রবিউল আউয়াল ১৪৩১   ||   মার্চ ২০১০

ছিত্তা নফর মিন বাংলাদেশ-এর ইয়েমেনে একশত বিশ দিন

দেওয়ান মুহাম্মাদ আজিজুল ইসলাম

বিরান মরু এলাকা। চারিদিকে ধু ধু প্রান্তর। ছোট ছোট ঢিবি ও আগাছা। মাঝে মধ্যে মস্ত বড় ছাতার মতো এক ধরনের কাঁটা গাছ (এদেশের বাবলা, স্থানীয় নাম সিডর) একসঙ্গে মেলে রাখা হাজার হাজার সবুজ ছাতার মতো দেখতে। আরও একটু সামনে এগুনোর পর চোখে পড়ল অসীম পাথার-নীল সমুদ্র। এখানে বিরাট এলাকায় এজতেমার আয়োজন করা হয়েছে। গোটা এলাকা নীল রংয়ের পর্দা দিয়ে ঘেরা। আজ বিকাল থেকেই এজতেমার বয়ান শুরু হবে। এজন্য সকাল বেলায়ই আমরা হুদায়দা মার্কায থেকে এজতেমা মাঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। মারকায থেকে এজতেমার মাঠের দূরত্ব পচিঁশ কিলোমিটার। মাথা পিছু ভাড়া একশত ইয়েমেনি রিয়েল। আমাদের হিসাবে পঁয়ত্রিশ টাকার মতো। চৌদ্দ সিটের একটা মাইক্রো ভাড়া করলাম আমরা ছয় জন, সঙ্গে এলেন এক আরবী তরুণ, তিনি মক্কায় থাকেন। এবং আরো দুই জন স্থানীয় বাসিন্দা। লোক কম হলেও মাথাপিছু ভাড়া একই থাকল। এখানে রিক্সা বা স্কুটার নেই। অসংখ্য ট্যাক্সি চলাচল করছে। মিটার নেই, কিন্তু ভাড়ার কোন জবরদস্তিও নেই। ড্রাইভাররা খুবই আন্তরিক- অনেকটা পড়শীর গাড়িতে লিফট নেওয়ার মতো। যেহেতু এজতেমা দুই দিন চলবে তাই এজতেমার আগের কাহিনীটাই আগে বলা দরকার। এখনও আমার ভাবতে অবাক লাগছে যে, কোনোদিন যা স্বপ্নেও ভাবিনি; বরং আমি যার বিরোধী ছিলাম সেই বিদেশ সফরে আমিই হঠাৎ করে রাজী হয়ে যাব! তাও এমন একটি দেশে, যার ভাষা পর্যন্ত আমার জানা নেই। অথচ এখন আমি ইয়েমেনের রাজধানী সানা হয়ে হুদায়দার এজতেমা মাঠে বসে ডাইরী লিখছি। আসলে মানুষ যে কিছুই করতে পারে না, সবকিছুই করান আল্লাহ তাআলা, তা অবিশ্বাস করার কোনোই যুক্তি নেই। *** তাশকিল বলতে যা বোঝায় সে রকম কিছু নয়। বিদেশী জামাতের সাথীরা অন্য মসজিদে কীভাবে যাবেন সেই ফিকির চলছিল। আমি বাড়ীতে চলে আসব এমন সময় তাদের একটা কথা কানে এল। “বিদেশ সফর বোধ হয় আর হচ্ছে না”। আগ্রহ হল। বিষয়টি জানতে চাইলাম। বললেন, গত বছর ডিসেম্বরে তারা সোয়াদ (অনুমতিপ্রাপ্ত) হয়েছেন কাকরাইলে। সাত জনের মধ্যে একজন মওলানা এখনও পাসপোর্ট করেননি। একজন ইংরেজীর শিক্ষক ঢাকায় বদলী হয়ে গেছেন এবং অপর একজন যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নতুন দুই জন জুড়লেও একজন অনেক দেরী হওয়ায় অন্য এক দলের সঙ্গে সফরে চলে গেছেন। কমপক্ষে ছয় জন প্রয়োজন অথচ আর কাউকে না পেয়ে এবং ইংরেজী-জানা তেমন কেউ না থাকায় তারা নিরাশ হয়ে গেছেন। হঠাৎ আমাকে বললেন, আপনি যদি যেতেন তবে দুইটা অভাব পূরণ হত এবং আমরা আবার নতুন করে চেষ্টা করতাম। হাঁ না কিছুই না বলে বাড়িতে চলে এলাম। কিন্তু বিষয়টি মাথা থেকে দূর হল না। বরঞ্চ ব্যথার খোঁচা দিতে লাগল। নিজের অপছন্দ বাদ দিলেও আমার বর্তমান অবস্থা কোনোভাবেই হাঁ বলার পক্ষে নয়। ব্যাঙ্কের অবস্থাও আমার বিপক্ষে। তবু একটা কিন্তু কিন্তু ভাব মনের মধ্যে কাজ করতেই থাকল। এদিকে সফরের জন্য আমার নিজেরও পাসপোর্ট করতে হবে। অর্ডিনারি করাতে হলেও দুই হাজার পাঁচ শত টাকা ফিস লাগবে, সময় লাগবে কমপক্ষে এক মাস। নিজস্ব তবলীগের গোপন তহবিলে হাত দিয়ে দেখি দুই হাজার পাঁচ শত টাকাই আছে। আল্লাহর উপর ভরসা করে পরের দিন পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। পাসপোর্টের ফরম পূরণ করে অফিসে জমা দেব, ক্লার্ক ভদ্রলোক বললেন, আপনি তো আপনার চাকুরী সংক্রান্ত যেকোনো একটি ডকুমেন্টের ফটোকপি ফরমের সঙ্গে জমা দিলে আর্জেন্ট এর সুবিধা পাবেন। সুতরাং ফরম আগামী কাল জমা দিন। এ যেন মেঘ না চাইতেই পানি। তার পরামর্শ মতো পরের দিন পেনসন বইয়ের একটি ফটোকপিসহ দরখাস্ত জমা দিয়ে ভেতরে গেলাম কবে আসব জানতে। ছেলেটি চিনে ফেলল। বলল, তিন দিন পর বিকাল চারটায় আপনার পাসপোর্ট আমি নিজে আপনার হাতে দিয়ে আসব ইনশাআল্লাহ। অদ্ভুৎ ব্যাপার! এসব কীসের আলামত! সব কিছু এ রকম দ্রুত একের পর এক হয়ে যাচ্ছে কেন? পরের দিন মওলানা মিজানের সঙ্গে দেখা। শুনলাম ভাঙ্গুরার সেই মওলানা কাল আসবেন পাসপোর্ট করতে। শুনে খুব ভালো লাগল। দুইজন মওলানা জামাতে থাকলে কাজের খুব সুবিধা হবে। আমি দরখাস্ত করেছি শুনে খুবই আনন্দিত হলেন। সময়মতই পাসপোর্ট পেলাম। ততদিনে সাথীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সবাই মারকাযে একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, যত বাধাই আসুক ২০/১২/০৮ আমরা ইনশাআল্লাহ কাকরাইল মারকাযে চলে যাবই। আমাদের দলের মধ্যে আমার ও আটঘরিয়ার হাজী মিজান ভাইয়ের ‘সোয়াদ’ হয়নি। সিদ্ধান্ত হল, আমরা সফরের সব প্রস্তুতি নিয়েই যাব। ‘সোয়াদ’ হয়ে গেলে বিদেশ সফরের পূর্বশর্ত হিসাবে দেশে যে প্রথম পনের দিন সময় লাগাতে হয় আমরা সে সময় লাগাতে থাকব এবং এর মধ্যে ভিসার জন্য দরখাস্ত করা এবং তাড়াতাড়ি ভিসা পাওয়ার প্রয়োজনীয় চেষ্টা-তদবির করব। সিদ্ধান্ত তো নিয়ে নিলাম কিন্তু রাহ-খরচের কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত হয়নি। প্রথম দিন থেকেই গভীর রাতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম আর সারাদিন কী হয়েছে, কতদূর হয়েছে জানাতাম। সময় মাত্র দশ/এগার দিন। ছেলে মেয়েরা সবাই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। তাদের একত্র করে মাশয়ারা করা সম্ভব হল না, তাই মোবাইলে মতামত নিলাম। আল্লাহ মেহেরবানী করে টাকার ব্যবস্থা তার গায়েবী খাজানা থেকে করে দিলেন। ছেলে মেয়েরা স্বেচ্ছায় দায়িত্বটি তাদের কাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে চিন্তামুক্ত করল। এখন শুধু যাত্রা শুরুর পালা। ২১/১২/০৮ আমরা কাকরাইল চলে এলাম। নাম লেখালাম । পরের দিন সকালে ‘সোয়াদ’ হয়ে গেল। প্রথম পনের দিনের প্রথম অর্ধেক ঢাকায় পূর্ব রামপুরায় কাটালাম। ইতোমধ্যে ইয়েমেনের মারকাযে ফ্যাক্স করা, টিকিটের খবর নেওয়া এবং ইতিপূর্বে যারা ইয়েমেন সফরে গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় তথ্য নেওয়া ইত্যাদি শেষ করা হল। এখন শুধু ভিসার জন্য অপেক্ষা করা, আর মাঝে মধ্যে ইয়েমেনে ফোন করা। সময়ের দ্বিতীয় অর্ধেক ঢাকার বাইরে যেতে হবে। ৭/০১/০৯ সকালে আমরা গাজীপুরে রওয়ানা হব। হঠাৎ রাতেই আমাদের ভিসার অনুমতি এসে হাজির। যেহেতু আমরা ইতোমধ্যেই পনের দিন ঢাকায় অবস্থান করেছি এবং ভিসা এসে গেছে তাই মুরুব্বীরা দয়া করে অবশিষ্ট ৭ দিনের বদলে চারদিন গাজীপুরে সময় লাগিয়ে চলে আসতে অনুমতি দিলেন। ঢাকা থেকে চিটাগাং এর বাসের ভাড়া ৩০০/=(তিনশত) টাকা। অথচ ঢাকার বদলে চিটাগাং থেকে প্লেনে তের/চৌদ্দ হাজার টাকা ভাড়া কম লাগবে। তার উপর এয়ার এরাবিয়ার ভাড়া বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন রকম। শেষ পর্যন্ত আমরা ১৪/০১/০৯ তারিখের সন্ধ্যার টিকেট করলাম। যাতায়াত মাথাপিছু ৪২,২০০ (বিয়াল্লিশ হাজার দুইশত) টাকা করে। পরে জেনেছি যে, ঢাকার বদলে চট্টগ্রাম থেকে টিকেট করলে অতিরিক্ত আরো ১১০০ (এক হাজার একশত) কমে টিকেট করা যেত। কাকরাইলেই ডলার কেনা সহ সব কাজ শেষ হল। মশোয়ারায় সিদ্ধান্ত হল যে, ১৩/০৪/০৯ সকালে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা হবে। মারকাযে উঠে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করব। এতে বিশ্রামও হবে, সময়ও পার হবে। এয়ার এ্যারাবিয়াতে সানা যেতে হলে শারজাহ্তে চব্বিশ ঘন্টা ট্রানজিট। ওখানে যাত্রীদের নিজের খরচে খাবার কিনে খেতে হয়। এই এক দিনের খাবার প্লেন থেকে কিনে খেতে মাথাপিছু ১৫০০-২০০০/-(পনের শত/দুই হাজার) টাকা খরচ পড়ে। এজন্য পাউরুটি, ডিম (সিদ্ধ ও ভাজা), জেলি, চিনি ও ফলমুল কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। খরচ হল মাথাপিছু একশত পঁয়ত্রিশ এবং খাবার এত বেশি হল যে, পরের দিন খাওয়ার পরও কিছু বেঁচে গেল। খাওয়ার পানিও নেওয়া হল বেশি করে। হাজী মিজান তার ছোট ভাইয়ের গাড়ী নিয়ে এসেছিলেন। ঐ গাড়িতেই চাপাচাপি করে মালপত্রসহ বাসষ্ট্যান্ডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা সবাই উঠে পড়লাম। এতক্ষণে মনে হল যে, আল্লাহর মেহেরবানীতে আমরা ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছি। গাড়ি ছাড়ামাত্র এক অভূতপূর্ব অনুভূতি সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেল। সকলের চোখে পানি। অনাস্বাদিত, অপার্থিব, অপূর্ব এক শিহরণ-জাগানো ভালো লাগার অনুভূতি হৃদয়ের তন্ত্রীতে সুরের অনুরণন তুলল। মনে পড়ল হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “ঈমান হচ্ছে ইয়েমেনি” বলে যে দেশটিকে সম্মানিত করেছেন, যে দেশের হেকমত ও ঈমান সম্পর্কে তিনি আপন যবান মুবারকে সনদ দিয়েছেন, আজ আমাদের গন্তব্য সেই গৌরবান্বিত দেশ ইয়েমেন। মনে হল, “পার হয়ে আসিলাম আজি নব শিখর চূড়ায়/রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায় আমার পুরানো নাম।” *** হায়াতুস সাহাবার ১ম খণ্ডে ইয়েমেনবাসীদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে একটি সুন্দর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য হযরত খালিদ ইবনে ওলীদ রা.কে একটা জামাতসহ ইয়েমেন প্রেরণ করেন। যাদের মধ্যে হযরত বারা রা.ও শামিল ছিলেন। হযরত খালিদ রা. ও তার জামাত ছয় মাস যাবৎ ইয়েমেনবাসী হামাদান গোত্রকে দাওয়াত দিলেন, কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণ করলেন না। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা.কে প্রেরণ করেন এবং হযরত খালিদ রা. ও যে সকল সাহাবী ফিরে আসতে ইচ্ছুক তাদের ফিরে আসার নিদের্শ দেন। হযরত বারা রা. ছিলেন থেকে যাওয়া সাহাবীদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন, আমরা ইয়েমেনবাসীদের নিকট উপস্থিত হলে তারাও শহর থেকে বের হয়ে এলেন। হযরত আলী রা. অগ্রসর হয়ে পুরা জামাতসহ নামাজ আদায় করে জামাতকে এক কাতারে দাড় করালেন। তারপর তিনি সামনে যেয়ে ইয়েমেনবাসীদেরকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চিঠি পড়ে শোনালেন, যে পত্রে তিনি ইয়েমেনবাসীদের ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়েছিলেন। চিঠি শুনে হামাদান গোত্রের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। এই সুসংবাদ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পত্র মারফত জানানো হলে পত্রপাঠ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদারত হলেন। অতঃপর মাথা উঠিয়ে বললেন, “আসসালামু আলা হামাদান”। তিনি দুইবার কথাটি বলেন, যার অর্থ শান্তি বর্ষিত হোক হামাদান গোত্রের উপর। সেই সোনার ইয়েমেন, শান্তির ইয়েমেন, বরকতের আর হেকমতের ইয়েমেনে আল্লাহ পাক আমাদের মঞ্জুর করলেন- এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে? হৃদয়ের গভীর থেকে শুধু একটি শব্দই বের হল,আলহামদুল্লিাহ! *** চট্টগ্রামগামী গাড়ি রওয়ানা হয়ে গেল। মধ্যে বিশ মিনিট যাত্রাবিরতি। সেই সুযোগে আমাদের যোহরের নামায হয়ে গেল। চট্টগ্রাম মারকাযের পক্ষ থেকে এস্তেকবালের গাড়ি আমাদের লাভ লেনের মারকাযে নিয়ে গেল। খাবারও তৈরি। খেয়ে উঠতেই আছরের আযান। তারপর মাশোয়ারা। অবাক ব্যাপার। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা তো তাঁরা করলেনই উপরন্তু টিকেট কনফার্মেসন করিয়ে এবং কিছু হাদিয়াসহ আমাদেরকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। আমাদের কিছুই করতে দিলেন না। আল্লাহ তাঁদের উভয় জাহানে জাযায়ে খায়ের দান করুন। এয়ারপোর্টের ঘটনা গতানুগতিক। মালামাল চেক করা, কাগজপত্র যাচাই বাছাই এইসব। আমাদের দেশে যেহেতু ইয়েমেনি দূতাবাস নেই তাই ইয়েমেনের ভিসা আমাদের সঙ্গে ছিল না। কাউন্টারের মহিলা বিব্রত হলেন। তাকে বলা হল যে, সানা এয়ারপোর্টে পৌঁছে ভিসার জন্য ফিস জমা দিলেই ভিসা পাওয়া যাবে এবং এ সম্পর্কীয় ইয়েমেন সরকারের অনুমতিপত্র এবং হুদাইদার মারকাযের আহলে শুরার চিঠি তার হাতে দেওয়া হল। কিন্তু তিনি সাহস পেলেন না, নিজেই অফিসারকে ডাকতে চলে গেলেন। ফলাফল আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গেই দিলেন। ভদ্রলোক ছুটে এসে আমাদেরকে তার অফিসের ভেতরে নিয়ে গেলেন এবং বসতে দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের কিছুই করতে হবে না। সব কিছু ঠিক করে বোর্ডিং-কার্ডসহ প্রত্যেকের পাসপোর্ট এখানেই দিয়ে যাচ্ছি।’ আমরা নামায পড়তে চাইলাম। ঐখানেই নামায পড়ার ব্যবস্থা হল। একটু পর ঐ মহিলা এসে কাগজগুলো দিয়ে গেলেন এবং তার একমাত্র ছোট্ট ছেলের জন্য খুব দোয়া চাইলেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে যে অফিসার ছিলেন তিনি সব বিষয়ে আমাদের অগ্রাধিকার তো দিলেনই এমনকি কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগের জন্য বার বার অনুরোধ করলেন। আল্লাহ তাঁদের সবাইকে দোজাহানের মঙ্গল দান করুন। *** মাগরিবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্লেনে উঠতে হল। এক শত পঁচিশ সিটের প্লেন। সময় মেপে যাত্রা। সময়মতো শারজাহ উপস্থিতি। আমাদের ঘড়িতে তখন ১-৩০ মি. ওদের ১১.৩৫ মি. অর্থাৎ দুই ঘন্টার পার্থক্য। প্লেনেই রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম। এরোপ্লেনে ওদের আতিথেয়তা প্রত্যেকের জন্য শুধু ছোট্ট আইসক্রিম এর কৌটার এক কৌটা পানি। এছাড়া যা কিছু দরকার সব ওদের কাছে ওদের রেটে কিনে নিতে হয়। আল্লাহর মেহেরবানীতে আমাদের প্রয়োজন হল না। রাত দুইটায় ইয়েমেনের রাজধানী সানায় পৌছলাম। এক ভিন্ন দেশের তাবলীগের সাথী এগিয়ে এসে আমাদের খবর নিলেন। ভেতরে যেয়ে আমাদের কথা বলতেই ওরা জানালেন, আমাদের জন্য সানা মারকাযের প্রধান ভাই আব্দুল্লাহ আলাভী কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছাবেন। ইয়েমেনে আমাদের সফরের মেয়াদ চার মাস অর্থাৎ এক শত বিশ দিন। সেভাবেই ভিসা চাইলাম। কিন্তু এদেশের ভিসা প্রথমে স্বল্প মেয়াদে ইস্যু করা হয়। পরে আবার ফিস জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় মেয়াদের জন্য ভিসা রিনিউ করতে হয়। সেভাবেই ভিসা হল। মাল-সামানা বুঝে নিচ্ছি এরমধ্যেই সানার জিম্মাদার ভাই আব্দুল্লাহ আলাভী এসে হাজির। কয়েক মিনিট বিলম্ব হওয়ায় বিনয়ের সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করলেন। এয়ারপোর্টে দেখলাম তার যথেষ্ট পরিচিতি এবং ক্ষমতা। মাল-সামানা পর্যন্ত অন্যরা বহন করে তার সঙ্গে আনা দুইটি গাড়িতে তুলে দিল। বাইরে হাড়কাঁপানো শীত। মোটা গেঞ্জির উপর জামা ও ফুল সোয়েটার এবং তার উপর ওভারকোট। হাতে পায়ে মোজা। মাথায় গরম টুপি। তবুও শীত আমল দিতে নারাজ। ঠাণ্ডা বাতাসে ঐ অল্প সময়েই হি হি কাঁপন শুরু হয়ে গেল। ভাই আলাভী আমাদের দ্রুত গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে রওয়ানা হলেন শীতের কামড় থেকে বাঁচাবার জন্য। কিন্তু তেমন একটা লাভ হল না। যাহোক মারকাযে এসে বিছানা খুলে প্রায় দুই ঘন্টার মতো ঘুমানোর সুযোগ পাওয়া গেল। ৫-২০ এ আযান ৫-৪০ এ নামায শেষ করে ঘরে এসে দেখি চা বিস্কুট ও খেজুর রেডি হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাত্রে যাদেরকে ঘুমাতে দেখেছিলাম তাঁদের কারো কারো সঙ্গে এসময় পরিচয় হল। মক্কা, মদীনা, মিসর, ফিলিস্তিন, লেবানন, সুদান, জিবুতি, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, বাহরাইন ইত্যাদি দেশের সাথী। যে সব সাথীর নাম আমাদের ভিসার কাগজে উল্লেখ করা ছিল তারাও এখানেই এখন আমাদের সঙ্গে। আমার পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম তার দেশের কথা। তিনি উরদুন অর্থাৎ জর্ডান থেকে এসেছেন। সবাই হাসি খুশি এবং মিশুক। বাংলাদেশী অর্থাৎ ‘আলমী এজতেমা’র দেশের মানুষ হিসাবে আমরা বিশেষ মর্যাদা পেলাম। সবাই এসে হাত মেলালেন এবং গলায় গলা মিশিয়ে চুমু খেলেন। প্রথমে কেমন যেন সঙ্কোচ লাগলেও পরে আর অসুবিধা হল না। সাতটায় ইশরাকের পর মসজিদ থেকে বাইরে এসে দেখি ঘরের সম্মুখে নুড়িপাথর বিছানো ছাউনি-ঘেরা স্থানে লম্বা একটা দস্তরখানা বিছানো এবং সাথীরা সবাই খেতে বসেছেন। আমাদেরও ‘ফুতুর’ অর্থাৎ নাস্তা করার জন্য ডেকে নিল। প্রতি চার জনের জন্য এক সেট নাস্তা। একবার ব্যবহার্য প্লাষ্টিকের একটা ট্রের একদিকে আরব অঞ্চলের নাম করা মিষ্টি হালুয়াই তুহিনা (এক ধরনের সাদা ও গুড়া জাতীয় মিষ্টি, খেতে ভালোই)। একপাশে পনির এবং দেশী টক দই। বাটিতে করে টমেটো কুচি মিশিয়ে দিয়ে দানা দানা করে ডিম ভাজা, নাম শুকশুকা, তাও পরিমাণে অনেক, সঙ্গে তন্দুর ও এক ধরনের লম্বা রুটি। যে যত খেতে পারে কোনো সমস্যা নেই। বড় কেটলি ভরা দুই রকম চা ও ডজন ডজন চায়ের কাপ। এখানে দুধ চা কে বলে ‘শায়ে দাউদী’ এবং লাল চা কে বলে ‘শায়ে সোলায়মানী’। যে যত কাপ ইচ্ছা খেতে পারে। কোনো প্রশ্ন তো করেই না, উপরন্তু আরো বেশি করে খাওয়াতে চায়। এই রকম নাস্তা এখানে প্রত্যেক দিনই হয়েছে। ১২-২০ মিঃ আযান। ১২-৪০ নামায। একটায় ফিরে এসে দুপুরের খাবার। সরু লম্বা চালের পোলাও, আধখানা মুরগী ও সবজী। সঙ্গে দই। এশার নামায বাদ রাতের খাবার। রুটি, তরকারী, ডাল, দই ও চা। সানা মারকাযে চারদিন ছিলাম সব বেলায় একই রকম ব্যবস্থা। সবচেয়ে অপূর্ব ছিল রান্না মুরগী। গোটা গোস্ত ও হাড্ডি একসঙ্গে, কিন্তু হাত দিলেই হাড় থেকে পুরা গোস্ত মোলায়েম হয়ে খুলে আসে। গায়ে সামান্য তেলের প্রলেপ, কোন ঝোল নেই, মসল্লাও সামান্য অথচ লবন মসল্লা গোস্তের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। অতি সুস্বাদু। রান্নাটা শেখার খুব ইচ্ছা হলেও সুযোগ পেলাম না। এখানের এই দোতালা মসজিদটি বিরাট। ঈদের বড় জামাতের মত কাতার। নামাজ শেষ হলেও লোকজন খুব কমই বাইরে যান। মিম্বারের কাছে এসে বসেন এবং বয়ান শোনেন। বয়ান চলাকালীন কেউ ওঠেন না। তা সেটা এক ঘন্টা বা দুই ঘন্টাই হোক না কেন। প্রথমে মনে হয়েছিল, এরা সবাই বোধ হয় তবলীগের সাথী। পরে দেখলাম গোটা ইয়েমেনে সব জায়গাতেই একই অবস্থা। স্থানীয় মানুষ, গাড়ীর ড্রাইভার, দোকানদার, পথচারী সবাই মোটামুটি পুরা সময় নামায শেষে মসজিদে বসে বয়ান শোনেন। উঠাউঠি নাই। তবে কেউ কোরআন পড়ছেন, বা তছবি হাতে মশগুল অথবা নামায পড়ছেন, কেউ নামায পড়ে চলে যাচ্ছেন অথবা মজমাতে এসে বসে যাচ্ছেন। কারো মুখে কথাবার্তা নেই বললেই চলে। পরিবেশটাই অন্য রকম। আমাদের দেশের সঙ্গে একদম মিল নেই। সবাই নিজের আমলে নিয়ে সন্তুষ্ট। অন্য কে কী করছে সে নিয়ে কারোই কোনো মাথাব্যথা নাই। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement