জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৯   ||   জুন ২০০৮

কল্যাণধর্মী বাজেট প্রণয়নে কিছু প্রস্তাবনা ও সুপারিশ

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

বাজেটের মাস জুন। এ মাসের শুরুতেই আগামী অর্থ-বছরের জাতীয় বাজেট ঘোষিত হবে। দেশে নির্বাচিত সরকার ও সংসদ না থাকায় এবারও বেতার-টিভিতে বাজেট ঘোষিত হয়ে মাসের শেষের দিকে তা অধ্যাদেশ আকারে পাস হবে।

শোনা যাচ্ছে, এবারের বাজেট হবে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার। অর্থাৎ জাতির সামনে আরেকটি উচ্চাভিলাষী বিশাল বাজেট আসছে। চলতি অর্থ-বছরের বাজেটও ছিল তেমনি উচ্চাভিলাষী, যার আয়তন ৮৭ হাজার কোটি টাকা। আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এ ধরনের বিশাল বিশাল বাজেট প্রণয়ন এখন মনে হয় রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। দেশে পার্লামেন্ট নেই, নেই বড় আকারের ক্যাবিনেট। মন্ত্রী, এমপি ও তাদের সহকারী-সহযোগীদের বেতন ভাতা ও বড় বড় সুবিধাদির পেছনে শত কোটি টাকার খরচ নেই। এছাড়া বর্তমান সরকার যেহেতু পূর্ববর্তী মন্ত্রী-এমপিদের অসংখ্য দুর্নীতির বিচার করছে, রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয়, অপব্যয় বা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য উদঘাটন করছে তাহলে এ সরকারের তো নিশ্চয় ঐ ধরনের কর্মকান্ড থেকে মুক্ত থাকার কথা। ফলে রাষ্ট্রের খরচ নিশ্চয় অনেকাংশে কমে যাওয়ার কথা। এরপরও এত বড় আকারের বাজেট কেন, তা সহজে বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। আসলে বাজেটের ছোট-বড় হওয়ার বিষয়টি আপেক্ষিক বিষয়। যে ব্যয়ের প্রাক্কলন সম্ভাব্য আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় তাই হচ্ছে উচ্চাভিলাষী। ধরে নেয়া যাক, একজন ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকা। নতুন বছরের প্রাক্কালে সে আসছে বছরের জন্য তার সম্ভাব্য খরচাদির একটি তালিকা তৈরী করল। দেখা গেল তাতে প্রাক্কলিত খরচের পরিমাণ দাড়িয়েছে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা। এ হিসাবে লোকটির সম্ভাব্য আয় থেকে ব্যয়ের পরিমাণ ৬০ হাজার টাকা বেশি। এ অতিরিক্ত ৬০ হাজারের জন্য তাকে অন্য পথ খুঁজতে হবে। যদি সে প্রভাবশালী হয় তাহলে নিজ খরচ নির্বাহের জন্য হয়তো অধীনস্তদের উপর জোরপূর্বক চাঁদা আরোপ করতে পারে। না হয় ঋণ গ্রহণ করতে পারে। হতে পারে তা স্বল্প সুদে আবার হতে পারে চড়া সুদে এবং কঠিন শর্তে। এবং উক্ত ঋণ পেতে অনেক ক্ষেত্রে তাকে ঋণ দাতার কটু কথাও শুনতে হতে পারে। তার জীবন চলার পথে ঋণ দাতার কু-ছায়াও বরাবর লেগে থাকতে পারে, যা তার জীবনকে করে তুলবে বিষাদময় ও অতি কষ্টের। কিন্তু যদি লোকটি তার খরচের হিসাবটি আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রাখত তাহলে খাওয়া-পরায় তাকে কিছু  কষ্ট  সইতে  হলেও সে শান্তিতে বসবাস করতে পারত।

প্রিয় পাঠক! জাতীয় বাজেটের  বিষয়টি উপরোক্ত উদাহরণের মতই। রাষ্ট্র যখন তার খরচের লাগাম হাত থেকে ছেড়ে দেয় তখন সে খরচ জোগান দেয়ার জন্য তাকে বহু ভাবে বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত হতে হয়। সাধারণ জনগণের উপর বহুমুখী করারোপ করে যেমনিভাবে তাদেরকে কষ্টে ফেলা হয় তেমনিভাবে তাদের বিরাগভাজনও হতে হয়। আর ব্যংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হয় মাঝে মাঝেই, যার কুপ্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। আর বিদেশী ঋণ ও সাহায্য নিতে গিয়ে শুধুমাত্র চড়া সুদই দিতে হয় না; বরং তাদের কঠিন শর্তাবলী, খবরদারী ও নজরদারীর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যেমনিভাবে সরকারকে পর্যুদস্ত হতে হয় তেমনি দেশ ও জাতির জন্য তা হয়ে থাকে কলংক ও লজ্জার বিষয়। এবং একটি জাতি হয়ে উঠে পরনির্ভরশীল ও নতজানু।

সুতরাং বাজেট বিষয়ে আমাদের প্রথম সুপারিশ হল, প্রচলিত ধারার উচ্চভিলাষী চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সংকুচিত বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। অনেক বড় খরচের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে গরীব জনগণের উপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর চাপিয়ে  এবং দেশী-বিদেশী   ঋণের  সাগরে ডুবে তা বাস্তবায়নের চিন্তা সকলেই করতে পারে। এটি এখন গতানুগতিক বিষয়। বলা বাহুল্য যে, এতে সামান্যতমও কৃতিত্ব নেই। পক্ষান্তরে খরচের আকার ছোট করে যদি বাজেট প্রণয়ন করা হয় তবে যেমনিভাবে দরিদ্র জনগণকে বাড়তি করের বোঝা সইতে হবে না তেমনি বিদেশীদের রক্তচক্ষুও দেখতে হবে না।

 

বর্তমান সরকার কোনো দলীয় সরকার নয়। তৃণমূল পর্যায় থেকে  উচ্চস্তর পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীদের খুশি রাখতে হবে-এমন কোনো সমস্যা তাদের নেই। আবার অনেক এমন কাজও তারা আঞ্জাম দিয়েছেন যা কিনা পূর্ববর্তী সরকারগুলোর পক্ষে ছিল প্রায় অসম্ভব, তাই এ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তারা একটি বিপ্লবী চিন্তা অবশ্যই করতে পারে (অবশ্য এমন কোনো নমুনা বিগত ১৬ মাসে দেখা যায়নি)। ব্যাপকভিত্তিক কৃচ্ছতা সাধন করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ের নতুন নজির স্থাপন করতে পারে।

 

এ কথাগুলো পড়ে কারো হয়তো মনে হতে পারে, তাহলে তো দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড থমকে যাবে, রাস্তা-ঘাট, পুল-ব্রিজ ইত্যাদি আর হবে না। বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। কারণ বাজেটে এ সকল খাতে বরাদ্দ থাকে খুবই কম। চলতি অর্থবছরের বাজেটের কথাই ধরা যাক, এতে এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী) বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৬ হাজার কোটি টাকা। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বছরের  প্রথম ৮ মাসে  এর  ৪০%ও বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থাৎ বছরান্তে দেখা যাবে, এ খাতে ২০ হাজার কোটি টাকাও খরচ করা হয়নি। যা কি না চলতি বাজেটের ২২% এরও কম। অর্থাৎ বর্তমানে প্রায় ৮০% খরচ হয়ে থাকে অনুন্নয়ন খাতে। অতএব বাজেট সংকুচিত  হলে উন্নয়ন কমে যাওয়ার কোনো আশংকা নেই। এ বিষয়ে আরো কিছু কথা এ লেখার শেষ দিকে বলার ইচ্ছা আছে। এখন বাজেট বিষয়ে আরো কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হচ্ছে।

কৃষি 

কৃষিখাতে ভর্তুকি দেওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে বহুদিন থেকে। শোনা যাচ্ছে, এবারের বাজেটে এখাতে বরাদ্দের হার বাড়ানো হবে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।  যত বেশি সম্ভব এ খাতের বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষির গুরুত্ব নতুন করে বলার দরকার নেই। চাল নিয়ে এবারের লংকাকান্ড এবং এখনো গরীবের মোটা চালের আকাশচুম্বী মূল্যই তা অনুধাবন করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু দেখার বিষয় হল, কৃষির ভর্তুকির সুফল কৃষকগণ কতটুকু পেয়ে থাকে। সরকার সার ও বীজে যে ভর্তুকি দিয়ে থাকে সে সার ও বীজ কৃষক পর্যন্ত কতটুকু পৌঁছায় এবং যথা সময়ে পৌঁছায় কি না? বিগত বছরগুলোর বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এসব প্রশ্নের জবাব অনেক ক্ষেত্রেই হবে নেতিবাচক। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে      বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী।

সার-বীজে ভর্তুকি ঢালাওভাবে না বাড়িয়ে প্রকৃত গরীব কৃষকদেরকে সরাসরি বাকিতে সার-বীজ সরবরাহ করে ফসল উৎপাদনের পর ন্যায্য মূল্যে তাদের থেকে সে ফসল খরিদ করে নেওয়ার চিন্তাও করা যেতে পারে। কোনো বছর ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হলে বকেয়া মূল্য পুরো বা আংশিক মওকুফ করে দেওয়া যেতে পারে। উপরোক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আগে পুরো দেশের কৃষি ও কৃষকদের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করতে হবে এবং প্রকৃত কৃষকদেরকে তাদের আওতাধীন জমি ও আর্থিক অবস্থাভেদে বিভিন্ন ক্যাটাগরির কার্ড জারি করতে হবে এবং কৃষি-ভর্তুকির সুবিধা যেন প্রকৃত কৃষক ছাড়া অন্য কেউ না নিতে পারে সে জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে কঠিন হাতে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে কৃষি-ভর্তুকির  সুফল আরো বেশি পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

আর চালের বাজার নিয়ন্ত্রনের জন্য উপরোক্ত পন্থা অবলম্বন  ছাড়াও সরকারকে বাজার থেকে ক্রয় করার মাধ্যমে বিশাল ভান্ডার গড়ে তুলতে হবে এবং ন্যায্যমূল্যে তা বিক্রয় করতে হবে ব্যাপক হারে। চলতি মৌসুমে সরকারের ধান ক্রয়ের মূল্য ধার্য হয়েছে ৮ শ টাকার বেশি। সে হিসাবে প্রথমোক্ত ধানের মন ১০০০/- টাকা হয়ে গেলেও বর্তমানে অনেক এলাকায় তা বিক্রি  হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকা দরে। অথচ চালের বাজারের অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। ৫৫০ টাকা ধানের মন হলে খুচরা বাজারে চালের কেজি তো ২২/- টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। অথচ তা এখনো বিক্রয় হচ্ছে ৩৬-৩৭/- টাকা দরে। এর সঠিক কারণ উদঘাটন করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যদি সরকারের কাজ না  হয় তবে আর কী বলার থাকে?

করমুক্ত আয়সীমা ও ভ্যাট প্রসঙ্গ

বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা হচ্ছে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ গড়ে মাসিক আয় ১২৫০০/- টাকা হলেই একজন লোক করের আওতায় আসবে এবং তাকে টিন গ্রহণ করে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এটি অবশ্য প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে। তা না হলে পরোক্ষভাবে তো দেশের প্রতিটি নাগরিক হর-হামেশা কর আদায় করতেই থাকে। নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সকল দ্রব্যতেই ভ্যাট তথা মূল্য সংযোজিত কর রয়েছে। এমনকি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটেও। কোনো ব্যক্তি মারাত্মক রোগী হয়ে হাসপাতালে গেলেও তাকে কর দিতে হয় পদে পদে। প্রতিটি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার উপরই রয়েছে ভ্যাট।  কেউ ল্যান্ড বা মোবাইল ফোনে ১ টাকার কথা বললে  সেখানে সরকার ভ্যাট হিসেবে নেয় আরো ১৫ পয়সা। ধরে নেওয়া যাক, দেশের সাড়ে চার কোটি মোবাইল গ্রাহক গড়ে দিনে ৫ টাকা করে সাড়ে ২২ কোটি টাকার কথা বলে; এক্ষেত্রে সরকার ভ্যাট পাবে দৈনিক তিন  কোটি সাইত্রিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা। এখানে ধনী-গরীবের কোনো ভেদাভেদ নেই। সকলকেই নির্ধারিত হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। শোনা যাচ্ছে, এবার ভ্যাটের আওতা আরো বাড়ানো হবে। ভ্যাট এখন সরকারের আয়-রোজগারের বড় হাতিয়ার। এর মাধ্যমে (অশিক্ষিত ও কম শিক্ষিত নাগরিকদেরকে) মানুষকে বুঝতে না দিয়েই তাদের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে কিছু কেটে নেওয়া যায়। 

১৯৯০ এর পর ক্ষমতায় এসে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী ভ্যাট প্রথা প্রবর্তন করেন। তখন বিরোধী দলীয় রাজনীতিকরা এর কড়া প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি ভ্যাটের অপর নাম সাইফুর রহমানও হয়ে গিয়েছিল অনেকের কাছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই ভ্যাট শাসককুলের কাছে হয়ে উঠেছে বড়ই প্রিয় বন্ধু! নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উচ্চমূল্যের সাথে ভ্যাট যোগ হয়ে নাগরিকদের হালত যেখানে গিয়েই ঠেকুক, সরকারগুলো তা দেখার প্রয়োজন অনুভব করেন না; বরং এ দেশে ভ্যাটের আবিষ্কারক মন্ত্রী সাহেব তো এটিকে অত্যাধুনিক প্রক্রিয়া বলেও তখন বক্তব্য দিয়েছিলেন। যাই হোক, আসন্ন বাজেটে ভ্যাটের আওতা না বাড়িয়ে বরং তা কত বেশি কমানো যায় সে চেষ্টাই করা উচিত। উচ্চ দ্রব্যমূল্যে বিপর্যস্ত গরীব জনগণের প্রতি সদয় হওয়া সরকারের কাছে সময়ের দাবি। বিশেষত গরীব মানুষের খাদ্য, শিশুখাদ্য ও চিকিৎসা খাত থেকে ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা খুবই জরুরি।

আর ব্যক্তি খাতের করমুক্ত আয়সীমা দেড় লাখ টাকার স্থলে কম পক্ষে তিন লক্ষ টাকা করা দরকার। মাসে সাড়ে বারো হাজার টাকার বেশি রোজগার করা একজন ব্যক্তি পর্যায়েও সরাসরি ট্যাক্স দিতে হবে এবং টিন সংগ্রহ করে রিটার্ণ দাখিল করতে হবে, কর কর্মকর্তাদের সওয়াল-জবাবপর্ব থেকে রক্ষার জন্য কর উকিল ধরতে হবে, বর্তমান বাজারদরের সময় এটি কি পর্যায়ের জুলুম, তা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

বিদেশ-নির্ভরতা আর কত দিন

বাজেটের একটি বড় উপাদান  থাকে বৈদেশিক ঋণগ্রহণ এবং তার সুদ প্রদান। বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ-এর মতো দাতাসংস্থা এবং বেশ কিছু ধনী দেশ থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশ অসংখ্য যৌক্তিক-অযৌক্তিক (অনেক ক্ষেত্রে মানহানীকর) শর্তে আবদ্ধ হয়ে ঋণগ্রহণ করে থাকে। এসব ঋণের সুদ আদায় বাবদ বাজেটে মোটা অংকের বরাদ্দ রাখতে হয়। চলতি বাজেটে এ খাতের বরাদ্দ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (পুরো বাজেটের ১৩.৫%) খাত। আর শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে পৃথক করলে সম্ভবত প্রথম সর্বোচ্চ খাত। অর্থাৎ সরকারের খরচের সবচেয়ে বড় খাত সুদ পরিশোধ। একটি দেশ কতটুকু ঋণনির্ভর হলে এবং স্বাভাবিক আয় থেকে কত বেশি পরিমাণে খরচ করলে তার অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

এ সব সুদের পরও ঋণদাতাদের উপদেশ নামের নির্দেশাবলি ও মানহানীকর শর্তাবলি তো রয়েছেই। একটি স্বাধীন দেশ এভাবে আর কত পর্যুদস্ত হবে। কতকাল তাকে শুনতে হবে অন্যের অযাচিত উপদেশ? সুতরাং বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে অবশ্যই আত্মনির্ভরশীলতার পথ ধরতে হবে এবং সুদী বা শর্তযু্ক্ত ঋণ নয়; বরং প্রয়োজনে কষ্ট করব তবুও মাথা উঁচু করা জাতিতে পরিণত হব-এ মনমানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

বিলাসপণ্য আমদানী

যেকোনো আমদানীর জন্যই প্রয়োজন হয় বৈদেশিক মুদ্রা। আর আমাদের মত আমদানী-নির্ভর দেশে সব সময়েই বৈদেশিক মুদ্রার বড় কদর থাকে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী (প্রবাসী চাকুরীজীবী ও রপ্তানীকারকগণ) দের রাষ্ট্রে্র পক্ষ থেকে বিভিন্ন রেয়াত ও সুবিধাদি দেওয়া হয়ে থাকে, তা ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ মুদ্রাগুলোর কতভাগ খরচ হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানী খাতে? দেশের দামী দামী বাজারগুলোর বিদেশী ফ্যাশন  ও নিছক দামী দামী বিলাসসামগ্রীর ছড়াছড়ি দেখলে এবং ঢাকার রাস্তায় কোটি কোটি টাকা মূল্যের প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা গুনলে কি মনে হয়, এ দেশের সিংহভাগ মানুষ সাধারণ জীবিকা অর্জনের জন্য নিত্য সংগ্রাম করতে হয়? অথচ এ দেশেরই খেটে খাওয়া মানুষের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দ্বারাই এ সব মালামাল আমদানী হয়ে আসে। আবার আমদানীর জন্যই  অনেক সময় সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রা চড়া সুদে ঋণও নিতে হয়। এ কয়েক মাস আগেও আইএমএফ এবং স্ট্যার্ন্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ডলার ঋণ করেছে সরকার। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থে অত্যধিক মূল্যের সকল গাড়ি, যাবতীয় বিলাস সামগ্রীর আমদানী কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন ও নিরুৎসাহিত করা দরকার। মানুষের প্রয়োজনীয় সামগ্রীই শুধু আমদানী করার সুযোগ দেওয়া দরকার।

নৈতিকতার উন্নয়ন

আলকুরআনুল কারীমের শুরুতেই মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন-এই কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই। এটি  খোদাভীরুদের জন্য পথপ্রদর্শক। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও এবং শাস্তিদানে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যান দেশব্যাপী গণসংযোগ ও র‌্যালি করে বেড়াচ্ছেন। কঠোর থেকে কঠোর অজামিনযোগ্য বিধি-বিধান তৈরি হচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতির লাগাম ঠেকানো যাচ্ছে না। কিছুদিন হল চেয়ারম্যান জেনারেল (অবঃ) হাসান মশহুদ সাহেব বলতে শুরু করেছেন যে, আইন করে , আমলা দিয়ে এবং কিছু লোককে জেল খাটিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। এ দিকে কিছু দিন থেকে বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলের লেখায় এবং বলায় নৈতিকতার বিষয়কে সিলেবাসভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে। এ মহলটি অবশ্য ধর্মের নাম নিচ্ছেন না, কারণ ধর্মের প্রতি তাদের এক প্রকারের এলার্জি রয়েছে এবং খুব বেশি দিন হয়নি তারা ধর্মকে পাঠ্যভুক্ত করার বিপক্ষে বলেছেন।  আমরা আগেও বলে এসেছি, এখনো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি যে, মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা ছাড়া দুর্নীতি দমন সম্ভব নয় এবং এটি করতে হবে বহুমুখীভাবে দীর্ঘ মেয়াদী ভিত্তিতে। স্কুল-কলেজের সিলেবাসে যেমন ধর্মকে গুরুত্বের সাথে জরুরিভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তেমনি সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থা। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় মিডিয়াতে ধর্মীয় নীতি নৈতিকতা শিক্ষাদানের কর্মসূচী নিতে হবে। অর্থাৎ বাজেটে নতুনভাবে এ খাতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে।

কৃচ্ছতা সাধন

এ লেখার শুরুতেই বিশাল বাজেটের পরিবর্তে সরকারের খরচ কমিয়ে এনে ছোট আকারের বাজেটের অভ্যাস গড়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কৃচ্ছতা সাধন কীভাবে হতে পারে তার জন্য আমলাদের বাইরের কোনো যোগ্য ব্যক্তিত্বকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গ্রহণ করা যেতে পারে, যারা এ বিষয়ে সুপারিশ করবেন। এ ক্ষেত্রে তারা কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে পাথেয় হিসাবে নিতে পারেন। রাষ্ট্রের আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাতসমূহ এবং জনগণের মালামালের ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় নির্ধারণে শরীয়ত কী বলে তা অধ্যয়ন করলে এবং আমাদের সাধারণ জনগণের অবস্থা বিবেচনায় এনে নীতিমালা তৈরি করলে দেখা যাবে যে, বর্তমান বাজেটগুলোর তুলনায় অনেক ছোট বাজেট দিয়েও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব।

আল্লাহ রাববুল আলামীন সরকার এবং জনগণ সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য আদায়ে এবং অন্যের অধিকারের ব্যাপারে সজাগ হওয়ার তাওফীক দিন।#

 

 

 

 

advertisement