জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৯   ||   জুন ২০০৮

মেরী ‘ইলমী ও মুতালা‘আতী যিন্দেগী

মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

এই সময়টা ছিল দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় আরবী সাহিত্য চর্চার সূবর্ণ-যুগ। একদিকে ছিল হিলালী ছাহেবের ফয়যে সোহবত, অন্যদিকে আমাদের বন্ধু মাওলানা মাসউদ আলম নদভী বের করছিলেন আরবী সাময়িকী আযযিয়া। আরবী বলা ও লেখা এবং আলোচনা ও পর্যালোচনা ছিল দিবস-রজনীর একান্ত মগ্নতা। মিসর, শাম, ইরাক, মাগরিব (আলজাযায়ের ও মারাকিণ) থেকে বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীর সৌজন্য সংখ্যা আসত এবং এগুলো নিয়ে আলোচনা হত। এটা ছিল আমার আরবী পত্রিকা পাঠের শৈশব। আরবী সাহিত্য অধ্যয়ন এবং আরব   উস্তাদদের সাহচর্য লাভের পরও পত্রিকার বড় একটা অংশ বোধগম্য হত না। তবে এ অসুবিধার জন্য-হিন্দুস্তানী আলিমগণ যেমন বলে থাকেন-এসব সাময়িকীর জাদীদ আরবী ভাষা দায়ী নয়; বরং শব্দমালা ও বাক্যগঠনের রীতির সঙ্গে পরিচিত না থাকাই ছিল এ অসুবিধার মূল কারণ।

ভাই ছাহেবের সাহায্যে পত্রিকা পাঠ শুরু করি এবং এতে যে পরিমাণ উপকৃত হই, উপস্থাপনা ও ভাবপ্রকাশে যে সক্ষমতা লাভ করি, ভাষা ও সাহিত্যের কোনো কিতাব দ্বারা তা হয়নি।

মিসরী ও শামী লেখক-সাহিত্যিকদের প্রবন্ধ-নিবন্ধে তাদের প্রাঞ্জলভাষিতা ও ভাব প্রকাশের শক্তিমত্তার প্রমাণ পেয়েছি। সন্দেহ নেই, আরবী ভাষার সুসমৃদ্ধ ভান্ডারের বিরল রত্নরাজি, যা বহু যুগ পর্যন্ত ছিল মোহর-অঙ্কিত, তা পত্র-পত্রিকার উন্মুক্ত পৃষ্ঠায় প্রতিদিন ছড়িয়ে দেওয়া হত। আমীর শাকীব আরসালানের মতে আববাসী যুগের একজন সাহিত্যিক কয়েক বছরে যে পরিমাণ লিখত, এ সময়ের একজন লেখক তা কয়েকদিনে লিখে থাকে। তবে ভাষার এ জৌলুস সত্ত্বেও ভাবের প্রাচুর্য ছিল অনুপস্থিত। রুচি ও বুদ্ধির উপর এগুলোর ভালো কোনো প্রভাব পড়েনি। আমাদের হিন্দী রুচি, যা   হিন্দুস্তানের তুলনামূলক অধিক গভীর, ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ও শক্তিশালী ইসলামী সাহিত্যে ও পরিবেশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে, আরবদের গোত্রীয় ও জাতীয়তাভিত্তিক চিন্তাধারা, পাশ্চাত্যভীতি ও অগভীর  চিন্তারীতির বিরুদ্ধে সর্বদা বিদ্রোহ করেছে।

এইসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ আমি সর্বদা পড়েছি রূহানী কষ্ট ও মনস্তাত্বিক চাপ সহ্য করে। এদিক থেকে আমীর শাকীব আরসালানের লেখালেখি ও চিন্তাধারায় কিছুটা গভীরতা, পরিপক্কতা ও ইসলামিয়াত অনুভূত হয়েছে। তবে উম্মতে ইসলামিয়ার ব্যাধি ও প্রতিষেধক নির্ণয়ে যে ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনায় তুলনামূলক বেশি হিম্মত ও সুক্ষ্মদর্শিতা অনুভূত হয়েছিল এবং  যার দূরদৃষ্টি মুগ্ধ ও প্রভাবিত করেছিল তিনি সাইয়্যেদ আবদুর রহমান আলকাওয়াকীবী ও তাঁর কিতাব-উম্মুল কুরা। যা এখন পুরানো হয়ে গিয়েছে এবং এ গ্রন্থের যোগ্য লেখককে লোকেরা ভুলতে বসেছে। কিন্তু পরে যখন দেখলাম, তিনি আরব জাতীয়তাবাদের প্রথম সারির আহবায়কদের অন্যতম এবং খিলাফতে উছমানিয়্যার বিরুদ্ধে আরবদেরকে উত্তেজিত করার পিছনে তারও প্রচেষ্টা ছিল তখন সে মনোভাব পরিবর্তন হয়ে যায় ও ভক্তি দূর্বল হয়ে যায়।

তখন অমৃতসর থেকে মাওলানা দাউদ গযনবীর সম্পাদনায় তাওহীদ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশিত হত। ওই সাময়িকীতে ১৯২৭ কি ১৯২৮ ঈসাব্দে তেরহোঁয়ে ছদী কা মুজাদ্দেদে আজম শিরোনামে মাওলানা সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ. সম্পর্কে মৌলভী মুহিউদ্দীন কাসূরী মরহুমের একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ভাই ছাহেবের নির্দেশে ১৯২৯ বা ১৯৩০ ঈসাব্দে আমি আরবীতে এর স্বাধীন অনুবাদ করি। হেলালী ছাহেবের সংশোধনের পর আল্লামা সাইয়্যেদ রশীদ রেযা মরহুম আলমানার পত্রিকায় তা প্রকাশ করেন। পরে তারজামাতুল ইমাম আসসাইয়্যেদ আহমদ ইবনু ইরফান আশশহীদ নামে পুস্তিকা আকারেও প্রকাশ করেন। এ বিষয়ের সঙ্গে এটাই আমার প্রথম সম্পর্ক।

 

মাদরাসার নেসাববদ্ধ পড়াশোনা এভাবেই সমাপ্ত হল এবং স্বাধীন অধ্যয়নের সূচনা হল। এ সময় হাফেয ইবনুল কাইয়েম রাহ.-এর যাদুল মাআদ ছিল আমার গ্রন্থাগার ও সফরসঙ্গী এবং আমার উস্তাদ ও মুরববী। দ্বীনিয়াত- এর কুতুবখানার এত ভালো প্রতিনিধিত্ব এক কিতাবে পাওয়া দুষ্কর। যদি কখনো আমাকে সকল ইলমী ও দ্বীনী কিতাবপত্র থেকে মাহরূম করে দেওয়া হয় এবং শুধু দুইটি কিতাব সঙ্গে রাখার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে আমি কিতাবুল্লাহযাদুল মাআদ সঙ্গে রাখব। এই কিতাব আমাকে নামায শিখিয়েছে, দুআ ও যিকির মুখস্থ করিয়েছে, সফরের আদব শুনিয়েছে, দিনযাপনের মাসনূন পদ্ধতি শিখিয়েছে এবং সুন্নতের প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেছে।

 

তারুণ্যের সূচনায় যে কিতাবগুলো রহমতের ফেরেশতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপকারী গ্রন্থটি ছিল মুহাম্মদ ইবনে নসর আলমারওয়াযীকৃত কিয়ামুল লায়ল। এ কিতাবের বৈশিষ্ট্য হল যুক্তি ও বিচারের মাধ্যমে নয়; ভক্তি ও আবেগের মাধ্যমে সে পাঠকের রুচি ও প্রেরণার গতিপথ পরিবর্তন করে। আর সন্দেহ নেই, রুচি ও প্রেরণাই হল সকল কর্মের নিয়ামক। এ কিতাবে রাত্রি জাগরণকারী নেককার নওজোয়ানদের এমন সব আকর্ষণীয় ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং কুরআন মাজীদের কিছু আয়াতের এমন জীবন্ত তাফসীর ও কিয়ামুল লায়লের এমন ফাযায়েল সংকলিত হয়েছে যে, যদি কোনো ভাগ্যবান নওজোয়ানের হাতে তার তারুণ্যের সূচনায় এই কিতাব এসে যায় এবং কাজ করতে সক্ষম হয় তাহলে তা একজন শায়খে কামেলের বায়আত থেকে কোনো অংশে কম নয়।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর তাফসীরে সূরা নূর এই ফিৎনার যমানায় অত্যন্ত সাহায্য করেছে। তাঁর এই কিতাব এবং  ইমাম ইবনুল কাইয়েম রাহ.-এর আলজাওয়াবুল কাফী হচ্ছে তারুণ্যের উত্তম নেগাহবান ও মুরববী, আখলাক-চরিত্র রক্ষায় এ কিতাব দুটোর অবদান কল্যাণকামী ও উপদেশ দানকারী মুরশিদের মতো।

ছাত্রজীবনের অবুঝ সময়ে যে কিতাব ইলম চর্চা ও উস্তাদদের সোহবত থেকে উপকৃত হওয়ার, উস্তাদগণের আদব-ইহতিরাম বজায় রাখার এবং ইলম-অন্বেষণের আদব-কায়েদা অনুসরণ করার প্রেরণা জুগিয়েছে তা হল হিদায়া-গ্রন্থকারের একজন শাগরিদের প্রণীত ছোট পুস্তিকা তালীমুল মুতাআল্লিম। আর ইলম হাসিলের সাহস ও উচ্চাকাঙ্খা এবং ইলমী যওক ও রুচি অর্জনে গভীর প্রেরণা জুগিয়েছে নওয়াব সদর ইয়ারজঙ্গ মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শেরওয়ানী রচিত উলামায়ে সালাফ। এ কিতাব দিল দেমাগে উলামায়ে সালাফের ভক্তি ও অবদান অঙ্কন করে দিয়েছে। আমার মতে সত্যিকারের তালিবে ইলম যারা তাদের প্রত্যেকেরই এ কিতাব অধ্যয়ন করা উচিত এবং ইলমী সফরে একান্ত সঙ্গী করে নেওয়া উচিত।

ওয়ালিদে মরহুম মাওলানা হাকীম সাইয়্যেদ আবদুল হাই রাহ. (সাবেক নাজেম, নাদওয়াতুল উলামা)-এর রচনাবলি নাড়াচাড়া করতাম। সেখানে আরমাগানে আহবাব নামে তাঁর একটি পান্ডুলিপি পাই, যা তিনি ২৬ বছর বয়সে লিখেছিলেন। এটা ছিল ১৩১২ হিজরীর এক তালিবে ইলমানা সফরের রোযনামচা। ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল, আড়ম্বরহীন, কিন্তু তা আমার অন্তরে অসাধারণ প্রভাব সৃষ্টি করে। আল্লাহ ওয়ালাদের মুহাববত এবং দ্বীনের মিষ্টতা অনুভূত হয়। হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধন এই পান্ডুলিপি থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল। যেখানে ওয়ালিদ সাহেব সাইয়্যেদুনা লিখতেন সেখানে এক বিশেষ আবেগ অনুভূত হত এবং হৃদয় যেন ছন্দের দোলায় দুলতে থাকত।

এরপর যে পুস্তিকা হৃদয়ে আল্লাহ ওয়ালাদের ভক্তি-মুহাববত সৃষ্টি করেছে এবং এক অনির্বচনীয় দ্বীনী মিষ্টতার সঙ্গে পরিচিত করেছে তা হল, হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আলী রাহ. (প্রতিষ্ঠাতা, নদওয়াতুল উলামা)-এর ছোট      পুস্তিকা- ইরশাদে রহমানী। এ পুস্তিকায় শায়খে ওয়াক্ত হযরত মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্জমুরাদাবাদী রাহ.-এর বিভিন্ন হালাত, বাণী ও ঘটনাবলি এবং সুলুক ও তাসাওউফের কিছু তত্ত্ব সংকলিত ছিল।

হযরত মাওলানা গঞ্জমুরাবাদী ওয়ালিদে মরহুমের শায়খ ছিলেন। শৈশব থেকেই তাঁর কথা শুনেছি। এই রূহানী তাআল্লুক ও মানসিক পরিচয়ের কারণে কিতাবটি আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি। ইশক ও      মুহাববতে ডুবন্ত বাণী ও পংক্তিগুলো তীর ও তরবারীর মতো মর্মের মূলে প্রবেশ করেছে। এই পুস্তিকা অধ্যয়নের কিছু আগে বা পরে ওয়ালিদে মরহুমের একটি রচনা বারবার পড়েছিলাম। রচনাটি- পুস্তিকা কিংবা-প্রবন্ধ ইস্তিফাদা নামে প্রকাশিত হয়েছিল। তার গঞ্জমুরাদাবাদ গমনের বিভিন্ন হালাত, সেখানকার বিভিন্ন দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা এবং মাওলানা রাহ.-এর অনুগ্রহ ও ইহসানের বিভিন্ন ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। এ রচনা মাওলানার প্রতি ভক্তি ও মুহাববত এবং আল্লাহ ওয়ালাদের সঙ্গে সাক্ষাত ও মুলাকাতের আগ্রহ বৃদ্ধি করেছিল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement