রবিউল আউয়াল ১৪৩১   ||   মার্চ ২০১০

আইন – শৃঙ্খলাঃ ডাকাতদের বীরত্ব কি চলবেই?

খসরূ খান

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার প্রকাশিত ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার একটি শিরোনাম ছিল ‘দিনদুপুরে ‘হেসেখেলে’ ছিনতাই’। নিজস্ব প্রতিবেদকের বরাতে ছেপে আসা প্রতিবেদনটির প্রথম দুটি প্যারা তুলে দিচ্ছি। সব কিছু স্বাভাবিক। বেলা আড়াইটায় ঢাকা শহরের ঘনবসতিপূর্ণ যেকোনো গলির মতোই গতকাল পশ্চিম রাজাবাজারের অলিগলিতে শত শত পথচারী। রিকশা, গাড়ি, মানুষজনের হাঁকডাক। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভরপুর। বাড়িঘরে লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এরই মধ্যে সাত যুবক পিস্তল, রামদা, চাপাতি হাতে ঢুকল গলিতে। প্রকাশ্যে চালাল ছিনতাই মিশন। পথচারীদের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে কেড়ে নিল যার যা আছে। দোকানে দোকানে ঢুকে লুট করল ক্যাশবাক্স। তারপর বীরদর্পে হেঁটে চলে গেল ফার্মগেটের দিকে। বাকরুদ্ধ লোকজন অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল হেসেখেলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে আধা ঘণ্টার এই নজিরবিহীন ছিনতাই ঘটনা। ঘটনার শিকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অস্ত্র উঁচিয়ে যুবকরা বলেছে, ‘চিৎকার করবি না, টাকা দে। যা আছে সব দিবি। না হলে মরবি।’ এ অবস্থায় তাদের হাতে সব কিছু তুলে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। অস্ত্রধারীরা এলাকার পরিচিত মুখ বলেই দোকানি-ব্যবসায়ীরা জানালেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা-পুলিশের দাবি, তারা কিছুই জানে না। কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেনি। পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে জানা গেছে, রাজধানির প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেটের পাশেই পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে এর আগের দিন বৃহস্পতিবার। অবশ্য কাগজে কলমে থানা-পুলিশের অজ্ঞতা থাকলেও সারা দেশের অবস্থা এখন এ রকম বা এর কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গেছে। দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে ঘনবসতিপূর্ণ শহরে-নগরে ডাকাতি করে বীরদর্পে ডাকাতরা হেলেদুলে স্থান ত্যাগ করলেও তাদেরকে দেখা বা ধরার কোনো আলামতই নেই। উল্টো আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গের মুখের বক্তব্য হচ্ছে-দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভালো।’ সময়ে সময়ে তারা যে কোনো সময়কালের অপরাধের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বুঝিয়ে থাকেন দেশ যে এখন কতটা ভালো আছে। কিন্তু তাদের হিসাবের ফাঁক-ফোকড় আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে ওই দিনের ওই দৈনিকটিই আরেকটি রিপোর্টে। সে রিপোর্টের শিরোনাম-‘পুলিশের হিসাব এক, বাস্তব আরেক।’ মোটামুটি দীর্ঘ সে রিপোর্টটির একটি অংশ দেখা যাক। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে গত বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্য্ন্ত সারা দেশে রাস্তায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ১৬টি অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন প্রায় তিনটি। ওই ১১ মাসে সারা দেশে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে ৩৪৭টি, এর মধ্যে ঢাকায় ১০১টি। অর্থাৎ সারা দেশে দিনে গড়ে প্রায় একটি চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। আবার ঢাকায় প্রতি তিন দিনে একটিও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেনি। শুধু তা-ই নয়, ওই ১১ মাসে ঠিকাদারি কাজে দরপত্র দাখিল করতে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে পাঁচটি। একই হিসাবে দেখা যায়, রাজধানীতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৮৫টি, আর রাস্তায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৩৬৮টি। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব আর বাস্তবতা এক নয়। মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল আর হলিফ্যামিলি হাসপাতাল সূত্র মতেই মলম পার্টি আর ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে গত বছর (জানুয়ারি-নভেম্বর) শুধু রাজধানীতেই চিকিৎসা নিয়েছেন পাঁচ হাজার ৭৮৫ জন। শুধু হাসপাতাল ফটকে যেসব পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করেন,তাদের তারবার্তা পর্যালোচনা করলেই ছিনতাই ঘটনার প্রকৃত পরিসংখ্যান বের হয়ে আসবে বলে তাদের দাবি। একমাত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছাড়া কোনো অপরাধেরই প্রকৃত পরিসংখ্যান থানায় রুজু হওয়া মামলার খতিয়ান বা সংখ্যা দেখে বোঝা সম্ভব নয়। গত বছর দেশে শুধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই পুলিশের নথিতে লিপিবদ্ধ আছে চার হাজারের বেশি। আবার অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অপমৃত্যু হিসেবেও লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। না, পাঠক। সরকারবিরোধী কোনো দৈনিক পত্রিকায় নয়, উপরের রিপোর্ট দু’টি ছাপা হয়েছে সদ্য চালু হওয়া এমন একটি দৈনিক পত্রিকায়, যার সম্পাদকের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের ব্যক্তিদের সু-যোগাযোগ সর্বজনবিদিত। এরপরও এ ধরনের রিপোর্টকে অপপ্রচার বা মতলবী প্রচার বলার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করা যায় না। আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা আমলে না নেওয়া দেশবাসী বা সরকার কারো জন্যই মঙ্গলজনক হতে পারে না। তাই সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের উচিত, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। দ্রুত সক্রিয় না হলে পরি্স্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।

 

advertisement