত, হযরতের পিছনে রওয়ানা হলাম। হযরতকে তখন মনে হলো খুব তাজাদম। বেশ দ্রুত হাঁটছেন। এ হাঁটা বলে দেয়, ইনি এখন অজানা কোন অভিসারের অভিসারী! একজন বৃদ্ধ কোন্ শক্তিবলে এভাবে হাঁটতে পারেন! সম্ভবত এটাকেই বলে মনযিলে চৌম্বকাকর্ষণ। আমাদের মত যুবকদেরও বেশ কষ্ট হচ্ছিলো হযরতের পিছনে চলতে। অথচ তিনি বলেছিলেন, আমরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাবো!
হযরতের পৌঁছার একটু আগে মসজিদের দরজা খোলা হয়েছে। বাবুসসালাম দিয়ে প্রবেশ করে হযরত যিয়ারাত করলেন। দিনের দৃশ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এখনকার দৃশ্য। যিয়ারতকারী সংখ্যায় অতি অল্প। নির্জন নাহলেও নির্জনতার আত্মসমাহিত একটি পবিত্র পরিবেশ বিরাজমান। অপূর্ব এক পুলক অনুভূত হলো ভিতরে। যেন শোনা গেলো একটি সাদর আহবান, ‘এসো এসো সালাম নিবেদন করো! শাফা‘আতের আরজি পেশ করো! রহমতের নবীর দয়া ও করুণার ছায়া গ্রহণ করো!’
দিনে ছিলো অদ্ভুত এক ত্রস্ততা, এখন অপূর্ব এক প্রশান্তি ও স্থিরতা! দাঁড়াও, আদবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকো! এখন কেউ তোমাকে বলবে না সরে যেতে। মনের যত আকুতি,হৃদয়ের যত ব্যথা-বেদনা বলে যাও নীরবে অশ্রুর ভাষায়! প্রতি ফোঁটা অশ্রু এখানে মুক্তার চেয়ে মূল্যবান! তোমার প্রেমহীন অশ্রুর হয়ত কোন মূল্য নেই, কিন্তু যুগ যুগের অসংখ্য অশিকানের চোখ থেকে ঝরা অশ্রুর সঙ্গে মিশে গিয়ে তোমারও অশ্রু হয়ে যাবে মূল্যবান।
হযরত বলেছিলেন, প্রতিটি যিয়ারতকে মনে হবে নতুন ভাবের, নতুন অনুভবের এবং নতুন স্বাদ ও নতুন প্রাপ্তির। হযরতের সে কথা আজকের রাতের নির্জনতার যিয়ারতে অত্যন্ত সত্য হয়ে উদ্ভাসিত হলো আমার সামনে। হৃদয়-মন আপ্লুত হলো অন্যরকম এক আত্মিক প্রশান্তিতে।
যিয়ারাতের পর হযরত রাওযাতুম মিন রিয়াযিল জান্নাতে দাখেল হলেন। সেখানে তখন সত্যি সত্যি এক জান্নাতি পরিবেশ। এদিকে যিকিরের, ওদিকে তিলাওয়াতের মধুর গুঞ্জন! এখানে দু‘আ ও মুনাজাতের, ওখানে কান্না ও রোনাযারির অনুচ্চ ধ্বনি! মন যেন এমনিতেই পবিত্র হয়ে ওঠে! হৃদয় যেন আপনাতেই বিগলিত হয়ে যায়! এরকম সুমধুর গুঞ্জনই হয়ত থাকবে জান্নাতে, হৃদয় ও আত্মার আনন্দ যা শতগুণ বাড়িয়ে দেবে!
উসতুয়ানা আবু লুবাবার কাছে হযরতের জায়গা হয়ে গেলো। দু’ তিনজন সরে গিয়ে ইকরামের সঙ্গে হযরতকে জায়গা করে দিলো। পুরো সফরে বারবার দেখেছি এ দৃশ্য; মক্কায়, মদীনায়, মিনায়, আরাফায়। কেউ তারা হযরতকে চেনে না; আপনাতেই যেন তাদের অন্তরে তাঁর প্রতি ইকরামের এবং মুহাববাতের জাযবা পয়দা হয়ে যায়।
হজ্বের পর শুক্রবারের ঘটনা। জুমু‘আর অপেক্ষায় হারামের উম্মে হানীতে হযরত বসে আছেন, এমন সময় হযরতের বের হয়ে আসার প্রয়োজন হলো। আমি ভাবলাম, ভিতরে আর জায়গা পাওয়া সম্ভব হবে না। জরুরত থেকে ফারিগ হয়ে যখন ফেরা হলো তখন খোতবা শুরু হতে বেশী বাকি নেই। কিন্তু আশ্চর্য! সবাই নিজে থেকে এমনভাবে পথ করে দিলো যে, হযরত সচ্ছন্দে ফিরে এলেন ঠিক আগের জায়গায়। এমনই হয়। আসমানে যখন কোন বান্দার প্রতি মুহাববাতের ফায়ছালা হয় তখন যমিনওয়ালাদের দিলেও তার প্রতি মুহাববাত ঢেলে দেয়া হয়।
ফিরে আসি আগের কথায়। রওযাতুল জান্নাহ সম্পর্কে হযরত অনেক কথা বললেন; প্রায় সবই জানা কথা। আমাদের তো আর জানার অভাব নেই! অভাব শুধু ভাবের! আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন-
‘আমার ঘরের এবং মিম্বরের মাঝে যা, তা জান্নাতের বাগিচাসমূহের একটি বাগিচা।’
এ হাদীছ জানতাম। অনেকবার পড়েছি, শুনেছি। কিন্তু আজ স্বয়ং রওযাতুল জান্নায় বসে হযরতের পাক যবানে শুনে, এ হাদীছের স্বাদ ও লজ্জতই মনে হলো অন্য রকম। রওযাতুল জান্নাহর হাদীছ যেন জান্নাতের খোশখবরের হাদীছ।
মহান ছাহাবী হযরত আবু লুবাবার তাওবার ঘটনা আমাদের হযরত এমনভাবে বর্ণনা করলেন, পুরো ঘটনা যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো। কল্পনার চোখে যেন দেখতে পেলাম, হযরত আবু লুবাবা নিজেকে বেঁধে রেখেছেন খুঁটির সঙ্গে। একসময় তাওবা কবুল হলো এবং তাঁর কোমরের বাঁধন খুলে দেয়া হলো।
হযরত যখন উসতুয়ানাতুল- হান্নানার ঘটনা বললেন; আল্লাহর নবীর বিচ্ছেদ ব্যথায় উসতুয়ানাতুল-হান্নানা কীভাবে কাঁদলো এবং আল্লাহর নবী মিম্বর থেকে নেমে এসে কীভাবে সান্ত্বনা দিলেন, তখন নিজের অজান্তে উসতুয়ানাতুল-হান্নানার দিকে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম, আর ভাবলাম, তাহলে তো এই মানবজীবনের চেয়ে ঐ জড়জীবন অনেক বেশী সৌভাগ্যের!
একটি কাষ্ঠখন্ড নবীর বিরহে কাঁদে! তোমার অন্তর যদি না কাঁদে মদীনার জন্য, নবীর যিয়ারাতের জন্য, তাহলে!
পাথরের পাহাড় ভালোবাসে আল্লাহর নবীকে! তোমার হৃদয় যদি ভালোবাসতে না পারে, তোমার দিলে যদি মুহাববাত না থাকে তাহলে কী মূল্য এমন মৃত হৃদয়ের! এমন মুরদা দিলের!
কি বললে! তুমি আশিকে রাসূল! তোমার দিলে আছে ইশকে নবী! তোমার হৃদয়ে বয়ে যায় নবীর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার ঝরণাধারা! তাহলে তোমার ঘরে, তোমার পরিবারে এবং তোমার জীবনে নেই কেন সুন্নাতের ছায়া?
নবীর সুন্নাত তোমার চোখের সামনে মিটে যায়, অথচ তুমি নির্লিপ্ত, তোমার দিলে লাগে না চোট!
নবুয়তের উপর হামলা আসে, যামানার মুসায়লামারা উল্লাস করে, অথচ তুমি নির্বিকার, তোমার হাতে ঝলসে ওঠে না তলোয়ার! তারপরো তুমি আশিকে রাসূল হওয়ার দাবীদার! ইশক ও মুহাববাতের এ কেমন দাবী তোমার, আমার! প্রেম ও ভালোবাসার প্রমাণ কি শুধু মুখের শ্লোগান!
শোনো বন্ধু! ইশক ও মুহাববাত এবং প্রেম ও ভালোবাসার দাবী হলো আনুগত্য। আমি যাকে ভালোবাসবো, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকেই তো অনুসরণ করবো! তার প্রতিটি আচরণ এবং উচ্চারণ, আমি চাইবো আমার মাঝে যেন ঘটে এর পূর্ণ প্রতিফলন! আমার ওঠা-বসা, চলা-ফেরা ও আহার-নিদ্রা সবকিছু যেন হয় তার মত! যুগে যুগে প্রেমের জগতে এটাই তো হয়ে এসেছে এবং হতে থাকবে! যুগে যুগে নবীকে যারা ভালোবেসেছেন, আজীবন তারা নবীর সুন্নাতের উপর অবিচল ছিলেন! কখনো পরোয়া করেননি যুগ ও সমাজের নিন্দা-উপহাসের। বরং তাদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ছিলো-
أأترك سنة حبيبي لهؤلاء الحمقاء
(আমি কি আমার হাবীবের সুন্নাত ছেড়ে দেবো এই মূর্খদের জন্য?)
উসতুয়ানাতু- হান্নানার দিকে তাকিয়ে থেকে এই সব ভাবনা আমার অন্তরে উদিত হলো এবং আমার হৃদয় উদ্বেলিত হলো। হযরত হাফেজ্জী হুযূর তাঁর ভাবের জগতে নিমগ্ন ছিলেন; আমি তা কিছুমাত্র না ভেবে বললাম, হযরত, আজ এই পবিত্র স্থানে, জান্নাতের এই টুকরায় বসে আমার জন্য দু‘আ করুন, আল্লাহ যেন সুন্নাতের পাবন্দ হওয়ার তাওফীক দান করেন।
বিঘ্ন ঘটালাম, তবু হযরত বিরক্ত হলেন না। মৃদু হেসে দু‘আ করলেন, আর বললেন, মিসওয়াকের ইহতিমাম করো, আর তোমার তহবন্দ টাখনুর নীচে থাকে, এদিকে খেয়াল করো। প্রত্যেক কাজে নবীর সুন্নাত কী, সুন্নাত তরীকা কোন্টি, তালাশ করে করে তার উপর আমল করার চেষ্টা করো এবং তোমার অধীনস্থদেরকে সুন্নাতের উপর ওঠানোর মেহনত করো। শুধু দু‘আ দ্বারা কাজ হয় না, দু‘আর সঙ্গে আমলের মেহনতও থাকা চাই।
ফজরের কিছুক্ষণ পর হযরত জান্নাতুল বাকীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। কিছুটা যেন ক্লান্ত। সারাটা রাত তো কেটেছে মুছল্লায় নামাযে দাঁড়িয়ে। আমরা বললাম, হযরত! আজ না হয় থাক; ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করুন। তিনি বললেন, মিয়াঁ, আমাকে বুড়া মনে করেছো! আমার শরীর বুড়া, কিন্তু দিল জোয়ান; আসো আমার পিছনে পিছনে।
জানি না হযরত বুঝলেন কি না, আসলে ক্লান্তি ছিলো আমাদের জোয়ানদের। বুড়োকে দেয়া পরামর্শটা ছিলো নিছক কৌশল। কিন্তু হযরত আমাদের ‘জোয়ানি’র উপর দয়া না করে সতেজ পদক্ষেপে সামনে চলতে লাগলেন, আমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ‘বার্ধক্যের যৌবন’ কাকে বলে!
জান্নাতুল বাকী হলো মদীনার প্রাচীনতম কবরস্তান। নবুয়তের যুগে আকারে ছোট ছিলো; পরে সম্প্রসারিত হয়ে হয়ে বর্তমান আয়তন লাভ করেছে। রামাযানে দেখেছিলাম মাঝখানে অনেক বাড়ী-ঘর ছিলো; এখন ভেঙ্গে প্রায় সমান করে ফেলা হয়েছে। দূর থেকেই দেখা যায় প্রাচীরঘেরা জান্নাতুল বাকী। সম্ভবত তিনটি প্রবেশপথ। আমরা প্রবেশ করলাম মসজিদে নববীর দিকের প্রবেশপথ দিয়ে।
জান্নাতুল বাকীর পুরো এলাকায় অবাক দৃশ্য। ইরান ও অন্যান্য এলাকার শিয়া হাজীরা এখানে সেখানে তাঁবু টানিয়ে দিন-রাত বাস করে। এমনিতে তারা বেশ স্বাভাবিক। কথা বলছে, চা-কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে, হাসি-আনন্দও করছে। কিন্তু নবী-কন্যা হযরত ফাতিমা (রা) এবং অন্যান্য আহলে বাইতের কবরের সামনে গিয়েই শুরু হয় তাদের অদ্ভুত আচরণ। কেউ মাটিতে গড়াগড়ি যায়; কেউ কবরের উপর ‘সিজদার মত’ পড়ে যায়। তাদের ফার্সি বিলাপগুলো যদ্দুর বোঝা গেলো, তাতে শিরক সুস্পষ্ট। সউদী পুলিশ ও ‘মুবাল্লিগ’ নরমে গরমে সবরকমে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টায় গলদঘর্ম, কিন্তু কে শোনে কার কথা! কে মানে কার উপদেশ আমার মনে হয়েছে, সউদীদের বিদ‘আত প্রতিরোধের প্রচেষ্টা বিফলে যাওয়ার কারণ একদিকে যেমন ভাষাগত, অন্যদিকে তেমনি মনস্তাত্ত্বিক। যদি ফার্সি ভাষায় পারদর্শী একদল চৌকশ লোককে এখানে নিযুক্ত করা হতো, যারা হিকমত ও প্রজ্ঞার সাথে তাদের বোঝাতেন তাহলে এ উত্তম প্রচেষ্টা অবশ্যই উত্তম ফল প্রদান করতো। একদিন এক শিক্ষিত ইরানীকে আমার টুটাফাটা ফার্সি যবানে বললাম, দেখো; কারবালার ঘটনা যেমন তোমাদের কাছে তেমনি আমাদেরও কাছে হৃদয়বিদারক। আহলে বাইতের প্রতি মুহাববাত আমাদেরও ঈমানের দাবী। তবে শোক ও ভালোবাসা দু’টোই হতে হবে শরীয়তনির্দেশিত পন্থায়। অহুদের শহীদানের প্রতি আল্লাহর নবী শোক প্রকাশ করেছেন, কিন্তু কীভাবে? মদীনার নারীদের তিনি চাচা হামযার শোকে বিলাপ করতে নিষেধ করেছিলেন। ...
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফার্সিতে যা বললাম তাতেই ভদ্রলোক বেশ নমনীয় হলেন।
জান্নাতুল বাকী হযরতের অতি পরিচিত এবং এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। হযরত হেঁটে হেঁটে যিয়ারাত করলেন এবং প্রসিদ্ধ কবরগুলোর পরিচয় বললেন। হযরতের দু‘আ ও যিয়ারত ছিলো আবেগপূর্ণ, তবে শান্ত ও সংযত। তাঁর আবেগ-উদ্বেলতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিলো তিনটি স্থানে; মা ফাতেমা (রা) ও অন্যান্য আহলে বাইতের কবরের সামনে, নবীজীর দুধমা বিবি হালিমা সাদিয়া (রা)-এর কবরের সামনে এবং তৃতীয় খলীফা হযরত উছমান (রা)-এর কবরের সামনে।
আল্লাহর নবীর কত প্রিয় ছিলেন এই মজলুম ছাহাবী! একে একে দুই কন্যাকে তিনি তাঁর বিবাহে দান করেছিলেন, তাই তাঁকে বলা হতো যিন্নূরাইন (দুই নূরের অধিকারী)।
তাঁরই জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বাই‘আতে রিযওয়ান, আর আল্লাহর নবী নিজের ডান হাতের উপর বাম হাত স্থাপন করে বলেছিলেন, ‘এ হাত উছমানের পক্ষ হতে।’ কারণ হযরত উছমান (রা) তখন আল্লাহর নবীর প্রতিনিধি হয়ে মক্কায় অবস্থান করছিলেন এবং খবর এসেছিলো যে, কোরেশ তাঁকে ধরে রেখেছে।
এসব ঘটনা আমাদের জানা ছিলো, অনেকেরই জানা আছে। জানা থাকে; থাকে না শুধু উপলব্ধি। জানা দ্বারা মানুষ জ্ঞানী হয়, আর উপলব্ধি দ্বারা হয়
অন্তর্জ্ঞানী।
উছমান (রা)-এর কবরের সামনে হযরত যখন এসকল ঘটনা এবং তাঁর শাহাদাতের মর্মন্তুদ কাহিনী বলছিলেন তখন অশ্রু শুধু হযরতের চোখেই ছিলো না, আমাদেরও চোখে ছিলো। অবশ্য অশ্রুর উষ্ণতা সব চোখে সমান হয় না।
যুগে যুগে আল্লাহর কত বান্দার চোখের পানি ঝরেছে এই কবরের মাটিতে, তবু কি শোধ হয়েছে এই মযলূম ছাহাবীর এক ফোঁটা রক্তের ঋণ! তিনি নিজের রক্ত ঝরিয়েছিলেন, যেন নবীর উম্মতের রক্ত না ঝরে। অনেক তলোয়ার ছিলো তখন মদীনায় মযলূম খলীফার প্রাণ রক্ষার জন্য, কিন্তু আশি বছরের বৃদ্ধ খলীফার একই কথা; আমার জন্য কোন মুসলমানের রক্ত ঝরবে, তা হতে পারে না।
ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে থেকে সময়ের পর্দা যেন সরে গেলো। সময়ের পর্দা যখন সরে যায়, অতীত তখন বর্তমানের চেয়ে আপন হয়ে যায়। পরম মমতায় অতীত যেন আমাকে টেনে নিলো তার কোলে। আমি যেন দেখতে পেলাম মযলূম খলীফাকে কবরে নামানোর এবং মাটি দেয়ার দৃশ্য। আমি যেন দেখতে পেলাম তাঁর রক্তভেজা কাফন।
আল্লাহর নবীর শহর এখন ফাসাদীদের দখলে। তাই সামান্য কয়েকজন মানুষ আসতে পেরেছেন মযলূম খলীফাকে শেষ বিদায় জানাতে? তারা কাঁদছেন নীরবে। মুখে শব্দ নেই, কিন্তু চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে অঝোরধারে। তের শতাব্দীর সময়ব্যবধানেও বন্ধ হয়নি সে অশ্রু ঝরা। এখনো যেন তরতাজা সেই পবিত্র রক্তের ঘ্রাণ!
আমার খুব ইচ্ছে হলো, কবরের অশ্রুভেজা এবং রক্তভেজা মাটির স্পর্শ গ্রহণ করি। কিন্তু সংযত হলাম। হযরতের সংযম যেন আমাকেও সংযত করলো।
কবরস্তানকে বলা হয় মৃতদের শহর। কিন্তু জান্নাতুল বাকীর খোলা ময়দানে বিচরণ করে আমার মনে হলো, মৃতদের এই শহরে যারা আছেন তারা জীবন্ত। তারা ঘুমিয়ে আছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকবেন, যেমন ঘুমিয়ে থাকে ‘নতুন দুলহা’ ‘আনন্দের সুখশয্যায়’!
দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো জান্নাতুল বাকীর যিয়ারাতে, কিন্তু হযরতের হৃদয় এখনো যেন তৃপ্ত হলো না; তাঁর আত্মার পিপাসা এখনো যেন নিবারিত হলো না। অশ্রুসিক্ত চোখে অনেক্ষণ তিনি তাকিয়ে থাকলেন ‘চিহ্ণহীন’ কবরগুলোর দিকে এবং দু‘আ করলেন নিজের মাঝে সম্পূর্ণ সমাহিত হয়ে। আমরা শুধু দেখতে পেলাম তাঁর ঠোঁটের কম্পন এবং গড়িয়ে পড়া চোখের পানি। এভাবে যদি দেখতে পেতাম তাঁর অন্তরের দৃশ্য! চোখের পানি অবশ্য অন্তরেরই ছবি, কিন্তু অশ্রুর ভাষা পড়ার ‘বর্ণমালা’ কি জানা থাকে সবার!
হযরতের পিছনে পিছনে জান্নাতুল বাকী থেকে আমরা বের হলাম অশ্রুসিক্ত চোখে, মৃত্যুর স্মরণকে সম্বল করে এবং অন্তরে জান্নাতুল বাকীতে দাফন হওয়ার আকুতি পোষণ করে। আল্লাহ যখন এতদিন এতভাবে বান্দার মনের আশা পূর্ণ করেছেন, আজকের এ আশাটুকুও পূরণ করবেন নিশ্চয়! বান্দা যেমন ধারণা করে আল্লাহ তো তেমনই আচরণ করেন! হে আল্লাহ, তোমার প্রতি আমি সুধারণা পোষণ করি, আমার আশা তুমি পূর্ণ করবে। তোমার নবীর শহরে আমাকে তুমি শাহাদাতের মওত দান করবে এবং তোমার নবীর প্রতিবেশে জান্নাতুল বাকীতে আমার কবর হবে। আমীন।
হযরতের দিল জোয়ান, একথা সত্য এবং তাঁর বুড়ো শরীর রূহের শক্তিতে বলীয়ান, একথাও সত্য; তাঁরপরো তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। আমরা একটি গাড়ী ঠিক করলাম। মাওলানা হামী-
দুল্লাহ এবং মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব হযরতকে নিয়ে মুসাফিরখানায় চলে গেলেন।
আজ এতদিন পর এই
সফরনামা লিখতে বসে মনে পড়লো, হযরত একদিন মদীনা শরীফে চানমিয়া সওদাগরের মুসাফিরখানায় বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার এই বিরাট মুসাফিরখানায় রয়েছে ছোট ছোট মুসাফিরখানা।’
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো জীবনটাই তো মুসাফিরের জীবন! কিন্তু আমরা বড় গাফিল মুসাফির।
হযরত চলে গেলেন মুসাফিরখানায়, আমি কিছুক্ষণ বসে থাকলাম জান্নাতুল বাকীর দেয়ালের ছায়ায়। বড় ভালো লাগছিলো মৃতদের শহরের ছায়ায় এই নিঃসঙ্গ সময়টুকু। কিন্তু না, আমাকে উঠতেই হলো। কারণ
জীবনের অনিবার্য উপদ্রব এই যে, তুমি যত গভীর তত্ত্বকথাই ভাবো, এবং যত সুন্দর কবিতাই লেখো, সময় মত ক্ষুধা ও পিপাসা তোমাকে পেরেশান করবেই। কারণ তুমি জড়দেহের মানুষ এবং তোমার মধ্যভাগে রয়েছে উদর নামের একটি গহবর। খাদ্য ও পানীয় হচ্ছে তোমার শরীরের জ্বালানী। এটা তোমাকে সরবরাহ করে যেতেই হবে, কী ঢাকায়, কী মক্কা-মদীনায়।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পরবর্তী উপসর্গটি হচ্ছে আরো ভয়াবহ এবং তা থেকেও তোমার মুক্তি নেই। কারণ তুমি ‘গন্দম খাওয়া’ আদমের বেটা! সুতরাং এটা কোন সমস্যা নয়। কিন্তু আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। কারণ উপদ্রব ও উপসর্গ, দু’টো দুর্বলতা একসঙ্গে হানা দিলো। আর সঙ্গত কারণেই তারতীব রক্ষা করা সম্ভব হলো না। প্রথমে খাদ্যপরবর্তী উপসর্গ থেকে মুক্ত হলাম, তারপর শূন্য উদরে খাদ্যজ্বালানী সরবরাহ করলাম। উদর যে পরিমাণ পূর্ণ হলো, পকেট সেই পরিমাণ শূন্য হলো। এটা প্রকৃতির বিধান; ত্যাগ ছাড়া ভোগ সম্ভব নয়। যখনই আমরা ত্যাগ ছাড়া ভোগে প্রবৃত্ত হই তখনি জীবনে অশান্তি দেখা দেয়।
নাস্তার পর নিজেকে বেশ তাজাদম মনে হলো। রামাযানের সময় হাতে সময় ছিলো না, তাই ইচ্ছে থাকলেও মদীনার পথে পথে বিচরণ করার সুযোগ ছিলো না। অথচ আমার স্বপ্ন ছিলো, মদীনার পথে পথে আমি বিচরণ করবো এবং মদীনার অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াবো। কারণ এ শহরের ধূলিকণায় জড়িয়ে আছে আনছার-মুহাজির ছাহাবা কেরামের পদস্পর্শ! এখানে পথের ধূলায় খেলা করেছেন মা ফাতিমার কলিজার টুকরো, পেয়ারা নবীর চোখের মণি ইমাম হাসান-হোসায়ন! এই মদীনার পথের ধূলো কতবার উড়েছে ঘোড়সওয়ার মুজাহিদীনের আসা-যাওয়ায়!
হয়ত তুমি বলবে, এখন কোথায় সেই সব স্মৃতিচিহ্ন মদীনায়?! আমি বলবো, সময়ের প্রাচীর অতিক্রম করো; বর্তমানের স্থূল বন্ধন ছিন্ন করে অতীতের পথে যাত্রা করো, তুমি খুঁজে পাবে সব স্মৃতিচিহ্ন। তুমি দেখতে পাবে নবীর মদীনার সব দৃশ্য। ঐ যে মাঠে ছেলেরা খেলা করছে; ছোটাছুটি করছে, বর্তমানের চোখে যদি দেখো, তাহলে এরা আজকের মদীনার শিশু, আর যদি অতীতের চোখে তাকাও তাহলে এদেরই মাঝে তুমি দেখতে পাবে সে যুগের মদীনার শিশুদের ছবি। একটি ছেলে তার নামের শেষে বললো, ‘আলআনছারী’। আচ্ছা বলো তো, এই ছেলেটির মাঝে তুমি কি দেখতে পাও না মু‘আওয়ায ও আফরার, কিংবা সামুরা ও জুন্দুবের ছবি! কিংবা তোমার কি মনে পড়ে না সেই এতীম দুই বালকের কথা, যারা মসজিদে নববীর জন্য আল্লাহর নবীকে দান করতে চেয়েছিলো তাদের একটুকরো জমি!
আল্লাহর শোকর, মদীনার পথে পথে আমি কিন্তু দেখতে পেয়েছি সে যুগের সোনার মদীনাকে। এখানে সেখানে কাঁচা পাকা ঘর, মাঝে মাঝে খেজুর বাগান এবং মিষ্টি পানির কূপ। আধুনিক পণ্যসম্ভারে সুসজ্জিত আজকের মদীনার বাজারে আমি দেখতে পেয়েছি সেযুগের মদীনার বাজার, যেখানে বিক্রেতা লাভ করেন এবং ক্রেতা লাভবান হন; যেখানে দোকানদার বিক্রি করেন এবং তিলাওয়াত করেন; যেখানে খরিদ্দার খরিদ করেন এবং যিকির করেন।
আমার প্রিয় ভাই, তুমি যখন মদীনার যিয়ারাতে যাবে, সাবধান! বর্তমানের ধাঁধায় হারিয়ে যেয়ো না। আসমানছোঁয়া ইমারত ও দালানকোঠায় বিভ্রান্ত হয়ো না। দোকানে দোকানে সাজানো পণ্যসম্ভার ও স্বর্ণালঙ্কার দেখে ভুলে যেয়ো না যে, তোমার লক্ষ্য আজকের মদীনা নয়, অতীতের মদীনা। বাইরের চোখ বন্ধ করে ভিতরের চোখ খুলে দেখো, সময়ের পর্দা সরে যাবে এবং অতীতের রাজপথ ধরে তুমি পৌঁছে যাবে নূরানী যুগের নূরের মদীনায়। তখন তুমি ধন্য হবে এবং তোমার প্রাপ্তির পাত্র পূর্ণ হবে।
এই যে বারবার বলছি সময়ের ব্যবধান অতিক্রম করে বর্তমান থেকে অতীতে ফিরে যাওয়ার কথা, এটা কিন্তু আমার নিজের কথা নয়; এটা শুধু বড়দের কথা বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দেয়া।
এক আরব দম্পতি সম্ভবত প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য এসেছে। কিছু মানুষ থাকে, প্রথম দর্শনেই তাদের সম্পর্কে মন সাক্ষ্য দেয়, এরা মানুষ! এখানেও আমার মন সাক্ষ্য দিলো। নিজের অজান্তেই আমি এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। পুরুষটিকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি মদীনার বাসিন্দা! তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, বললেন, হাঁ; আমি আউস গোত্রের ... শাখার লোক। চৌত্রিশ সিঁড়ি উপরে আমার দাদা হলেন ... (রা)।
আমি রোমাঞ্চিত হলাম। শ্রদ্ধায় অভিভূত দৃষ্টিতে তাকে নতুন করে দেখলাম। আমি তার কোলের শিশুটিকে দেখিয়ে অনুনয়ের স্বরে বললাম, আমি কি ... (রা)-এর পঁয়ত্রিশতম বংশধরকে একটু কোলে নিতে পারি?
তিনি মৃদু হেসে বললেন, অবশ্যই।
হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ দ্বারা সিক্ত করে শিশুটিকে আমি কোলে নিলাম। আবার .. আবার আমি কোলের শিশুটিকে আশ্রয় করে অতীতের কোলে ফিরে গেলাম। এ শিশুটি তো সে যুগের মদীনার ঐ সকল শিশুদেরই প্রতিনিধি, যারা তাদের শৈশবে আল্লাহর রাসূলকে দেখেছে! এমনকি হয়ত ...
মদীনায় নতুন শিশুকে তো বরকতের জন্য আল্লাহর নবীর কাছে আনা হতো, আর তিনি খেজুর চিবিয়ে, পবিত্র থুথু মিশিয়ে শিশুটির মুখে দিতেন। এ শিশুটি তো ঐসকল ভাগ্যবান শিশুরই প্রতিনিধি! আমি তার মাথায় মখমল-চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে ঐ শিশুদের স্পর্শ অনুভবের চেষ্টা করলাম।
আমি শিশুটির মাথার ঘ্রাণ নিলাম। কে জানে, হয়ত এরকমই ছিলো তাদেরও মাথার ঘ্রাণ!
মন চাইছিলো তাকে কিছু দান করি! কিন্তু কী দেবো আমি! কী দিতে পারে মদীনার এক গরীব মুসাফির! শিশুটির রক্তের কাছে হৃদয়ের সবটুকু মিনতি নিবেদন করে গভীর আবেগে তার গোলাপরাঙ্গা গালে শুধু একটি কোমল চুম্বন এঁকে দিলাম। ফুলের মত সুন্দর শিশুটি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! আশ্চর্য! কোন শিশুর চোখের চাহনি হতে পারে এমন মায়াকাড়া! কিন্তু সে চোখের তারায় এবার আমি অতীতের ছায়া দেখতে পেলাম না, বরং আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার শিশুকন্যার ছবি। মদীনার শিশুর মুখাবয়বে সুদূর বাংলাদেশের কোন শিশুর মুখচ্ছবি! কী আশ্চর্য মধুর অনুভূতি যে জেগেছিলো তখন আমার মনে! এমন দুর্লভ অনুভূতির মুহূর্ত জীবনে বারবার আসে না। যখন আসে হৃদয় থেকে কখনো তা মুছে যায় না। সুখের এবং সৌভাগ্যের স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় চিরকাল।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এই নম্র, বিনয়ী ও স্মিতভাষী মানুষটির সঙ্গে পথের সামান্য কথা থেকে গভীর
অন্তরঙ্গতা হয়ে গেলো। তার নাম শায়খ আছিম বিন আব্দুল জাববার। তিনি তার ‘পরিচয় বিতাকা’ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার বিশুদ্ধ ভাষা এবং আরবীয় উচ্চারণ সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশুদ্ধ আরবী ভাষা তো এখন খোদ আরবদের মাঝেই ‘আজনবী’ হয়ে গেছে। তুমি যদি আমাদের বাড়ীতে আসো তাহলে আমার বৃদ্ধ পিতা তোমাকে পেয়ে খুশী হবেন।
আমি বললাম, তোমার
আন্তরিকতার জন্য তোমাকে জাযাকাল্লাহ। কিন্তু আমি আমার শায়খের সঙ্গে এসেছি; তাঁর অনুমতি ছাড়া কোথাও যেতে পারি না। তিনি বললেন, তোমাদের মুসাফিরখানা আমি চিনি। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল আমি তোমার শায়খের সঙ্গে দেখা করতে এবং দু‘আ নিতে যাবো, আর তাঁকেও আমার আববার পক্ষ হতে দাওয়াত দেবো। আশা করি, মদীনার মেযবানকে তিনি নিরাশ করবেন না।
শায়খ আছিম ও তার স্ত্রী একটু দূরে তাদের গাড়ীতে উঠলেন। আমি মায়াভরা দৃষ্টিতে কোলের শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গাড়ী দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো। একজন মাদানীর সঙ্গে এ আকস্মিক শুভপরিচয়, আমার হৃদয় তাতে খুবই আপ্লুত হলো। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম এবং ধীরে ধীরে মসজিদে নববীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
যোহরের সময় হয়ে এসেছে। আমি নামাযের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে মসজিদে প্রবেশ করলাম। হযরত হাফেজ্জী হুযূর যেখানে বসেন সেখানে হাযির হলাম। মানুষ আসতে শুরু করেছে। সামনের খোলা চত্বর একেবারে খালি। রোদের তীব্রতার কারণে এখনো কেউ সেখানে বসেনি। তবে একটু পরে সেটাও পূর্ণ হয়ে যাবে। হযরতের কাছে শুনেছি, তুর্কীদের আমলে মসজিদ তৈরী করার সময় এই চত্বরে খেজুর বাগান ছিলো এবং সুপেয় পানির কূপ ছিলো। পরে বাগান কেটে ফেলা হয় এবং কূপটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই খেজুর বাগান এবং সেই পানির কূপ আমি কল্পনার চোখে দেখতে চেষ্টা করলাম। নবীজীর যামানায়ও এই বাগান ও কূপ বিদ্যমান ছিলো এবং তিনি তার পানি পান করেছেন। কত ভালো হতো, এখনো যদি এই বাগানে খেজুর হতো! এখনো যদি এই কূপ থেকে পানি উঠতো! সময় বড় নির্মম হাতে সবকিছু মুছে দিতে চায়। অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে রাখতে উম্মতকে এখন সময়ের প্রাচীর অতিক্রম করা শিখতে হবে। অতীত তো আর ফিরে আসবে না, বর্তমান থেকে আমাদেরই যেতে হবে অতীতের কাছে। এ আকুতি বারবার আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন হযরত আলী মিয়াঁ তাঁর কলমের কালিতে। আজীবন আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো, আর কিছু না হোক শুধু একটি লেখার জন্য- ‘উফূদুল উম্মাহ বাইনা ইয়াদাই নাবিয়্যিহা’ (নবীর দরবারে উম্মাহর প্রতিনিধিদল)। আমি কৃতজ্ঞ থাকবো, কারণ এ আশ্চর্য লেখাটির মাধ্যমে তিনি আমাকে দেখিয়েছেন অতীতের কাছে ফিরে যাওয়ার আলোকিত পথ।
সউদী আমলে তৈরী মসজিদের এ অংশে ছাহাবা কেরামের বসতি ছিলো। মসজিদের পড়শী হওয়ার জন্য সবারই আকাঙ্ক্ষা হতো মসজিদের আশেপাশে বাড়ী করার। একবার দূরের এক কবীলা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে দরখাস্ত করেছিলো মসজিদের নিকটে আবাদ হওয়ার। আল্লাহর নবী তাদের বলেছিলেন, ‘যেখানে আছো সেখানেই থাকো। কারণ মসজিদে আসার পথে প্রতিটি পদক্ষেপে তোমাদের জন্য আজর ও ছাওয়াব লেখা হয়।’
আল্লাহর নবীর উপদেশ তারা অম্লান বদনে মেনে নিলেন। ছাহাবা কেরাম শিখেছিলেন নবীর ইচ্ছার সামনে নিজেদের আকাঙ্ক্ষাকে হাসিমুখে কোরবান করতে। প্রতিবছর যে লক্ষ লক্ষ আশিকানে রাসূল এখানে এই মসজিদে আসেন তারা যদি এই মহান শিক্ষাটুকু এখান থেকে নিয়ে যেতে পারেন তাহলে কত যে ভালো হয়! জীবনের অঙ্গনে প্রতিটি কর্মে আমার ইচ্ছায় নয়, আমি চলবো আমার নবীর ইচ্ছায়। তাহলে তো মুসলিম উম্মাহর জীবন-চিত্রই পরিবর্তিত হয়ে যেতো! অন্যের কথা ভাবছি, আমি নিজেও কি তা পেরেছি! হে আল্লাহ, তাওফীক দাও আমাকে এবং সবাইকে; যারা এসেছে তাদেকে; যারা আসবে তাদেরকে এবং যারা আসতে চাইবে তাদেরকে।
আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলাম সবুজ গম্বুজের পানে। যত দেখি তত যেন পিপাসা বাড়ে, মধুর এক পিপাসা! সারা জীবন তাকিয়ে থাকো, তবু যেন আশা মিটবে না! তবু যেন পিপসা দূর হবে না!
আমি জানি, ঐ সবুজ এবং গম্বুজ, তার সঙ্গে নেই শরীয়তের কোন যোগসূত্র, তবু কেন হৃদয়কে তা এমন অভিভূত করে! কীভাবে কলবকে তা এমন সজীবতা দান করে! এরই নাম কি ইশক ও মুহাববাত এবং প্রেম ও ভালোবাসা!
সবুজ কি আমার ভালোবাসা, না শুধু ভালো লাগা! আমি জানি না। তবে ভালোবাসা না হোক, শুধু ভালো লাগাও যদি হয়, আমাদের মত দুর্ভাগাদের জন্য সেও তো অনেক পাওয়া। কবি হয়ত আমার মনের কথাই বলেছেন এভাবে-
হে প্রেমিক! তুমি ধন্য হও তোমার ভালোবাসার সৌরভে/ আমি বেঁচে থাকতে চাই একটু সামান্য ভালো লাগার গৌরবে।
আমার তন্ময়তার মাঝে হযরত কখন এসেছেন বুঝতে পারিনি। আযানের সমধুর ধ্বনিতে যখন ধ্যান ভঙ্গ হলো তখন লোকে সব পরিপূর্ণ এবং আশ্চর্য এক নীরবতা! বিশ্বাস করো আমার ভাই! এ আযানের সুর থেকে সবাই যেন অন্য কোন সুরের মধুরতা আহরণ করছিলো; সেই সুরের নাম তুমি যদি বলো বেলালী সুর, বলতে পারো।
এখানেই তো তিনি একদিন প্রথম আযান দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমের আদেশে! তিনি এবং আরেকজন, যার শানে নাযিল হয়েছিলো ‘আবাসা ও তাওয়াল্লা’!
হযরত একটু দূরে বসে আছেন। হাতে সেই পরিচিত তাসবীহ। কয়েকবার তিনি আমার হাতে তাসবীহ তুলে দিয়েছেন, কিন্তু থাকে না। একবার মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘মিয়াঁ আবুতাহের! হযরত হাকীমুল উম্মতের হাতে কলম এবং তাসবীহ দু’টাই ছিলো, তুমিও চেষ্টা করো, কলম এবং তাসবীহ দু’টোই হাতে রাখতে!’
বিশবছর হলো, হযরত দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর দেয়া তাসবীহ এখনো আছে আমার কাছে। আল্লাহ যেন তাওফীক দেন; হযরতের আকাঙ্ক্ষা যেন পূর্ণ হয়; আমার হাতে যেন হয় কলম এবং তাসবীহের শুভমিলন।
রাতে মুসাফিরখানায় ফিরে হযরতকে বললাম দুপুরের ঘটনা। হযরত বললেন, ‘আচ্ছা’।
শায়খ আছিম যথাসময়ে এলেন এবং হযরতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গভীরভাবে প্রভাবিত হলেন। হযরত তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করলেন, রাতের দাওয়াত। তিনি নিজে এসে হযরত ও তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে যাবেন।
শায়খের বাসভবন জামিয়া ইসলামিয়ার নিকটে। রাতের আলোকজ্জ্বল মদীনার আলোকিত পথে গাড়ীর সংক্ষিপ্ত সফর বেশ আনন্দদায়ক হলো। পথের দু’পাশে সবুজ বৃক্ষ ছিলো। পরিকল্পিত সবুজায়ন সত্যি মনোমুগ্ধকর! দিনে সূর্যের প্রখর তাপ থাকে, কিন্তু রাতে ঝির ঝির বাতাস দেহমন জুড়িয়ে দেয়।
শায়খের আববা সত্তরোর্ধ্ব শান্ত সৌম্য নূরানী চেহারার বৃদ্ধ; মদীনার বিশিষ্ট আলিম। এখন তার প্রায় সবটুকু সময় কাটে ঘরে ও কিতাবঘরে। হযরতকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। হযরতও মনে হলো অন্তরঙ্গতা অনুভব করছেন। শায়খের দস্তরখান ছিলো বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। তবে হযরতের অনুকরণে আমাদেরকে আহারসংযম রক্ষা করতে হলো।
বাংলাদেশের দ্বীনী শিক্ষা এবং ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে শায়খ ও তার আববা অনেক প্রশ্ন করলেন। আমি হযরতের পক্ষ হতে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। অহীর কেন্দ্র থেকে বহু দূরে বাংলাদেশে ইলমের প্রচার প্রসার এবং খিদমতে দ্বীনের ক্ষেত্রে আলিম সমাজের ত্যাগ ও কোরবানি এবং মেহনত ও মোজাহাদার বিবরণ শুনে উভয়ে অত্যন্ত অভিভূত হলেন। দেখা গেলো, এসম্পর্কে তাদের ধারণা বেশ অসম্পূর্ণ। তারা ভাবতেন, মালের গরীব বাংলাদেশ বুঝি ইলমেরও গরীব এবং বাংলাদেশের মুসলিম শুধু শিরক ও বিদ‘আতে ডুবে আছে।
হযরত সদ্য ইরান সফর করে এসেছেন শুনে তারা ইরানের শিয়া বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর মনোভাব জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, কিন্তু হযরত এ আলোচনায় আগ্রহী হলেন না। আমার কৌতুহল ছিলো খোমেনীর ইরান সম্পর্কে হযরতের মন্তব্য শোনার। কিন্তু হযরত দু’চার বাক্যে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। তিনি বললেন, ইরানে আলিমদের কিয়াদাত ও নেতৃত্ব কায়েম হয়েছে এবং তারা প্রশংসনীয় কিছু সংস্কার সাধন করেছেন। শাহের আমলের পর্দাহীনতা ও বেহায়াপনা ছিলো চরম। আলিমগণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং নারীসমাজকে পর্দার ভিতরে এনেছেন। মনে হয় তাদের প্রতি কাওমের সমর্থন রয়েছে। তবে তাদের আকায়েদ সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে হযরত কোন মন্তব্য করতে রাজি হলেন না। জনাব আখতার ফারূক নিজে থেকে বললেন, ইরাকীরা বহু ইরানী শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, যা খুবই বেদনাদায়ক; নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন।
এ মন্তব্য হযরতের পছন্দ হয়েছে বলে মনে হলো না। তাঁর চেহারায় অসন্তোষের ছাপ ছিলো স্পষ্ট।
শায়খ আমাদেরকে তার ব্যক্তিগত কুতুবখানা দেখালেন। বেশ সমৃদ্ধ কুতুবখানা। শায়খ বললেন, এ কুতুবখানায় রয়েছে তিনপুরুষের সংগ্রহ। তখন কুতুবখানা ভালো করে দেখার সময় ছিলো না।
একজন মাদানী আলিমের ব্যক্তিগত কুতুবখানা দেখার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হওয়া আমার জন্য ছিলো খুব আফসোসের। এ আফসোস আরো তীব্র হলো এ কথা ভেবে যে, এমন একটি কুতুবখানা হয়ত সারা জীবনেও আমার হবে না। অবশ্য আল্লাহর কুদরতের কাছে অসম্ভব কিছু নেই।
বেশ রাত করে আমরা মুসাফিরখানায় ফিরে এলাম। শায়খ আছিম নিজে হযরতকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। তিনি উষ্ণ আন্তরিকতার সাথে আমার সঙ্গে মুছাফাহা করে বললেন, ‘কখনো আর যদি দেখা নাও হয়, তোমার কথা আমার মনে থাকবে। তোমাদের দেশে কোরআন ও সুন্নাহর ভাষা শিক্ষাদানের সাধনায় তোমার জীবন ভাস্বর হোক, কামনা করি।’
পরবর্তী দিন ফজরের পর হযরত যিয়ারাতে রওয়ানা হলেন; আমরা হযরতের অনুগামী হলাম। এখানে যিয়ারাত মানে মদীনার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দেখতে যাওয়া। গত রামাযানের সফরে মদীনা শরীফে মাত্র একদিন ছিলাম। তাই অন্য কোন স্থান যিয়ারাতের সুযোগ ছিলো না। শুধু দূর থেকে আফসোসের নযরে অহুদ পাহাড় দেখেছিলাম। আজ সে আফসোসের অবসান হলো। হযরতের সঙ্গে বিভিন্ন পবিত্র স্থানের যিয়ারাতে এবং পরবর্তীতে হজ্বের সমস্ত আমলে যে রূহানী সুকূন ও সাকীনা এবং ফায়য ও ফায়যান অনুভূত হয়েছিলো, তার সত্যি কোন তুলনা নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে সঙ্গ ও ছোহবতের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। আল্লাহর নেক বান্দাদের ছোহবত ও সঙ্গ হৃদয় ও আত্মাকে যেমন সজীবতা দান করে তেমনি আমলের মাঝেও সৃষ্টি করে রূহ ও প্রাণ। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-
وَ ارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِیْنَ۴۳
(তোমরা রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো)
আরো ইরশাদ হয়েছে-
وَ كُوْنُوْا مَعَ الصّٰدِقِیْنَ۱۱۹
(তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গ অবলম্বন করো।)
যারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোহবত-সৌভাগ্য লাভ করেছেন তাঁরাই হলেন ছাহাবা। এই ছোহবতের ফযীলত এমন যে, শ্রেষ্ঠ তাবেঈও আদনা দরজার ছাহাবীর সমমর্যাদার অধিকারী হতে পারেন না। কারণ তাবেঈর ইলম ও আমল নবীর ছোহবতধন্য নয়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায়ের পর উম্মতকে ছোহবত দান করেছেন ছাহাবা কেরাম। তাই তাবেঈনের মর্যাদা তাবয়ে তাবেঈনের উপরে। যুগপরম্পরায় উম্মতকে এই ছোহবত দান করে এসেছেন নবীর ওয়ারিছ ওলামায়ে উম্মত। এই ছোহবত ছাড়া না ঈমান পূর্ণতা লাভ করে, না আমলে সজীবতা আসে।
আল্লাহর শোকর, জীবনের
অন্তত একটি হজ্ব ও যিয়ারাত হযরত হাফেজ্জী হুযূর (র)-এর ছোহবতে আদায় করার তাওফীক হয়েছিলো। পরবর্তী হজ্ব ও যিয়ারাতগুলোর সঙ্গে এর পার্থক্য আমার মত নাদান ইনসানও বুঝতে পারে। বাকী কবুল করার মালিক আল্লাহ।
হে প্রিয় ভাই, তুমি যখন বাইতুল্লাহর মুসাফির হবে, আমি প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন তোমাকে কোন আল্লাহওয়ালার ছোহবত দান করেন এবং মকবুল হজ্ব ও যিয়ারাত নছীব করেন। আমীন।
মদীনা শরীফ থেকে কোবার মসজিদে যেতে পায়ে হেঁটে চল্লিশ মিনিট লাগে। কোবা হচ্ছে নবীজীর মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের প্রবেশপথ। মদীনায় প্রবেশ করার পূর্বে তিনি চৌদ্দ দিন কোবায় অবস্থান করেছিলেন। কোবার মসজিদই হলো আল্লাহর নবীর হাতে তৈরী প্রথম মসজিদ। কোবার মসজিদ ও তার জনপদের সঙ্গে আমাদের নবীজীর ছিলো অত্যন্ত মুহাববাতের সম্পর্ক। মাঝে মাঝে তিনি মদীনা থেকে কোবায় আসতেন, কখনো সওয়ারিতে, কখনো পায়দাল। এ কারণেই আল্লাহর বান্দাগণ মদীনা যিয়ারাতের সময় কোবার মসজিদে হাযির হন এবং দু’রাকাত নফল আদায় করেন। গত রামাযানে মদীনা থেকে মক্কায় ফেরার পথে একঝলকের জন্য কোবার মসজিদ দেখেছিলাম, আর আফসোসের দহনে দগ্ধ হয়েছিলাম। আজ আল্লাহ সৌভাগ্য দান করেছেন তাঁর এক মাকবূল বান্দার ছোহবতে কোবার মসজিদে হাযির হওয়ার এবং দু’ রাকাত নামায আদায় করার। শোকর আলহামদু লিল্লাহ।
কোবায় হযরত হাফেজ্জী হুযূরকে আমরা যেন এক নতুনরূপে দেখতে পেলাম। আমাদের মাঝে থেকেও তিনি যেন ছিলেন না আমাদের মাঝে। বর্তমানকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন সুদূর অতীতে। বাহ্যিক জগতে আমরা ছিলাম হযরতের ছোহবতে, কিন্তু আত্মার জগতে তিনি নিজে যেন লাভ করছিলেন অন্য কোন ছোহবতের ফায়য ও ফায়যান। নামাযে ও মুনাজাতে এখানে হযরতের যে আত্মসমাহিত রূপ আমরা দেখেছি তার সত্যি কোন তুলনা নেই। আমার জীবনের সৌভাগ্য, এই মুনাজাতে আমিও দু’ হাত তুলেছিলাম এবং নিজের ভিতরে প্রাপ্তির অব্যাখ্যাত একটি আশ্বাস লাভ করেছিলাম।
কোবার মসজিদ এখন এক শানদার ইমারত। পুরো মসজিদে মূল্যবান গালিচা বিছানো। আশিকীন যাইরীনের আগমনে গমগম করছে পুরো মসজিদ। মুনাজাতের পর হযরত স্মৃতিচারণ করছিলেন তাঁর প্রথম জীবনে প্রথম দেখা কোবা মসজিদের। তখন হযরতের মুখমন্ডল উদ্ভাসিত ছিলো আলোর অন্যরকম এক আভা। অতীতের সঙ্গে তুমি যত বেশী একাত্ম হবে, এ আলোর আভা অন্তরে এবং বাইরে তোমার মাঝে তত বেশী উদ্ভাসিত হবে। অতীত কিন্তু মুছে যায়নি সময়ের অবয়ব থেকে; শুধু লুকিয়ে আছে বর্তমানের আবরণে। এ আবরণ যদি সরাতে পারো তাহলেই তুমি দেখতে পাবে অন্যরকম দৃশ্য এবং শুনতে পাবে অন্যরকম আওয়ায।
ধীরে ধীরে এক মধুর স্বপ্ন-আবেশ থেকে আমাদের হযরত যেন জাগ্রত হলেন এবং বর্তমানের মাঝে ফিরে এলেন। তিনি আমাদের দেখতে পেলেন এবং মৃদু মধুর একটি হাসি উপহার দিলেন। সে পবিত্র হাসিতে, মনে হলো আমাদেরও জন্য কিছু আশ্বাস ছিলো। আমরা যে তাঁর সঙ্গে! আমরা যে তাঁর পিছনে!
কোবার মসজিদে হযরত সেদিন নামায পড়েছেন, মুনাজাত করেছেন এবং অশ্রুবর্ষণ করেছেন। আমরাও নামায পড়েছি, মুনাজাত করেছি এবং আমাদেরও চোখ অশ্রুবঞ্চিত ছিলো না, কিন্তু .. এবং এই ‘কিন্তু’টুকুই হলো এক বিশাল মরুভূমি, যার একপ্রান্তে আমরা, অন্য প্রান্তে তিনি। এ মরুভূমি পাড়ি দিয়ে আমাদেরও যেতে হবে অন্য প্রান্তে, অন্তত চেষ্টা তো করতে হবে! কিন্তু বড় গাফেল, বড় দুর্ভাগা আমরা!
এরপর দুই কিবলার মসজিদ। এখানে দু’ রাকাত নামায পড়ার আগে হযরত আমাদের কিছু কথা বললেন। খোলাছা হলো-
‘এখানে আসা সুন্নাতের
অন্তর্ভুক্ত নয়; তাহলে কেন, আমরা এই মসজিদে আসি? কী শিক্ষা এবং কী প্রেরণা এখান থেকে আমরা নিতে চাই?
প্রথম কেবলার চিহ্নিত স্থানটি দেখিয়ে হযরত আমাদের বললেন, ‘তখন বাইতুল মুকাদ্দাস ছিলো মুসলমানদের কিবলা। ছাহাবা কেরাম এখানে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে নামায আদায় করছিলেন। নামাযরত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তনের আয়াত নাযিল হওয়ার খবর এসে পৌঁছলো। বলা হলো, বাইতুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে বাইতুল্লাহকে কিবলারূপে গ্রহণ করার আয়াত নাযিল হয়েছে। এরপর কোন প্রশ্ন নয়, নয় কোন দ্বিধা-সংশয়। নামাযের মাঝেই তারা কিবলা পরিবর্তন করলেন এবং অবশিষ্ট নামায কাবা অভিমুখে আদায় করলেন। আর কিছু নয়, শুধু আল্লাহর নবীর দূত এসে খবর দিয়েছেন। এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশের সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, সেই স্মৃতিকে স্মরণ করার জন্যই এখানে আমাদের আসা। যিন্দেগির সকল ক্ষেত্রে আনুগত্যের এই জাযবা ও প্রেরণা এখান থেকে আমরা নিতে চাই।’
মোটামুটি এই ছিলো হযরতের বক্তব্য। এরপর আমরা দু’ রাকাত নামায পড়লাম, মুনাজাত করলাম এবং নতুন এক প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অহুদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
এখানে এবং কোবার মসজিদে বিশাল খেজুর বাগান ছিলো, ছায়াঘেরা বড় শান্ত পরিবেশ ছিলো। মদীনার খেজুর বাগানের প্রতি কবির কবিতায় উচ্ছ্বাস দেখেছি। সেই কবিতা আবৃত্তি করে নিজেও উচ্ছ্বসিত হয়েছি, কিন্তু ছায়াঘেরা খেজুর বাগান যে মনকে এমনভাবে টানে, হৃদয়কে এভাবে বিগলিত করে তা তো আমার জানা ছিলো না! মন চাইছিলো, খেজুর বাগানের শীতল ছায়ায় কিছুক্ষণ বসি। কে জানে, আর কখনো আসা হবে কি না এখানে, এই খেজুর বাগানের সান্নিধ্যে! কিন্তু সময় ও সুযোগ ছিলো নিয়ন্ত্রিত, তাই মনের ইচ্ছাকে মনেই ‘কবর’ দিয়ে রওয়ানা হলাম হযরতের সঙ্গে। এরকম অনেক কবর আছে আমার মনের মাটিতে। মাঝে মাঝে আমি যিয়ারাত করি সেই সব কবর! এবং তাতে অনেক শান্তি ও সান্ত্বনা পাওয়া যায়!
অহুদ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আমাদের গাড়ী থামলো। আমরা গাড়ী থেকে নামলাম। এখন এখানে জনপদ গড়ে উঠেছে; তখন জনবসতি ছিলো না। ছিলো শুধু অহুদ পর্বত এবং অহুদ প্রান্তর; সেই প্রান্তর, যেখানে যুদ্ধের সাজে আল্লাহর নবী হাযির হয়েছিলেন সাতশ জানবায ছাহাবাকে সঙ্গে নিয়ে। কেন? শিরক ও কুফুরির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীনকে কেয়ামত পর্যন্ত যিন্দা রাখার জন্য। আজ চৌদ্দশ বছর পর আমরা হাযির হয়েছি অহুদ প্রান্তরে আরামদায়ক গাড়ীতে আরোহণ করে, কেন? এই ‘কেন’-এর কী জবাব আছে আমার কাছে? না, কোন জবাব নেই। তবে আমার ভিতর থেকে যেন একটি আওয়ায এলো, জিজ্ঞাসা করো তোমার হযরতকে।
এখানে একটি ছোট মসজিদ আছে। হযরত প্রথমে মসজিদে দু’ রাকাত নামায আদায় করলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত! অহুদের ময়দানে আমরা কেন এসেছি? প্রশ্ন শুনে তিনি আমার দিকে তাকালেন, তাঁর দৃষ্টি থেকে স্নেহ ঝরে ঝরে পড়ছিলো। তিনি বললেন, ‘অহুদের ময়দানে আমরা এসেছি শহীদানে অহুদের পিছনের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য; ‘তা-দমে যিন্দেগি’ ঈমান ও কুফুরের জিহাদে অবিচলতার বাই‘আত গ্রহণের জন্য এবং আমাদের মুরদা দিলে শাহাদাতের তামান্না আবার যিন্দা করার জন্য।’
শহীদানে অহুদের কবরগুলো এখন দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা। ভিতরে যাওয়ার সুযোগ নেই। দূর থেকে হযরতের সঙ্গে আমরাও যিয়ারাত করলাম। এখানে শুয়ে আছেন নবীজীর প্রিয় চাচা সাইয়েদে শুহাদা হযরত হামযা (রা)। আজ এতদিন পর সেদিনের অনুভব অনুভূতি লিখতে বসে আমার বুক কাঁপছে, আমার হাত কাঁপছে, আমার কলম কাঁপছে! হৃদয়ের ক্ষত থেকে তখন তো রক্ত ঝরছিলো; শব্দের ভাষা কি যখমি দিলের বেদনা ধারণ করতে পারে! কলমের কালিতে কি রক্তের ঘ্রাণ আসতে পারে!
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এখানে আজ আমরা এসেছি ‘দর্শক’ হয়ে, অথচ একদিন এখানে হক-বাতিলের মাঝে ঘোরতর এক যুদ্ধ হয়েছিলো। আল্লাহর নবীর দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে এসেছিলো; এখানে এই মাটিতে আল্লাহর নবীর রক্ত ঝরেছিলো, দান্দান শহীদ হয়েছিলো! এখানে এই মাটিতে আমার পেয়ারা নবী পড়ে গিয়েছিলেন যখমি হয়ে!
অহুদের প্রান্তরে আমরা আজ ‘দর্শক’, কিন্তু সেদিন এখানে শহীদানের সরদার, নবীর চাচা হযরত হামযা (রা)-এর বুক চিরে কলজে বের করা হয়েছিলো এবং সে দৃশ্য আল্লাহর নবীকে দেখতে হয়েছিলো! কেমন কষ্ট হয়েছিলো সেদিন আমার পেয়ারা নবীর!
হায়, কী মুরদা দিল নিয়ে এসেছি এখানে, এই পবিত্র ভূমিতে! অন্তরে কেন ব্যথার ঢেউ জাগে না! হৃদয় থেকে কেন রক্ত ঝরে না! এই শহীদানে অহুদের কোরবানী ও শাহাদাতের পথ ধরেই তো ইসলাম পৌঁছেছে আমাদের কাছে! এখন কি দুনিয়াতে ঈমান ও কুফুরের মোকাবেলা নেই? এখন কি যিন্দেগির ময়দানে হক ও বাতিলের লড়াই নেই? সে ময়দানে কোথায় শহীদানে অহুদের উত্তরসূরীরা?
এখানে এই মাটিতে একদিন ইতিহাস তৈরী হয়েছিলো, শাহাদাত ও কোরবানির ইতিহাস! সাতশ জানবায ছাহাবার মাথার উপর তিন হাজার তলোয়ার ঝলসে ওঠার ইতিহাস! ছাহাবা কেরাম এখানে ইতিহাস তৈরী করেছেন। সেই ইতিহাস আমরা লিখি এবং পড়ি; একটু রক্ত সিঞ্চন করে ইতিহাসকে প্রাণ দিতে পারি না, তবু দাবী করি, আমরা তাদের উত্তরসূরী!
আকাশের সূর্য সেদিনও এখানে ছিলো। কী দেখেছিলো সে এখানে সেদিন? তালহার বীরত্ব! আলীর শৌর্য! আবু দোজানার বিক্রম! ওয়াহশীর হিংস্রতা! হিন্দার পৈচাশিক উল্লাস!
নূরের ফিরেশতারা আকাশ থেকেই তো নেমে এসেছিলো এখানে তাঁকে গোসল দিতে, যিনি বাসরশয্যা থেকে ছুটে এসেছিলেন জিহাদের ময়দানে!
হে জাবালে অহুদ! তুমি তো আজো দাঁড়িয়ে আছো সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে! তোমার পিছন থেকেই তো এসেছিলো জান্নাতের খোশবু! বলো না হে প্রিয় অহুদ! কী দেখেছিলে সেদিন তুমি! আবু জামূহের লাশ বহন করতে কেন অস্বীকার করেছিলো উট! তুমি কি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলে, যেন এখানে তোমারই ছায়ায় শুয়ে থাকেন তিনি!
তুমি কি দেখেছিলে আল্লাহর নবীর জন্য জান কোরবান করার সেই সব দুর্লভ দৃশ্য! তুমি কি দেখেছিলে সেই পুণ্যবতী ছাহাবিয়াকে, ভাই স্বামী ও পুত্রের শাহাদাতের খবর শুনেও যার মুখে শুধু একটি ব্যাকুল প্রশ্ন ছিলো, আল্লাহর নবী কেমন আছেন? তারপর আল্লাহর নবীকে দেখে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে দেখার পর আমার কোন দুঃখ নেই!
হে জাবালে অহুদ! আল্লাহর নবী তোমাকে ভালোবাসতেন; তুমিও ভালোবাসতে আল্লাহর নবীকে; সেই ভালোবাসার দোহাই, আমাকে বলো যা যা দেখেছো সেদিন! কিতাবের পাতা থেকে নয়, আমি শুনতে চাই তোমার মুখ থেকে! হয়ত তাতে আমারও কলবে পয়দা হবে জিহাদের জাযবা! শাহাদাতের তামান্না! কিতাবের পাতায় আছে শুধু ঘটনার বর্ণনা; তোমার কাছে আমি পেতে চাই ঘটনার মর্ম ও বেদনা! কিতাবের পাতা থেকে তো আসে না জান্নাতের খোশবু; আসে শুধু তোমার পিছন থেকে! এবং পায় শুধু তারা যারা ছুটে যায় তলোয়ার হাতে তলোয়ারের দিকে! হে জাবালে অহুদ, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আজীবন আমি জিহাদ করবো সত্যের পক্ষে; আজীবন আমি লড়াই করবো বাতিলের বিরুদ্ধে; তোমার পিছন থেকে আসা সেই খোশবুর একটুখানি ভাগ পাওয়ার জন্য!
আমি আমার ভাবের জগতে তন্ময় ছিলাম; হৃদয় আমার দুলছিলো আবেগের দোলায়; হঠাৎ ভেসে এলো কান্নার আওয়ায! কার কান্না! অহুদের কান্না! হাঁ, অহুদের কান্নাই যেন ধ্বনিত হলো আমার হযরতের কণ্ঠে! তাঁর হৃদয়-নিংড়ানো মুনাজাতে। মুনাজাত তো নয়, কান্নার ঢেউ এবং অশ্রুর ঢল! আমি শরীক হলাম মুনাজাতে। আমারও হৃদয়-তটে আছড়ে পড়লো কান্নার ঢেউ! আমারও চোখ থেকে নেমে এলো অশ্রুর ঢল! আজকের দৃশ্যই যেন লিখে গেছেন পারস্যের কবি অনেক আগে এভাবে-
তোমার কান্না দেখে কাঁদি আমি, কিন্তু/ জানি না তুমি কেন কাঁদো? কিসের ব্যথা তোমার বুকে?/ এতদিন দেখেছি দীপ থেকে দীপ জ্বলে, আজ/ দেখি, চোখ ভেজে ভেজা চোখ থেকে!
দীর্ঘ সময় হযরত অহুদের ময়দানে অবস্থান করলেন। আমরা তাকে দেখতে পেলাম অন্য জগতের অন্য এক মানুষরূপে। কখনো তিনি তাকিয়ে থাকেন শহীদানে অহুদের কবরের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে; কখনো জাবালে অহুদের দিকে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে। কখনো মনে হয়, কল্পনার চোখে তিনি যেন দেখছেন অহুদের সেই সব দৃশ্য, যা সংঘটিত হয়েছিলো আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে এখানে, এই প্রান্তরে। বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে তাঁর মুখমন্ডল উদ্ভাস, কখনো বেদনার
ছায়াপাত! হয়ত তাঁর অন্তরে চলছে বিভিন্ন ভাবের তরঙ্গ এবং বিভিন্ন আবেগের জোয়ার-ভাটা। হৃদয়ের গভীরে এই যে রহস্যলীলা, এটা বুঝতে পারে শুধু আশিক দিল ও প্রেমিক হৃদয়; আমারা নয়, আমরা নয়। আমরা যে সঙ্গে ছিলাম এবং ‘সঙ্গী’ ছিলাম সেটাই তো আমাদের পরম সৌভাগ্য! শুনোনি পারস্যের প্রেমিক কবির প্রেমকবিতা! -
পানের আসরে পাওনি প্রবেশপত্র/ হাতে আসেনি তোমার পানপাত্র/ একটু দাঁড়াও, দু’চোখ ভরে দেখে যাও/ মাতাল জলসার উন্মাতাল কিছু দৃশ্য।
(চলবে, ইনশাআল্লাহ)