রবিউল আউয়াল ১৪৩১   ||   মার্চ ২০১০

সার্বভৌমত্বঃ বাঘাইছড়ি না হোক পূর্ব তিমুর

ওয়ারিস রব্বানী

বাঘাইছড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার একটি উপজেলা। গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই বাঘাইছড়ি সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছে। কারণ, গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়িতে পাহাড়ি উপজাতীয়দের সঙ্গে সেখানকার বাঙ্গালি অধিবাসী ও সেনাবাহিনীর সংঘাত সৃষ্টি হয়। বাঙ্গালিদের দুই শতাধিক বাড়িঘর আগুন দিয়ে পাহাড়িরা পুড়িয়ে দেয়, সশস্ত্র পাহাড়িদের নিবৃত্ত করতে সেনাবাহিনী একশনে গেলে ৩/৪ জন পাহাড়ি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। সেনাবাহিনী কয়েকজন সদস্যও আহত হন পাল্টা গুলি বর্ষণে। এরপর থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বাঙ্গালিদের ওপর উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হামলা ও ভাংচুর অব্যাহত থাকে। মাঝে স্থানীয় ইউএনওর ওপর হামলা করা হয়, তার গাড়ি ভাংচুর করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীকে ঘেরাও করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা সেখান থেকে বাঙ্গালি অধিবাসীদের উচ্ছেদ ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহারেরও দাবি জানায়। এ লেখা তৈরি পর্যন্ত সেখানে পালাক্রমে কারফিউ চলছে এবং সেনা, বিডিআর ও র্যা ব সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে গত আওয়ামী লীগ আমলে শান্তিচুক্তি হয়েছে, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অস্ত্র জমা দিয়েছে বলে ফলাও প্রচার হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে শান্তি আসেনি, পাহাড়ে পাহাড়িদের সশস্ত্র তৎপরতাও বন্ধ হয়নি। পুরো পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিশনারী সংগঠনগুলোর তৎপরতার বিষয়টি বার বার সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। একই ভাবে এ দেশে রাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন ও বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে জড়িত কোনো কোনো ক্ষুদ্র মহলের পাহাড়িদের প্রতি অন্ধ সমর্থন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এবারের বাঘাইছড়ি ঘটনার পর যদিও ঘটনার জের থামানো ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তথাপি বাঘাইছড়ি ইস্যু নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত দু’ধরনের দু’টি বক্তব্য অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। ২২ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বিবৃতির নমুনা হচ্ছে : সেনাবাহিনীর প্রশ্রয় ও নগ্ন হস্তক্ষেপেই বাঘাইছড়ি রক্তাক্ত -মেনন ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বাঘাইছড়ির ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, পাহাড়ে এসব ঘটনাবলিতে সেখানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর প্রশ্রয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে নগ্ন হস্তক্ষেপ রয়েছে। বাঘাইছড়ির রক্তাক্ত সংঘাতেও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাঘাইছড়িতে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ৬টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়িদের ওপর গুলিবর্ষণের কারণেই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়। অবশ্য বাঙালিদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং সেনা কর্মকর্তার ওপর হামলার বিষয়ে বিবৃতিতে কিছুই বলা হয়নি। আরেকটি বক্তব্য পাওয়া যায় ২৩ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রে। ঘটনার পূর্বাপর ধারণা নেওয়ার জন্য সে বক্তব্যটিও দেখা যেতে পারে। শিরোনামসহ রিপোর্টটি ছিল এ রকম- বাঘাইছড়িতে হামলা ‘স্বতন্ত্র খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠন’ চক্রান্তের অংশ -ওয়াদুদ ভুঁইয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঘাইছড়িতে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অস্ত্রধারীদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ‘স্বতন্ত্র খ্রিস্টান রাষ্ট গঠন’ চক্রান্তের অংশ বলে অভিযোগ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভুইয়া। তিনি বলেন, বিদেশীদের উষ্কানি ও সরাসরি মদতে ওই হামলা-সংঘর্ষ ঘটেছে। গতকাল বিকেলে পুরানা পল্টনে তার ব্যবসায়িক অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে ওয়াদুদ ভুঁইয়া এ অভিযোগ করেন। তিনি সংঘর্ষের ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং অস্ত্রধারী উপজাতিদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারে সরকারের পদক্ষেপ কামনা করেন। ওয়াদুদ ভুঁইয়া বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের মিজোরাম ও বার্মার কিছু অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের পাঁয়তারা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন (সিএইচটি), ইউএনডিপি, ডব্লিউএফপি সশস্ত্রদের দিয়ে হত্যা-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বাঙ্গালিদের ৩০০ বাড়িতে অগ্নিসংযোগের আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি সিএইচটি কমিশনের কর্মকর্তারা সশস্ত্র উপজাতিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি বলেন, উপজাতি ও বাঙালিরা সহমর্মিতার ভিত্তিতে পাহাড়ে বাস করতে চায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক একটি মহল চায় এই অঞ্চলে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। যে কারণে উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা চলছে। দেশের কিছু মিডিয়াকে এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে অভিযোগ করে ওয়াদুদ ভুঁইয়া বলেন, দেশীয় কিছু মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী আন্তর্জাতিক চক্রের এসাইনমেন্ট পালন করছে। আর পাহাড়ে আদিবাসীদের স্বাধীনতার দাবি তুলে দিতে পারলে জাতিসংঘ এখানে হস্তক্ষেপ করবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রধারী উপজাতিদের সঙ্গে সিএইচটি কমিশনের কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক, ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও সেনাসদস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ এবং জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করে ভারতের একটি মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি প্রকাশ একইসূত্রে গাঁথা। তিনি এ বিষয়ে সরকারের সচেতন পদক্ষেপ কামনা করে বলেন, দিল্লি হতে পরিচালিত এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস-এর পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনার বিষয়টি আমলে নিন। এরপর সিএইচটি কমিশনের কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও সারা হোসেনদের দেশবিরোধী মিশন তদন্ত করে পদক্ষেপ নিতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। মেনন সাহেবের বিবৃতি পড়লে মনে হয়, সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করার কাজটি করে আমাদের সেনাবাহিনী মস্ত বড় অন্যায় করে ফেলেছে। তিনি তাতে প্রচণ্ড না-খোশও হয়েছেন। তাই তিনি তার অধিকার প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেননি, যদিও পাহাড়ে দীর্ঘকাল যাবত পরিচালিত সার্বভৌমত্ব বিরোধী সশস্ত্র তৎপরতার বিরুদ্ধে এখন এবং অতীতে কখনো তিনি স্পষ্ট কোনো অবস্থান গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়নি। এই বিস্ময়ের মধ্যেই ওয়াদুদ ভুঁইয়ার বক্তব্য পড়ে থমকে যেতে হয়। পূর্ব তিমুরের ঘটনা যাদের সামনে রয়েছে তারা ফুঁ দিয়ে ওয়াদুদ ভুঁইয়ার বক্তব্য উড়িয়ে দিতে পারেন না। বাঘাইছড়ি নিয়ে দেশের কর্তারা কী করেন, দেখে যাওয়া ছাড়া দেশবাসী আর কী করতে পারেন! কর্তাদের দায়িত্বই এখানে বড় কথা। দেশবাসী অবশ্য দুআ করতে পারেন এদেশে যেন রক্তাক্ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে আরেকটি পূর্ব তিমুর গজিয়ে না উঠে।

 

advertisement