এক মহিয়সী মুমিনার শেষ সফর
[লক্ষ্ণৌ নদওয়াতুল ওলামার সম্মানিত উস্তায ও প্রখ্যাত আদীব, গবেষক আলেম মাওলানা নজরুল হাফিয নদবীর সম্মানিতা মাতা ইন্তেকাল হয়েছিল ১৪ সেপ্টেম্বর-০৩ রবিবার বাদ নামাযে ফজর ইন্তেকাল করেন।
উর্দু মাসিক ‘বাঙ্গে হেরা’ কর্তৃপক্ষের আবেদনে সে সময় মাওলানা নজরুল হাফিয নদবী তার মায়ের জীবন থেকে হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষণীয় কিছু বিষয় তুলে ধরেছিলেন। এ প্রজন্মের নারীদের জন্য এই মহিয়সীর জীবন শিক্ষণীয় হবে মনে করে আল কাউসার-এর পাতায় তার অনুবাদ পেশ করা হল।]
আম্মা আমাকে বলতেন, ‘বেটা! তুমি কতদিন যাবত আমার দীর্ঘ জীবনের জন্য দুআ করে আসছ, আমি অনেক দিন যিন্দা থেকেছি, এখন আমাকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দাও।’
আমি বলতাম- আম্মা! আমিতো স্বার্থবাদী! আমি একারণে দুআ করি যে, আপনার অস্তিত্ব আমাদের জন্য খায়র ও বরকতের কারণ হোক। কেননা আপনি যতদিন পর্যন্ত জীবিত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত আমাদের জন্য দুআ করতে থাকবেন।
অবশ্য অবশেষে তাই হল যা তার তামান্না ছিল। আমাদের সকলের আশা ও বাসনা সত্ত্বেও তিনি আমাদের ছেড়ে পরকালের পথে যাত্রা করলেন এভাবে যে, আমি বদনসীব তার আখেরী খেদমত থেকেও বঞ্চিত থাকলাম।
১৪ সেপ্টেম্বর রবিবার আম্মাজান নিয়ম মাফিক ফজর নামায আদায় করে দীর্ঘক্ষণ দুআ করেন। এরপর তিনি চেয়ারে বসেন। এসময়ে তার সামনে চা বিস্কুট হাজির করা হয়। ঘরের সাতটি বাচ্চা তাকে কেন্দ্র করে জমায়েত হয়। তিনি প্রত্যেককে বিস্কুট ভাগ করে দেন এবং নিজেও চা ও দুধের সাথে দুটি বিস্কুট নেন। তিনটি বিস্কুট রেখে দিয়ে বলেন, আল্লাহ চাহে তো আগামীকাল খাওয়া যাবে। একথা বলার সময়ই তার শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে। তিনি পানি তলব করেন। আমার বড় মেয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল। সে কাউকে ডাক্তার ডাকতে বলে। আমার আম্মা তার কথা শুনে বলেন- ডাক্তার ডেক না, আমি আর বেশি সময় বেঁচে থাকব না। সে সময় তার চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায়। তিনি নিজেই বিছানার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েন। চোখ বন্ধ করে ফেলেন এবং যেভাবে শুতে চাইতেন সেভাবে শুয়ে হাত সোজা করে নেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
এই মর্মন্তুদ ঘটনা সকাল ছ’টা বেজে চল্লিশ মিনিটে এত অপ্রত্যাশিতভাবে সংঘটিত হয় যে, যেই তার মৃত্যু সংবাদ শুনছিল সেই স্বভাবগত কৌতূহলে বলছিল, তিনি কি অসুস্থ ছিলেন? আমি অভাগা তখন শত শত মাইল দূরে লক্ষ্ণৌতে অবস্থান করছিলাম। সকাল সাতটায় যখন আমার কাছে এই সংবাদ পৌঁছল তখন আমি একারণে খবরটি বিশ্বাস করলাম যে, তিনি কয়েকবার আমাকে বলেছিলেন যে, আমি হাঁটাচলা করতে করতেই এক সময় দুনিয়া থেকে বিদায় নেব। বাড়ি থাকতে তিনি কয়েকবার বলেছেন- আমার উভয় ছেলেই লক্ষ্ণৌতে থাকে। এ রকম অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয়ে যায় তাহলে যেন কাফন-দাফন ও জানাযার নামাযে বিলম্ব না করা হয়, কেননা এটা গুনাহ। যখন দ্বিতীয়বার টেলিফোন আসল তখন মনের ওপর চাপ দিয়েই আমি দাফনের অনুমতি দিলাম। দ্বিতীয় দিন যখন কবরে হাজির হলাম তখন আত্ননিয়ন্ত্রণের সকল বাধ ভেঙ্গে গেল। একথা স্বরণ হয়ে অজস্র ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল যা তিনি অসিয়ত স্বরূপ বলেছিলেন- ‘বেটা! যখন লোকেরা আমাকে দাফন করে দূরে চলে আসবে তখন তুমি কবরের কাছে বসে ততক্ষণ পর্যন্ত সুরা ইয়াছিন তিলাওয়াত করবে যতক্ষণ পর্যন্ত কবরে আমার সওয়াল-জওয়াব শেষ না হবে। তোমার উপস্থিতি এবং দুআর কারণে আমার মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হবে।’ কিন্তু এত বড় দৌলত আমার হাত ছাড়া হয়ে যাবে তার কল্পনাও ছিল না।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতেই হবে। তবে কারও মৃত্যু হয় সুন্দর আর কারও মৃত্যু হয় তিক্ত। আম্মার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এজন্য এ লেখাটি লেখা হচ্ছে না যে, তিনি আমার মা এবং আমি তার দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম এবং তার ব্যক্তিত্বকে অনুকরণীয় মনে করছি। যদিও এটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং আরবী প্রবাদ বাক্যও এরকম- ‘প্রতিটি বাচ্চা তার জনকের প্রতি দুর্বল থাকে’।
এই লেখাটি এজন্য লেখা হচ্ছে যে, এটা আল্লাহর এক নেক বান্দীর আলোচনা এবং আল্লাহর নেক বান্দা/বান্দীর আলোচনা পাঠ করলে লাভবান হওয়া যায়। তাছাড়া এ আলোচনা একারণেও করা দরকার যে, এটা ঐ প্রজন্মের মানুষের আলোচনা যে প্রজন্মের ধারা এখন শেষ হতে চলেছে এবং বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে এসব গুণাবলী বিরল ও দুর্লভ হতে চলেছে। নিঃসন্দেহে নতুন প্রজন্মের জন্য এ জীবনে রয়েছে কিছু সবক।
দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী ধরে রাতদিন আমি আমার মাকে যেভাবে জীবন যাপন করতে দেখেছি তার এক ঝলক পাঠকদের সামনে পেশ করব মাত্র। হয়ত এতে কেউ লাভবান হবেন এবং আম্মার জন্য দুআর হাদিয়ার ব্যবস্থা হবে।
আমার মায়ের বয়স ৮৫ পেরিয়ে গিয়েছিল। শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি নিজেই নিজের কাজগুলো আঞ্জাম দিতেন। অথচ তার নাতী-নাতনীরা সব সময় তার খেদমত করার জন্য মুখিয়ে থাকত। যে আরাম ও প্রশান্তির সাথে আমার মা মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়েছেন এতে তার সারা জীবনের নেক আমলের ঝলক পরিলক্ষিত হয়। সারা যিন্দেগী তিনি নামায আদায় ও কুরআন তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকতেন। খেদমতে খলক এবং শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা ও তারবিয়াত দানে তিনি সবার আদর্শে পরিণত হয়েছেন।
আমার মা একটি দ্বীনদার ঘরানায় চোখ মেলেন। তার পিতা (আমাদের নানা) মোল্লা সিরাজুদ্দিন হযরত থানবী রহ. এর হাতে বাইয়াত হয়েছিলেন এবং মোল্লা কারী নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। আমাদের পিতা মাওলানা ক্বারী আব্দুল হাফিয সাহেব রহ. বাইআত হয়েছিলেন হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আহমদ সাহেব প্রতাপগড়ী রাহ. এর হাতে এবং তার খেলাফতপ্রাপ্ত ছিলেন। আমার আম্মাজানও হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আহমদ ছাহেব রাহ. এর কাছে বাইআত ছিলেন।
তার বাল্যশিক্ষা হয়েছিল ইসমাঈল মিরাঠীর কিতাব পর্যন্ত। এরপর তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুতালাআ করেন। আমাদের বসতি মলমলের মহিলারা ‘ইসলাহে নিসওয়ান’ নামে একটি আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার মা ও সেই আঞ্জুমানের বানীদের একজন ছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবারে গুরুত্বের সাথে ঐ ইসলাহী জলসায় শরীক হতেন। ঐ আঞ্জুমানের একটি লাইব্রেরিও ছিল। সেখান থেকে তিনি ঐতিহাসিক এবং সামাজিক ঘটনাবলি ও উপন্যাসের বই সংগ্রহ করে তা পাঠ করতেন। রাশেদ আলখায়েরী এবং ডেপুটি নযীর আহমদের কিতাব তিনি অনেক বার পাঠ করেছেন। হযরত থানবী রহ. এর ‘বেহেশতি যেওর’ শুধু তার অধ্যয়নেই শামিল ছিল না বরং অনেক মেয়েকে তিনি এটা পড়িয়েছেন। এই কিতাবটি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার শিয়রের পাশে ছিল।
যতদিন পর্যন্ত সুস্থ ও শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন ততদিন পর্যন্ত প্রত্যেক জুমআয় সালাতুত তাছবীহ আদায় করতেন এবং নিয়মিত সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করতেন। পরবর্তীতে দুর্বলতার কারণে জুমআর পরিবর্তে প্রতি রমযানের প্রতি জুমআয় এই নামায আদায় করতেন। এ দিনে বিশেষ গুরূত্বের সাথে এক হাজার বার দরুদে ইবরাহীম পাঠ করতেন। ঘরে বাচ্চাদেরকেও হেদায়াত করতেন সংক্ষিপ্ত দরুদ শরীফগুলো নিয়মিত পাঠ করার জন্য। বাল্যকাল থেকেই অভ্যাস ছিল শোয়ার আগে সূরা মুলক, সূরা সিজদা, সূরা ইয়াছিন তিলাওয়াত করার। ফজরের নামায আদায়ান্তে তিলাওয়াত সমাপ্ত করার পর হযরত শাইখুল হিন্দের তরজমাকৃত কুরআন তরজমা দেখতেন। রমযানুল মুবারকে প্রতিদিন চার-পাঁচ পারা করে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করতেন অত্যন্ত দরদ ও মহববতের সাথে। সহীহ মাখরাজের সাথে তিলাওয়াতের প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন। আমার পিতাকে তিনি দুইবার তিলাওয়াত করে শুনিয়েছেন। কিন্তু এরপরেও তিনি স্বস্তি না পেয়ে স্বীয় হাফেয নাতী মুয়াজ্জমকে পুনরায় তিলাওয়াত করে শোনান। কখনও কখনও আমাদেরকেও কোনো কোনো আয়াত সহীহ মাখরাজের সাথে তিলাওয়াত করে শোনাতেন।
এছাড়া সূরা আররহমান, সূরা ক্বাফ ইত্যাদিও তার মুখস্থ ছিল। নামাযে তিনি লম্বা লম্বা সূরা পাঠ করতেন। ইশার নামাযে তার পুরো এক ঘণ্টা ব্যয় হত। নামাযের পর দীর্ঘ সময় ধরে দুআ করার অভ্যস ছিল। মাছূর দুআ এবং মুনাজাতে মাকবুলের প্রতি বিশেষ যত্ন দিতেন। নিয়মিত দরুদ শরীফ এবং অন্যান্য তাসবীহ তাহলীল বিশেষ গুরুত্বের সাথে আদায় করতেন।
যিকির, তিলাওয়াত ও নামাযের পর তার আগ্রহ ও রুচির কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুর্বল, নিঃস্ব ও অসহায় লোকজনের খোঁজখবর নেওয়া। অসুস্থদের শুশ্রুষা এবং মৃতদের জন্য শোক ও সমবেদনা প্রকাশেও গুরুত্ব দিতেন। চলাফেরার উপযুক্ত যতদিন ছিলেন ছওয়াব মনে করে এ কাজ নিজেই করতেন। শ্বাসকষ্ট ও দুর্বলতার কারণে যখন চলাফেরার শক্তি কমে গেল তখনও শুশ্রুষা ও শোক-সহানুভূতির জন্য নিজের নাতিকে পাঠিয়ে দিতেন।
আমরা বাল্যকাল থেকেই মাকে দেখেছি, তিনি অভাবীদেরকে সাহায্য করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকতেন। তাদেরকে খাদ্য, কাপড় ও নগদ টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। খানার সময় হলে ক্ষুধার্তদের অত্যন্ত সম্মানের সাথে খানা খেতে দিতেন। সামাজিক দায়িত্ব
পালনে তিনি ছিলেন খুবই যত্নবান। যখনই সমাজের পক্ষ থেকে কিংবা মুসলিম জামাতের পক্ষ থেকে কোনো বিপদ-আপদে অথবা মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য কিংবা কোনো অসুস্থ বা অভাবী লোকের জন্য চাঁদা চাওয়া হত তখন তিনি তাতে সবার আগে থাকতেন।
ঘরের লোকদের তিনি নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, কোনো ব্যক্তি করজ চাইলে অবশ্যই তাকে করজ
দিতে হবে কিন্তু করজ আদায়ের জন্য চাপাচাপি করা যাবে না। যদি স্বেচ্ছায় কেউ আদায় করে দেয় তাহলে তা গ্রহণ করে নিবে। কোনো অভাবী কিংবা হাজতমন্দকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া আমার মায়ের অভ্যাসে ছিল না।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
অনুবাদ- আবু বকর সিরাজী