বাইতুল্লাহর মুসাফির-১১
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এবার আমরা রওয়ানা হবো মক্কার পথে পবিত্র হজ্বের উদ্দেশ্যে। আমার জীবনের প্রথম হজ্ব! স্বভাবতই অন্তরে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগছে বারবার! যে সৌভাগ্য আমারই নির্বুদ্ধিতায় হাতছাড়া হতে চলেছিলো, আল্লাহর অশেষ দয়া ও রহমতে আবার তা আমার কিসমতের দুয়ারে উপস্থিত! জাহিল বান্দাকে আর কতভাবে তুমি রহম করো হে মাওলা!
তোমার রহম ও করম দেখে মনে বড় আশা জাগে; এভাবেই তোমার অধম বান্দা যত, তাদের তুমি টেনে টেনে নিয়ে যাবে হে আল্লাহ! আমরা পথ হারাবো, তুমি পথ দেখাবে! আমরা ভুল করবো, তুমি শোধরে দেবে! তুমি যে রাহীম! তুমি যে রাহমান!
মদীনা শরীফ থেকে বিদায়ের বেদনা অন্তরে অবশ্যই ছিলো, কিন্তু এ আনন্দেও অন্তর পরিপূর্ণ ছিলো যে, এখন আমাদের সফর হবে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইকের ঝান্ডা নিয়ে! আগামী সূর্যোদয়ের আগেই ইনশাআল্লাহ আমাদের নছীব হবে বাইতুল্লাহর দীদার! হৃদয়ের গভীরে বেদনার সঙ্গে আনন্দের এই যে অপূর্ব মিলন তার অনুভব অনুভূতি অন্তত আমার পরিচিত কোন বর্ণমালায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শুধু প্রার্থনা করি হে ভাই, এই মিলনের স্বাদ ও শান্তি আল্লাহ যেন তোমাকেও দান করেন। তখন শুধু ভুলে যেয়ো না এ অভাগা ভাইকে! মাটির উপরে, কিংবা নীচে যেখানেই থাকি, তোমার কাছ থেকে কিছু উপহার যেন আমার কাছে আসে। যুগের যত দীর্ঘ ব্যবধান হোক তোমার আমার মাঝে, আমি তোমার জন্য হে ভাই দু‘আ করেছি, তুমিও আমার জন্য দু‘আ করো।
ধীরে ধীরে সবুজ গম্বুজ থেকে দূরে চলে এলাম। চলে আসতে হলো। বারবার ফিরে তাকাই এবং দেখতে পাই! একসময় আর দেখতে পেলাম না। তবু বারবার ফিরে তাকাই এবং মিনার দেখতে পাই! এক সময় আর দেখতে পেলাম না। হৃদয়ের পর্দায় তবু যেন আছে সবুজের ছোঁয়া! আমার হাবীব! আবার আমি আসবো, ইনশাআল্লাহ আবার আমি আসবো!
মুসাফিরখানায় এসে হযরত আমাদের একত্র করলেন। ইহরামের মাসায়েল বয়ান করলেন। হজ্বের হাকীকত ও ফযীলত আলোচনা করলেন। আমার মনে হলো হযরত যেন পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত আদায় করলেন। বিদায় হজ্বে রওয়ানা হওয়ার সময় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবা কেরামকে হজ্ব সম্পর্কে হিদায়াত দান করেছিলেন।
আমার নিজের জন্য এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয় মনে হলো যে, জীবনের প্রথম হজ্বের সফর মদীনা শরীফ থেকে শুরু হচ্ছে! নবীজীর বিদায় হজ্বের সফর তো মদীনা থেকেই শুরু হয়েছিলো! এতটুকু সাদৃশ্যের বরকতে হয়ত অধম বান্দার টুটাফাটা হজ্বও আল্লাহ কবুল করে নেবেন। তাঁর রহমত তো তালাশ করে শুধু বাহানা, আর এটা তো খুব সুন্দর ‘বাহানা’!
মদীনার পথে যারা হজ্বের সফর করেন তাদের মীকাত হলো যুলহোলায়ফা। মদীনা থেকে এর দূরত্ব হলো সাত আট মাইল। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবা কেরামকে নিয়ে বিদায় হজ্বের ইহরাম যুলহোলায়ফা থেকেই করেছিলেন।
আমরা বাস টার্মিনালের উদ্দেশ্যে মুসাফিরখানা থেকে বের হলাম। সউদী আরবের সরকারী পরিবহন সংস্থা ‘সাবকো’-এর বাসটার্মিনাল শহর থেকে বাইরে। আমার ইচ্ছা ছিলো হযরতের পিছনে বসবো, কিন্তু সম্ভব হলো না। অন্য গাড়ীতে বসতে হলো, তবে এই ফাঁকে একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়ে গেলো। অনেক ভাবনা চিন্তার পর এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোন বিশেষণ যোগ করা থেকে বিরত থাকলাম। কারণ, যদি বলি তিক্ত অভিজ্ঞতা তাহলে পূর্ণ সত্য বলা হয় না, কেননা এ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে আমি আমার হৃদয়ের গভীরে একটি স্নিগ্ধতা অর্জন করেছিলাম। যদি বলি মধুর অভিজ্ঞতা তাহলে অর্ধসত্য বলা হয়; কারণ এ অভিজ্ঞতা আমার হৃদয়ের আবরণে ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো এবং তা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিলো। তুমি যদি জানতে চাও, আমি বলবো না। কারণ তাতে আমি অনেক ছোট হয়ে যাবো। তবে সেদিন আমি যে শিক্ষা অর্জন করেছিলাম তা তোমাকে বলতে পারি; কেউ যদি আমার কাছে কিছু মিনতি করে আমি তা রক্ষা করতে চেষ্টা করবো; যদি না পারি, কোমলভাবে তার মিনতি তার হাতে তুলে দেবো, কিন্তু তার মনে ব্যথা দেবো না, এমনকি বিব্রত হওয়ার মত কোন কথাও তাকে বলবো না। স্খলন অবশ্যই ঘটে, তবু সেই ঘটনা স্মরণ করে এ শিক্ষা এখনো আমি পালন করে যাওয়ার চেষ্টা করি।
গাড়ীর চাকা চলতে শুরু করলো এবং আমার অন্তর দুলতে শুরু করলো। ক’দিন আগে এই আলোকনগরীতে আগমন করেছিলাম অন্তরে আনন্দের শিহরণ নিয়ে, আজ এখান থেকে আমাদের নির্গমন হতে চলেছে
বিচ্ছেদ-বেদনার দহন নিয়ে। হে আল্লাহ, আমাদের আগমন এবং নির্গমন দু’টোই যেন হয় কল্যাণময়। জীবনের যে সোনালী দিনগুলো তুমি সোনার মদীনায় অতিবাহিত করার তাওফীক দিলে, তোমার দরবারে তা যেন কবুল হয়। হে আল্লাহ, আমার মাঝে গান্দেগি ছিলো, অপবিত্রতা ছিলো, দুর্গন্ধ ছিলো। এই সব নিয়েই হে আল্লাহ, মদীনায় আমার আগমন ঘটেছিলো। তোমার কাছে হে আল্লাহ, সেদিন আমি প্রার্থনা করেছিলাম, আমার সমস্ত অপবিত্রতা ও দুর্গন্ধ থেকে মদীনাকে তুমি পাকছাফ রাখো এবং মদীনার পবিত্রতা দ্বারা
আমাকে পবিত্র করে দাও এবং মদীনার সুবাস দ্বারা আমাকে সুবাসিত করে দাও। হে আল্লাহ, তোমার প্রতি সুধারণা, আমার দু‘আ তুমি কবুল করেছো এবং মদীনার পবিত্রতা দ্বারা পবিত্র এবং মদীনার সুবাস দ্বারা সুবাসিত হয়ে আজ আমি মদীনা হতে বিদায় গ্রহণ করছি।
দেখতে দেখতে যুলহোলায়ফার মীকাত এসে গেলো। এখন এটি বীরে আলী নামে পরিচিত। বাংলাদেশের হাজীদের ধারণা, এটি হযরত আলী (রা)-এর কূপ। এখানে এসে তারা হযরত আলী (রা.)-এর কুয়া তালাশ করে এবং না পেয়ে হতাশ হয়। প্রথম কথা, এখানে একসময় যে কুয়াটি ছিলো এখন তার অস্তিত্ব নেই। কালের করাল গ্রাসে অনেক কিছু হারিয়ে যায়; সময়ের স্রোতে অনেক কিছু ভেসে যায়। মদীনা শরীফে পূর্ব যুগের অনেক কুয়া এখন আর নেই। নেই অনেক প্রসিদ্ধ খেজুর বাগানের অস্তিত্ব। তের শতকের বিখ্যাত কিতাব ‘আখবারুল ওয়াফা’-এর পাতায় পাতায় মদীনার যে চিত্র পাওয়া যায়, যে চিহ্ন ও স্মৃতি-
চিহ্নের উল্লেখ দেখা যায় তার কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই।
সেই নুরানি যুগের সাক্ষী হয়ে অটল অবিচল আছে শুধু পাহাড়-পর্বতগুলো। তাও বা সময়ের থাবা থেকে রক্ষা পেলো কোথায়! প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এখানেও সমানে চলছে পাহাড়-কর্তন। তো বলছিলাম, বীরে আলীর কোন অস্তিত্ব এখন এখানে নেই। দ্বিতীয়ত যা ছিলো সেটি হযরত আলী (রা)-এর কুয়া নয়, বরং অনেক পরের যুগে আলী নামের অন্য কোন ব্যক্তির কুয়া।
মদীনায় একটি কুয়া অবশ্য এখনো আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়, যার পানি আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করেছিলেন। সে কুয়া আমরা দেখেছি। কুয়াটি দেখে আমার মনে হয়েছে, যদি যত্ন করা হতো তাহলে সেই কুয়ার পানি এখনো পাওয়া সম্ভব হতো। উম্মত যেখানে নবীর সুন্নাতই ছেড়ে দেয়, সেখানে নবীর স্মৃতি ধরে রাখার প্রেরণা আর আসবে কোত্থেকে?!
এক সময় এখানে যুলহোলায়ফায় - এমনকি হযরত হাফেজ্জী হুযূরের প্রথম হজ্বের সময়ও - হাজীদের ইহরাম গ্রহণের কোন সুব্যবস্থা ছিলো না। পানির ইন্তিযাম ছিলো নামমাত্র। গোসল করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব ছিলো না। ছোট ও জীর্ণ একটি মসজিদ ছিলো শুধু। তাই তখন অনেকেই মদীনা শরীফ থেকে গোসল করে ইহরাম বেঁধে নিতো। আবার অনেকে ইহরামের লেবাস পরতো মদীনায়, কিন্তু ইহরাম
ধারণ করতো এখানে যুলহোলায়ফায়।
গোসল করা অবশ্য ফরয বা ওয়াজিব নয়, মুস্তাহাব। গোসলের সমস্যা হলে শুধু অযু করাই যথেষ্ট। আর ইহরামের লিবাস পরা দ্বারাই মানুষ
মুহরিম হয়ে যায় না। ইহরাম শুরু হয় দু’রাকাত নামাযের পর ইহরামের নিয়তে তালবিয়া পড়া দ্বারা। এ বিষয়টি মনে রাখা খুব জরুরি। ইহরাম যদি শুদ্ধ না হয় তাহলে তো পুরো হজ্বই বাতিল, সবকিছু বেকার। বহু হাজীর কথা শুনেছি এবং নিজের চোখে কিছু হাজী দেখেছি, ইহরাম সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান নেই। অথচ তারা দিবিব ‘আলহাজ্ব’ হয়ে দেশে ফিরে আসছেন! সারা জীবনে একবার মাত্র ফরয, ইসলামের এ মহাগুরুত্বপূর্ণ রোকনটি সম্পর্কে আমাদের এহেন অবহেলা ও অজ্ঞতা সত্যি মর্মান্তিক।
যার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে তার প্রথম কর্তব্য হলো একজন অভিজ্ঞ আলিমের নিকট হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল জেনে নেয়া। তারপর হজ্বের আহকাম সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন কিতাব সঙ্গে রাখা, যাতে প্রয়োজনে তা থেকে সাহায্য নেয়া যায়। সবচে’ ভালো হয় বিশ পঁচিশজনের একটি কাফেলায় একজন আলিমকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, যিনি হজ্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল বিষয়ে সফরসঙ্গীদের সাহায্য করতে পারেন।
একথাগুলো এখানে বিশেষভাবে বলার কারণ যুলহোলায়ফায় দেখা একটি ঘটনা। ইহরাম গ্রহণ করে সকল যাত্রী যখন বাসে ফিরে এসেছেন তখন জানা গেলো ভারতের সম্ভবত রাজস্থানের এক হাজী ছাহেব শুধু ইহরামের লিবাস পরে চলে এসেছেন। না অযু, না গোসল, না নামায, না ইহরামের নিয়ত, আর না তালবিয়া। এমনকি তালবিয়া কি ‘বস্ত্ত’ সেটাই জানা নেই বেচারার। আরো আশ্চর্যের বিষয়, হাজী ছাহেবের যারা সফরসঙ্গী তারা কেউ খেয়াল করেননি। আমাদের সফরসঙ্গী মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেছবাহ ‘হাজী বেচারা’র সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টি জানতে পারেন। পরে গাড়ীর চালককে অনেক করে বুঝিয়ে গাড়ী ফেরানো হয় এবং হাজী ছাহেবকে যথা নিয়মে ইহরাম করানো হয়।
মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেছবাহ এখন দুনিয়ায় নেই। আল্লাহ তাকে বেলা-হিসাব জান্নাত নছীব করুন। হজ্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছি, পরিচিত-অপরিচিত, বাংলাদেশী-অন্যদেশী হাজীদের হজ্বের খোঁজ খবর নিতেন। আল্লাহর রহমতে বহু হাজীর হজ্ব তার ওছিলায় ছহী-শুদ্ধ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, অনেক হজ্বের ছাওয়াব তার আমলনামায় সেবার জমা হয়েছিলো। যেসকল আলিমকে আল্লাহ হজ্বের তাওফীক দান করেন, আমি মনে করি, এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।
ফিরে আসি আমাদের নিজেদের কথায়, নিজেদের চিন্তায়।
যুল হোলায়ফার সমস্ত ব্যবস্থা এখন অত্যন্ত উন্নতমানের। অযুখানা, গোসলখানা ও ইস্তিনজাখানা যেমন আরামদায়ক তেমনি পর্যাপ্ত এবং মহিলা ও পুরুষদের সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা। এমনকি সুগন্ধি সাবানও রয়েছে গোসলখানায়।
স্বাস্থ্যগত দিক লক্ষ্য করে হযরত হাফেজ্জী হুযূরকে গোসলের পরিবর্তে শুধু অযু করার পরামর্শ দেয়া হলো। হযরত মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, এই যুলহোলায়ফায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসল করে ইহরাম গ্রহণ করেছেন, আর আমি অধম উম্মতি এত আরামের ইন্তিযাম থাকা সত্ত্বেও তাঁর অনুসরণ করবো না!
হযরত পূর্ণ ইতমিনানের সঙ্গে গোসল করলেন। অথচ আমার মত যুবক ‘ভিড়ের’ ভয়ে গোসল না করার চিন্তা শুরু করেছিলাম। মাসআলার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে, তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হজ্ব কিন্তু মাসআলার নাম নয়; হজ্ব হলো ইশক ও মুহাববাতের এবং প্রেম ও ভালোবাসার নাম। হজ্বের প্রতিটি আমলের মাধ্যমে বান্দাকে প্রমাণ করতে হয় যে, সে এখন যুক্তি ও বুদ্ধির খোলস থেকে বের হয়ে এসেছে। সে এখন হৃদয়ের রাজ্যে এবং প্রেম ও ভালোবাসার জগতে প্রবেশ করেছে। প্রতিটি পদে ও পদক্ষেপে এখন সে তালাশ করবে যে, আল্লাহর নবী কিভাবে হজ্ব করেছেন? কোথায় কোন্ আমল কিভাবে আদায় করেছেন। প্রতিটি আমলে সে অনুসরণ করবে তার নবীকে,
অন্তত অনুসরণ করার চেষ্টা করবে, যাতে তার হজ্ব অন্তত ছুরতের দিক থেকে নবীর হজ্বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। তাই আমাদের হযরত অসুস্থতা সত্ত্বেও গোসলের সুন্নত থেকে বিরত থাকতে রাজি হলেন না, বরং এমন পরামর্শ দেয়ার কারণে মনঃক্ষুণ্ণতা প্রকাশ করলেন। আসলে বাইরের হজ্ব তো আমরা সবাই করি, কিন্তু ভিতরের হজ্ব ক’জন করি?!
গোসলের পর ইহরামের সাদা লেবাস পরে আমরা মসজিদে প্রবেশ করলাম। কালীন বিছানো বিরাট শানদার মসজিদ। লোকে লোকারণ্য। সকলে রওয়ানা হয়েছেন হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ডাকে মিনা-আরাফায় হাজির হওয়ার জন্য, মিল্লাতে ইবরাহীমের প্রতি আনুগত্যের নতুন শপথ গ্রহণের জন্য। আশিক ও প্রেমিকের জন্য রয়েছে আলাদা লেবাস; সেই শুভ্র-পবিত্র লেবাস তারা এখানে ধারণ করছেন। হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু নেই কোন গোল বা শোরগোল! পূর্ণ প্রশান্ত ও ভাবগম্ভীর পরিবেশ!
ইহরামের সাদা লেবাসে পুরো মসজিদে এক অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য হলো। কোথাও যেন কোন কলংক নেই, কালিমা নেই; ময়লা নেই, দাগ নেই। বাইরের শুভ্রতা আমাদের সবার ভিতরের জগতকেও যেন শুভ্র-পবিত্র করে দিলো। মনে হলো মসজিদে যেন এক নূরানি জামা‘আতের সমাবেশ! এরা যেন সুদূর অতীতের সেই নূরানি জামা‘আতের অবশেষ! ধীরে ধীরে ভাবতন্ময়তা আমাকে এমন আচ্ছন্ন করলো যে, সময়ের ব্যবধান মুছে গেলো। অতীতের রাজপথ ধরে মুহূর্তের মাঝে আমি চলে গেলাম পিছনে, অনেক পিছনে; একেবারে চৌদ্দশ বছর পেছনে। আধুনিক সভ্যতার কোন চিহ্ন নেই সেখানে; আছে শুধু মরুভূমির বালু,আর উটের কাফেলা। আমি যেন দেখতে পেলাম সেই নূরানী কাফেলাকে। আমিও যেন স্নাত হলাম সেই নূরানিয়াতে! ঐ যে ইহরামের সাদা লেবাসে কারা দাখিল হলো, নামাযে দাঁড়ালো, রুকু করলো, সিজদায় গেলো! কাদের নূরানি আওয়ায শুনতে পেলাম, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শারিকা লাকা লাববাইক ...
লাববাইক ধ্বনির মাঝেই আমি আমার তন্ময়তা থেকে জাগ্রত হলাম। আমি বুঝতে পারলাম, আসলে এতক্ষণ আমার
ভাবনায় ও চেতনায় অতীত ও বর্তমানের লাববাইক ধ্বনির তরঙ্গমিশ্রণ ঘটেছিলো। কিংবা আমি বর্তমানের লাববাইক ধ্বনিতে অতীতের লাববাইক ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি শুনেছিলাম!
হযরত নামাযে দাঁড়াবেন, আমি কাছে গিয়ে বললাম, হযরত! আমার ইহরামের লেবাস ঠিক করে দিন। হযরত মৃদু হেসে আমার চিবুক স্পর্শ করলেন এবং ইহরামের চাদরটা ঠিক করে দিলেন। এটা তো আমি নিজেই পারতাম, আসলে
অন্তরের ইচ্ছা ছিলো, আমার ইহরামের লেবাস যেন হযরতের পবিত্র হাতের স্পর্শ লাভ করে। স্পর্শ তো অন্য কিছু! স্পর্শই তো সবকিছু! ফুলের স্পর্শ কি তোমার মাঝে কোন অনুভূতি সৃষ্টি করে না! তাহলে ফুলের মত পবিত্র যারা, তাদের স্পর্শ কি তোমার মাঝে পবিত্রতার অনুভূতি সৃষ্টি করবে না!
নামায শেষ হলো। ইহরামের নিয়ত করে হযরতের সঙ্গে আমরা তালবিয়া পাঠ করলাম। আমি আমার জীবনের প্রথম হজ্বের, ফরয হজ্বের মুহরিম হয়ে গেলাম। পরিচিত জীবন ও জগতকে পরিত্যাগ করে আমরা নতুন লেবাসে নতুন এক জগতে প্রবেশ করলাম। আমি সেই জগতের আসল বাসিন্দা না হলেও তাদের কাতারে শামিল হয়ে গেলাম। আমার সেই সময়েয় দিলের অনুভব-অনুভূতি কেমন ছিলো তা কিভাবে বোঝাবো?! আর মানুষকে তা বোঝানোর প্রয়োজনই বা কী?! আফসোস শুধু এই যে, জীবনের দীর্ঘ পথে চলতে গিয়ে সেই অনুভব-অনুভূতিগুলো নিজের মাঝে আর ধারণ করে রাখতে পারিনি। ইশক ও মুহাববাতের ‘জিয়ন-কাঠি’র ছোঁয়ায় আমি যেন তখন এক জীবন্ত মানুষ হয়ে উঠেছিলাম। এখন নিজেকে মনে হয় সেই জীবন্ত মানুষটির প্রাণহীন ছবি! তবু এখনো আল্লাহ যতটুকু রেখেছেন সে জন্য আল্লাহর শোকর।
হযরত আমাদেরকে নিয়ে মুনাজাত করলেন। হজ্বের ইহরাম গ্রহণ করে এবং ইহরামের শুভ্র লেবাস ধারণ করে আল্লাহর দরবারে এটা আমার প্রথম মুনাজাত। আমার তখন এমনই আত্মহারা অবস্থা যে, হৃদয়ের আকুতি নিবেদন করার মত কোন শব্দ খুঁজে পেলাম না। ভিতরে ভিতরে আবেগের তরঙ্গে শুধু দোল খেলাম, আর হযরতের মুনাজাতের সঙ্গে আমীন আমীন বলে গেলাম।
মুনাজাত শেষ হলো, হযরত আমাদের বললেন, হজ্বের ফযীলত তো বয়ান করে শেষ করা যাবে না; তবে আর কোন ফযীলত যদি নাও থাকে, এতটুকু ফযীলতই তো যথেষ্ট যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্ব করেছে, আর হজ্বের অবস্থায় কোন অশ্লীলতা ও অনাচার করেনি, সে হজ্ব থেকে ফিরে আসবে ঐ দিনের মত যেদিন তার মা তাকে জন্মদান করেছে।’
সুবহানাল্লাহ! আমাদের সামনে এখন সুযোগ এসেছে সারা যিন্দেগির সমস্ত গোনাখাতা থেকে পাকছাফ হওয়ার। সুতরাং আমাদের খুব হুঁশিয়ার থাকা চাই, নফস ও শয়তানের ধোকায় যেন না পড়ে যাই এবং কোন প্রকার গোনাহ ও নাফরমানি যেন না হয়ে যায়। অশ্লীল ও ফাহেশা কথাবার্তা যেন না হয়, কারো সাথে কোন রকমের ঝগড়া-বিবাদ যেন না হয়। তুমি যদি হকের উপর থাকো তবু ঝগড়া-বিবাদ না করা চাই। দিলের মধ্যে এ কথা সর্বদা ইয়াদ রাখা চাই যে, ইহরামের লেবাস তো কাফনের লেবাস, মুরদা মানুষের লেবাস। মুরদা মানুষ কিভাবে গোনাহ করতে পারে?! মুরদা মানুষ কিভাবে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতে পারে?! মওতের মুরদা তো আমাদের হতেই হবে, তাহলে ইহরামের মুরদা আমরা কেন হতে পারবো না?! তো আজ থেকে ইহরামের শেষ দিন পর্যন্ত আমরা মুরদা হয়ে গেলাম। আল্লাহ না করেন যদি কখনো ভুল হয়ে যায়, পরস্পরকে আমরা ইয়াদ করিয়ে দেবো যে, ভাই, আমরা তো এখন ইহরামের মুরদা ইনসান! সঙ্গে সঙ্গে ইস্তিগফার করে নেবো। ভুল হয়ে যাওয়া বড় খাতরার বিষয় না, বড় খাতরার বিষয় হলো ভুলের উপর গাফলাত। গাফলাত থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।
সুবহানাল্লাহ! এসব কথা কি আগে শুনিনি! পড়িনি! কিন্তু বহুবার পড়া ও শোনা কথাগুলোই যখন হযরতের যবান থেকে বের হয়ে আসে তখন সবকিছু যেন অন্য রকম হয়ে যায়! দিলের দুনিয়া যেন একেবারে বদলে যায়! অন্তরের গভীরে গিয়ে যেন আঘাত করে, তবে কঠিন আঘাত নয়, কোমল আঘাত, ধীরে ধীরে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার মত। হযরতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেব একটা চিৎকার দিলেন, যেন জিগরফাটা চিৎকার! পুরো হজ্বের সফরে এই মানুষটিকে মুরদা মানুষই মনে হয়েছে আমার। হাঁটা-চলায় এবং ওঠা-বসায় তিনি আমাদের মাঝে ছিলেন, কিন্তু অন্য জগতে! হযরত অনেকবার তাঁর প্রশংসা করেছেন। এখনো তিনি বেঁচে আছেন এবং পৃথিবীর আলো-বাতাসকে নূরানিয়াত দান করছেন। তাঁর স্নেহ-শিশিরে আমি সবসময় সিক্ত। আমার জন্য তিনি যে সকল দু‘আ করেন ইনশাআল্লাহ যদি তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় তাহলে আমি বড় ভাগ্যবান। আল্লাহ তাঁকে সুন্দর দীর্ঘ জীবন দান করুন, আমীন।
হযরতের নছীহত শুনে আমি খুব আপ্লুত হলাম এবং মনে মনে প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ! তোমার দেয়া ইহরামের কাফনে মুরদা সেজে তোমার ঘরে রওয়ানা হয়েছি। হে আল্লাহ, আমি যেন মুরদা হই, আমার হজ্ব যেন জীবন্ত হয়।
হযরতের পিছনে পিছনে মসজিদ থেকে বের হলাম। হযরত দাঁড়িয়ে দেখলেন, সবাই এসেছে কি না? শেষ মানুষটি না আসা পর্যন্ত হযরত অপেক্ষা করলেন। সবাই একত্র হওয়ার পর হযরত বাসের দিকে রওয়ানা হলেন। আমার মনে হলো, হযরত এখানে একটি সুন্নত আদায় করলেন, কাফেলার সঙ্গীদের ‘খবরগিরি’ করার সুন্নত। আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের সময় অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, যাতে হজ্বের সফরে যারা শরীক হতে চায় তারা প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে পারে। যোহরের পর মদীনা শরীফ থেকে রওয়ানা হয়ে যুলহোলায়ফায় তিনি আছর আদায় করেছেন এবং পরবর্তী দিন যোহর পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেছেন, যাতে বিলম্বে আসা লোকেরা কাফেলায় শামিল হতে পারে। এখানেও নবীজী তাঁর আমল দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, কাফেলার যিনি আমীর, তার কর্তব্য হলো অন্য সবার প্রতি লক্ষ্য রাখা। হযরত যেন কিছু সময় অপেক্ষা করার মাধ্যমে সেই সুন্নত আদায় করলেন। পুরো সফরেই দেখেছি, আমরা হযরতের আরামের যতটা না খেয়াল রেখেছি, তিনি আমাদের খেয়াল রেখেছেন তার চেয়ে বেশী। আমরা হজ্বের প্রতিটি আমল ঠিকমত করতে পারছি কি না সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিলো। একটি কথা আমার বলতে ইচ্ছে করে, আমাদের আমীরে কাফেলার হজ্ব ছিলো যেন সেই মহান আমীরে কাফেলার হজ্বের প্রতিচ্ছায়া। কিতাবে যা পড়েছি তাই যেন স্বচক্ষে অবলোকন করেছি।
গাড়ীর চাকা সচল হলো। গাড়ী চলতে শুরু করলো বাইতুল্লাহর পথে। এখন আমি বাইতুল্লাহর মুসাফির! স্বপ্ন এখন শুধু স্বপ্ন নয়; আমার জীবনের স্বপ্ন এখন পূর্ণ পেখম মেলা ময়ূর!
আল্লাহ যে তার খলীলকে আদেশ করেছিলেন-
‘মানুষের মাঝে ঘোষণা দাও হজ্বের, আসবে তারা তোমার কাছে পদব্রজে এবং সকল শীর্ণ বাহনের উপর; আসবে তারা সকল দূরবর্তী পথ থেকে।’
তখন থেকে শুরু হয়েছে হযরত ইবরাহীম খালীলের দাওয়াতি কাফেলার যাত্রা। আমি এখন সেই কাফেলার লাববাইক বলা মুসাফির। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
এমন মোবারক সফর যেন গাফলতের ঘোরে কেটে না যায়, সেজন্য হযরতের নির্দেশে মাওলানা ফযলুল হক আমীনী ছাহেব কিছু কথা বললেন। অধিকাংশ যাত্রী উর্দুভাষী, তাই তিনি উর্দুতে বললেন। তার আশ্চর্য সুন্দর ও ‘সাফসুথরা’ উর্দু শুনে হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো আমার প্রিয় উস্তায মাওলানা আব্দুল হাই বরিশালী ছাহেবের কথা। তিনি আমীনী ছাহেবের সহপাঠী। তিনিও ‘খুবছূরত’ উর্দু বলেন! মানুষের মন বড় অদ্ভুত! কাউকে যখন মনে পড়ে না, সবরকম উপলক্ষ থাকা সত্ত্বেও মনে পড়ে না। যখন মনে পড়ে, ক্ষীণতম উপলক্ষেও মনে পড়ে যায়। হুযূরকে মনে পড়ে খুব আফসোস হলো। রামাযানের সফরে হুযুরের সাথে দেখা করেছিলাম, এবার দেখা করে আসা হয় নি, অথচ তিনি আমার মুহসিন উস্তায। আরবী ভাষার প্রতি আমার দিলে যে মুহববত তা তাঁরই ছোহবতের বরকত। এজন্য ‘এসো আরবী শিখি’ কিতাবটি আমি হুযুরের নামে উৎসর্গ করেছি। খুব অনুশোচনা হলো যে, এমন মুহসিন উস্তাযের কথা ভুলে গেলাম! তখন আর কী করতে পারি! হুযুরের জন্য দিলভরে দু‘আ করলাম। হযরতের কাছেও দু‘আ চাইলাম, আল্লাহ যেন তাঁকে বাইতুল্লাহর মকবূল সফর নছীব করেন। আমীনী ছাহেবের প্রতিও মনে মনে কৃতজ্ঞ হলাম, তাঁর ওছিলায় অন্তত এখন তো মনে পড়লো।
লালবাগ মাদরাসায় তারা দু’জন যখন দাওরাতুল হাদীছ পড়েন, আমি তখন ইবতেদা আউয়ালের এক নাদান ছাত্র। সেই দৃশ্যটি এখনো মনে পড়ে; একটি ভুল কাজ করতে দেখে বরিশালী হুযূর আমকে কাছে ডেকে বলেছিলেন,আপনিও ছাত্র, আমিও ছাত্র। আমার কোন ভুল দেখলে আপনি আমাকে সতর্ক করবেন, আপনার কোন ভুল দেখলে আমি আপনাকে সতর্ক করবো। ... কী প্রজ্ঞা! কী স্নেহ ও মমতা! এমনই ছিলেন সেযুগের ‘ছাত্র’!
পরে তো তিনি আমার উস্তাযই হলেন এবং বড় মুহসিন
উস্তায। তাঁর হক আদায়ের ক্ষেত্রে সবসময় আমার ত্রুটি হয়েছে, এবারও হলো। আল্লাহ মাফ করুন।
হয়ত প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা বিচ্যুতি ঘটলো, কিন্তু মানুষের বুকে যে দিল, তারও তো কিছু দাবী থাকে! অনেক সময় প্রসঙ্গ থেকে বিচ্যুত হয়েও সে দাবী পুরা করতে হয়।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পথ এগিয়ে গেছে। সেই পথ ধরে বাস ছুটে চলেছে, আর বাসের ভিতরে তালবিয়ার সমধুর আওয়ায ধ্বনিত হচ্ছে-
লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারীকা লাকা লাববাইক।
ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি‘মাতা লাকা ওয়ালমুলকা লা-শারীকা লাকা।
(আমি হাযির! হে আল্লাহ, আমি হাযির! তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির! সকল প্রশংসা তোমার, সকল নেয়ামত তোমার এবং তোমারই জন্য সকল রাজত্ব। তোমার নেই কোন শরীক।)
তালবিয়ার মাঝে ইশক ও মুহববতের কী স্বাদ ও লয্যত আল্লাহ রেখেছেন তা তো জানেন শুধু আল্লাহর আশিক ও প্রেমিক বান্দাগণ। আমাদের মত মুরদা দিলেও তালবিয়া যখন ভাবের এমন তরঙ্গ সৃষ্টি করে, তখন তাদের দিলের অবস্থা কী হয় ! কী হতে পারে!
হযরতের দিলের ভিতরে তাকাবার কোন জানালা যদি থাকতো! বাইরে এমন শান্তসমাহিত রূপ, ভিতরেও কি তাই! নাকি দিলের দরিয়ায় উঠছে মওজের পর মওজ!
লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শারীকা লাকা লাববাইক!
ইহরামের লেবাস এবং তালবিয়া তো অন্য কিছু নয়, মেযবানের পক্ষ হতে মেহমানের ইকরাম! তোমার শোকর, হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
আয়নার মত ঝকঝকে মসৃণ সড়কে বোঝা যায় না, গাড়ী চলছে না থেমে আছে! মরুভূমির উপযোগী উপমা নয়, তবু মনে হলো, নদীর শান্ত পানির উপর দিয়ে তরতর করে যেন ভেসে চলেছে।
এ যুগের সফর কত আরামের, আর সে যুগের সফর ছিলো কত কষ্টের! তবু কেন আমাদের মাঝে এত অভাব শোকরের! ছয় সাত ঘণ্টায় ইনশাআল্লাহ আমরা পৌঁছে যাবো মক্কা শরীফে! অথচ খুব বেশী দূর অতীতের কথা নয়, আমাদের হযরত বলেছেন তাঁর জীবনের প্রথম হজ্বের কথা! তখন উটের কাফেলা ছিলো, বাসের সফরও ছিলো। কিন্তু বর্তমানের আরামদায়ক বাসের সাথে তার কোন তুলনাই চলে না। যখন মরুভূমির লু হাওয়া চলতো, হযরতের ভাষায়, ‘বাসের ভিতরে সবাই যেন ভুনা হয়ে যেতো।’ দু’একজন মারাও যেতো এবং মরুভূমিতেই তাদের দাফনের ব্যবস্থা করে কাফেলা আগে রওয়ানা হয়ে যেতো। পাকা রাস্তা বলতে কিছুই ছিলো না। দু’দিনের বেশী লেগে যেতো বাসের সফরে, আর উটের সফর ছিলো নয় দশদিনের।
আমার সৌভাগ্য, এবার কোন চেষ্টা না করেই হযরতের পাশে বসার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি আরয করলাম, হযরত! আমার একটি আবদার আছে। কীভাবে কীভাবে আল্লাহ আমার উপর এত দয়া করেছেন। জীবনের প্রথম হজ্বের সফর, তার উপর আপনার ছোহবতের নেয়ামত! কীভাবে আমি আল্লাহর শোকর আদায় করবো!
হযরত! আপনি আমাকে এখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের সফরের ঘটনা শোনাবেন; মদীনা থেকে রওয়ানা হয়ে মদীনায় ফিরে আসা পর্যন্ত পুরো ঘটনা।
আমার ধারণা ছিলো হযরত হয়ত এখন কথা বলা পছন্দ করবেন না। হয়ত এখন তিনি নিজের মাঝে বিভোর থাকাই পছন্দ করবেন। কিন্তু না, হযরত বরং খুশী হয়ে বললেন, চলো, তোমার ওছিলায় একটি বরকতপূর্ণ মুযাকারা হোক, তাতে হয়ত আমাদের সফরও কিছুটা জানদার হবে।
হযরত খুব স্বাদ ও লয্যত নিয়ে বয়ান করলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের পুরো ঘটনা। কীভাবে তিনি মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছেন; পথে কোথায় কোথায় মনযিল করেছেন। কীভাবে মক্কায় প্রবেশ করেছেন; মিনায় গমন করেছেন, আরাফায় ওকূফ করেছেন, মুযদালিফায় রাত্রিযাপন করছেন, রামীজামারা ও কোরবানি করেছেন এবং মক্কায় ফিরে এসে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেছেন? বিশদভাবে হযরত সবকিছু বয়ান করলেন। তিনি এমন জোশ ও উদ্দীপনা এবং জাযবা ও উচ্ছ্বাসের সাথে বর্ণনা করলেন যেন বৃদ্ধের অবয়বে তারুণ্যের ছবি! শুরু থেকে শেষ সমস্ত ঘটনা যেন তাঁর চোখের সামনে! বুখারী-মুসলিমের কিতাবুলহজ্ব অধ্যায়ে বিদায় হজ্বের বর্ণনা পড়েছি খুব বেশী দিন হয়নি। কিন্তু আজ যা শুনলাম তাতে কালব ও রূহ যেন আবার তাজা হলো, ইশক ও মুহাববাত যেন নতুন শাওক ও জাযবা লাভ করলো, বরং আমি যেন হজ্বের সফরে হজ্বের নতুন তারবিয়াত হাছিল করলাম। এতে আমার মনে হলো, হজ্বের সফরে এভাবে যদি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের বয়ান শোনা হয় তাহলে তা অশেষ বরকতের কারণ হতে পারে। ক’জন হাজী ছাহেব জানেন বিদায় হজ্বের বয়ান! বাইতুল্লাহর আশেক এবং নবীর প্রেমিক যারা তাদের জন্য এ অজ্ঞতা কি লজ্জার বিষয় নয়?!
পূর্ণ গতিতে গাড়ী এগিয়ে চলেছে মক্কার পবিত্র ভূমির দিকে, আর হযরত বয়ান করে চলেছেন পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের মোবারক ছফরের কাহিনী। বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে আমি তাকিয়ে আছি হযরতের নূরঝলমল চেহারার দিকে। আমার কানে যেন মধুবর্ষণ এবং হৃদয়ে যেন আলোর প্লাবন। আমার সমগ্র অস্তিত্বে যেন আনন্দের শিহরণ। আমার স্রষ্টার প্রতি, আমার আল্লাহর প্রতি শোকর ও কৃতজ্ঞতার গভীর অনুভূতিতে আমার হৃদয়-মন আপ্লুত হলো। হজ্বের সফরে আমিও আজ মদীনা থেকে মক্কার যাত্রী! এই যে ক্ষীণতম সাদৃশ্য, এরও কোন বরকত রয়েছে নিশ্চয়! তাই তো আজকের আরামের সফরের মাঝেও অনুভব হলো সেই নূরানী কাফেলার নূরানী সফরের কিছুটা স্নিগ্ধতা! কিছুটা পবিত্রতা! আমি যেন এযুগের ‘শীতল’ গাড়ীর আরামের যাত্রী নই; আমি যেন সে যুগের উত্তপ্ত মরুর উটের কাফেলার
মুসাফির। সময়ের সীমারেখা যেন মুছে গেছে ভাবের এবং অনুভবের প্রবল প্রবাহে। উটের দুলুনিতে দোল খেয়ে, আনন্দের তরঙ্গে আন্দোলিত হয়ে আমিও যেন এগিয়ে চলেছি সেই কাফেলার পিছনে পিছনে।
হযরত বললেন, ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুল হোলায়ফা থেকে রওয়ানা হয়ে রওহা নামক স্থানে মনযিল করলেন। মদীনা থেকে রওহা দুই রাত্রির দূরত্ব। এখনো তা রওহা নামেই পরিচিত। আমার প্রথম সফরের সময়ও উটের কাফেলা রওহায় মনযিল করতো। পরে আর সেখানে মনযিল হতো না।
মদীনা থেকে রওয়ানা হওয়ার পর এটা ছিলো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বিতীয় মনযিল।’
আমি আরয করলাম, হযরত! নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথে সফর করেছেন এবং যেখানে যেখানে মানযিল করেছেন, এখনো যদি সে পথেই সফর হতো এবং মানযিলে মানযিলে কিছুক্ষণ গাড়ী থামতো তাহলে কি ভালো হতো না? এযুগের মুরদা সফরগুলো সেই সফরের অনুকরণের বরকতে কিছুটা কি জানদার হতো না?
হযরত বললেন, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই হয় এবং তাতেই কল্যাণ।
হযরত বললেন, রওহা উপত্যকায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়েছেন এবং ইরশাদ করেছেন, আমার আগে সত্তরজন নবী এখানে নামায পড়েছেন।
স্থূল চোখে যদিও রওহার সেই পবিত্র উপত্যকা আমার দেখা হলো না, কিন্তু কল্পনার দৃষ্টিকে বাধা দেবে কে? কল্পনার চোখে তো আমি দেখতে পেলাম সেই উপত্যকায় সেই নূরানী কাফেলার মানযিল এবং আমার হৃদয়-মন আপ্লুত হলো অভূতপূর্ব এক অনুভবে!
হযরত বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তৃতীয় মানযিল ছিলো আলআছায়া। মদীনা থেকে এর দূরত্ব সাতাত্তর মাইল। চতুর্থ মানযিল ছিলো আলআরজ। এর দূরত্ব নববই মাইলের কিছু বেশী।
হযরত বললেন, প্রত্যেক মানযিলে অবতরণের পর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফেলার সকলের খোঁজ-খবর নিতেন এবং বিভিন্ন কাজ সকলের মাঝে বন্টন করে দিতেন। তিনি নিজেও ছাহাবা কেরামের সঙ্গে কাজে শরীক হতেন। এটা ছিলো তাঁর সারা জীবনের আদত শরীফ।
হযরত বললেন, ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পঞ্চম মানযিল ছিলো আবওয়া। যত দিন উটের সফর ছিলো তত দিন আবওয়া ছিলো হজ্বের কাফেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানযিল।’
এবারও আমি কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম আবওয়ার উপত্যকা এবং সেই নূরানী কাফেলার রাতের মানযিল। আমি দেখতে পেলাম আকাশে তারাদের ঝিলিমিলি, আর মরুপ্রান্তরে শত শত মশালের আলোকসজ্জা। আকাশ ও পৃথিবী সেখানে যেন একসাথে আলোকিত হয়েছিলো।
আমাদের নবীজী শৈশবে মা আমেনার সঙ্গে মদীনায় এসেছিলেন। মদীনা থেকে মক্কায় ফেরার পথে আবওয়ার বালুভূমিতেই মা আমেনা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এখানে এই বালুভূমিতেই তাঁর কবর হয়েছিলো। পরে একসফরে আবওয়ার বালুভূমি অতিক্রমকালে পেয়ারা নবী মা আমেনার কবর যিয়ারত করেছিলেন। তাঁর চোখের পানিতে সিক্ত হয়েছিলো মায়ের কবর।
বিদায় হজ্বের সফরেও হয়ত নবীজী মা আমেনার কবর যিয়ারত করেছিলেন, কিতাবের বর্ণনায় যদিও তার উল্লেখ নেই। আমি হযরতকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার প্রথম হজ্বের সফরে কি আবওয়ায় মা আমেনার কবরের চিহ্ণ ছিলো?
হযরত বললেন, না, কোন চিহ্ণ ছিলো না।
হযরত বললেন, হাফিয ইবনুল কাইয়িম (রহ)-এর বর্ণনামতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ষষ্ঠ মানযিল ছিলো ওয়াদি উসফান, আর বুখারীর বর্ণনামতে মাররুয্যাহরান।
উসফান উপত্যকা অতিক্রমকালে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবুবকর (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবুবকর! এটি কোন্ উপত্যকা? তিনি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি উসফান উপত্যকা। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর নবী হুদ ও ছালিহ আলাইহিস-সালাম দু’টি লাল উটে সওয়ার হয়ে এ উপত্যকা অতিক্রম করেছেন। তাঁরা বাইতুল্লাহর হজ্বের নিয়তে তালবিয়া পড়ছিলেন।
হযরতের পাক যবানে এ বয়ান শুনে আমার দেহে অভূতপূর্ব এক ভাবের উদয় হলো। উসফান উপত্যকা কত দূর কে জানে? হে ওয়াদি উসফান! তোমাকে সালাম! আমার পেয়ারা নবীর সেই পবিত্র সফরের প্রতিটি মানযিলকে সালাম!
হযরত বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরবর্তী মানযিল ছিলো সারিফ। মক্কা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ছয় মাইল। সারিফের বিস্ময়কর ঘটনা এই যে, ওমরাতুল কাযা-এর সফরে এখানেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মায়মূনা (রা)-কে বিবাহ করেছেন এবং ওমরা শেষে ফেরার পথে এখানেই একটি গাছের নীচে তাঁবুতে হযরত মায়মূনা (রা)-এর সঙ্গে বাসর যাপন করেছেন। বহু বছর পর সারিফেই হযরত মায়মূনা (রা) মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং সেই গাছের নীচেই তাঁকে দাফন করা হয়েছিলো। ৫১ হিজরীতে উম্মুল মুমিনীনদের মাঝে তিনিই সর্বশেষ মৃত্যুবরণ করেছেন।
হযরত বললেন, প্রথম হজ্বের সফরে আমি সারিফে এসেছিলাম। সেখানে তখন ছোট একটি মসজিদ ছিলো এবং লোকেরা বলতো, মসজিদটির অবস্থান হযরত মায়মূনা (রা)এর কবরের পাশেই; তবে কবরের কোন আলামত তখন সেখানে ছিলো না।
আমাদের গাড়ী ছুটে চলেছে মক্কার পথে। কত দূরত্ব দু’টি কাফেলার মাঝে! কত ভিন্নতা দু’টি সফরের মাঝে! দূরত্ব সময়ের এবং সম্পর্কের! ভিন্নতা পবিত্রতার এবং শুভ্রতার! তবু তো আছে একটি নৈকট্য! একটি অভিন্নতা! লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের নৈকট্য এবং লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইকের অভিন্নতা! এটা ভাবলে অন্তরের গভীরে কিছুটা তো সান্ত্বনা আসে! আশা ও আশ্বাসের একটুখানি পরশ তো লাগে!
হযরত বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ মানযিল ছিলো মক্কার নিম্নভূমিতে, মক্কা ও তানঈমের মধ্যবর্তী স্থান যী-তোয়ায়। নবীজী এখানে রাত্রিযাপন করেছেন, ফজর আদায় করেছেন এবং গোসল করেছেন।
হযরত বললেন, মক্কায় প্রবেশ করার আগে গোসল করা
মুস্তাহাব, যদি সম্ভব না হয় তাহলে অযু করে নেয়াও যথেষ্ট।
সেদিন ছিলো রোববার। আল-আযরাক উপত্যকা হয়ে মক্কার ঊর্ধ্বভূমির দিক দিয়ে দিনের বেলা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফে প্রবেশ করেছিলেন। আল-আযরাক উপত্যকা অতিক্রম করার সময় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি মূসাকে দেখতে পাচ্ছি যে, তিনি উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়ে চলেছেন।
বুখারী শরীফে এ হাদীছ পড়েছি, কিন্তু হযরতের যবানে শোনার পর আমার সামনে
অন্তর্জগতের যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। সেখানে দৃশ্য এবং অদৃশ্য একাকার হয়ে যেন অব্যাখ্যাত এক সৌন্দর্য-মহিমা উদ্ভাস লাভ করলো। কী ব্যাখ্যা এই হাদীছে নববীর?! কোন কোন বরেণ্য মুহাদ্দিছ তো বলেছেন, এখানে কোন রকম রূপকতা নেই, বরং হাকীকতই উদ্দেশ্য। কারণ নবিগণ জীবিত এবং রিযিকপ্রাপ্ত। সুতরাং এ অবস্থায় তাঁদের হজ্ব করা অসম্ভব নয়। যেমন মুসলিম শরীফের বর্ণনায় আছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুসা (আ)-কে তাঁর কবরে দাঁড়িয়ে নামায পড়া অবস্থায় দেখেছেন।
কোন কোন গবেষকের মতে এটা ছিলো রূহের জগতের বিষয়। সম্ভবত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতেনি দৃষ্টির সামনে হযরত মূসা (আ)-এর রূহ দৃশ্যমান হয়েছিলো।
তাহলে কি আমরা একথা ভাবতে পারি যে, আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি মদীনায় শুয়ে আছেন, তাঁর পবিত্র রূহ এখনো আল্লাহর ঘরে হজ্ব করেন এবং তাঁর এতীম উম্মত পৃথিবীর দূরদূরান্ত থেকে এসে কীভাবে হজ্ব করে তা অবলোকন করেন! রূহানিয়াতের জগতে যারা অত্যুচ্চ মর্যাদার অধিকারী তাঁদের অন্তর্দৃষ্টির সামনে হয়ত অনেক রহস্য উদ্ভাসিত হয়!
এ ভাব ও ভাবনায় আমার হৃদয় ও আত্মা এমনই উদ্বেলিত হলো যে, আমি .. আমি জানি না, কোন ভাষায় কীভাবে তা প্রকাশ করা যায়! আমি আমার দিলের ভাবনা হযরতের সামনে পেশ করলাম। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘এই সব ফিকির বান্দাকে আসল মাকছূদ থেকে গাফেল করে দেয়। বান্দার জন্য তো আল্লাহর রহমতই যথেষ্ট!’
মরুভূমির দিগন্তে সূর্য অস্ত গেলো। পথে একটি জলাশয়ের মত স্থান ছিলো। সবুজ ঘাস ছিলো। সেখানে বাস থামলো। হযরতের সঙ্গে আমরা মাগরিব আদায় করলাম। সেই নামাযের কথা আমার আজো মনে পড়ে। হযরতের আদেশে মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব নামায পড়ালেন। অপূর্ব এক বেদনা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে তার তেলাওয়াত থেকে। ভিতরের সব তরঙ্গ যেন কালামের মাধুর্যকে আশ্রয় করে বাইরে এসে আছড়ে পড়ছে। সবসময় এমন হয় না। হৃদয় যখন অন্য রকম হয় তখনই শুধু এমন হয়। এখানে এই কাফেলায় যতজন মানুষ ততটি হৃদয় এবং প্রতিটি হৃদয়েই রয়েছে কিছু সিক্ততা! কিছু আর্দ্রতা! কিছু ভাব! কিছু তরঙ্গ! এতগুলো হৃদয়ের মাঝে একটি হৃদয়, হোক না তা পাপের কালিমায় মলিন, একেবারে মাহরূম যাবে না, আল্লাহর রহমতের কাছে এ আশা অবশ্যই করা যায়!
মধ্যপথে একটি বিশ্রামক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাস থামলো। হযরত আমাকে তাম্বীহ করে বললেন, মাগরিবের সময় বাস থেকে নামা ও ওঠার সময় আমি খেয়াল করেছি, তুমি তালবিয়া পড়োনি। ফিকাহর কিতাবে দেখোনি, সওয়ারি থেকে নামার সময় এবং সওয়ারিতে ওঠার সময় উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়া সুন্নত! আমি খুব লজ্জিত হলাম। এই তো আমাদের অবস্থা! গাফলতের উপর গাফলত! তবু দিলের ভিতরে নেই কোন অনুতাপ-অনুশোচনা! হযরতের মত শফীক ও হাকীম মুরববীর ছায়ায় রয়েছি বলেই না সতর্ক হওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাদের হযরত এখন এ দুনিয়ায় নেই। সত্যিকার অর্থেই আমরা এখন এতীম। সারা জীবন তিনি যত হজ্ব করেছেন, যত মানুষ তাঁর ছোহবতে হজ্ব আদায় করেছেন তাদের সকলের পক্ষ হতে আল্লাহ তাঁকে উত্তম থেকে উত্তম
বিনিময় দান করুন। আমীন।
এবার বাস থেকে নামার সময় (এবং ওঠার সময়) উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়লাম। লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লাশারীকা লাকা লাববাইক ...
বাস থেকে নেমে আমরা জরুরত থেকে ফারেগ হলাম এবং সামান্য কিছু খাবার গ্রহণ করলাম। আমি একা এক কোণে বসে খেতে চেয়েছিলাম। মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেব এসে বসলেন এবং বললেন, মেহেরবানি করে যদি কবুল করেন তাহলে আজ আপনি আমার মেহমান! আমি বুঝতে পারলাম, কেন তিনি আমাকে মেহমান বানাতে চান! কিন্তু এমন মানুষের দাওয়াত কবুল না করে উপায় কী! সুতরাং শোকরগুজারির সাথেই কবুল করলাম।
এঁরা আসলেই অন্য জগতের মানুষ। এঁদের কাছ থেকে যিকির আযকারের শিক্ষা যেমন নেয়া উচিত, তেমনি মাকারিমে আখলাকের শিক্ষাও গ্রহণ করা উচিত। আল্লাহর শোকর, এখনো আমার মনে আছে, রুটি ও গোশতের টুকরো ছিঁড়ে তিনি আমার মুখে তুলে দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে হয়ত তুলে দিয়েছিলেন অন্যকিছুও। না হলে আমার চোখে তখন পানি আসবে কেন?! মুসাফিরের দিল বড় নরম হয়। আর আমরা দু’জনই ছিলাম বাইতুল্লাহর মুসাফির। তিনি বড় মুসাফির, আমি এক ক্ষুদ্র মুসাফির। তবু সেদিন আমি দিলভরে দু‘আ করেছিলাম তাঁর জন্য। দু‘আ করার জন্য তো বড় হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সেখানেই এশার নামায পড়া হলো। বাস ছাড়ার তখনো কিছুটা দেরী। অনেক বাস থেমেছে। বাস আসছে, থামছে, আবার রওয়ানা হয়ে যাচ্ছে। কয়েক হাজার হাজীর উপস্থিতিতে পুরো এলাকা গমগম করছে। কেউ ব্যস্ত পানাহারে, গল্পগুজবে; কেউ মগ্ন একা একা পায়চারিতে। একজন শুধু নিমগ্ন বালুর উপর বিছানো জায়নামাযে! জায়নামায তো তাঁর জীবনের সঙ্গী, এমনকি হজ্বের মত কঠিন সফরেও।
সেদিন সেখানে একজন ‘কালো’ হাজীর শুভ্র হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছিলাম। ঘটনা যদি লিখতে যাই তাহলে তো সফরনামা হয়ে যাবে সফরের চেয়ে অনেক দীর্ঘ! শুধু এইটুকু বলি, তার সঙ্গে আমার ভাষার ব্যবধান ছিলো। কিন্তু হৃদয়ের তাপ এবং ঈমানের উত্তাপ দিয়ে তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সুদূর আফ্রিকাতেও আছে আমার ভাই!
দূর থেকে আলো দেখা গেলো, আলোকিত মক্কার আলো! যেন আল্লাহর ঘরের প্রথম আভাস! এ আলো আরেকবার দেখেছিলাম গত রামাযানে। তাতে ছিলো প্রথম অবলোকনের অনাস্বাদিতপূর্ব এক শিহরণ। আজ ছিলো হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমকে ফিরে পাওয়ার সেই আনন্দ যা কিছুক্ষণের জন্য মানুষের অনুভব অনুভূতিকে বিবশ করে রাখে। শহরের আলোকে এবং আলোর শহরকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে শুধু দেখতেই থাকলাম। কখন যে দু’চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমে এসেছে, বুঝতে পারিনি। আমার অবস্থা তো ছিলো কাফেলার আর সবার থেকে ভিন্ন। আমি তো নিজের নির্বুদ্ধিতায় এই পবিত্র শহরের আলো হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার আল্লাহ দয়া করে আবার আমাকে সেই হারানো আলো দেখার তাওফীক দিয়েছেন। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
যাদের দৃষ্টি আছে তারা হয়ত এ আলো ছাড়িয়ে দেখতে পান অন্য কোন আলোর উদ্ভাস! তাদের হৃদয়ের জগতে হয়ত জেগে ওঠে অন্য রকম কোন ভাবতরঙ্গ। তখন ইশক ও মুহববতের জোরওয়ার মউজ হয়ত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্য কোন রহস্যলোকে! আমি শুধু দেখতে পেলাম বিদ্যুতের লাল আলোর অপূর্ব সজ্জা! তাতেই আমার হৃদয় ও আত্মা উদ্বেলিত হলো। আসন্ন মিলনের সুখানুভূতি আমার সমগ্র অস্তিত্বের পরতে পরতে যেন অপূর্ব এক শিহরণ জাগালো।
বাসের সকল যাত্রী, আশেকানে হারাম তখন নতুন জাযবায়, নতুন উদ্দীপনায় পড়ে চলেছেন হজ্বের তালবিয়া-
লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শরীকা লাকা লাববাইক ...
শহর যে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, অথবা আমরা যে ধীরে ধীরে শহরের দিকে এগিয়ে চলেছি তা স্পষ্ট অনুভব করা যায়। দূরত্ব যত কমে আসছে আমাদের বুকের কম্পন এবং হৃদয়ের স্পন্দন ততই বেড়ে চলেছে। জানি না, ভিতরের এ অবস্থাকে কিসের সাথে তুলনা করা যায়!
শহরের আভাস দেখা যাওয়ার পর থেকে হযরত নিজেও বারবার এ দু‘আ পড়লেন এবং আমাদেরও পড়ার তারগীব দিলেন-
...
হে আল্লাহ এই শহরে আমাকে সুস্থিতি দান করুন এবং এই শহরে আমাকে হালাল রিযিক দান করুন।
শহরের ভিতরে জনাকীর্ণ রাস্তায় বাস ধীরে ধীরে চলছে। একসময় দেখতে পেলাম হারামের আলোকিত মিনার! সেই মিনার যা দু’দিন আগে শোকার্ত হৃদয়ে ফিরে ফিরে অশ্রুঝাপসা চোখে দেখছিলাম এবং একসময় যা দৃষ্টিপথ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো আমাকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে। সেই মিনার আজ আবার দেখতে পেলাম উদ্বেলিত হৃদয়ে, আনন্দ ঝলমল চোখে।
বাস থামলো হারামকে বেষ্টনকারী ‘গোলসড়ক’ বা রিংরোডে এসে। এবার আমাদের চোখের সামনে আলোকিত হারাম। কয়েক মুহূর্ত যেন স্বপ্নের ঘোরে কেটে গেলো। তারপর হযরতকে অনুসরণ করে কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম-
...
সকল প্রশংসা আল্লাহর; অশেষ, উত্তম ও বরকতময় প্রশংসা। ইয়া রাবব! আপনি আমাকে দান করুন বরকতময় অবস্থানক্ষেত্র। আপনিই তো সর্বোত্তম অবস্থানক্ষেত্র দানকারী!
লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শারীকা লাকা লাববাইক ...
আবেগের আতিশয্যে আমি তখন আত্মহারা। চোখের সামনে ভেসে উঠলো রামাযানের আটাশ তারিখের সেই মুহূর্তটি। ঠিক এখান থেকেই গাড়ীতে উঠে বিদায় হয়েছিলাম। তখন কি কল্পনায়ও ছিলো, এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন আশ্চর্য উপায়ে আল্লাহ তাঁর নাদান বান্দাকে আবার ফিরিয়ে আনবেন হারামের পবিত্র অঙ্গনে! বান্দার যা কল্পনায়ও ছিলো না, আল্লাহ তাঁর অশেষ রহমতে এবং অসীম কুদরতে তাই বাস্তব করে দেখালেন। শোকর আলহামদু লিল্লাহ!
বাস থামলো, হযরতের সঙ্গে আমরা বাস থেকে নামলাম।
হযরতের ভক্ত মুরিদ জনাব ক্কারী মীযান সেখানে হযরতের প্রতীক্ষায় ছিলেন, আর ছিলেন ফারুক ভাই। আমার খবর তিনি জানতেন না। নিজের চোখকে তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক তাকিয়ে থাকলেন, তারপর হযরতের উপস্থিতি ভুলে বে-ইখতিয়ার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তার মুখে ছিলো শুধু ‘আলহামদু লিল্লাহ! আলহামদু লিল্লাহ!’
আমি জানি না, আল্লাহর ওয়াস্তে মুহাববাত আর কাকে বলে?! আল্লাহ তাকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
হাজী মীযান বাংলাদেশের সিলেট জেলার অধিবাসী। হজ্ব-মৌসুমে বাড়ী ভাড়ার তেজারত করেন। নম্র-ভদ্র মানুষ। মিসফালায় হারামের নিকটবর্তী একটি বাড়ীতে তিনি হযরতের থাকার ইনতেযাম করেছেন। মোটামুটি প্রশস্ত একটি কামরায় সবার থাকার ব্যবস্থা।
আমাদের অবস্থা তখন যাকে বলে, ‘ক্লান্তিতে চূর চূর’। সুতরাং মনের গোপন ইচ্ছা তো ছিলো, বাকি রাত আরাম করে ফজরের পর তাওয়াফে কুদূম করবো। আমাদের ধারণায়ও ছিলো না, হযরত তখনই তাওয়াফের কথা বলবেন! কিন্তু বয়সে বৃদ্ধ এই চিরতরুণ মানুষটি হারামে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলেন। সুতরাং তারুণ্যের লাজ রক্ষা করতে আমরাও দু’চারজন প্রস্ত্তত হলাম এবং হযরতের পিছনে পিছনে রওয়ানা হলাম।
হযরত যখন লজ্জা ও বেদনামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, মিয়াঁ, এই নাপাক কদম এই পাক যমীনে রাখতে শরম লাগে, ডর লাগে তখন নিজেদের ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর কী করার ছিলো আমাদের। আমাদের না লজ্জা-শরম আছে, না ডর-ভয় আছে! আমাদের তো এই মাকামের পরিচয় ও মা‘রিফাতই নেই! আর লজ্জা ও ভয় তো আসে মা‘রিফাত থেকে! যিনি মা‘রিফাতের যত উচ্চ স্তরে উপনীত হবেন তিনি ততই লজ্জিত ও শরমিন্দা হবেন, ততই ভীতসন্ত্রস্ত হবেন। তাই আমাদের ভয়-সংকোচহীন আনন্দ যেমন স্বাভাবিক তেমনি হযরতের ‘শরম ও ডর’ও অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং তিনি যাদের উত্তরসূরী তারা তো হারামে প্রবেশ করার সময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। কারো কারো সম্পর্কে তো বর্ণিত আছে যে, লোকজনকে তিনি নিজের থেকে দূরে থাকতে বলতেন এই ভয়ে যে, যদি তাঁর উপর আসমানের আযাব নাযিল হয় তাহলে তারা যেন বিনা দোষে শুধু সঙ্গে থাকার কারণে বিপদগ্রস্ত না হয়। কবির ভাষায় তাঁদের ভাবনা হতো এমন-
কাবাঘরের তাওয়াফ করিতে চাই/ দুয়ারে এসে হায়, অনুমতি না পাই/ গায়ব থেকে আসে আওয়ায বারেবার/কী করেছো বাইরে, সাহস করো ভিতরে আসার?
হযরত আমাদের সতর্ক করে বললেন, তাঁর আওয়াযে এমন ভয়ভীতি ছিলো যে, ভাবতে সত্যি অবাক লাগে! তিনি বললেন, মিয়াঁরা, হুঁশিয়ার, সাবধান! মদীনায় ছিলো জামাল (সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতা), এখানে হলো জালাল (প্রতাপের প্রখরতা)। সেখানে তুমি ছিলে পেয়ারে উম্মতি, এখানে তোমাকে প্রকাশ করতে হবে পূর্ণ আবদিয়াত ও বন্দেগি। এখানে তুমি দাখেল হবে গোলামের লেবাসে। খুব সাবধান! এখানে যেন আবদিয়াতের খেলাফ কোন কিছু প্রকাশ না পায়; না যবানে, না ‘আদা ও আন্দাযে’।
হযরত হারাম শরীফে দাখেল হলেন এবং অবনত দৃষ্টিতে ধীর নম্র পদক্ষেপে অগ্রসর হলেন। হযরত আগে, আমরা তাঁর পিছনে। আমার বুক দুরু দুরু করছে! কেমন যেন একটা জড়োসড়ো অবস্থা লজ্জায় শরমে, ভয়ে ভীতিতে! রামাযানে তো এ অবস্থাটা ছিলো না! তখন তো ছিলো আনন্দের শিহরণ এবং আবেগের উদ্দীপনা!
হে আল্লাহ! কত ভুল পথে চলেছে এ দু'টো পা; এখন কোন সাহসে এগিয়ে যাবো তোমার ঘরের দিকে! কত গোনাহ করেছে এ চোখ দু'টো; কোন মুখে তাকাবো তোমার ঘরের দিকে! কীভাবে অবলোকন করবো কালো গিলাফের সৌন্দর্য! তোমার রহমত, হে আল্লাহ, তোমার রহমত শুধু ভরসা!
যেখান থেকে বাইতুল্লাহ দেখা যায় সেখানে এসে হযরত দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে অবনত দৃষ্টি উত্তোলন করে তাকালেন। হযরতকে অনুসরণ করে আমরাও তাকালাম এবং দেখতে পেলাম কালো গিলাফে ঢাকা চিরসুন্দর সেই বাইতুল্লাহ! ভক্তি-মুহববতে আপ্লুত কণ্ঠে হযরতের সঙ্গে আমরাও উচ্চারণ করলাম,
...
হে আল্লাহ! তুমি এই ঘরের মর্যাদা ও মহিমা এবং সম্মান ও সমীহ বৃদ্ধ করে দাও। যারা হজ্ব করে, ওমরা করে এবং এই ঘরকে তা‘যীম ও সম্মান করে তাদেরও ইয্যত, সম্মান, মর্যাদা ও ছাওয়াব বাড়িয়ে দাও। হে আল্লাহ তুমিই তো ‘সালাম’; শান্তি তো তোমারই পক্ষ হতে বর্ষিত হয়। সুতরাং হে আমাদের রাবব! আমাদেরকে সুখে-শান্তিতে জীবিত রাখুন।
কা‘বা শরীফ দেখার সময় এই দু‘আ পড়া সুন্নত! আল্লাহর ঘরের ইয্যত ও মর্যাদা তো আমার-তোমার দু‘আর মুহতাজ নয়; এ তো শুধু বান্দাকে নতুন কিছু দান করার বাহানা! এ সময় দু‘আ কবুল হওয়ার খোশখবরি এসেছে ছহীহ হাদীছে। আমি প্রাণভরে দু‘আ করলাম ঘরের মালিকের দরবারে। দু‘আর সঙ্গে কবুলিয়াতের আশাও হলো
অন্তরে। হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী (রহ) লিখেছেন, দু‘আ করার সময় কবুলিয়াতের আশা হওয়া দু‘আ কবুল হওয়ারই আলামত।
(চলবে, ইনশাআল্লাহ)