আল-কুরআনের অলৌকিকত্ব
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় আন্তঃধর্মীয় সম্মেলনের একটি ঘটনা। উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, সম্মেলনের সমাপ্তি টানা হবে প্রধান ধর্মসমূহের যে ধর্মগ্রন্থ তা থেকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে। পাঠ করবেন ভিন্ন ধর্মের কোনো অনুসারী। তা-ই হলো। যথারীতি একজন আরব খ্রীষ্টান কুরআনুল কারীম থেকে একটি সূরা পাঠ করে শোনালেন। তিনি ছিলেন একজন ভালো আবৃত্তিকার। তাঁর মর্মস্পর্শী আবৃত্তি সবাইকে দারুণভাবে বিমোহিত করল। আবৃত্তিকার নিজেও বিশেষভাবে আন্দোলিত। পাঠ সমাপ্তির পর প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে উপস্থিত একজন প্রখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ ও লেখক খ্রীষ্টান আবৃত্তিকারের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি মনে করেন, কুরআন আল্লাহর বাণী?’ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘অবশ্যই।’ কিন্তু তারপরই মুহূর্তকাল চিন্তা করে পুনরায় বললেন, ‘কিন্তু সেটা কেবল আরবদের জন্য।’
প্রকৃতপক্ষে কুরআনের যে পয়গাম, তা শুধু সারা বিশ্বের মানুষকেই আকর্ষণ করে না, কুরআনের বাণীই এত মর্মস্পর্শী, যা এমন সব মানুষকেও অভিভূত করে যারা একটিও কোনো আরবি শব্দ বোঝে না। অপর একটি ঘটনা। একবার সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসেরের এক বৈঠকে অন্যতম সঙ্গী ছিলেন মিশরের বিখ্যাত আবৃত্তিকার ক্বারী আবদুল বাসিত। আলোচনার এক বিরতি পর্বে প্রেসিডেন্ট জনাব বাসিতকে সোভিয়েত শীর্ষ নেতাদের সম্মুখে আল-কুরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করার জন্য আহবান জানালেন। যখন তেলাওয়াত শেষ হলো, ক্বারী আবদুল বাসিত দেখলেন, চার জনের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। পরে তারা বললেন, ‘কী পাঠ করা হলো তার কোনো অর্থ আমরা বুঝতে পারিনি, কিন্তু কী এক অনুপম মর্মস্পর্শিতা বিষয় যেন কথাগুলির মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছিল।’
এটা সেই সময়ের কথা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে কুরআন মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল। এটা সেই সময়ের কথা, যখন কুরআন পাঠ, কুরআন শিক্ষা এমনকি এক খন্ড কুরআন কাছে রাখাও ছিল গুরুতর দন্ডযোগ্য অপরাধ। কেজিবি সর্বদা অত্যন্ত কঠিনভাবে এদিকে নজর রাখতো।
কেজিবি এজেন্টদের এতটুকু সন্দেহ হলেই তারা যখন তখন যে কোনো গৃহে প্রবেশ করতো এবং দেখতো সেখানে কুরআন পাঠ বা সালাত আদায় করা হয় কি না। ধর্মীয় নেতাদেরকে বাধ্যতামূলক কঠিন শ্রমের কাজে নিয়োগ করা হতো। মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে দিয়ে সেগুলি প্রেক্ষাগৃহ (Cinema House) ফ্যাক্টরি এবং অফিস হিসাবে ব্যবহার করা হতো। কেউ কোথাও কুরআন শরীফ এর একটি কোনো কপিও দেখতে পেতো না। রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়ে এমন নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল যাতে কুরআন শরীফের একটি স্ফুলিঙ্গও কোথাও দেখা না যায়। তবুও ৭০ বছরের সেই কলঙ্কময় অন্ধকারের মধ্যেও মুসলমানরা কুরআনের আলোকশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিল। জীবনের কঠিন ঝুঁকি নিয়ে তারা এমন একটি গোপন-ছদ্মবেশী কৌশল অবলম্বন করেছিল যাতে তাদের সন্তানেরা কুরআন শিক্ষা করতে পারে। পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছোট ছোট ছেলেরা ওস্তাদদের কাছে মুখে মুখে কুরআন কণ্ঠস্থ করতো এবং কোনোরকম মুদ্রিত পুস্তক ছাড়াই ধর্মীয় শিক্ষা ও নির্দেশনার তালিম নিত। তাদের কথা যদিও কেউ মনে রাখেনি, কিন্তু আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়।
কী ধরনের গ্রন্থ এ রকম চূড়ান্ত ভক্তি ও চূড়ান্ত কোরবানীর পরাকাষ্ঠা দাবী করতে পারে? পারে কেবল সেই মহাগ্রন্থ, যা শুরুতেই এই নিশ্চয়তা প্রদান করে- ‘এই সেই মহাগ্রন্থ, যাতে অনুমান সন্দেহের অবকাশ নেই এবং এই গ্রন্থ শুধু আল্লাহভীরুদের (মুত্তাকী) জন্যই পথপ্রদর্শক।’(সূরা বাকারা- ২) এবং তারপর কুরআনের প্রতিটি পংক্তি এই নিশ্চয়তারই সত্যতা তুলে ধরে এবং কুরআন এই ঘোষণা প্রদান করে- ‘পরম করুণাময় (আল্লাহ তাআলা) তিনিই (তোমাদেরকে) কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন’। (সূরা আর-রাহমান ১-২) এবং এই চ্যালেঞ্জও ঘোষণা করা হয়েছে:
‘তুমি (তাদের এ কথাও) বলো যে, যদি সব মানুষ ও জীন (এ কাজের জন্য) একত্রিত হয় এই কুরআনের অনুরূপ কিছু বানিয়ে আনবে, তারা তা করতে সক্ষম হবে না। যদি এ ব্যাপারে তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয় (তবুও)।’ (সূরা আলে ইমরান-৮৮) এতদসঙ্গে আল-কুরআনে আল্লাহ পাক অকাট্যভাবে এই কথাও জানিয়ে দেন যে, ‘আমিই এই স্মরণসম্বলিত (আল কুরআন) নাযিল করেছি, আমিই একে সংরক্ষণ করবো।’ (সূরা হিজর-৯)
আল কুরআন আরবী ভাষার সর্বপ্রথম লিখিত দলীল বা নমুনা। পৃথিবীতে এমন আর কোনো ভাষা নেই, যা চৌদ্দশ বছর ধরে একইভাবে অক্ষত অবস্থায় বিরাজমান। শতাব্দীর পর শতাব্দী কত সময় অতিবাহিত হয়ে গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল কত নদীর কত গতিপথ, কত সভ্যতার কত উত্থান-পতন ঘটলো, ভাষা হারিয়ে গেল, জন্ম নিলো নতুন ভাষা। প্রসঙ্গত একটি বাককীতির উপমা তুলে ধরতে পারি, Faeder ure on heo-vfonum (প্রভুর প্রার্থনা, ম্যাথু ৬, বাইবেল ৯০০ পর্ব), জানানো হয়েছে এই কথার অর্থ ‘সদাপ্রভু পিতা স্বর্গে আছেন।’ কিন্তু এ থেকে এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তৎকালীন কোনো রচনাই বর্তমান ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে পরিচিত ও পাঠযোগ্য নয়। কিন্তু যে কোনো আরবিভাষী মানুষ কুরআন আজ সাবলীলভাবে পাঠও করতে পারে, কুরআনের কী বক্তব্য তা বুঝতেও পারে এবং এই কথা মধ্যবর্তী সকল শতাব্দীর সকল পাঠকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রখ্যাত পন্ডিত ড. হামিদুল্লাহ একটি ঘটনার বর্ণনা করেন। যেহেতু এ্যারামাইক (Aramaic) ভাষার মূল বাইবেল আর পাওয়া যায় না, খ্রীষ্টান পন্ডিতেরা একবার জার্মানীতে বাইবেলের সমস্ত গ্রীক পান্ডুলিপি একত্রিত করলেন। পৃথিবীর যেখানে যত পান্ডুলিপি ছিল, সব সংগ্রহ করার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল, ‘এই সব পান্ডুলিপির মধ্যে দুই লক্ষাধিক বৈপরিত্য ও স্ববিরোধী বক্তব্য বিদ্যমান ... যার এক অষ্টমাংশ অর্থাৎ পঁচিশ হাজার ভুল গুরুতর প্রকৃতির।’ এই প্রতিবেদন যখন প্রকাশিত হল, কিছু লোক মিউনিখে কুরআন গবেষণার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করল। উদ্দেশ্য, বাইবেলের মতো একইভাবে কুরআনকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচাই করে দেখা। এক বিশাল গবেষণা প্রকল্পের কাজ শুরু হল। যা প্রায় তিন প্রজন্মব্যাপী অব্যাহত ছিল। ১৯৩৩ সালের মধ্যে কুরআনের ৪৩,০০০ (তেতাল্লিশ হাজার) ফটোকপি সংগৃহীত হলো। সকল পান্ডুলিপি পরীক্ষার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হল তাতে দেখা গেল, তু্চ্ছ দু’একটি অনুলিখনের ভুল ছাড়া কোথাও কোনো বৈপরিত্য খুজে পাওয়া যায়নি।
আল কুরআন যে অলৌকিকভাবে সংরক্ষিত হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ কারণ হলো, কুরআনের প্রতি মুসলমানের এই প্রগাঢ় অনুরাগ ও ভক্তি ও সযত্ন মনোযোগ এবং এই বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত অনুপ্রেরণারও সুফল। একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূফফার সাহাবীদেরকে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে প্রতিদিন ভোরে গিয়ে ‘বুথান’ অথবা ‘আল আকীক’ (মদীনার সন্নিকটে অবস্থিত দুটি বাজার) থেকে কোনোরূপ অপরাধ ও সম্পর্কচ্ছেদ ছাড়াই দুটি বড় উটনী নিয়ে আসতে পসন্দ কর?’ তৎকালীন সময়ে উট ছিল খুবই মূল্যবান আর উটনী ছিল আরো মূল্যবান। অনেকটা বর্তমান সময়ের ঝকঝকে নতুন একটি মোটরগাড়ির মতো। সাহাবীদের রা. আগ্রহদৃষ্টে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল-কুরআন থেকে দুটি সূরা শিক্ষা দেয়া অথবা পাঠ করা দুটি উটনী লাভ করা থেকেও উত্তম এবং তিনটি সূরা তিনটি উটনী অপেক্ষা উত্তম। -সহীহ মুসলিম ১৩৩৬
এবং এজন্যই শতাব্দীর পর শতাব্দী এই মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর কিতাবের প্রতি এমন অভাবনীয় অনুরাগ ও ভক্তি অব্যাহত রেখেছে। ছেলেমেয়েদের জীবনে প্রথম পাঠ শুরু হয় এই কুরআন শিক্ষার মধ্য দিয়ে এবং কুরআন পাঠের মধ্য দিয়েই শুরু হয় মুসলমানের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা। আলকুরআন সাতটি অংশে বিভক্ত। এক একটি অংশকে বলা হয় ‘মনযিল’। অতএব প্রতি সপ্তাহে সম্পূর্ণ কুরআন পাঠ করা সম্ভব। আবার এই কুরআন ৩০ পারায় (Juz) বিভক্ত, সুতরাং প্রতি মাসেই কুরআন একবার পুরোপুরি পড়ে ওঠা যায়। আল-কুরআন হলো পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত এবং সর্বাধিক কণ্ঠস্থ একটি গ্রন্থ।
বর্তমান সময়ে আমরা অবশ্য কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করি। উপনিবেশবাদী শিক্ষাব্যবস্থা এবং টেলিভিশনের যৌথ ও যুগপৎ যে যন্ত্রণাদায়ক কষাঘাত, তাকে আমরা ‘ধন্যবাদ’ জানাই। এই দুই কষাঘাতের অশুভ প্রভাবের শিকার হওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলিম ছেলেমেয়ের জীবনে কুরআন আজ আর তাদের শিক্ষা ও জীবনগঠনের সাথে সম্পৃক্ত নয়। আমরা দেখতে পাই, বহু মুসলিম গৃহে কুরআন পাঠের ব্যবস্থা করা হয় কেবল কারো মৃত্যু ইত্যাদি ধরনের বিশেষ উপলক্ষে। এতদসত্ত্বেও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ও সমাজ, অন্তত বিগত কলঙ্কিত সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো এমন তমসাচ্ছন্ন হয়নি যে, কুরআন পাঠ একটা বড় রকমের ঝুঁকির ব্যাপার। সত্যই কী বদনসীব সেই ব্যক্তির, যে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে মারা যাচ্ছে অথচ তার হাতে রয়েছে নির্মল শান্তিদায়ক পানীয়! কী হতভাগা সেই ব্যক্তি, যে ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে অথচ তার নিজেরই হাতে ধরা আছে নিরাময়ের অব্যর্থ ঔষধ!
অবশ্যই আমরা কুরআন পাঠ করবো, বুঝতে চেষ্টা করবো এবং বাস্তব জীবনে তার ব্যবহারিক প্রয়োগেও সচেষ্ট হবো। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখা আবশ্যক যে, পূর্ণ আত্মস্থতা এবং পরিপূর্ণ আদব ও শিষ্টাচার হলো কুরআন পাঠ ও কুরআনের পয়গাম অনুধাবনের অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আমাদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হবে আল-কুরআনকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকা এবং সেটাই হবে প্রকৃত জীবন। অন্যথায় আমাদের জীবন হবে নিতান্তই বেঁচে থাকার ভান ও অভিনয়মাত্র।#