হাদীস ও আছারের সুপ্রাচীন ও সুসমৃদ্ধ সংকলন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : নতুন তাহকীক ও তা’লীক এবং গবেষণার নতুন দিগন্ত
‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা’ ‘হাদীস’ ও ‘আছারে’র সুবৃহৎ সংকলন, যা সংকলিত হয়েছে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে। সংকলক ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা আলকূফী (১৫৯ হি.-২৩৫ হি.) ইলমে হাদীসের অনেক বড় ইমাম ছিলেন। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ও তাদের সমসাময়িক হাদীসের ইমামগণ তাঁর শীষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
ইলমে হাদীসে অনেক কিতাব তিনি রেখে গেছেন। সেগুলোর মধ্যে ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও সহজলভ্য।
এই কিতাব প্রথমে হিন্দুস্তানে এরপর পাকিস্তান ও বৈরুতে কয়েকবার মুদ্রিত হলেও আজ পর্যন্ত পূর্ণ গ্রন্থের যথাযথ তাহকীককৃত কোনো সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। আল্লাহ তাআলার শোকর, বর্তমান যুগের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ, উলূমুল হাদীস ও উলূমুল ফিকহ বিষয়ে গভীর পারদর্শিতার অধিকারী শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা হালাবী (৭১), মুকীম মদীনা মুনাওয়ারা, তাঁর তিন পুত্রের সহযোগিতায়, যারা প্রত্যেকে যোগ্যতা সম্পন্ন আলিম, দীর্ঘ ষোল বছরে পূর্ণ গ্রন্থের তাহকীক, তাখরীজ ও তা’লীক সম্পন্ন করেছেন এবং আধুনিক মুদ্রনের মাধ্যমে বৈরুত থেকে প্রকাশ করেছেন।
মোট ২৬ জিলদে এই এডিশন প্রকাশিত হয়েছে। পাঁচ জিলদে বিভিন্ন ধরনের সূচি ও নির্ঘন্ট। অবশিষ্ট ২১ জিলদে পূর্ণ কিতাব উন্নত সম্পাদনা ও দৃষ্টিনন্দন সজ্জায়নের সঙ্গে পেশ করা হয়েছে। টীকায় প্রায় সকল রেওয়ায়াতের ‘তাখরীজ’ অর্থাৎ এ রেওয়ায়েত অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে কোথায় কোথায় রয়েছে তার স্থান-নির্দেশ, রেওয়ায়াতের সনদগত মান, তুলনামূলক কম প্রচলিত শব্দের সংক্ষিপ্ত ও প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ ইত্যাদি এসেছে। এছাড়া অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তো রয়েছেই।
পাঠক-গবেষকদের অধিকতর সুবিধার জন্য মুহাক্কিক (পান্ডুলিপি-সম্পাদক) গ্রন্থটির সিডিও প্রস্ত্তত করিয়েছেন, যা প্রত্যেক নুসখার সঙ্গে পাওয়া যাবে।
এই এডিশনে সর্বমোট রেওয়ায়েত-সংখ্যা উনচল্লিশ হাজার আটানববই (৩৯০৯৮)। মারফু হাদীসের পাশাপাশি আছারে সাহাবা, তাবেয়ী ইমামগণের বাণী ও ফতোয়া এবং কিছু সংখ্যক তাবে তাবেয়ী ইমামদেরও বাণী সংকলিত হয়েছে। এছাড়া অনেক ইতিহাসের বর্ণনাও স্থান পেয়েছে। প্রত্যেক বর্ণনা সনদসহ উল্লেখিত হয়েছে আর টীকায় সনদগুলোর শাস্ত্রীয় মান চিহ্নিত করা হয়েছে।
রেওয়ায়েতের উপরোক্ত সংখ্যা থেকেই এ গ্রন্থের কলেবর ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। কিতাবের শুরুতে শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা লিখিত ১৯৮ পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ ভূমিকা রয়েছে, যা উলূমুল হাদীসের মূল্যবান তথ্য ও আলোচনায় সুসমৃদ্ধ। এ ভূমিকায় তিনি ওই পান্ডুলিপিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন যেগুলোর সাহায্যে এই এডিশন প্রস্ত্তত হয়েছে। পান্ডুলিপিগুলোর কিছু নমুনার হুবহু ফটোও সংযুক্ত হয়েছে। তাহকীক, তাখরীজ এবং তা’লীক (পান্ডুলিপি পাঠ ও সম্পাদনা, বর্ণনাসমূহের সূত্র-নির্দেশ ও টীকা-সংযুক্তি)-এই সকল বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, নিখুঁত ও বিশুদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ভূমিকা থেকেই হয়ে যায়। এরপর কিতাবের অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে তা আরো পরিষ্কার হতে থাকবে।
আলোচিত এডিশন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে আলেমদের মাঝে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে এবং প্রায় সকল ঘরানার আলেম-ওলামা শায়খের এই অবদানকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করেছেন।
কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করার বিষয় এই যে, আরবের কিছু বিত্তশালী ব্যক্তি কিতাবটির এই পূর্ণাঙ্গ এডিশন ব্যাপক আকারে প্রচার করার জন্য বাংলা-পাক-ভারত অঞ্চলের মাদরাসা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিতরণ করার নিয়্যত করেন। সে হিসেবে ১৪২৭ হিজরী মোতাবেক ২০০৬ ঈসাব্দে বিতরণের উদ্দেশ্যেই উপরোক্ত তাহকীককৃত এডিশনের একটি ফটো এডিশন শায়খের অনুমতিক্রমে পাকিস্তান থেকে ছাপানো হয়, যা মূল এডিশনের কয়েক মাস পরই মুদ্রিত হয়। এই এডিশনের শুরুতে শায়খের আরেকটি ভূমিকা সংযুক্ত হয়েছে, যা চার পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র কলেবরে হলেও জরুরি কিছু আলোচনা তাতে স্থান পেয়েছে। এ ক্ষুদ্র ভূমিকাও উলামা-তলাবার অধ্যয়নে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের দাওরায়ে হাদীস মাদরাসায় বিতরণ করার জন্য তিনশ নুসখা পাঠানো হয়েছিল। বিতরণের যিম্মাদারী শায়খের পক্ষ থেকে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা- এর উপর অর্পিত হয়। মাশাআল্লাহ, তাখাসসুস- এর প্রতিষ্ঠান এবং মিশকাত-জালালাইন মাদরাসাগুলো ছাড়াই আমাদের দেশে শুধু দাওরায়ে হাদীস মাদরাসাই তিন শতাধিক। যেহেতু মাত্র তিনশ নুসখা, এজন্য আবার শায়খকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। তিনি বন্টনের জন্য একটি নীতি নির্ধারণ করে দেন। সেই নীতি অনুযায়ী মারকাযুদ দাওয়ার দায়িত্বশীলরা কিতাব বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন। আল্লাহ তাআলা এই সামান্য খিদমত কবুল করুন এবং মুহাক্কিক, প্রকাশক ও এ কিতাব বিতরণে যে বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ অংশ নিয়েছেন তাদের সবাইকে এই বিশাল খিদমতের যথাযোগ্য প্রতিদান দান করুন। আমীন।
হাদীস ও সুন্নাহর এই সুবিশাল সংকলনের এতগুলো নুসখা সারা দেশে বিতরণ করা হয়েছে এবং দেশের প্রায় সকল বড় মাদরাসায় এ কিতাবের এক নুসখা পৌছে গিয়েছে-এরই পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে এ কিতাব থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা অর্জন করা যায় এ বিষয়ে লেখার জন্য বন্ধুরা আদেশ করেছেন। বর্তমান নিবন্ধটি তাঁদের আদেশ পালন ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ তাআলা প্রয়োজনীয় ও উপকারী কিছু কথা পেশ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
মাদরাসার দায়িত্বশীলদের কাছে আবেদন
এ প্রসঙ্গে সকল মাদরাসার দায়িত্বশীলদের খিদমতে অত্যন্ত বিনীত ও করজোর নিবেদন এই যে, প্রত্যেক মাদরাসায় স্বতন্ত্র ‘দারুল মুতালাআহ’ থাকা উচিত এবং সকাল থেকে রাত সাড়ে ন’টা দশটা পর্যন্ত তা খোলা রাখা উচিত। যাতে দরসের সময় ছাড়া অন্য সময়ে তালিবে ইলমরা সেখানে কাজ করতে পারে এবং খালি ঘন্টায় আসাতিযায়ে কেরাম মুতালাআ করতে পারেন। স্বতন্ত্র দারুল মুতালাআর ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে কুতুবখানাই সারাদিন খোলা রাখা উচিত এবং রাতেরও একটি উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত সেখানে কাজ করার সুযোগ থাকা উচিত।
শুরূহে হাদীস, ইলমু আসমাইর রিজাল, ইলমে উসূলে হাদীস এবং আরবী লুগাতের পাঁচ-দশটি বুনিয়াদী গ্রন্থ দাওরায়ে হাদীসের দরসগাহেই বিদ্যমান থাকা চাই। হিদায়া-জালালাইনের দরসগাহের জন্যও তাফসীর, ফিকহ ও ফতোয়ার কিছু বুনিয়াদী কিতাবের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত, যাতে তালিবে ইলমগণ সালাফের ইলমী মীরাছের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারে এবং তাদের মধ্যে অধ্যয়নের অভ্যাস তৈরি হতে পারে আর ধীরে ধীরে অধ্যয়নের মান উন্নত হতে থাকে। এই ব্যবস্থা ওই সব অধ্যয়ন-পিপাসু তালিবে ইলমের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে যারা দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদি ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করতে সক্ষম নয়।
এমন ব্যবস্থা আমাদের দেশে কোথাও নেই-এ কথা বলছি না, আলহামদুলিল্লাহ কোনো কোনো মাদরাসায় কুতুবখানা খোলা রাখারও নিয়ম আছে এবং কোথাও কোথাও দাওরায়ে হাদীসের দরসগাহে মাদরাসার পক্ষ থেকে কিছু ব্যাখ্যা-গ্রন্থেরও ব্যবস্থা থাকে। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে আমি একজন তালিবে ইলমের মুখে, যে হযরত মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী ছাহেবের শাগরিদ, এক আলোচনা প্রসঙ্গে শুনেছিলাম যে, তিনি দাওরায়ে হাদীসের বছর ‘মাআরিফুস সুনান’ অধ্যয়ন করেছেন এবং ওই নুসখা থেকেই অধ্যয়ন করেছেন, যা মাদরাসা থেকে সরবরাহ করা হয়েছিল। অন্যদিকে এ-ও শুনেছি যে, ঢাকারই এক বড় মাদরাসার তালিবে ইলম শশমাহী ইমতেহান হয়ে যাওয়ার পরও ‘তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম’ গ্রন্থটিরও নাম শোনেনি!
এ মুহূর্তে বিষয়টি আলোচনা করার এক উদ্দেশ্য এই যে, ‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা’র যে নুসখাগুলো আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মিলিয়ে দিয়েছেন তা যেন আমরা সংরক্ষিত কুতুবখানায় না রাখি, যা শুধু বছরের সূচনা ও সমাপ্তিতে খোলা হয়ে থাকে কিংবা সাময়িক প্রয়োজনে হঠাৎ কখনও খোলার সুযোগ আসে। বরং এমন কোথাও রাখা উচিত, যা দরস ও মুতালাআর অধিকাংশ সময়ই উন্মুক্ত থাকে। কিতাব হেফাযতের ব্যবস্থা অবশ্যই করা উচিত, কুতুবখানা ও দারুল মুতালাআর নেগরানও থাকা চাই, অন্য কোনো কামরায় কোনো আলমিরাতে কিতাব রাখতে হলে সেখানে তালা-চাবিরও ব্যবস্থা থাকা দরকার তবে সংরক্ষণের নামে এতটা বাড়াবাড়ি করা উচিত নয় যে, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকগণও সহজে তা ব্যবহার করতে পারেন না। এমন হলে তা হবে খুবই দুঃখজনক এবং কিতাব ওয়াকফকারীর উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আমাদের এ অঞ্চলে অধিকাংশ মাদরাসা কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত। কমিটির সদস্যরা যদি মাদরাসার আলাদা কুতুবখানা ও দারুল মুতালাআ স্থাপনে মনোযোগী হন তাহলে খুব ভালো হত। কিতাবসংগ্রহের জন্য বাৎসরিক বরাদ্দ থাকা উচিত এবং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কিতাব সংগ্রহ করা উচিত। তারা নিজেরা বা তাদের বন্ধুবান্ধবরা যখন হজ্ব-ওমরায় যান তখন মাদরাসার জন্য কিতাব সংগ্রহ করতে পারেন। এরপর সংগৃহীত কিতাবের সংরক্ষণ ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এবং সর্বোচ্চ সময় কুতুবখানা খোলা রাখার জন্য একাধিক দায়িত্বশীল নিযু্ক্ত করতে পারেন, যারা পালাক্রমে সেখানে দায়িত্ব পালন করবেন।
কমিটির মূল কাজ মাদরাসার উন্নতি-অগ্রগতির বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আর মাদরাসার পড়াশোনা ও শিক্ষক নিয়োগ-বরখাস্ত সংক্রান্ত বিষয়গুলো উলামায়ে কেরামের দায়িত্বে অর্পণ করা উচিত।
‘মুসান্নাফ’ থেকে আমরা কী কী ফায়েদা গ্রহণ করতে পারি
(১) এ গ্রন্থের সংকলক হলেন ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা। মূল নাম আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ। ১৫৯ হিজরীতে জন্ম এবং ২৩৫ হিজরীতে মৃত্যু। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী এবং ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন-এর মতো ইলমে হাদীসের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ও জরহ-তাদীলের ইমামগণের তিনি সমসাময়িক এবং তাঁদের সমপর্যায়ের ইমাম।
আর উপরোক্ত মনীষীগণ ছিলেন ‘কুতুবে সিত্তা’ (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ী, সুনানে তিরমিযী ও সুনানে ইবনে মাজাহ)এর সংকলকদের উস্তাদ কিংবা দাদা উস্তাদ ।
ওই সময়ের ইমামগণের এবং তাঁদেরও পূর্বসূরী ইমামগণের সংকলিত অনেক হাদীসগ্রন্থ আমাদের সামনে বিদ্যমান রয়েছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ., যিনি বুখারী ও আবু দাউদের উস্তাদ ছিলেন, তাঁর সংকলিত সুবৃহৎ হাদীসগ্রন্থ ‘আলমুসনাদ’-এর ১৩১৩ হি. থেকে এ পর্যন্ত অনেকগুলো এডিশন প্রকাশিত হয়েছে। অল্প কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে এ গ্রন্থের সবচেয়ে নিখুঁত ও সুসম্পাদিত এডিশন। বৈরুতের মুআসসাতুর রিসালা থেকে ৫২ খন্ডে তা প্রকাশিত হয়েছে। শায়খ শোয়াইব আরনাউত্ব-এর তত্ত্বাবধানে আলেমদের একটি জামাত এর তাহকীক ও তাখরীজ করেছেন।
ইমাম আবদুর রাযযাক ইবনে হাম্মাম আসসানআনী ইমাম ইবনে আবী শাইবা (২৩৫ হি.) এরও আগের মনীষী। ১২৬ হিজরীতে জন্ম ও ২১১ হিজরীতে মৃত্যু। তিনিও হাদীস ও আছারের অনেক বড় সংকলন ‘আলমুসান্নাফ’ নামে তৈরি করেন। তিনি ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হি.) ইমাম ইবনে জুরাইজ (৮০-১৫০ হি.) ইমাম সুফিয়ান ছাওরী (৯৭-১৬১ হি.), ইমাম মা’মার ইবনে রাশিদ (৯৫-১৫৪ হি.) , ইমাম মালিক (৯৩-১৭৯ হি.) এবং এঁদের সমসাময়িক তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের শাগরিদ ছিলেন। আর ইমাম আহমদ, ইবনুল মাদীনী ও ইবনে মায়ীন ছিলেন তার শাগরিদ।
ইমাম আবদুর রাযযাক ছানআনী সংকলিত হাদীসগ্রন্থটি ১৩৯০ হি. মোতাবেক ১৯৭০ ঈসাব্দে সর্বপ্রথম বৈরুত থেকে এগারো খন্ডে প্রকাশিত হয়। এর তাহকীক ও তাসহীহ, পান্ডুলিপি পাঠ ও সম্পাদনার কাজ সম্পন্ন করেছিলেন এ উপমহাদেশেরই বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আ’জমী রাহ. যিনি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপন করেছিলেন এবং হযরত মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ. এর বিশিষ্ট শাগরিদ ছিলেন। ১৪১২ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকাল হয়।
মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকে সর্বমোট রেওয়ায়েত সংখ্যা একুশ হাজার তেত্রিশ।
ইমাম আবদুর রাযযাক (২১১ হি.) ও তাঁর পূর্বসূরী ইমামদের সংকলিত বহু হাদীস-গ্রন্থও আলহামদুলিল্লাহ বহু পূর্বেই মুদ্রিত হয়েছে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পাঠক-গবেষকদের মাঝে সমাদৃত। ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. (১১৩-১৮২ হি.) যিনি ইমাম আবু হানীফার বিশিষ্ট শাগরিদ এবং দ্বিতীয় হিজরী শতকে গোটা ইসলামী বিশ্বের ‘কাযিউল কুযাত’ ছিলেন, ফিকহ ও হাদীস বিষয়ে তাঁর অন্যতম রচনা ‘কিতাবুল খারাজ’ বহুদিন যাবৎ মুদ্রিত। ইমাম মালেক রাহ. (৯৩-১৭৯ হি.)-এর ‘মুয়াত্তা’ এরও আগে সংকলিত ও মুদ্রিত।
ইমাম মালেক রাহ. প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে জন্মগ্রহণ করলেও তাবেয়ী ছিলেন না। ইমাম আবু হানীফা রাহ. তাঁর আগে ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং একাধিক সাহাবীর সাক্ষাত-সৌভাগ্য লাভ করেন। এজন্য তিনি তাবেয়ী ছিলেন। তাঁর সংকলিত হাদীস-গ্রন্থ ‘কিতাবুল আছার’ও আজ থেকে প্রায় আড়াই শত বছর আগে মুদ্রিত হয়েছে। মুদ্রিত নুসখাটি ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর বিন্যাসকৃত ও রেওয়ায়েতকৃত।
বিশিষ্ট সাহাবী সাইয়্যেদুনা আবু হুরায়রা রা.-এর শাগরিদ হাম্মাম ইবনে মুনাবিবহ, যিনি ৪০ হিজরী সনের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩১ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন, তাঁর হাদীস-সংকলন ‘সহীফা হাম্মাম ইবনে মুনাবিবহ’ নামে প্রসিদ্ধ। ১৩৭৫ হি. মোতাবেক ১৯৫৬ ঈসাব্দে ড. হামীদুল্লাহর তাহকীক ও মুকাদ্দিমাসহ প্রকাশিত হয়।
এ নিবন্ধে আমার আলোচ্য গ্রন্থ ‘মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা’ থেকে ‘সহীফা হাম্মাম ইবনে মুনাবিবহ’ পর্যন্ত এই হাদীস-সংকলনগুলো এবং এ ধরনের আরো বহু হাদীস-গ্রন্থ, যা এ নিবন্ধে উল্লেখিত হয়নি, সবগুলোই হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের পূর্বের সংকলন। হাদীস ও সুন্নাহ এবং আছারে ছাহাবা ও তাবেয়ীদের এই প্রাচীন গ্রন্থগুলো হাদীস অস্বীকারকারী ফের্কা ও তাদের অনুসারীদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বাস্তব জওয়াব। আফসোসের বিষয় এই যে, আমাদের দেশেও এদের অবাধ বিচরণ রয়েছে।
তাদের প্রচারণা এই যে, হিজরী তৃতীয় শতকের আগে হাদীস সংকলিত হয়নি।
যদি ওই সময় পর্যন্ত হাদীস শরীফ সংকলিত না-ও হত তবুও এতে সংশয়ের কিছু ছিল না, কেননা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হওয়া হাদীস সংরক্ষিত থাকার একটিমাত্র মাধ্যম। আর আল্লাহ তাআলা হাদীস ও সুন্নাহকে এক মাধ্যমে নয়, একাধিক মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখবেন। তবে বাস্তবতা এই যে, হাদীস শরীফ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে, এরপর খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও বিপুল আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। গোটা সাহাবী-যুগ ও তাবেয়ী-যুগব্যাপী হাদীস শরীফ লিপিবদ্ধ করার ধারা অব্যাহত ছিল। ওই সময়ের বহু সংকলনের মধ্যে বেশ কিছু সংকলন মুদ্রিতও হয়েছে। আর এর পরবর্তী যুগের হাদীস-গ্রন্থগুলোর একটি বিশাল অংশ এখনও পর্যন্ত সহজলভ্য।
এই হাদীস অস্বীকারকারীদের জানা আছে যে, একটি বর্ণনা তখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস বলে গণ্য হয় যখন তার (সনদ) সূত্র বিদ্যমান থাকে। এবং সে সনদের সকল রাবী সত্যবাদী, আস্থাভাজন, তাকওয়া-পরহেজগারীসম্পন্ন এবং স্মৃতি ও মেধার দিক থেকে নির্ভরযোগ্য ও চৌকস হওয়ার পাশাপাশি বর্ণনার সূত্র ও বক্তব্য সংক্রান্ত অন্য সকল শর্তও বিদ্যমান থাকে। বলাবাহুল্য, এই মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার পর এটি কি প্রথম শতাব্দীর কোনো কিতাবে সংকলিত হল কি দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো কিতাবে এতে কিছুই যায় আসে না। অথচ তারপরও বুঝেশুনে এরা এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণায় মগ্ন থাকে। বস্ত্তত জ্ঞানপাপীদের অবস্থা এমনই হয়ে থাকে।
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
তো মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা থেকে যে বিষয়গুলো অর্জন করা সম্ভব তার মধ্যে প্রথম বিষয় আমার মতে এই যে, এই কিতাব এবং তার পূর্বে সংকলিত কিতাবসমূহ হাদীস অস্বীকারকারী ও তাদের অনুসারীদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বাস্তব জওয়াব এবং তাদের পক্ষে চপেটাঘাত তুল্য।
(২) সেক্যুলার মানসিকতার লোকদের দাবি এই যে, দ্বীনের সম্পর্ক (তাদের ভাষায়, ধর্মের সম্পর্ক) একান্তই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়ে দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই কিংবা দ্বীন সেখানে অনধিকার প্রবেশ করে না। ভালো কাজ করা এবং নৈতিক মূল্যবোধগুলো অনুসরণ করাই হল দ্বীনের দাওয়াত এবং এ পর্যন্তই ...!! নাউযুবিল্লহ!
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, আলমুয়াত্তা, কিতাবুল আছার বলুন কি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাব কিংবা এ ধরনের যে কিতাবগুলোতে হাদীস ও আছার বিষয়ভিত্তিক শিরোনামে সংকলিত হয়েছে-এগুলোর শুধু সূচিপত্রে একবার নজর বুলালেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উপরোক্ত দাবি সত্য নয়।
এই কিতাবগুলোতে যেমন আখিরাত বিষয়ক অধ্যায় রয়েছে, তেমনি দুনিয়ার জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ও রয়েছে। আকীদা, ইবাদত, আখলাক-চরিত্র বিষয়ক শিরোনাম যেমন আছে, যা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তেমনি পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ও রয়েছে। শান্তি ও সন্ধি বিষয়ক শিরোনামের পাশাপাশি আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার ও জিহাদ বিষয়ক শিরোনামও রয়েছে। মসজিদ বিষয়ক শিরোনামের মতো রাষ্ট্র-পরিচালনা, খিলাফত ওয়া ইমারত, আইন ও বিচার সংক্রান্ত শিরোনামও রয়েছে। নামায-রোযা, দুআ-দরূদ বিষয়ক শিরোনামের সঙ্গে সভ্যতা-সংস্কৃতি, লেবাস-পোশাক, আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ক শিরোনামও রয়েছে, যা প্রায় সকল হাদীসগ্রন্থেই ‘কিতাবুল আদব’ নামে বিদ্যমান। যাকাত, ছদকা, দান ও ঋণের শিরোনামগুলোর পাশাপাশি সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়, সম্পদ বন্টন, ইজারা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি শিরোনামও রয়েছে।
ব্যক্তিগত সংশোধনের সঙ্গে সন্তানের তরবিয়ত ও গোটা সমাজের তা’লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়টিও রয়েছে। দ্বীনী শিক্ষার পাশাপাশি প্রযুক্তি ও কারিগরি বিদ্যা অর্জনেরও কথা রয়েছে। সমাজের শুধু একটি শ্রেণী নয় সকল শ্রেণীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিরোনাম রয়েছে।
চিকিৎসা ও এ সংক্রান্ত বিধান ও নিদের্শনা বিষয়ক শিরোনাম রয়েছে। উপদেশ-নসীহতের সঙ্গে শাস্তি ও তিরষ্কার এমনকি হদ, কিসাস ও তা’যীর বিষয়ক শিরোনামও রয়েছে। আল্লাহর হকের সঙ্গে বান্দার হক এমনকি সৃষ্টি জগতের হকসমূহও শিরোনাম আকারে এসেছে। মানুষের ভূমিষ্ট হওয়ার আগ থেকে নিয়ে মৃত্যুর পরের অবস্থাগুলোও সূচিবদ্ধ হয়েছে, ‘মীরাছ’ ও ‘ফারাইয’ তার একটি দৃষ্টান্ত।
মোটকথা, দ্বীন ও দুনিয়ার এমন কোনো বিষয় নেই, যে সম্পর্কে কিতাব ও সুন্নাহতে মৌলিক ও ব্যাপক কিংবা বিশেষ ও স্পষ্ট কোনো নিদের্শনা বিদ্যমান নেই। এ জন্য হাদীস ও সুন্নাহর কিতাবসমূহকে বিষয়ভিত্তিকভাবে বিন্যস্ত করা হলে এতে জীবন ও জগতের সকল অঙ্গন অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বর্তমানে যে সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে বিবেচিত এবং সমাধান পেশ করার দাবিতে সকল মতবাদ উচ্চকণ্ঠ অথচ বাস্তবতা এই যে, তাদের কেউই এই সমস্যাগুলোর বিশুদ্ধ ও ইনসাফভিত্তিক সমাধান পেশ করতে সক্ষম হয়নি, যদি এই সকল লোকেরা নিজেদের নির্ধারিত পরিভাষা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করে মূল বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং এগুলোর সমাধান নবী-শিক্ষায় অন্বেষণ করার জন্য সীরাত ও হাদীসের গ্রন্থসমূহ মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করেন, পাশাপাশি সীরাত ও হাদীসেরই ব্যাখ্যা ও সারনির্যাস ফিকহে ইসলামী থেকে সাহায্য গ্রহণ করেন তাহলে তারা অনুভব করতে সক্ষম হবেন যে, ইসলামী শরীয়ত বহু পূর্বেই এই বিষয়গুলোর বিশুদ্ধ ও ইনসাফভিত্তিক সমাধান পেশ করেছে, যার চেয়ে উত্তম সমাধান পৃথিবীর কোনো মতবাদ কিয়ামত পর্যন্ত পেশ করতে সক্ষম হবে না।
আলোচনা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি আরজ করছিলাম যে, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার মতো বিষয়ভিত্তিক বিন্যাসে সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহের শুধু সূচিপত্রগুলোও ওই কুফরী মতবাদকে খন্ডন করে, যে মতবাদে বলা হয়, ওহীর শিক্ষায় মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে দিক-নির্দেশনা নেই। অন্যভাষায় ইসলাম মানুষের কাছে শুধু নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ হওয়ার দাবি জানায়। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই। নাউযুবিল্লাহ।
উপরোক্ত ধর্মবিরোধী মুলহিদ শ্রেণীর প্রচার-প্রচারণায় যেসব দুর্বল ঈমান, স্বল্পজ্ঞান-বিশিষ্ট মুসলমান প্রভাবিত হয় তাদের জন্যও এই সূচিপত্রে নজর বুলানো প্রতিষেধকের কাজ করতে পারে।
(৩) আলোচিত গ্রন্থে সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, কর্ম ও নির্দেশনা অর্থাৎ মারফু হাদীস যেমন রয়েছে তেমনি প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের মধ্যে যারা ফকীহ ছিলেন তাঁদের ফতোয়া এবং তাঁদের পরবর্তী ফকীহদেরও অনেকের ফতোয়া। আর এই হাদীস, আছার ও ফতোয়ায়ে ফুকাহা সবকিছুই বর্ণিত হয়েছে সনদের সঙ্গে।
যে সাহাবীদের ফতোয়া এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে তাঁদের সংখ্যা দেড়শরও অধিক। পরবর্তী যুগের লোকদের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে। লক্ষ করার বিষয় এই যে, ফতোয়া দানকারীগণ সকলেই যদিও দ্বীনী ইলমে পারদর্শী ও কুরআন-সুন্নাহর ফকীহ ছিলেন, কিন্তু কাযী বা বিচারক স্বল্প সংখ্যকই ছিলেন। যারা কাযী ছিলেন তাদেরও বিচারিক সিদ্ধান্ত উল্লেখিত হয়েছে কম, ফতোয়াই উল্লেখিত হয়েছে বেশি। এ জন্য এ কিতাবের উপর শুধু একবার নজর বুলিয়ে গেলেও এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা সামনে এসে যায় যে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই ফতোয়ার প্রচলন ছিল আর যিনি ইলমে দ্বীনে পারদর্শী ও কুরআন ও সুন্নাহর ফকীহ তিনিই ফতোয়া প্রদানের উপযুক্ত, চাই তিনি সরকারীভাবে নিযুক্ত হয়ে থাকুন অথবা নাই হয়ে থাকুন।
যারা বলে থাকে, ‘দ্বীনী ইলমে পারদর্শী ব্যক্তির ফতোয়া ফতোয়া নয়; বরং আইন ও বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রায়ই হল ফতোয়া এবং সরকারীভাবে অনুমোদিত নয়-এমন কারো ফতোয়া প্রদানের অধিকার নেই’-এরা প্রকৃতপক্ষে বেদ্বীন ও ইসলামী শরীয়তকে অস্বীকারকারী। যদি এরা মুসলমান হত এবং মূর্খতার কারণে এসব বলত তাহলে তাদের সামনে ‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা’ খুলে রেখে দেওয়া যথেষ্ট হত। এ কিতাবে নজর বুলালেই তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হত যে, ইসলামের প্রথম দিন থেকেই ফতোয়ার এই ধারাটি পূর্ণ স্বীকৃতি ও ব্যাপকতার সঙ্গে বিদ্যমান ছিল। শরীয়তের বিধান যার জানা নেই সে জ্ঞানী ও পারদর্শী ব্যক্তির কাছ থেকে তা জেনে নিত। আর ফতোয়া দানের দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন যিনি দ্বীনী ইলমে পারদর্শী। কাযী যদি দ্বীনী ইলমে পারদর্শী না হত তবে তাকেও ‘মুফতী’ র শরণাপন্ন হয়ে শরীয়ত মোতাবেক বিচার কার্য সম্পন্ন করতে হত। এককথায় ফতোয়া বিচারকে নিয়ন্ত্রন করত, বিচার ফতোয়াকে নয়। এই পদ্ধতিই ইসলামের প্রথম দিন থেকে প্রচলিত এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রচলিত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
তবে যদি এমন কেউ ‘ফতোয়া’ দেওয়া শুরু করে, যে দ্বীনী বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে অযোগ্য বা অনাস্থাভাজন তাহলে তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই অযোগ্য লোককে উপরোক্ত কাজ থেকে বিরত রাখা প্রশাসনের দায়িত্ব।
(৪) সাহাবা, তাবেয়ীন এবং তাবে তাবেয়ীনের এই বিপুল সংখ্যক ফতোয়া, যা উপরোক্ত কিতাবে এবং এ ধরনের অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে তার ধরন এই যে, প্রশ্নকারী আলেম হোক বা না হোক, মুফতী অর্থাৎ উত্তরদাতা উত্তর দেওয়ার সময় সাধারণত দলীল উল্লেখ করেন না। তিনি দলীলের ভিত্তিতে উত্তর দিয়ে থাকেন তবে সে দলীল প্রশ্নকারীকেও বলে দেওয়া অপরিহার্য মনে করেন না। ফতোয়াপ্রার্থীকে এভাবে জওয়াব দেওয়ার রীতি আলেমদের মধ্যে এখনো প্রচলিত রয়েছে।
যারা মনে করে, দলীল উল্লেখ করা ছাড়া মাসআলা বলা জায়েয নয় এবং ফতোয়াপ্রার্থীর জন্য দলীলের উল্লেখবিহীন মুফতী (ইলমে দ্বীনের পারদর্শী)র ফতোয়া অনুসরণ করা জায়েয নয় তারা সাহাবা-যুগ থেকে বিদ্যমান সর্বস্বীকৃত ও ইজমায়ী একটি বিষয় থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। যদি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা গ্রন্থটি তারা এই দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করেন তাহলে আশা করা যায়, এই বিভ্রান্তি সম্পর্কে তারা সচেতন হতে পারবেন। তারা আরও জানতে পারবেন যে, ফিকহের বিভিন্ন মাযহাব খায়রুল কুরুনেই (সাহাবা-তাবেয়ী যুগ) ছিল এবং কোনো ধরনের দ্বিধা-সংশয় ছাড়াই সেই মাযহাবগুলো অনুসৃত হয়েছে।
ওই মাযহাবগুলো যেভাবে দলীলসহ সংকলিত হয়েছে তেমনি দলীল উল্লেখ ছাড়াও ভিন্নভাবে সংকলিত হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর গ্রন্থসমূহকে ‘ফিকহে মুদাল্লাল’ ও ‘ফিকহে মুকারান’ বলা হয়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রন্থগুলোকে বলা হয় ‘ফিকহে মুজাররাদ’ ।
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে ফিকহ-সংকলনের এই শেষোক্ত পদ্ধতির সূত্র ও বিশুদ্ধতা কত স্পষ্টরূপে প্রকাশিত! যারা এই পদ্ধতিকে বিদআত আখ্যা দেয় তারা প্রকৃতপক্ষে সালাফের রীতি-নীতি সম্পর্কে অবগত নয়।
তারা আরও জানতে পারবেন যে, আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ যে চার মাযহাবের তাকলীদ ও অনুসরণ করে আসছেন তা মূলত সালাফেরই ওই মাযহাবগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। আর ফিকহী মাযহাব বলাই হয় কিতাব ও সুন্নাহর বিধিবিধানের বিশ্লেষিত, বিন্যাস্ত ও সংকলিত রূপকে।
পাঠকদের মধ্যে যারা আলকাউসারে প্রকাশিত আমার দু’টি প্রবন্ধ ‘সালাফের বক্তব্যে তাকলীদ ও মাযহাব শব্দের ব্যবহহার’ (মুহাররম ’২৮, ফেব্রুয়ারী ’০৭) ও ‘ফিকহে হানাফীর সনদ’ (জুমাদাল উলা ’২৮, জুন ’০৭; জুমাদাল উখরা ’২৮, জুলাই ’০৭) পড়েছেন তাদের পক্ষে উপরোক্ত কথাগুলো খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নেওয়া সম্ভব হবে। সম্মানিত পাঠকবৃন্দের প্রতি আরেকবার প্রবন্ধ দু’টিতে নজর বুলিয়ে নেওয়ার অনুরোধ রইল।
(৫) ‘মুসান্নাফ’ থেকে অর্জন করার মতো একটি বিষয় হল ইখতেলাফী মাসাইলের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য পদ্ধতি, যার পারিভাষিক নাম ‘আদাবুল ইখতিলাফ।’
আপনি এ কিতাবেই দেখতে পাবেন যে, এক দুই মাসআলায় নয়, অসংখ্য মাসআলায় সাহাবা-তাবেয়ীন যুগে ফকীহগণের মধ্যে এবং পরবর্তী যুগের ফকীহদের মধ্যেও মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হল, এই মতভিন্নতা কেন দেখা দিল অথচ তাঁদের প্রত্যেকেরই ঈমান রয়েছে আল্লাহর উপর এবং কুরআন মজীদের উপর আর খাতামুন্নাবিয়ীন হযরত মুহাম্মাদ মুসতাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবারই নবী, হাদীস ও সুন্নাহকেই সবাই দ্বীন ও শরীয়তের দলীল মনে করেন? আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও সবাই একতাবদ্ধ, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ’র আকীদাই সকলের আকীদা? দ্বীন ও শরীয়তের ইজমায়ী ও সর্বস্বীকৃত বিষয়াদিতে এবং সর্বজনস্বীকৃত নীতিমালাতেও সবাই একমত? এরপরও তাঁদের মধ্যে ইখতিলাফ বা মতভিন্নতা কীভাবে সৃষ্টি হল?
বস্ত্তত ইখতিলাফ বা মতভিন্নতা দু’ধরনের। এক হল হঠকারিতাপ্রসূত মতভিন্নতা। অর্থাৎ একপক্ষ দলীল মানতে প্রস্ত্তত, অপরপক্ষ হঠকারিতাবশত তা মানতে প্রস্ত্তত নয়, কিন্তু তার এই অবস্থান গোপন রাখার জন্য সে দলীলের অপব্যাখ্যা করে। এ শ্রেণীর মতভিন্নতা সৃষ্টি করা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে, পূর্বোক্ত মনীষীগণ, যারা ইতোপূর্বে উল্লেখিত মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত, তাঁদের মধ্যে এ ধরনের ইখতিলাফ হতেই পারে না।
দ্বিতীয় প্রকার ইখতিলাফ হল, দলীল ভিত্তিক ইখতিলাফ। অর্থাৎ বিভিন্ন মত পোষণকারী প্রত্যেকেই দলীল মানতে প্রস্ত্তত এবং দলীলের অনুসরণ করতে গিয়েই বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে এই মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, খোদ শরীয়তের দলীলের মধ্যেই কোনো কাজের দুইটি পদ্ধতি উল্লেখিত হয়েছে আর উভয়টিই মোবাহ ও স্বীকৃত। তো কেউ এক পদ্ধতি অনুযায়ী আমল করলেন, অন্যজন অন্য পদ্ধতি অনুযায়ী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, হজ্বের তিন প্রকার-কিরান, ইফরাদ, তামাত্তু; ইকামতের দুই পদ্ধতি-তাকবীরের মতো অন্য বাক্যগুলোও দুই বার করে বলা কিংবা একবার করে বলা ইত্যাদি এই মতভিন্নতাকে পরিভাষায় ‘ইখতিলাফুত তানাউ’ ও ‘ইখতিলাফে মুবাহ’ বলা হয়।
কখনো মতভেদ এজন্য হয় যে, আলোচিত দলীলে ভাষার রীতি ও ব্যাকরণ এবং দলীল-ব্যাখ্যার কায়েদা-কানুনের আলোকেই একাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। তো কারো দৃষ্টিতে এক ব্যাখ্যা শক্তিশালী মনে হয়েছে, অন্যজনের দৃষ্টিতে অপর ব্যাখ্যা।
এ ধরনের আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যা এ বিষয়ক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার উপরোক্ত এডিশনের সঙ্গেও এ বিষয়ের দু’টি স্বতন্ত্র গ্রন্থ সংযুক্ত হয়েছে : (১) আছারুল হাদীসিশ শরীফ ফী ইখতিলাফিল আইম্মাতিল ফুকাহা, (২) আদাবুল ইখতিলাফ ফী মাসাইলিল ইলমি ওয়াদ দ্বীন।
প্রথমোক্ত কিতাবে ওই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলোর কারণে হাদীসের প্রত্যেক ইমাম সর্বান্তকরণে হাদীস-অনুসরণে সমর্পিত হওয়ার পরও তাঁদের মধ্যে মতভিন্নতা হয়েছে। আর শেষোক্ত কিতাবে এ ধরনের মতভিন্নতার ক্ষেত্রে, যা আহলে হক ইমামদের মধ্যে যৌক্তিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে এবং স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেই যার সূচনা হয়েছে, সঠিক কর্ম-পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়েছে। আলকাউসারের উদ্বোধনী সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ফকীহগণের মতভেদ : একটি মূল্যায়ন’ থেকে পাঠকবৃন্দ এ বিষয়ে কিছু ধারণা অর্জন করতে পারবেন।
বর্তমানে আমাদের সমাজে দু’ধরনের প্রান্তিকতা লক্ষ করা যায়। একশ্রেণীর লোক যাদের পক্ষে দ্বীন ও ঈমানের প্রাথমিক বিষয়গুলোও জানা কিংবা মানার সৌভাগ্য হয় না তারা ‘উদারতা’ শব্দের অপপ্রয়োগ করে থাকেন। তারা যেন বলতে চান, সত্য ও বাস্তবতার অস্বীকার বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। কেউ যদি সত্যকে অস্বীকার করে, বাস্তবতার বিরোধিতা করে তবে এগুলোও তাদের দৃষ্টিতে ‘মতের ভিন্নতা’ মাত্র। এ কারণেই কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের, তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতের মতো দ্বীনের একটি স্বতঃসিদ্ধ আকীদা-‘খতমে নবুওত’ অস্বীকার করাও ‘ভিন্ন মতে’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়! নাউযুবিল্লাহ!
তদ্রূপ বেশরা সূফীদের ও সেক্যুলার মানসিকতার লোকদের শরীয়ত-অস্বীকারের মতো কুফরীও ‘ভিন্ন মত’ হিসেবে গণ্য! নাউযুবিল্লাহ। তো এই শ্রেণীর লোকেরা সত্য ও বাস্তবতার বিরোধিতাকেও ‘ভিন্নমত’ নামে আখ্যায়িত করে এবং যৌক্তিক ও স্বীকৃত মতভিন্নতার মতো এগুলোকেও সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করার কথা বলে থাকে।
আসলে ‘ভিন্ন মতে’র প্রতি মর্যাদা প্রদান এদের একটি শিরোনামমাত্র। আর এই শিরোনামের অপব্যবহারের পিছনে সত্য ও বাস্তবতার প্রতি তাদের বিদ্বেষী মনোভাবই প্রধানত দায়ী।
এর বিপরীতে অন্য এক শ্রেণী, যাদের মধ্যে দ্বীনের গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুপস্থিত, তারা ওই ইখতিলাফ সম্পর্কেও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন যার পিছনে যৌক্তিক ও স্বীকৃত কারণ বিদ্যমান রয়েছে এবং যে ইখতিলাফ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সহনশীল হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। যেহেতু শরীয়তের দলীল-প্রমাণের অনুসরণের প্রেরণা থেকেই এই ইখতিলাফ উৎসারিত তাই কখনো একে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। যেভাবে তা ইসলামের প্রথম যুগে চলমান ছিল, কিয়ামত পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকবে।
অথচ এই স্বীকৃত মতভিন্নতাও এই শ্রেণীর লোকেরা মেনে নিতে প্রস্ত্তত নন। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ নিয়ে বিতর্ক করতে থাকেন যে, তোমরা কেন আমীন আস্তে বল, উচ্চস্বরে কেন বল না? রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে ওঠার সময় কেন ‘রাফয়ে ইয়াদাইন’ কর না? ইমামের পিছনে ফাতেহা কেন পড় না? ঈদের নামাযে ছয় তাকবীর কেন দাও, বারো তাকবীর কেন দাও না? তোমাদের নামায হয় না। অন্তত সুন্নত মোতাবেক হয় না!!
মোটকথা, এ ধরনের কিছু মাসাইলকে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদের সূত্রপাত ঘটানো হচ্ছে এবং নিশ্চিন্তে ইবাদত-বন্দেগী করার স্থান-মসজিদগুলোকে তর্ক-বিতর্ক ও শোরগোলের আখড়া বানানো হচ্ছে। অথচ উভয় দিকেই দলীল-প্রমাণ রয়েছে এবং সাহাবা-তাবেয়ীন যুগ থেকেই এই মতভিন্নতা বিদ্যমান রয়েছে। আপনি যদি ‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা’য় এ বিষয়গুলো অধ্যয়ন করেন এবং সালাফের যে ফকীহগণের মধ্যে এসব বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল তাদের পারস্পরিক সম্পর্কও তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন, তাঁরা সর্বদা তাদের মতপার্থক্যকে ওই বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এর কারণে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য ও বিবাদ-বিসংবাদের সূচনা করেননি। তাদের মতভিন্নতা উম্মাহর ঐক্যে বিন্দুমাত্র চিড় ধরায়নি। এইসব শাখাগত বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে একে অপরকে গোমরাহ, বিদআতী বা ফাসেক আখ্যা দেওয়ার প্রশ্নই সে আমলে ছিল না।
অথচ আজকাল কিছু মানুষ এগুলোরই ভিত্তিতে এমনকি কাফের পর্যন্তও বলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। অন্যদিকে প্রথমোক্ত ধরনের মতভেদ, যা প্রকৃতপক্ষে ‘মতভিন্নতা’ই নয়, সত্য ও বাস্তবতার প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, এ সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে কোনো নমনীয়তা ছিল না। এ কথা ঠিক যে, ইসলামে কট্টর কাফেরেরও নির্ধারিত হক্ক ও অধিকার রয়েছে এবং চরম বিদআতীরও হক ও অধিকার রয়েছে। আল্লাহর মাখলুক হিসেবে এবং মানবজাতির সদস্য হিসেবে ইসলামে যার যে হক ও অধিকার প্রাপ্য তা স্বস্থানে স্বীকৃত এবং এ হকগুলো তাঁরা আদায়ও করতেন, কিন্তু উদারতার নামে কখনো তারা শিথিলতা অবলম্বন করতেন না।
আকীদা-বিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনস্বীকৃত বিষয়াদিতে অবিচলতা তাদের নিদর্শন ছিল। এসব বিষয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং সাধারণ মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে তাদের সম্পর্কে তারা প্রকাশ্য-প্রতিবাদ করতেন। বিদআতকে বিদআত, বাতিলকে বাতিল এবং কুফরকে স্পষ্টভাবে কুফরই বলতেন। এ বিষয়ে কোনো ধরনের শৈথিল্যের প্রবণতা তাঁদের মধ্যে ছিল না।
সালাফের এই নীতি পুনরুজ্জীবিত করাই হল সময়ের দাবি। স্বীকৃত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা আর অস্বীকৃত মতানৈক্যগুলোর উপর দ্বিধাহীনভাবে প্রতিবাদ জানানো আমাদের সকলের কর্তব্য।
(৬) ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে একবার নজর বুলিয়ে গেলেও যে সুফল আমাদের উপরোক্ত বন্ধুরা লাভ করতে পারবেন, যারা শাখাগত, দলীলসমৃদ্ধ ও সাহাবা-তাবেয়ীনযুগ থেকে বিদ্যমান মত-ভিন্নতাকে সহ্য করতে পারেন, না তা এই যে, তাদের একটি ভুল ধারণা দূর হবে। তারা মনে করে থাকেন, সকল সহীহ হাদীসই সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এসে গেছে। এর বাইরে হয় কোনো সহীহ হাদীসই নেই কিংবা থাকলেও সেগুলো এই দুই গ্রন্থের হাদীসের মোকাবেলায় কিছুই নয়। নাউযুবিল্লাহ!
যদি আমাদের এই বন্ধুরা মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসনাদে আহমদ, সহীহ ইবনে হিববান, শরহু মুশকিলিল আছার প্রভৃতি কিতাব অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন যে, শত শত নয়, হাজার হাজার হাদীস ও আছার এই কিতাবগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে, যা রেওয়ায়েতের বিচারে একদম সহীহ এবং সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেরই রেওয়ায়েতের সমপর্যায়ের ও একই মানদন্ডে উত্তীর্ণ। উপরোক্ত কিতাবগুলোর মধ্যে শেষোক্ত তিন কিতাবের টীকায় ওই হাদীসগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা হয়েছে এবং লেখা হয়েছে-
صحيح على شرط البخاري، صحيح على شرط مسلم، صحيح على شرط الشيخسن.
‘মুসান্নাফ’ অধ্যয়নকালে ওই বন্ধুরা দেখতে পাবেন যে, ইখতিলাফী বিষয়গুলোতে যেমন উভয় দিকেই হাদীস রয়েছে তেমনি ওই হাদীসগুলোর উপর আমলকারীদের মধ্যে উভয় দিকেই সাহাবী, তাবেয়ী এবং হাদীস ও ফিকহের বড় বড় ইমামও রয়েছেন। এ অবস্থায় আপনি কোনো একটি মত অবলম্বন করতে পারেন কিন্তু অন্য মতকে বাতিল ও ভ্রান্ত আখ্যা কি দিতে পারেন? তদ্রূপ কোনো এক মত অনুযায়ী যারা আমল করছেন তারা তো সালাফ থেকে অনুসৃত হাদীস মোতাবেকই আমল করছেন এবং সুন্নাহ মোতাবেকই চলছেন তাহলে তাদের মধ্যে অপর মত প্রচার করার কী অর্থ? সালাফ কি এরূপ করেছেন?*
(৭) ফিকহে হানাফী পাঠকারী এবং এই ফিকহের নির্দেশনা অনুযায়ী কিতাবুল্লাহ ও সুন্নতে রাসূলুল্লাহর উপর আমলকারী তালিবে ইলমগণ ‘মুসান্নাফ’ অধ্যয়ন করে নিজেদের ফিকহ সম্পর্কে আরো অধিক আস্থা ও প্রশান্তি অর্জন করতে পারেন। রদ্দুল মুহতার ও আলমগীরীর শত শত মাসআলার দলীল তারা শুধু এই এক কিতাব থেকে আহরণ করতে পারবেন এবং স্বচক্ষে দেখতে পারবেন যে, ফিকহে হানাফী ফিকহুস সালাফের কত নিকটবর্তী।
‘মুসান্নাফে’র বিংশ খন্ডে যদি ‘কিতাবুর রাদ্দি আলা আবী হানীফা’ নামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় তাদের দৃষ্টিগোচর হয় তবে তারা নিজেরাই এই ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থের সাহায্যে ওই অধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের পর্যালোচনাও করতে পারবেন। পাশাপাশি ফিকহে হানাফীর বুনিয়াদ সম্পর্কেও তাদের আস্থা আরো শক্তিশালী হবে। এরই সঙ্গে তারা যদি আল্লামা মুহাম্মদ যাহিদ কাওছারী রাহ. (১৩৭১ হি.) প্রণীত ‘আননুকাতুত তরীফা ফিত্ তাহাদ্দুছি আন রুদূদি ইবনে আবী শাইবা আলা আবী হানীফা’ এবং ড. আবদুল মজীদ মাহমূদ আশশাফেয়ী প্রণীত ‘আলইত্তেজাহাতুল ফিকহিয়্যা ইনদা আসহাবিল হাদীছ ফিল কারনিছ ছালিছ’ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করেন তবে তো নুরুন ‘আলা নূর। একদম সোনায় সোহাগা। এ বিষয়ে বিংশ খন্ডের সূচনায় মুহাক্কিকের ভূমিকাও অত্যন্ত সারগর্ভ ও চমৎকার।
(৮) ‘মুসান্নাফে’ যেমন ‘ফিকহে মুজাররাদ’-এর স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে তেমনি ‘ফিকহে মুকারান’-এরও মৌলিক সূত্র বিদ্যমান রয়েছে। ‘ফিকহে মুকারান’ বলতে ফিকহের ওই সব প্রবন্ধ ও গ্রন্থাদি বোঝায় যেগুলোতে প্রত্যেক মাসআলা সকল মাযহাব ও দলীলপ্রমাণসহ আলোচিত হয় এবং বিভিন্ন মতামতের দলীল সম্পর্কেও পর্যালোচনা করা হয়। শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা বলেছেন, ‘ফিকহে মুকারান’-এর প্রাচীন নাম ‘‘ফিকহুল খিলাফিল ‘আলী’’ ছিল এবং ‘মুসান্নাফ’ হাদীস ও সুন্নাহর কিতাব হওয়ার পাশাপাশি একটি পর্যায় পর্যন্ত এই শাস্ত্রেরও কিতাব।
বর্তমানে ‘ফিকহে মুকারান’ শব্দের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে ‘ফিকহে মুতাওয়ারাছ’ (স্বীকৃত ও অনুসৃত ফিকহ) অস্বীকার করার ফিৎনা আরম্ভ হয়েছে, ‘আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদ’ নামধারী একটি শ্রেণী এ ফিৎনার ধারক ও বাহক।
শরীয়ত অস্বীকারকারী লোকেরা সেখান থেকে প্রচুর সহযোগিতা পেয়ে থাকে। এজন্য এরা তাদেরই উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে।
ফিকহে মুকারানের নামে দ্বিতীয় ফিৎনা ‘তাওহীদুল মাযাহিব’ (এক মাযহাব প্রণয়ন)-এর প্রবক্তারা আরম্ভ করেছে, যা প্রকৃতপক্ষে পঞ্চম মাযহাব প্রতিষ্ঠার সমার্থক। বলাবাহুল্য, ইসলামের সর্বোত্তম যুগে ইমামদের মাধ্যমে সংকলিত এবং প্রতি যুগে মুসলিম উম্মাহ কর্তৃক অনুসৃত মাযহাবগুলোর তুলনায় এর কোনোই মূল্য নেই। এরপরও এ বিষয়ে অনমনীয়তা প্রদর্শন করা এবং এমনভাবে এগুলোর দিকে দাওয়াত দেওয়া যেন লোকদেরকে গোমরাহী থেকে হেদায়েতের দিকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে, পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
প্রায় তিন বছর আগে সাইয়্যেদ সুলায়মান নাদভী রাহ. (১৩০২ হি.-১৩৭৩ হি.) এর পুত্র মাওলানা সালমান নাদভী (মাওলানা সালমান হুসায়নী নদভী নন) আগমন করেছিলেন। মাদরাসা শরফুদ্দীন আবু তাওআমা সোনারগাঁও-এ তার সঙ্গে সাক্ষাত করি। তিনি নিজের কথা শোনালেন যে, ‘আমি জওয়ান বয়সে ড. হামীদুল্লাহ ছাহেবের সামনে অত্যন্ত জোশের সঙ্গে এই প্রস্তাব পেশ করি যে, প্রত্যেক মাযহাব থেকে বিশুদ্ধতম মত চয়ন করে নতুন ফিকহ সংকলন করা কি উচিত নয়? এর মাধ্যমে সকল মতভেদ দূর হতে পারে?’ এর উত্তরে তিনি শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন-
‘পঞ্চম মাযহাবের সূত্রপাত ঘটবে।’
যৌক্তিক কথা ছিল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে এসেছে। আমি বললাম,, ‘বুঝতে পেরেছি। আর বলার প্রয়োজন নেই।’
মূল বিষয় এই যে, বিশুদ্ধতম মত নির্বাচন করার অধিকার আপনার যেমন রয়েছে তেমনি অন্যেরও রয়েছে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন যে, স্বীকৃত ও সুপ্রাচীন মতভেদগুলোর মধ্যে (আহলে হকের ফিকহের মাঝে বিদ্যমান মতভেদগুলো এ শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত।) তুলনাকারীদের মধ্যেও অগ্রগণ্য মত নির্ধারণে মতভেদ হয়ে যায়। অতএব এ ধরনের প্রয়াস অর্থহীন। এখানে করণীয় হল, ইমাম ইবনে আবী শাইবা ও তাঁরও অগ্রজ ইমামদের আদর্শ গ্রহণ করে দ্বন্দ-বিভেদ দূর করার ক্ষেত্রে কার্যকর পন্থা অবলম্বন করা। সালাফের মধ্যে ইখতিলাফ ছিল, কিন্তু ঐক্যও ছিল। তাদের মধ্যে দ্বন্দ ও বিভেদ ছিল না। শাখাগত বিষয়ে মতভিন্নতা থাকলেও নিজেদের ঐক্য ও হৃদ্যতা তারা সংরক্ষণ করতেন। ঐক্যের মধ্যে কোনোরূপ ফাটল সৃষ্টি হতে দিতেন না। শাখাগত বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে একে অপরকে গোমরাহ, বিদআতী আখ্যা দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, হিংসা-বিদ্বেষ থেকেও তারা নিজেদেরকে দূরে রাখতেন। আজ এই ধারাই পুনরায় জীবিত করা প্রয়োজন, ‘ফিকহে মুকারান’-এর নাম ব্যবহার করে স্বীকৃত মতভিন্নতা দূর করার প্রয়াস অর্থহীন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ‘ফিকহে মুতাওয়ারাছ’কে অর্থাৎ যে ফিকহ উম্মাহর মাঝে স্বীকৃত ও অনুসৃত, তাকে সংরক্ষণ করার জন্য ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ ও ‘অপ্রয়োজনীয় আবদ্ধতা’ উভয় ব্যাধি থেকেই একে মুক্ত রাখতে হবে। ‘ফিকহে মুকারান’ অর্থাৎ দলীলভিত্তিক ও তুলনামূলক ফিকহ অধ্যয়নের কাজ অব্যাহত থাকবে তবে তা ফলদায়ক তখনই হবে যদি এই কাজ উসূল মোতাবেক হয়। আর এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় উসূল এই যে, ‘ফিকহে মুকারান’কে গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণকারীকে ‘উসূলে ফিকহ’, কাওয়ায়েদে ফিকহ’, মাকাসিদে শরীয়ত, আসবাবুল ইখতিলাফ ও আদাবুল ইখতিলাফ বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। পাশাপাশি উলূমুল হাদীসের বুনিয়াদী চার বিষয়েও পারদর্শিতা থাকতে হবে। এ ছাড়া তাকওয়া-পরহেযগারী, বুদ্ধিমত্তা ও সহনশীলতা এবং স্বভাবগত প্রতিভার অপরিহার্যতা তো রয়েছেই।
‘ফিকহে মুকারান’-শব্দটি যারা আজকাল ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে যেসব বড় বড় ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে তুলনামূলক ক্ষুদ্র বিষয়টি হল, (যদিও তা স্বস্থানে অনেক বড় ত্রুটি) তারা মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্তগুলো তুলনা করে থাকে। অথচ এই তুলনার অধিকাংশ তথ্য ও উপকরণে এরা সম্পূর্ণ রূপে অন্যের মুকাল্লিদ-অনুসারী। আর এই ধারকৃত ইলমকেই (অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা আত্মস্থ করতেও তারা সক্ষম হয়ে ওঠেন না) ইজতিহাদী ইলমের চেয়েও উঁচু ও তর্কাতীত মনে করেন বলে অনুমিত হয়।
এই ইলমের চর্চা ব্যাপক হওয়া দরকার তবে অবশ্যই উসূল ও আদাব, নিয়ম ও নীতি অনুযায়ী। মনে রাখতে হবে যে, ‘আবদ্ধতা’ যদি নিন্দার বিষয় হয় তবে ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ হল গর্হিত।
উঁচু শ্রেণীর তালিবে ইলমের মনে রাখা উচিত যে, ফিকহে ইসলামী সম্পর্কে শরীয়তবিরোধী ও মুসলমানদের মধ্যে সংশয় বিস্তারকারী লোকদের প্রোপাগান্ডা থেকে ফিকহে ইসলামীকে রক্ষা করার প্রয়োজনেও বিশুদ্ধ পন্থায় ‘ফিকহে মুকারান’ চর্চা করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এজন্য প্রথমে, আমাদের পূর্বসূরী আকাবিরের বক্তব্য অনুযায়ী, উচ্চমার্গীয় ইলম ও ফন আত্মস্থ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এরপর ইমাম আবদুর রাযযাক ও ইবনে আবী শাইবার দুই ‘মুসান্নাফ’, ইবনে আবদিল বার রাহ.-এর ‘আততামহীদ’ ও ‘আলইসতিযকার’, তহাবী-এর ‘শরহু মাআ’নিল আছার’ ও ‘শরহু মুশকিলিল আছার’, বায়হাকী রাহ.-এর ‘আসসুনানুল কুবরা’, ইবনে কুদামা রাহ.-এর ‘আলমুগনী’ শাহ ছাহেব রাহ.-এর রচনাবলি, বিশেষত ‘ফয়যুল বারী’ ও বিন্নুরী রাহ.-এর ‘মাআরিফুস সুনান’ ইত্যাদি এমন একজন ব্যক্তিত্বের তত্ত্বাবধানে নিখুঁতভাবে অধ্যয়ন করতে হবে যিনি একইসঙ্গে উলূমুল কুরআন, উলূমুল হাদীস ও উলূমুল ফিকহে প্রাজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞতার অধিকারী।
এ অধ্যয়নের সূচনা ইবনে রুশদের ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’ দ্বারা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তালিবে ইলমদের সামনে শাহ ছাহেব রাহ.-এর নিম্নোক্ত নসীহত বিদ্যমান থাকা উচিত।
يجب على الفقيه أن يشتغل بالقرآن والحديث، ليكونا بمرأى عينيه، ومن لم يشتغل بالحديث فإنه لا يحصل له علم بكثير من المسائل التي تتعرض لها الأحاديث، ولم يتعرض لها الفقهاء، وذلك لعدم كونها من موضوع فنهم. وقد مر مني التنبيه أن التقليد لا يكون مستحكما إلا بعد النظر في الحديث، وكذا الحديث لا يستقر مرادُه إلا بعد النظر في أقوال السلف، فليجمع بين الأمرين. (من فيض الباري 2/451)
আল্লাহ তাআলা যদি তাওফীক দান করেন তাহলে একটি বিস্তারিত নিবন্ধে শাহ ছাহেবের এই নসীহতের ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
وما توفيقي إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنبي.
তাহকীকের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাহকীকে মগ্ন না হয়ে কোনো বড় মুহাক্কিকের তাকলীদ করাতে দোষের কিছু নেই। মুসান্নাফে ইবনে শাইবা এ বিষয়ের স্পষ্ট প্রমাণ যে, সালাফের মধ্যে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। এরপরও কিছু লোক এর নিন্দা করে থাকে। প্রশ্ন এই যে, বিভিন্ন অনুবাদের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনকারী লোকেরা এই অসম্পূর্ণ ইলমের ভিত্তিতেই যদি ‘ফিকহে মুকারান’ চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং তাহকীক-গবেষণায় নেমে পড়ে তবে কি তা খুব উত্তম বিষয় হবে? তখন কি وَتَكَلَّمَ الرُّوَيْبِضَةُ এর বাস্তব দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে না? অথচ এ বিষয়ে তাদেরকে আপত্তি করতে দেখা যায় না।
আরবের এক আলিম আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ড. ইউসুফ কারযাভী সাহেবের ব্যাপারে তোমার মত কী? আমি বলেছিলাম, তাঁর ইলমী মকাম তো তার রচিত কিতাবাদি থেকেই বোঝা যায়, তবে জ্ঞান-গবেষণার বিষয়ে সর্বদা তিনি ‘আবদ্ধতা’র নিন্দা করে থাকেন এবং এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে তার মধ্যে একটু বেশি পরিমাণে ‘উত্তাপ’ সৃষ্টি হয়ে যায়, কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার যে ফিৎনা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে এ বিষয়ে তাঁকে আজ পর্যন্ত কিছুই লিখতে দেখিনি। যেন এটা কোনো ফিৎনাই নয়। অথচ এটা আবদ্ধতার চেয়েও অধিক মারাত্মক ফিৎনা।
পাঠকবৃন্দের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন আলকাউসারের সূচনা-সংখ্যায় প্রকাশিত নিবন্ধ-‘গবেষণা : অধিকার ও নীতিমালা’ অবশ্যই মুতালাআ করেন।
(৯) ‘মুসান্নাফ শুধু হাদীস ও আছার-এর গ্রন্থই নয়, এতে সীরাতে নববী এবং ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাসেরও প্রচুর তথ্য সংকলিত হয়েছে।
(১০) ইতোপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ গ্রন্থটি হাদীসগ্রন্থ হওয়ার পাশাপাশি ফিকহুস সালাফেরও উত্তম সংকলন। কেউ যদি দৃষ্টির সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টি যোগ করে এ কিতাব অধ্যয়ন করে তাহলে এখান থেকে ব্যাপক অর্থেই ফিকহুস সালাফের অনেক বড় সংগ্রহ হাসিল করতে পারবে। এ গ্রন্থে ফতোয়া বিভাগের তালিবে ইলমগণ ফকীহ হওয়া ও ফকীহ বানানো, ফতোয়া প্রার্থনা ও ফতোয়া প্রদান, রেওয়ায়েত ও দেরায়েত, মাসাইল আহরণ ও উদঘাটন-এসকল বিষয়ে সালাফে সালেহীনের নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
উলূমুল হাদীসের তালিবে ইলমগণ এ গ্রন্থ থেকে হাদীস গ্রহণের আদব-কায়েদা, হাদীস বর্ণনাকারীর নীতি ও চরিত্র, এবং রেওয়ায়েতের পরীক্ষা ও পর্যালোচনা, হাদীস শরীফের সঠিক মর্ম অনুধাবন ও ইলমু আসমাইর রিজাল বিষয়ক অনেক মৌলিক নীতি ও প্রয়োজনীয় বিষয় আহরণ করতে পারবেন।
আর সব ধরনের তালিবে ইলম এ গ্রন্থ থেকে আদাবুল মু’আশারা, আখলাকে জাহেরা ও আখলাকে বাতেনা অর্থাৎ সমাজবদ্ধ জীবন-যাপনের ইসলামী পদ্ধতি, উত্তম আচার-ব্যবহার এবং অর্মতজগতের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি সম্পর্কে সালাফের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অনেক দৃষ্টান্ত আহরণ করবেন পারেন, যা আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে একান্ত সম্পর্কযুক্ত।
এই বিষয়গুলোর প্রয়োজন ইলমের দ্বীনে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদেরই সবচেয়ে বেশি, অথচ তাঁদের মধ্যেই এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
(১১) সীরাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সীরাতে খোলাফায়ে রাশেদীন, আছারে সাহাবা এবং নবী ও সাহাবা-যুগের কর্মধারা যা এই কিতাবে সংকলিত হয়েছে এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে দ্বীনের প্রকৃত চিন্তাধারা এবং দ্বীনের স্বভাব ও প্রকৃতি। দ্বীনের সঠিক প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য এগুলো অনুধাবন করা অপরিহার্য। আলোচ্য গ্রন্থ থেকে এ সকল বিষয়ে ধারণা অর্জন করা তুলনামূলক সহজ।
(১২) তালিবে ইলমগণ এ গ্রন্থের মুহাক্কিক শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ-এর টীকা ও ভূমিকাগুলো থেকে অনেক কিছু অর্জন করতে পারেন। বিশেষত উলূমুল হাদীসের তালিবে ইলমগণ তাঁর টীকাগুলো থেকে ‘ইলমুত তাখরীজ’, ‘ইলমুল জারহি ওয়াত তা’দীল’, ‘ইলমু ইলালিল হাদীস’, ‘ইলমুল ইসনাদ’ প্রভৃতি বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শাণিতকারী বহু তথ্য ও তত্ত্ব আহরণ করতে পারেন।
উপরের শ্রেণীর তালিবে ইলমগণ এই টীকাগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তাহকীক-গবেষণার রুচি তৈরি করতে পারেন।
তাছাড়া কিছু ‘শায’ বক্তব্য এবং ‘জয়ীফ’ কিংবা ‘মুনকার’ রেওয়ায়েত, যা এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে, সেগুলোও যেহেতু টীকায় চিহ্নিত করা হয়েছে তাই এ বিষয়ে সবাই এই টীকাগুলোর সহযোগিতা পেতে পারেন।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হিম্মতওয়ালা তালিবে ইলমরা এই কিতাবের তাহকীক-তা’লীক থেকে অর্জন করতে পারেন যদি তারা ইচ্ছা করেন। তা হল ‘তাহকীকুত তুরাছ’ শাস্ত্র। আলকাউসার রজব ’২৮, আগষ্ট ’০৭ সংখ্যায় ‘তাহকীকুত তুরাছ’ বিষয়ে একটি সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছিল। এই শাস্ত্রের সঙ্গে যাদের পূর্বপরিচিতি নেই তারা ওই আলোচনা থেকে এ বিষয়ের গুরুত্ব ও নাযুকতা এবং এর সুকঠিনতা অনুমান করতে পারেন।
‘মুসান্নাফে’র উপর শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ-এর এই কাজ তাহকীকুত তুরাছের উন্নত, উত্তম ও মনোরম দৃষ্টান্ত। যদি কেউ একে নমুনা হিসেবে গ্রহণ করে তবে এ শাস্ত্রে প্রজ্ঞা হাসিল করা তার পক্ষে সম্ভব হবে।
পাঠকদের কাছে দুআর দরখাস্ত যে, মারকাযুদ দাওয়াহ-এর ‘তাহকীকুত তুরাছ’ বিভাগের জন্য আল্লাহ তাআলা যেন প্রশস্ত জায়গা দান করেন এবং জরুরি ব্যয় ও উপকরণের ব্যবস্থা করে দেন। যাতে এ বিভাগের কাজ গতিশীল করা সম্ভব হয়।
তালিবে ইলমদের কাছে আবেদন
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. (১৩৩৬ হি.-১৪১৭ হি.) বলতেন-
الكتاب إذا لم تقرأه كله لم يعطك سره
কোনো গ্রন্থ যে পর্যন্ত আদ্যোপান্ত না পড়বে সে তোমাকে তার মনের কথা বলবে না।
আজকাল আদ্যোপান্ত অধ্যয়নের রীতি প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গিয়েছে। হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.) কে দেখেছি, তিনি অনেক বড় বড় গ্রন্থ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করতেন এবং তথ্য নোট করতেন। অন্তত প্রয়োজনীয় তথ্যের তালিকা প্রস্ত্তত করে ফেলতেন। আরবের কোনো কোনো নওজোয়ানকে পঞ্চাশ-ষাট খন্ডের সুবৃহৎ গ্রন্থও আদ্যোপান্ত পাঠ করতে দেখেছি।
যদি প্রয়োজনীয় সকল গ্রন্থ সম্পূর্ণ পাঠ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নাও হয় তবে কি অধিক গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ-দশটি গ্রন্থ এভাবে পাঠ করা সম্ভব নয়? কত ভালো হত যদি আমাদের সকল তালিবে ইলম, অন্তত কিছু সাহসী তালিবে ইলম, এই হিম্মত করত যে, প্রতিদিন অল্প অল্প অধ্যয়নের মাধ্যমে একুশ খন্ডের এই ‘মুসান্নাফ’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলবে। নিঃসন্দেহে এটা হত তাদের ইলমী জীবনের অনেক বড় পাথেয়, নিজের অজান্তেই চিন্তাগত, চরিত্রগত ও কর্মগত এত উন্নতি তাদের হত যা অনুমান করাও দুঃসাধ্য।
আর কেউ কি আছে হিম্মতকারী??
কিছু ফায়েদা :
সবশেষে কিতাব থেকে কিছু দুআ ও জ্ঞানগর্ভ বাণী উল্লেখ করে দিচ্ছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন।
اَللّهُمَّ ارْزُقْنِيْ حُبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يَنْفَعُنِيْ حُبُّهُ عِنْدَكَ، اَللّهُمَّ وَارْزُقْنِيْ مِمَّا أُحِبُّ وَاجْعَلْهُ قُوَّةً لِيْ فِيْمَا تُحِبُّ، وَمَا زَوَيْتَ عَنِّيْ مِمَّا أُحِبُّ فَاجْعَلْهُ فَرَاغًا لِيْ فِيْمَا تُحِبُّ. (15/302)
বান্দার জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ বিষয় এই যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সে তার পসন্দনীয় বস্ত্ত লাভ করবে কিন্তু তা ব্যবহার করবে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্টির ক্ষেত্রে । কিংবা পসন্দের বিষয়টি লাভ করল না বলে এত পেরেশান হয়ে যাবে যে, জরুরি ইবাদত ও কাজকর্মেও বিঘ্ন ঘটতে থাকবে।
উপরোক্ত দুআয় উল্লেখিত দুই বিষয় থেকেই নিরাপদ থাকার উপাদান রয়েছে। এই দুআয় প্রার্থনা করা হয়েছে, ইয়া আল্লাহ, আমাকে আমার পসন্দনীয় বস্ত্ত দান করুন, তবে এর মাধ্যমে আপনার পসন্দনীয় কাজ করার শক্তি দান করুন। আর যদি আমার পসন্দের কোনো বিষয় আপনি আমাকে দান না করেন তাহলে এটা আমার জন্য নিশ্চিন্ততার কারণ বানিয়ে দিন। যাতে আমি একাগ্রতার সঙ্গে আপনার ইবাদত করতে পারি।
اَللّهُمَّ اشْفِنِيْ مِنَ النَّوْمِ بِيَسِيْرٍ، وَارْزُقْنِيْ سَهَرًا فِيْ طَاعَتِكَ. (15/302)
‘ইয়া আল্লাহ, সামান্য ঘুম দ্বারাই আমার প্রয়োজন পূরণ করুন এবং আপনার আদেশ পালনে রাত্রিজাগরণের তাওফীক দিন।’
সুস্থতা ও কর্মক্ষমতা রক্ষা করার জন্য ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে। তবে আল্লাহ যদি চান তাহলে তিন চার ঘন্টার ঘুমেও আট ঘন্টার সুফল দান করতে পারেন। যাতে তাহাজ্জুদ ও তেলাওয়াত এবং অধিক মুতালাআর সুযোগ পাওয়া যায়। বুযুর্গ তাবেয়ী হাম্মাম ইবনুল হারিছ ও মি’যাদ এই দুআ করতেন এবং নামকেওয়াস্তে সামান্য ঘুমিয়ে রাতভর তাহাজ্জুদ পড়তেন।
عن هلال بن يساف قال : لَيْسَ بَأَسَرَّ لِلْمُؤْمِنِ مِنْ أَنْ يَّخْلُوَ وَحْدَهُ. (19/501)
‘মু’মিননের জন্য নির্জনতার চেয়ে অধিক আনন্দের বিষয় আর নেই।’
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার আলোচনায় বারবার মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক-এর কথা এসেছে। ইচ্ছা হচ্ছে ওখান থেকেও একটি কথা উল্লেখ করি।
عن صالح بن كيسان قال : اجتمعت أنا وابن شهاب (الزهري) ونحن نطلب العلم، فاجمتعنا على أن نكتب السنن، فكتبنا كل شيء سمعناه عن النبي صلى الله عليه وسلم، ثم قلنا : نكتب أيضا ما جاء عن أصحابه، فقلت : لا، ليس بسنة، وقال هو : بلى، هو سنة، فكتب ولم أكتب، فأنجح وضَيَّعتُ.
ছালেহ ইবনে কায়সান বলেন, ‘ইলম অন্বেষণে আমি ও ইবনে শিহাব (যুহরী) একত্র হলাম। আমরা ‘সুনান’ লিপিবদ্ধ করতে একমত হলাম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ও কর্ম যা কিছু শ্রবণ করার সুযোগ হল লিপিবদ্ধ করলাম। এরপর আলোচনা হল যে, সাহাবীদের বাণী ও কর্ম লিপিবদ্ধ করব কি না। আমি বললাম, ‘না, এটা সুন্নাহ নয়।’ আর তিনি বললেন ‘কেন নয়, এগুলোও সুন্নাহ।’ তো তিনি লিখলেন, আমি লিখলাম না। ফলে তিনি সফল হলেন আর আমি বঞ্চিত রইলাম। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ১১/২৫৮; শরহুস সুন্না্হ বগভী ১/২৯৬; আছারুল হাদীস, ড. খালিদ মাহমূদ ১/১০৯)
ছালেহ ইবনে কায়সান যে চিন্তার কারণে পরে দুঃখ করেছেন, সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাবে আজ জামেয়াসমূহের বহু ফাযেল এই একই চিন্তাধারায় প্রভাবিত। অথচ খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহকে সুন্নাহ বলা হাদীস থেকেই প্রমাণিত।
হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে সংকলিত অধিকাংশ হাদীসগ্রন্থে; বরং পরবর্তী যুগেরও বহু সংকলনে হাদীস শরীফের পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের বাণী, ফতোয়া, আমল ও তাবেয়ীগণের ফতোয়া সংকলিত হয়েছে। এর অর্ন্তনিহিত কারণও এটাই।
উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নু’মানী রাহ. তাঁর তাজদীদী কিতাব-‘ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস’ (পৃষ্ঠা ৪৬) লেখেন, এ কিতাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এই যে, এ কিতাবে হাদীসে নববীর পাশাপাশি সাহাবা ও তাবেয়ীনের বাণী ও ফতোয়া সংকলিত হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় সুফল এই যে, প্রত্যেক হাদীসের সঙ্গে এটাও জানা হয়ে যায় যে, সালাফের কাছে এই বর্ণনার গ্রহণযোগ্যতা কীরূপ ছিল এবং সাহাবা-যুগ থেকে এই রেওয়ায়েত মোতাবেক আমল হয়েছে কি না। এটা এই গ্রন্থের এমন এক বৈশিষ্ট্য, যে বৈশিষ্ট্যে (এরূপ বিশদ ও বিস্তৃত আকারে) তার কোনো নযীর নেই। (মুসান্নাফে বাকী ইবনে মাখলাদের বিষয় ভিন্ন, কেননা বর্তমানে তা নিখোঁজ পান্ডুলিপির তালিকাভুক্ত) আর এ জন্যই এ গ্রন্থ ফকীহ মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সর্বদা সমাদৃত ছিল। হাদীস ও ফিকহের যেসব ব্যাখ্যাগ্রন্থে বিধান বিষয়ক হাদীস সম্পর্কে আলোচনা থাকে সেগুলোর মধ্যে এমন গ্রন্থ পাওয়া দুষ্কর হবে যাতে এই কিতাবের উদ্ধৃতি ও এ কিতাবের হাদীস সম্পর্কে আলোচনা নেই।’
এ কিতাবের প্রথম যে বৈশিষ্ট্যের কথা হযরত উল্লেখ করেছেন তা তালিবে ইলমগণ তাঁর কিতাব ‘ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস’ পৃষ্ঠা ৪৬-এ পড়ে নিতে পারেন।
سبحان ربك رب العزة عما يصفون، وسلام على المرسلين، والحمد لله رب العالمين.
(অনুবাদে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ)
* وتأمل جيدا أن هناك حديثين : أحدهما في رفع اليدين في الركوع، وأخرى في ترك رفع اليدين في غير الافتتاح، عمل بأحدهما عبد الله بن عمر وجماعة، وعمل بالآخر عمر بن الخطاب وجماعة، ثم لما ألف البخاري صحيحه أدخل فيه الحديث الأول، ولم يدخل فيه الحديث الثاني، فهل نقول : أن حديث ترك الرفع ضعيف، أم مرجوح، أم أن ترك الرفع خلاف السنة؟! إذًا جهلت عمر ومن معه، ولا بأس عليك أن ترجِّح الرفع، ولكن إذا رجحته لأن حديثه دخل في صحيح البخاري، فقد أعلنت أن الرفع كان مرجوحا قبل ذلك، فالاختلاف القديم لا ينبغي أن تذكر فيها وجوه الترجيح الحادثة، سواء ذكرت في الأرجحية أم في المرجوحية.