অপরাধীদের নিষ্ফল আর্তনাদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
জাহান্নামে নিক্ষেপ করার পর প্রত্যেক অপরাধী দুঃখে, বেদনায় নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে থাকবে। আর দুঃসহ মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়ে বলতে থাকবে, হায়! আমি যদি রাসূলের সঙ্গে সৎ পথ অবলম্বন করতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। সেই দুর্ভাগা তো আমাকে আমার নিকট উপদেশ আসার পরও বিভ্রান্ত করেছে। -সূরা ফুরকান ২৭-২৯
অপরাধী জাহান্নামীরা যাদের প্ররোচনায় ও কুমন্ত্রণায় পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হল, একপর্যায়ে তাদের প্রতি ক্রোধোন্মত্ত হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করবে-
وَ قَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا رَبَّنَاۤ اَرِنَا الَّذَیْنِ اَضَلّٰنَا مِنَ الْجِنِّ وَ الْاِنْسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ اَقْدَامِنَا لِیَكُوْنَا مِنَ الْاَسْفَلِیْنَ۲۹
‘হে আমাদের প্রতিপালক! যে সব জিন ও মানব আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদের উভয়কে দেখিয়ে দাও। আমরা উভয়কে পদদলিত করব, যাতে তারা লাঞ্ছিত হয়।’- সূরা হা-মীম সাজদা ২৯
অপরাধীদের পথভ্রষ্টকারী নেতৃস্থানীয় জিন ও মানুষেরা যদিও ইতোপূর্বেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তবে জাহান্নাম এক বিশাল স্থান হওয়ার কারণে এরা ওই নেতাদেরকে দেখার আকাঙ্খা করবে। যদিও মন্দ কর্মে অগ্রগামী প্রধান কাফেররা পূর্ব থেকেই লাঞ্ছনা ও অপমানে যুক্ত হবে, এরপরও অনুগামীরা তাদেরকে অতিরিক্ত লাঞ্ছিত এইভাবে করতে চাবে যে, নিজেদের পদতলে ওদেরকে পিষ্ট করার প্রার্থনা করবে। কারণ এদেরকেই তারা দুনিয়ায় নিজেদের নেতা, সর্দার ও অনুসরণীয় জ্ঞান করত।-মাআরেফুল কুরআন (মাও. ইদরীস কান্দলভী) ৭/২০৩
এহেন ভীতিপ্রদ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে অপরাধকর্মের মূল হোতা অভিশপ্ত শয়তান কারো কোনো উপকার করতে সক্ষম হবে না। এমন কি সে নিজেরও বিন্দু পরিমাণ উপকার সাধন করতে পারবে না। সে তার নিষ্ঠুর পরিণতি অসহায় অবস্থায় গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। আর তার অনুগামীদের ব্যাপারে সে তার মজ্জাগত মহাপ্রতারণাসুলভ কথা বলবে।-সূরা ফুরকান ২৯
সে বলবে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম (যে, কেয়ামত হবে না এবং হিসাবও দিতে হবে না), কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। তোমাদের উপর তো আমার কোনো আধিপত্য ছিল না। আমি কেবল তোমাদেরকে আহবান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না, তোমরা নিজেদের প্রতিই দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।-সূরা ইবরাহীম ২২
মুমিনগণ জান্নাত লাভের এবং অপরাধীরা জাহান্নামে পোঁছার পর সকল জাহান্নামী একত্র হয়ে শয়তানকে অভিশাপ দিতে থাকবে। অভিশপ্ত শয়তান তখন আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলবে, আমার প্রতি অভিসম্পাতকারী হে দুর্ভাগারা! আল্লাহ তাআলা তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, কেয়ামত, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান, হিসাব ও কর্মফল প্রদান সত্য, আর যে এগুলো অস্বীকার করবে সে ধ্বংস হবে এবং যে বিশ্বাস করে সৎকর্ম করবে সে সফল হবে, আল্লাহর এ সত্য প্রতিশ্রুতি তোমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছ। আর আমি তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, এই জীবনের পর আর কোনো জীবন নেই এবং এ জীবনের কোনো হিসাব-কিতাব হবে না। আমার প্রতিশ্রুতি আজ পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণিত হল। তোমরা আমাকে আজ ভৎর্সনা করছ কেন? তোমাদের উপর তো আমার কোনো আধিপত্য ছিল না এবং তোমাদেরকে আমি জবরদস্তিমূলক আমার আনুগত্যে বাধ্য করিনি। তোমরা আমার নির্দেশনা অমান্য করলে আমি তোমাদের কী করতে পারতাম? তোমরা ভোগের বশবর্তী হয়ে আমার হুকুম মান্য করেছ। এখন তার শাস্তি আস্বাদন কর। সে আরও বলবে, তোমাদেরকে আমার হুকুম পালনে বাধ্য করার উপযোগী কোনো শক্তি-সামর্থ্য আমার ছিল না, কোনো দলীল-প্রমাণও ছিল না। আমি নিছক কুমন্ত্রণার মাধ্যমে জাগতিক ক্ষণস্থায়ী আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসিতার উপকরণ তোমাদের দৃষ্টিপথে আহৃত করেছি। তোমরা অপদার্থরা সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রলোভনে সাড়া দিয়েছ। অথচ নবী-রাসূলগণ বিভিন্ন প্রকার দলীল-প্রমাণ ও সুস্পষ্ট নিদর্শন তোমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করেছেন। তোমরা তাদের কথায় কর্ণপাত করনি। এখন তোমাদের এই নিকৃষ্ট পরিণাম হয়েছে। সুতরাং তোমরা আমাকে তিরষ্কার না করে নিজেদেরকে কর। আমার পক্ষ থেকে তো শুধু প্রলোভন ছিল, শাস্তির মূল কারণ অপরাধ-তো তোমরা স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে সংঘটিত করেছ। অতএব আজ আমি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারব না, তোমরাও আমার কোনোরূপ উপকার করতে পারবে না। -মাআরিফুল কুরআন ৪/২৫২
অভিশপ্ত শয়তানের এরূপ নৈরাশ্যপূর্ণ উত্তর শ্রবণ করে অপরাধীদের প্রচন্ড মর্মজ্বালা উৎপাদিত হবে। তারা অতিশয় হয়রান-পেরেশান হয়ে জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমাদের থেকে একদিনের শাস্তি লাঘব করেন। উত্তরে প্রহরীগণ বলবেন, তোমাদের নিকট কি স্পষ্ট নিদর্শনসহ আল্লাহর রাসূলগণ আগমন করেননি? এবং জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষার পথ বাতলে দেননি? অপরাধীরা বলবে, অবশ্যই এসেছিলেন। তবে আমরা তাদের কথা মান্য করিনি। প্রহরী ফেরেশতাগণ তখন বলবেন, তাহলে আমরা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করতে পারব না। তোমরাই কর, আর তাদের তখনকার প্রার্থনা কোনো কাজে আসবে না; বরং শুধু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।-সূরা মুমিন ৫০
অপরাধীরা দুঃখে, বেদনায় ও অনুশোচনায় ক্রোধোন্মত্ত হয়ে নিজেদের অঙুলি দংশন করতে থাকবে। এ সময় তাদেরকে উচ্চ কণ্ঠে বলা হবে, এখন নিজেদের প্রতি তোমাদের যে ক্ষোভ, তদপেক্ষা পৃথিবীতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অপ্রসন্নতা ছিল অধিক-যখন তোমাদেরকে ঈমানের প্রতি আহবান করা হয়েছিল আর তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলে। তখন তাদের দুঃখ, যাতনা ও মনস্তাপ আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তারা নিরতিশয় বেদনাক্লিষ্ট হয়ে বলবে-
قَالُوْا رَبَّنَاۤ اَمَتَّنَا اثْنَتَیْنِ وَ اَحْیَیْتَنَا اثْنَتَیْنِ فَاعْتَرَفْنَا بِذُنُوْبِنَا فَهَلْ اِلٰی خُرُوْجٍ مِّنْ سَبِیْلٍ۱۱
‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে প্রাণহীন অবস্থায় দুইবার রেখেছ এবং দুইবার আমাদেরকে জীবন দান করেছ। আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি, এখন নিষ্ক্রমণের কোনো পথ মিলবে কি?’-সূরা মুমিন ১১
অর্থাৎ আমাদের এক মৃত্যু তো আমাদের জন্মের পূর্বে ছিল, যখন আমরা প্রাণহীন ছিলাম আর দ্বিতীয় মৃত্যু এসেছে ইহকালীন জীবনের পর। আর দুইবার জীবন পেয়েছি, একবার পৃথিবীতে এবং দ্বিতীয়বার মৃত্যুর পরবর্তী এ পুনরুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। যে পুনর্জীবনকে আমরা অমান্য করতাম ও অস্বীকার করতাম। যার পরিণতিতে আমরা অন্যায়, অপকর্ম ও নাফরমানীতে লিপ্ত হই। এখন আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি। অতএব এ দুঃখময় স্থান থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার কোনো পথ খোলা আছে কি? তাহলে আমরা পুনরায় পৃথিবীতে গমন করে ঈমান আনয়ন করব এবং আনুগত্য প্রকাশ করব।
তাদের এইরূপ প্রার্থনা করার গূঢ় তাৎপর্য হল, তারা নিজেদের দুইবার মৃত্যু ও দুইবার জীবন প্রত্যক্ষ করেছে। এ কারণে তাদের ধারণা জন্মে, যে মহান পরাক্রমশালী প্রতিপালক মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করতে পারেন, তিনি হয়তো তাদেরকে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করবেন। অতএব যদি তাদেরকে আরো একবার সুযোগ দান করা হয়, তবে তারা অধিক হারে সৎকর্ম সম্পাদন করবে। কিন্তু তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হবে, তাদের পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার আর কোনো অবকাশ নেই।-মাআরিফুল কুরআন ৭/১২৮
অপরাধীরা শাস্তির প্রচন্ডতায় অতিষ্ঠ হয়ে জাহান্নামের অধিকর্তা মালিক ফেরেশতাকে চিৎকার করে বলবে-
وَ نَادَوْا یٰمٰلِكُ لِیَقْضِ عَلَیْنَا رَبُّكَ ؕ
‘হে মালিক! তুমিই প্রার্থনা কর, তোমার প্রতিপালক আমাদের মৃত্যু দিয়ে যেন আমাদের নিঃশেষ করে দেন।’-সূরা যুখরুফ ৭৭
উত্তরে তিনি বলবেন, তোমরা স্থায়ীভাবে এ অবস্থাতেই থাকবে। তোমাদের মৃত্যুও হবে না; তোমরা বেরও হতে পারবে না।-সূরা যুখরুফ ৭৭
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, অপরাধী জাহান্নামীদের এ আবেদনের পর সহস্র বৎসর অতিবাহিত হবে অতঃপর ফেরেশতা হযরত মালিক তাদেরকে এ জবাব দেবেন।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/২৪১
এরপর হযরত মালিক আলাইহিস সালাম তাদেরকে বলবেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সরাসরি আবেদন কর এবং তাঁর নিকটই প্রার্থনা কর। কেননা তিনিই সর্বনিয়ন্তা, তাঁর উপর আর কেউ নেই। তারা তখন আল্লাহ পাকের নিকট আবারও প্রার্থনা করে বলবে-
قَالُوْا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَیْنَا شِقْوَتُنَا وَ كُنَّا قَوْمًا ضَآلِّیْنَ۱۰۶ رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْهَا فَاِنْ عُدْنَا فَاِنَّا ظٰلِمُوْنَ۱۰۷
‘হে আমাদের প্রতিপালক! দুর্ভাগ্য আমাদেরকে পেয়ে বসে এবং আমরা ছিলাম এক বিভ্রান্ত সম্প্রদায়। হে আমাদের প্রতিপালক! এই অগ্নি থেকে আমাদেরকে উদ্ধার কর, অতঃপর আমরা যদি পুনরায় কুফরী করি তবে তো আমরা অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী হব।’
জাহান্নামীদের এ স্বীকারোক্তির এক হাজার বছর পর (তাফসীরে কুরতুবী ১২/১০২) আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘তোমরা হীন অবস্থায় এই খানেই থাক এবং আমার সঙ্গে কোনো কথা বলো না।’-সূরা মুমিনুন ১০৮
হযরত আবুদ্দারদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলার উপরোক্ত কথার পর অপরাধীদের শাস্তি লাঘবের ক্ষীণতম আশাও নিঃশেষ হয়ে যাবে।-সুনানে তিরমীযী ২/৮৬, মিশকাত ২/৫০৪
অতঃপর অপরাধীরা জাহান্নামে গর্দভের কুশ্রী স্বরের ন্যায় বিকট শব্দে আর্তরোল উৎক্ষিপ্ত করতে থাকবে।-সূরা হুদ ১০৬
কিন্তু তাদের এ আকুল ক্রন্দন নিষ্ফল আর্তনাদে পর্যবসিত হবে।
অবশেষে তাদের রোরুদ্যমান অবস্থায়ই জাহান্নামের কবাট চিরতরে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হবে।-তাফসীরে ইবনে কাসীর৫/৪৯৯
জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। তন্মধ্যে এ দুইখানি দুআ অন্যতম।
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ.
اَللّهُمَّ أَجِرْنِيْ مِنَ النَّارِ.
প্রথম দুআটির ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কুরআনের সূরা যেভাবে শিক্ষা দিতেন, সেভাবে এ দুআটিও শিক্ষা দেন। (আবু দাউদ ১/২১৫)
আর দ্বিতীয় দুআটির ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুসলিম তামিমী রা.কে বলেছেন, তুমি মাগরিবের সালাতের পর কারো সঙ্গে কথা বলার পূর্বে যদি এ দুআটি সাত বার পাঠ কর,তবে ঐ রাত্রে তোমার মৃত্যু হলে জাহান্নাম থেকে তুমি নাজাত লাভ করবে। তেমনিভাবে ফজরের সালাতের পরও এ নিয়মে তা পাঠ করলে এই দিন তোমার মৃত্যু হলে তোমার জন্য জাহান্নাম থেকে নাজাতের ফায়সালা হবে। (মিশকাত ১/২১০)