তাসাউফ সম্পর্কে প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা ও অভিজ্ঞতা
১৩৬১ হিজরী সনের শেষে ১৩৬২ হিজরীর শুরুতে আমি এমন একটি অস্বস্তিকর অবস্থার সম্মুখীন হলাম যে, আমার তখন কিছু দিন এমন জায়গায় কাটানোর প্রয়োজন হল, যেখানে আমার মন ও মস্তিষ্ক অস্বস্তিকর চিন্তা-ভাবনা থেকে মু্ক্ত থাকবে এবং আমার হৃদয় শান্তি ও স্বস্তি লাভ করবে। এ উদ্দেশ্যে আমার নির্বাচনের দৃষ্টি সে সময় একজন আল্লাহ ওয়ালা বুযুর্গের খানকাহর প্রতি নিবদ্ধ হল। খানকাহটি লোকালয়ের কোলাহল থেকে দূরে একটি নির্জন জায়গায় অবস্থিত। সেখানের পরিবেশ সবুজ শ্যামল ও মনোরম। মোটকথা আমি সেখানে পৌঁছে গেলাম।
সম্ভবত প্রথম দিন মাগরিব নামাযের পর উক্ত বুযুর্গ খানকাহর প্রাঙ্গনে একটি খাটে বসেছিলেন। আমাকেও স্নেহ করে নিজের সাথে বসালেন। আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ছিল না। নিকটেই খানকাহর কয়েকজন দরবেশ ‘নফী-ইসবাত’ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর যিকর করছিলেন। অপর কয়েকজন ‘ইসমে যাত’ (আল্লাহ আল্লাহ)-এর যিকর করছিলেন। এরা সকলেই খুব জোরে জোরে যিকর করছিলেন। পীর সাহেবদের নির্দেশিত বিশেষ পন্থায় কলবের উপর ‘যরব’ লাগাচ্ছিলেন। আল্লাহ পাকের যিকর উচ্চ স্বরে করা এবং বিশেষ পদ্ধতিতে যরব লাগান সে সময় কেবল যে আমার জন্য অপরিচিত ছিল তাই নয়, কিছুটা অসহ্যও ছিল। কাজেই আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আদব ও সম্মানের সঙ্গে ঐ বুযুর্গকে বললাম-
‘হযরত! সারা জীবন ইসলাম সম্পর্কে যা পড়াশোনা করেছি এবং কিতাবপত্রে যা পেয়েছি, তা থেকে একথা বুঝেছি যে, প্রকৃত ইসলাম সেটাই যার শিক্ষা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম থেকে পরবর্তী লোকেরা শিখেছেন। এভাবে বিশুদ্ধ বর্ণনাসূত্রে আমাদের নিকট পৌঁছেছে।
‘এ সকল দরবেশ ছাহেবান যেভাবে উচ্চস্বরে এবং ‘যরব’সহ যিকর করছেন, আমার যতটুকু জানা আছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এভাবে যিকর করতে শেখাননি। সাহাবায়ে কেরামও তাবেয়ীদেরকে এভাবে যিকর করাননি। তাবেয়ীগণ পরবর্তীদেরকে এভাবে যিকর করতে বলেননি। এ জন্য যিকরের এই পদ্ধতি সম্পর্কে আমার সংশয় আছে। আমি চাই যে, এ সংশয় যদি কোনো ভুল ধারণার কারণে হয়ে থাকে তাহলে তা যেন দৃঢ় হয়ে যায়।
ঐ বুযুর্গ আমার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত, আমার প্রশ্নকে একেবারেই এড়িয়ে গিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বলে উঠলেন-
‘মৌলবী ছাহেব! এ সকল নিরীহ লোক যারা আমার কাছে আসে, অন্য কোনো কাজের যোগ্য নয়। শুধু এ কাজটাই করতে পারে। আর এ জন্য আমিও তাদেরকে এটাই (যিকর) শিখিয়ে দেই। আপনি যে কাজ করেন সেটা অনেক বড় কাজ। আপনি ঐ কাজই করতে থাকুন। আপনি (এদের মতো) যিকর করার চক্করে পড়বেন না।
জানা কথা, এটা আমার প্রশ্নের উত্তর ছিল না। কিন্তু ঐ বুযুর্গ আমার কথার জবাবে এতটুকুই বললেন। আমাকে আর কিছু বলার কিংবা পুনরায় ঐ প্রশ্নের প্রতি তার মনোযোগ আকর্ষণ করার কোনো সুযোগ না দিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানদের সমস্যা ও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি নতুন আলোচনা শুরু করলেন। এ বিষয়টি আমার জন্যও আকর্ষণীয় ছিল। আমি তার এ ব্যবহার দেখে নিজ থেকে পুনরায় প্রশ্ন উত্থাপন করা সমীচীন মনে করলাম না। এশার নামাযের সময় আমাদের বৈঠক শেষ হল।
পরদিনও মাগরিব নামাযের পর একই অবস্থা হল, যাকেরীন (দরবেশগণ) একই ধরনের অধ্যাবসায় ও মনযোগসহ নিজ নিজ যিকর আরম্ভ করে দিলেন। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। গতকালের প্রশ্ন আমি তাকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলাম। কিন্তু ঐ বুযুর্গ আজও কালকের মতো একই পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি আমার কথার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে ভারতবর্ষের অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা আরম্ভ করলেন। আমার প্রশ্নের উত্তর আজো পেলাম না।
তাঁর এ আচরণে আলহামদুলিল্লাহ আমি এমন কোনো ভুল ধারণার শিকার হইনি যে, আমার প্রশ্নের উত্তর যেহেতু তার কাছে নেই তাই তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। বরং আমার এই ধারণা হল যে, সম্ভবত আমার প্রশ্নকে কোনো যোগ্য ও আগ্রহী ব্যক্তির প্রশ্ন মনে করা হয়নি। একজন উদ্ধত ও অহংকারী ব্যক্তির (অহেতুক) আপত্তি মনে করা হয়েছে। আমারও যদ্দূর মনে পড়ে, সে সময় এই প্রশ্নের দ্বারা নিজের সংশয় নিরসন উদ্দেশ্য ছিল না; বরং অন্য কিছু উদ্দেশ্য ছিল।
খানকাহর যে কামরায় আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল, আমি এশার নামায ও অন্যান্য কাজ থেকে ফারেগ হয়ে সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে তাসাউফের এ সকল যিকর ও ‘শোগল’ বিশেষ পদ্ধতিকে নিয়ে নিজে নিজেই চিন্তা করতে লাগলাম। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম এবং নিজেই উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার এখনো মনে পড়ে যে, মনোজগতের এ প্রশ্নোত্তরের কারণে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমার ঘুম আসেনি। আমি চাচ্ছিলাম এ সমস্যার ব্যাপারে আমার মন যেন একেবারে সংশয়মু্ক্ত হয়ে যায়। আর এ ব্যাপারে আমার কোনো ভুল ধারণা থকলে সেটাও যেন দূর হয়ে যায়। আর আমার চিন্তা-ভাবনা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আমার মনে যেন এমন শক্তি ও বিশ্বাস অর্জিত হয় যার সাহায্যে আমি পূর্ণ শক্তি দিয়ে এ সকল বিষয়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে পারি এবং একজন হকপন্থীর ভূমিকা পালন করতে পারি।
দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এ চিন্তা-ভাবনায় ডুবে থাকার পর আমার মাথায় একথাটি আসল যে, তাসাউফের এই বিশেষ পদ্ধতির আমল ও ‘শোগল’কে (যেমন, যিকর ও মুরাকাবার ঐ সকল বিশেষ পদ্ধতি যা পীর ছাহেবান মুরীদদেরকে বাতলে থাকেন, যা প্রচলিত রূপে সরাসরি সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়) আমি যে অবৈধ মনে করছি, আমার এ ধারণা যদি সঠিক হয় তাহলে এর অর্থ হবে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ. হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ রাহ. হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ. হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. এবং তাদের পূর্বের ঐ সকল বুযুর্গ যারা এদের মতো এ সকল কাজ করতেন তাদেরকে মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক না বলে বিদআতপন্থী এবং বিদআতের প্রচলনকারী বলতে হবে। কেননা এ সকল মনীষী কেবলমাত্র কল্যাণ চিন্তা অথবা সময়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য এ সকল বিষয়ে শিথিলতা করেছেন তা নয়; বরং এ সকল বিষয়ের তালীমে তাদের রচিত কিতাবসমূহ পরিপূর্ণ। তারা সারা জীবন তাদের কাছে আগত খোদা প্রেমিক লোকদেরকে এ পদ্ধতিতে যিকর ও শোগল করিয়ে তাদের খোদাপ্রাপ্তির পথ অতিক্রম করিয়েছেন। এ সকল বুযুর্গদের রচিত কিতাব যারা পড়েছেন এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে যারা অবগত তারা সবাই জানেন যে, এ সকল মহা মনীষীর জীবনের এ দিকটি অন্যান্য দিকের তুলনায় অত্যন্ত প্রবল ও পরিস্ফুট।
এ ভাবনা আসার পর আমার হৃদয় এ সিদ্ধান্তে অতি দ্রুতই উপনীত হল যে, আমার মতো নির্বোধ ও অসম্পূর্ণ ইলমের অধিকারী ব্যক্তি কোনো মাসআলা বুঝার ক্ষেত্রে ভুল করারই সম্ভাবনা বেশি এবং এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। পক্ষান্তরে ইমামে রববানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ.,হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ রাহ. এবং হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর মতো ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহক আকাবিরের সাথে ভুলের সম্বন্ধ করা নিতান্তই বোকামি। সেটাও আবার এমন বিষয়ে যার সাথে আমার সম্পর্ক অতি সামান্য আর তাদের ছিল এ বিষয়ে জীবনব্যাপী গভীর সম্পর্ক।
যেহেতু আমি তাঁদের কিতাবাদি পড়েছি এবং তাঁদের ব্যক্তিজীবন, ইসলাহী খেদমত ও সংস্কারমূলক অবদান সম্পর্কে অবগত ছিলাম এবং তাঁদের ইলমের গভীরতা, দ্বীনের সঠিক বুঝ এবং আল্লাহ পাকের প্রিয় পাত্র হওয়ার বিষয়গুলো আমার কাছে পূর্ব হতেই স্বীকৃত ছিল তাই নিজ ধারণার বিরুদ্ধে অতি সহজে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম। আমার অন্তর কোনোভাবেই এ কথা মানতে পারছিল না যে, এ সকল মহা মনীষী তৎকালীন সময়ে দ্বীনী বিষয়ে অধিক অবগত এবং উম্মতের জীবন ও চরিত্রের সংস্কারক হওয়া স্বত্ত্বেও কিছু কুসংস্কার ও বিদআতকে আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে নিজেরা সমগ্র জীবন তাতে মগ্ন থেকেছেন এবং আল্লাহ পাকের হাজার হাজার বান্দাকে তাতে মগ্ন করেছেন। এটা হতেই পারে না।
নিঃসন্দেহে মুজাদ্দিদগণ নবীদের মতো নিষ্পাপ নন এবং তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীও আসে না। কিন্তু তাঁরা বিদআতের প্রবর্তক এবং বিদআতের দিকে আহবানকারীও হতে পারেন না। বিশেষত দ্বীনের ঐ শাখায় যাতে তাঁরা অন্যান্য শাখার তুলনায় বেশি মনোনিবেশ করেছেন, যেদিকে মানুষের মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করেছেন এবং যার মাধ্যমে মানুষের সংশোধন ও সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। এ শাখায়ই যদি তাঁরা বিদআত ও বিদআত নয়-এমন বিষয়ে পার্থক্য করতে না পারেন তাহলে অবশ্যই তাঁরা সংশোধনের চেয়ে অধঃপতন এবং হেদায়েতের পরিবর্তে গোমরাহীর কারণ হবেন। মোটকথা, চিন্তার এ পর্যায়ে পৌঁছে আমার মানসিক সংশয় কিছুটা দূর হল এবং আমি এ কথা মেনে নিলাম যে, সম্ভবত এ বিষয়ে বুঝতে আমার ভুল হয়েছে। এখন আমার কর্তব্য, নিজের ভুল চিহ্নিত করা এবং তা সংশোধনের চেষ্টা করা।
রাত অনেক হয়েছিল। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে আমি ঘুমানোর ইচ্ছা করলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম।
এ কাহিনী যে বুযুর্গের খানকাহর তার নিয়ম ছিল, প্রতি দিন ফজর নামাযের পর কয়েক মাইল হাঁটতেন। সেদিন হাঁটার সময় আমিও সঙ্গে চললাম। গতরাতে নিজের মনের সাথে বোঝা-পড়া করা ও পরিশেষে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম তাও তাকে খুলে বললাম, যে, ‘আমার মন ও মস্তিষ্ক এ কথা তো মেনে নিয়েছে যে, তাসাউফের এ সকল আমল ও ‘শোগল’ সম্পর্কে এ পর্যন্ত আমি যা বুঝেছিলাম সম্ভবত তা সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে আমার কোথাও না কোথাও ভুল হচ্ছে। কিন্তু আমি এখনো পর্যন্ত নিজের সে ভুল চিহ্নিত করতে পারিনি। যেহেতু আমার মন ও মানসিকতা ছাত্রসুলভ তাই আমার ইচ্ছে হল, এ রহস্যটিও আমার সামনে উদঘাটিত হোক। আমার মনে এখনো যতটুকু সংশয় আছে তাও দূর হয়ে যাক। সেই বুযুর্গ আমার এ কথা শুনে মুচকি হাসলেন এবং বললেন-
মৌলবী ছাহেব! আপনার হয়তো এই সন্দেহ হচ্ছে যে, এ সকল কর্ম-কান্ড বিদআত। আচ্ছা, আপনি বলুন বিদআতের সংজ্ঞা কী?
আমি বললাম, বিদআতের সংজ্ঞা উলামায়ে কেরাম কয়েকভাবে দিয়েছেন। কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন মনে হয় সেটা এই সাদাসিধে সংজ্ঞা যে ‘দ্বীনের ব্যাপারে এমন কোনো জিনিস সংযোজন করা যার কোনো দলিল শরীয়তে নেই।’
সে বুযুর্গ বললেন, হ্যাঁ, এটা ঠিক। কিন্তু আপনি এর কী জবাব দিবেন ‘যদি শরীয়তে কোনো জিনিস উদ্দেশ্য হয় এবং শরীয়ত তা পালন করতে নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা পালন করাকে আবশ্যক করেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন হওয়ার ফলে সেটা ঐ পদ্ধতিতে অর্জন করা না যায়; যে পদ্ধতিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে এবং সাহাবায়ে কেরামের সময়ে অর্জিত হয়েছে। বরং তা অর্জন করার জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হয় তাহলে কি আপনি ঐ নতুন পন্থা অবলম্বন করাকেও ‘দ্বীনের মধ্যে নবসংযোজন’ এবং ‘বিদআত’ বলবেন? (এরপর তিনি নিজ বক্তব্য আরো স্পষ্ট করার জন্য বললেন) যেমন মনে করুন, দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা এবং দ্বীন শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। ইসলাম এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। আপনি এটাও জানেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগে শুধু সোহবতই (সান্নিধ্য) এ জন্য যথেষ্ট ছিল। শিক্ষা দানের ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাদরাসাও ছিল না। কিতাবও ছিল না। কিন্তু পরবর্তী যুগের অবস্থা এমনভাবে বদলে গেছে যে, ইলম শিক্ষার জন্য এখন শুধু সোহবত যথেষ্ট নয়। কিতাব, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় আল্লাহর বান্দাগণ কিতাব লিখেছেন, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এরপর হতে দ্বীন শেখা ও শেখানোর সকল কাজ এভাবেই চলছে। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। তাহলে দ্বীন শেখা ও শেখানোর এই পদ্ধতিগত পরিবর্তনকেও দ্বীনী বিষয়ে নতুন সংযোজন ও ‘বিদআত’ বলা হবে?
আমি বললাম, ‘না, দ্বীনী বিষয়ে নব সংযোজন তো তখন বলা হবে যখন এটাকেই উদ্দেশ্য এবং শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বিধান হিসেবে পালন করা হবে। কিন্তু যদি দ্বীনী কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পুরাতন পদ্ধতি যথেষ্ট না হওয়ার কারণে শরীয়তে বৈধ নতুন কোনো পন্থা অবলম্বন করা হয়, তাহলে সেটা দ্বীনী ব্যাপারে নব সংযোজন বলা যাবে না এবং সেটা বিদআতও হবে না ।
সে বুযুর্গ বললেন, তাসাউফের যে সকল আমল ও ‘শোগল’ সম্পর্কে আপনার বিদআত হওয়ার আশঙ্কা হচ্ছে সেগুলোও এ ধরনেরই। এর মধ্যে কোনোটাকেই আসল উদ্দেশ্য মনে করে চর্চা করা হয় না; বরং এগুলো শুধু আত্মশুদ্ধি ও আত্মাকে উত্তম গুণে গুণান্বিত করার জন্য (মাধ্যম হিসেবে) করানো হয়। আর এটা (আত্মশুদ্ধি এবং আত্মাকে উত্তম গুণে গুণান্বিত করা) দ্বীনের উদ্দেশ্য এবং শরীয়তের নির্দেশ। যেমন মনে করুন, আল্লাহ পাকের সাথে মুহাববত রাখা, সর্বক্ষণ তাঁকে স্মরণ রাখা, তাঁর সন্তুষ্টির প্রতি খেয়াল রাখা, এ ব্যাপারে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকা, কোনো সময় অমনোযোগী না হওয়া-এ অবস্থাটা ধর্মের উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বোঝা যায় যে, এটা ছাড়া ঈমান ও ইসলাম পূর্ণ হয় না। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে দ্বীনী তালীমের মতো এ সকল ঈমানী গুণও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্য থেকেই অর্জিত হত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় সোহবত থেকে অর্জিত করার ফলে সাহাবায়ে কেরামের সোহবতেও এ রকম প্রভাব ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে পরিবেশ বিকৃত হওয়ার কারণে এবং মানুষের যোগ্যতা কমে যাওয়ার কারণে এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য শুধু কামেল লোকদের সোহবত যথেষ্ট মনে করা হয় না। তখন এ বিষয়ের ইমামগণ ঐ সকল গুণ অর্জন করার জন্য বুযুর্গদের সোহবতের সাথে সাথে অধিক পরিমাণে যিকর ও ফিকর সংযোজন করলেন।* অভিজ্ঞতায় এই সংযোজন সার্থক প্রমাণিত হল। তদ্রূপ কোনো কোনো বুযুর্গ সে সময়ের লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাদের রিপু দমন এবং প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদাকে পরাজিত করে স্বভাবের মধ্যে নম্রতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তাদেরকে বিশেষ বিশেষ ধরনের পরিশ্রম এবং সাধনা (মুজাহাদা) করিয়ে থাকেন। এমনিভাবে যিকর এর ক্রিয়া বৃদ্ধির জন্য স্বভাবের মধ্যে নম্রতা ও একনিষ্ঠতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যরবের এই পন্থা আবিষ্কার করেছেন। এ সবের কোনোটাকেই উদ্দেশ্য এবং শরীয়ত কর্তৃক সুনির্ধারিত এবং আদিষ্ট পন্থা মনে করা হয় না। বরং এ সকল কাজ কেবল চিকিৎসা ও চেষ্টা হিসেবে করা হয়ে থাকে। আর এ জন্যই মূল উদ্দেশ্য (আল্লাহ পাকের সাথে বিশেষ সম্পর্ক ও মুহাববত) অর্জন হয়ে গেলে এ সকল অতিরিক্ত বিষয়গুলো ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এই একই কারণে এ বিষয়ের ইমামগণ নিজ নিজ সময়ের অবস্থা ও অভিজ্ঞতার আলোকে এ সকল জিনিসে (যিকর শোগল, রিয়াযত ও মুজাহাদার) পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করে থাকেন এবং এখনো করছেন। যোগ্যতা অনুসারে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আমল ও পন্থা বাতলে থাকেন। কেউ কেউ অবশ্য এমন উচ্চ পর্যায়ের যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে থাকেন, যার দরুন তার এ ধরনের যিকর ও শোগল করারই প্রয়োজন হয় না । আল্লাহ পাকের মুহাববত ও নৈকট্য তাদের এমনিই অর্জিত হয়। এর দ্বারা সকলেই এ কথা বুঝতে পারে যে, এই সকল বিষয় কেবল চিকিৎসা ও সহায়ক হিসেবে অবলম্বন করা ও করানো হয়।’
তাঁর এ ব্যাখ্যায় আমার সংশয় তো দূর হল। কিন্তু একই সঙ্গে নতুন এই আগ্রহও জাগ্রত হল যে, তিনি যা বললেন তা নিজে পরীক্ষা করে দেখব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আত্মিক প্রশান্তি ও বিশ্বাসকে আরো মজবুত করব। কিন্তু আমার সে সময়ের অবস্থা ও ব্যস্ততায় এটা সম্ভব ছিল না যে, আমি এ কাজের জন্য ভিন্নভাবে দীর্ঘ সময় বের করি। এ জন্য আমি তাঁকে সরাসরি সাফ সাফ বললাম যে-
যদি এ সকল যিকর-শোগল ঐ উদ্দেশ্যে (আল্লাহ পাকের মুহাববত ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য) করা হয় এবং এর দ্বারা তা অর্জন করা যায় তাহলে তো আমিও এর মুখাপেক্ষী। কিন্তু আমি তো এ কাজের জন্য বেশি সময় দিতে পারব না। কারণ দ্বীনের যে সকল কাজের সাথে আমার সামান্য সম্পর্ক আছে, তাও আমি ছাড়তে চাই না।
সেই বুযুর্গ বললেন-
তাসাউফ দ্বীনের কাজ ছাড়ানোর জন্য নয়; বরং তাসাউফের মাধ্যমে দ্বীনের কাজে আরো শক্তি সঞ্চার হয় এবং তাতে প্রাণশক্তি আসে। কিন্তু কী বলব, আল্লাহ পাকের ইচ্ছা, যাদেরকে আল্লাহ পাক দ্বীনের কাজের জন্য বানিয়েছেন, তারা এ দিকে মনোযোগ দেন না। অথচ তারা যদি এ দিকে সামান্য মনোযোগ দেন, তাহলে দেখতে পারবেন তাদের কাজে কীরূপ শক্তির সঞ্চার হয়। হযরত খাজা ছাহেব পরবর্তীতে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহ., হযরত শাহ ওলীউল্লাহ রাহ., হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ. প্রমুখ বুযুর্গানে দ্বীন আমাদের এ দেশে দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং যা কিছু করে দেখিয়েছেন (যার শতাংশ বা সহস্রাংশও বড় বড় সংগঠন ও দল করতে সক্ষম নয়) এ ক্ষেত্রে তাদের ইখলাস এবং হৃদয়ের ঐ আধ্যাত্মিক শক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল, যা তাসাউফের এ পথে অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু এখন অবস্থা এই হয়েছে যে, এদিকে শুধু ঐ সকল লোকই আসে যারা শুধু আল্লাহ আল্লাহই করতে জানে। এটাতো আপনিও জানেন যে, আল্লাহ পাক তাঁর বিভিন্ন বান্দার মধ্যে বিভিন্ন মাপের যোগ্যতা রেখেছেন। অযোগ্য লোকেরা কখনও যোগ্য লোকদের (সমান) কাজ করতে পারে না।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
অনুবাদ : মাওলানা হাবীবুর রহমান খান
* অধিক পরিমাণে যিকর ও ফিকিরের তাকিদ তো সুস্পষ্টভাবে কোরআন ও হাদীসেই রয়েছে। এখানে যিকর ও ফিকিরের বিশেষ পদ্ধতিগুলো উদ্দেশ্য।