ইসরা ও মি’রাজ বিষয়ে একটি উত্তম ও প্রাচীন রচনা
আলকাউসারের রজব ১৪২৬ হি. সংখ্যায় ‘মিরাজ : কিছু তথ্য, কিছু শিক্ষা, কিছু ভুল ধারণার সংশোধন’ শিরোনামে আমার একটি প্রবন্ধ এবং ‘মাহে রজব : করণীয় ও বর্জনীয়’ শিরোনামে মাওলানা মুতীউর রহমানের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর রজব ১৪২৭ হি. সংখ্যায় ‘রজব, মিরাজ ও শবে মিরাজ : কিছু কথা’ শিরোনামে আমার দ্বিতীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গত বছর ১৪২৮ হিজরীর রজব সংখ্যায় মাওলানা দানিশ ইবনে দানিশের কলমে ‘সহীহ হাদীসের আলোকে মিরাজুন্নবী-এর ঘটনা’ শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ বছরও এ প্রসঙ্গে কিছু লেখার ছিল, ঘটনাক্রমে কিছু দিন আগে কায়রো থেকে এক বন্ধু আল্লামা আবুল খাত্তাব উমর ইবনে দিহইয়া (৫৪২হি-৬৩৩হি.) রচিত ‘আলইবতিহাজ ফী আহাদীসিল মি’রাজ’ নামক কিতাবটি আমার কাছে পাঠান। ইসরা ও মিরাজ সম্পর্কে রচনাটি খুবই হৃদয়গ্রাহী। এজন্য ইচ্ছা করেছি, আলকাউসারের এ সংখ্যায় এ কিতাবের পরিচিতি ও কিতাবটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরি।
গ্রন্থকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
রচনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে রচয়িতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। সংক্ষেপে এ বিষয়ে আলোকপাত করছি।
গ্রন্থকার সপ্তম হিজরী শতাব্দীর ইলমে শরীয়তের মাহির আলিমদের মধ্যে গণ্য। বিশেষত ইলমে হাদীসের সকল শাখায় তার অবাধ সঞ্চরণ ছিল, যেন এটা তাঁর বিশেষ শাস্ত্র। তাছাড়া আরবী ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল শাস্ত্রে তার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। ‘ইলমে উসুলুদ্দীন’ ও ‘ইলমুল কালাম’ বিষয়েও তার যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল।
মাতুল সূত্রে হুসায়নী। নাম উমর ইবনুল হাসান। উপনাম আবুল খাত্তাব ইবনে দিহয়া। আদি নিবাস আন্দালুসে। ইলম অর্জনের জন্য মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। শেষে মিসরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মিসরের তৎকালীন শাসক আল মালিকুল কামিল (মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর ইবনে আইয়ুব) তার জন্য আলাদা দারুল হাদীস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের শায়খুল হাদীস পদে বরণ করেছিলেন।
প্রায় নববই বছর বয়সে ৬৩৩ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকাল হয়। জন্মেছিলেন ৫৪২ হিজরীতে।
তাঁর রচনাবলির তালিকা দীর্ঘ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের সঙ্গে যেসব মু’জিযা সম্পৃক্ত ছিল সে সম্পর্কে তার রচনা ‘আলআয়াতুল বাইয়িনাত ফী যিকরি মা ফী আ’যাই রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনাল মু’জিযাত’ ১৪২০ হিজরীতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাকতাবা উমারাইন থেকে শায়খ জামাল আয-যাওনের তাহকীক-সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে।
রজব মাসকে কেন্দ্র করে যেসব ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজ এবং মওজু ও জাল বর্ণনা তার যুগে প্রচলিত হয়েছিল; বরং এখনও কোনো কোনো মহলে প্রচলিত রয়েছে সেগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করে তিনি রচনা করেন-‘আদাউ মা ওয়াজাব মিন বায়ানি ওয়াযয়িল ওয়াযযাঈনা ফী রাজাব’। এটি একটি শানদার কিতাব, যা ১৪২১ হিজরীতে মুআসসাসাতুর রায়্যান বৈরূত থেকে প্রকাশিত হয়। উপরোক্ত শায়খ জামাল আযযাওন এ গ্রন্থেরও মুহাক্কিক-সম্পাদক।
তার অমুদ্রিত পান্ডুলিপিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ দু’টি :
(১) ‘আততানবীর ফী মাওলিদিস সিরাজিল মুনীর’। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত বিষয়ে এটি অত্যন্ত শানদার ও জানদার কিতাব। বিলাদত (জন্ম) থেকে ওফাত পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ সীরাতে মুবারাকার বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বহু আলোচনাও এতে এসেছে। এ কিতাবের নামের সঙ্গে ‘মাওলিদ’ শব্দ শ্রুতিগোচর হওয়ায় কিছু মানুষ এই ভুল ধারণায় পড়ে গেছেন যে, নিশ্চয়ই এ গ্রন্থ প্রচলিত মীলাদ সম্পর্কে রচিত!
এই কিতাবের মাখতূতা (হস্তলিখিত পান্ডুলিপি) হালাবের ‘আলমাকতাবাতুল আহমদিয়া’তে সংরক্ষিত রয়েছে।
(২) ‘আল ‘আলামুল মাশহুর ফী ফাযাইলিল আয়্যামি ওয়াশ শুহূর’।
বিভিন্ন ফযীলতপূর্ণ দিবস-রজনী ও ফযীলতপূর্ণ মাহিনা সম্পর্কে বিশদ ও সমৃদ্ধ এবং মৌলিক ও দালীলিক গ্রন্থ। ইয়ামানের ছানআ শহরের আলজামিউল কাবীর-এর গ্রন্থাগার ‘আলমাকতাবাতুল গারবিয়্যা’তে এর পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।
আশা করা যায়, খুব শিগগিরই এ দু’টি গ্রন্থ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হবে। আরও আগেই তা প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন ছিল বিশেষত শেষোক্ত বিষয়ে যেহেতু ইবনে রজব রাহ-এর ‘লাতাইফুল মা’আরিফ ফী মা লিমাওয়াছীমিল ‘আম মিনাল ওযাইফ’ ছাড়া বিশদ ও দলীলসমৃদ্ধ এবং মানোত্তীর্ণ কোনো গ্রন্থ এ যাবৎ মুদ্রিত ছিল না।
এ দু’টো গ্রন্থ ছাড়া আরও কিছু গ্রন্থ যেমন:
(৩) আম্বিয়া কেরাম আলাইহিমুস সালাম-এর নিষ্পাপত্ব সম্পর্কে তার রচনা-দলীলুলমুতাহাইয়িরীন’-এর আলোচনা তিনি আলইবতিহাজ ফী আহাদীসিল ইসরা ওয়াল মিরাজ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৯৬) করেছেন। এ গ্রন্থটি কোথাও সংরক্ষিত আছে না বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে-তা জানা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
(৪) ‘নিহায়াতুস সূল ফী খাসাইসির রাসূল’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা তিনি ‘আলইবতিহাজ’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১৪২) উল্লেখ করেছেন। যিরিকলী রাহ. ‘আল আ’লাম’ গ্রন্থে ইঙ্গিত করেছেন যে, এ গ্রন্থ এখনো মাখতূত- পান্ডুলিপি আকারে রয়েছে।
‘রিওয়ায়েত’-এর বাছাই ও সতর্কতার ক্ষেত্রে ইবনে দিহয়া রাহ-এর যে সাধারণ রীতি তার আলোকে বলা যায় যে, এ কিতাব যদি মুদ্রিত হয়ে যেত তাহলে খুবই ভালো হত। ‘আল খাসাইসুল কুবরা’য় জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ-এর যে শিথিলতা প্রকাশ পেয়েছে এ গ্রন্থ তার উত্তম প্রতিষেধক হয়ে যেত।
(৫) তার ‘আ’লামুন নাসরিল মুবীন ফিল মুফাযালাতি বাইনা আহলিস সিফফীন’ নামক রচনাটিও বিষয়বস্ত্তর বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। স্পেনের মাকতাবাতুল ইছকোরিয়াল-এ (নং ১৬৯৩) এ গ্রন্থের পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। কায়রোর দারুস সালাম থেকে প্রকাশিত ‘তাহকীকু মাওয়াকিফিস সাহাবা ফিল ফিতনা’ কিতাবে উপরোক্ত গ্রন্থের কিছু কিছু উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। দারুস সালাম থেকে প্রকাশিত কিতাবটির দ্বিতীয় সংস্করণ আমার সামনে রয়েছে, যার মুদ্রণকাল ১৪২৮ হিজরী।
(৬) ইবনে দিহয়ার মুদ্রিত কিতাবগুলোর মধ্যে একটি হল ‘আননিবরাছ ফী তারীখি খুলাফাই বনীল আববাস’। তবে তা দেখার সুযোগ আমার হয়নি।
তার রচনার তালিকা অনেক দীর্ঘ। এখানে যে রচনাগুলোর নাম উল্লেখ করা হল তা থেকেই আহলে ইলম অনুমান করতে পারেন যে, ইবনে দিহয়া কত উঁচু পর্যায়ের মুহাক্বিক ও রুচিশীল আলিম ছিলেন।
ইবনে দিহয়া রাহ-এর জীবন ও কর্মের ওপর শায়খ জামাল আযযাওন একটি বিশদ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘আদাউ মা ওয়াজাব’ এর ভূমিকায় তার কথা থেকে অনুমিত হয় যে, গ্রন্থটি ছেপে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা আমার কাছে নেই। না হয় পাঠকবৃন্দের খিদমতে আরো কিছু তথ্য পেশ করতে পারতাম। ওয়াল আমরু বিয়াদিল্লাহ।
আলইবতিহাজ ফী আহাদীছিল ইসরা ওয়াল মিরাজ-এর পরিচিতি
ইবনে দিহয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ কিতাবটি আমার জানা মতে সর্বপ্রথম কায়রোর মাকতাবাতুল খানজী থেকে ১৪১৭ হিজরী মোতাবেক ১৯৯৬ ঈসাব্দে ড. রিফআত ফাওযী আব্দুল মুত্তালিব-এর তাহকীক-সম্পাদনায়, যিনি জামেয়া কাহেরায় কুল্লিয়াতুশ শরীয়ার উস্তাদ, প্রকাশিত হয়। ‘মুকাদ্দিমাতুত তাহকীক’ ও ‘ফাহারিস’সহ পূর্ণ কিতাবের পৃষ্ঠাসংখ্যা এক শ চুরাশি।
কিতাবের নাম থেকে মনে হতে পারে যে, ইসরা ও মিরাজ বিষয়ক অধিকাংশ হাদীস এতে সংকলিত হয়েছে এবং সেগুলোর ‘সনদ’ ও ‘মতন’ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু হাদীসের কিছু প্রসিদ্ধ গ্রন্থ থেকে কিছু প্রসিদ্ধ হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোরই আলোকে ইসরা ও মিরাজের তাৎপর্য, ইঙ্গিত ও ফলাফল সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এই আলোচনাই তাঁর এ কিতাব রচনার মূল উদ্দেশ্য বলে অনুমিত হয়। তবে উল্লেখিত হাদীসসমূহের কঠিন শব্দগুলোর বিশ্লেষণ গুরুত্বের সঙ্গে করেছেন এবং জটিলতাপূর্ণ স্থানগুলোও প্রয়োজনীয় আলোচনা থেকে শূন্য থাকেনি।
এসব সত্ত্বেও আমার মতে কিতাবের বিশিষ্টতা এখানে যে, এতে মিরাজ সংক্রান্ত ইসলামী আকীদা পরিষ্কার ও প্রমাণসিদ্ধ করে তুলে ধরা হয়েছে এবং এমন কিছু ভুল ধারণাও সংশোধন করা হয়েছে, স্বল্প জ্ঞান ও অগভীর চিন্তার লোকেরা যেগুলোর শিকার হয়ে যায়। অথচ বিষয়গুলোর পরিষ্কার আলোচনাও কম হয়ে থাকে।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ‘মওজু’ বর্ণনা তো দূরের কথা, কোনো ‘মুনকার’ বর্ণনাও তিনি এ কিতাবে উল্লেখ করেননি। এ প্রসঙ্গে তাঁর পরিষ্কার কথা-
إنما تكلمنا على ما صح وأسقطنا الموضوع والمنكر، لأنه خزي في الدنيا ويوم القيامة، يصلي صاحبه العذاب الأكبر.
এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান থাকলেও, আগেই বলেছি, ইসরা ও মিরাজ বিষয়ে হাদীস শরীফের বিশদ কোনো সংকলন এটি নয়। এজন্য হাদীস ও সীরাতের দীর্ঘ গ্রন্থসমূহের সহায়তা গ্রহণ করার প্রয়োজন থাকছে।
এ গ্রন্থের পান্ডুলিপি-সম্পাদক ড. রিফআত ফাওযী ‘আহাদীসুল ইসরা ওয়াল মিরাজ দিরাসাতান তাওছীকিয়্যা’ নামে একটি সংকলন তৈরি করেছেন যা ইবনে দিহয়ার আলোচিত কিতাবের পূর্বে মাকতাবাতুল খানজী কায়রো থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এক আশ্চর্য মিল এই যে, এক বছর আগে আমি মারকাযুদ দাওয়ার উলূমুল হাদীস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মৌলবী ত্বহা হুসাইনকে সাধ্যমত ইসরা ও মিরাজ বিষয়ক হাদীস ও আছার একত্র করে সেগুলোর ‘সনদ’ ও ‘মতন’-এর ওপর আলোচনা করার কাজ দিয়েছিলাম। একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায় পর্যন্ত সে একাজটি করেছিল। রচনাধীন কিতাবটির নামও আমি ‘আলইবতিহাজ’ নির্বাচন করেছিলাম। অথচ সে সময় ইবনে দিহয়ার এ গ্রন্থের নাম আমার স্মৃতিতে ছিল না।
কিছু বিষয় আলোচিত কিতাব থেকে
(১) ইসরা ও মিরাজ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ মুজিযা। অন্য কোনো নবীকে এই মুজিযা প্রদানের কথা কোনো ‘নাছ’ (কুরআন-হাদীসের বক্তব্য) দ্বারা প্রমাণিত নয়। (পৃ. ১০৯)
(২) ইসরা ও মিরাজ (কোন রাতের একাংশে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত এরপর সেখান থেকে সাত আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত ও জাহান্নাম এবং উর্ধ্ব জগতের অন্যান্য বড় বড় নিদর্শন দর্শনের উদ্দেশ্যে তাঁর সফর) জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে হয়েছে। না এটা নিছক একটি স্বপ্ন-নাউযুবিল্লাহ, আর না শুধু রূহানী ভ্রমণ। এমন বলা হলে, যেমন কতক বিদআতী বলেছে, সেটা হবে পরোক্ষভাবে এ মু’জিযাকে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা।(পৃ. ৫,১৭-২০, ৬০-৭৩, ৫৯)
(৩) দ্বিতীয় নাম্বারে যে আকীদা উদ্ধৃত হল তা স্পষ্টভাবে কুরআন মজীদে (সূরা ইসরা, আয়াত ১, ও সূরা নাজম, আয়াত ১২-১৮) এবং মুতাওয়াতির হাদীসসমূহের মাধ্যমে প্রমাণিত। এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী আকীদা।
এ বিষয়ে বিদআতীদের অপব্যাখ্যা যে কতটা হাস্যকর তা বোঝানোর জন্য অন্যান্য মুহাক্কিকের মতো তিনিও বলেছেন যে, যদি এই ঘটনা একটি স্বপ্নমাত্র হত তাহলে এটা কোনো মু’জিযা হত না এবং কুরাইশের কাফেরদের ঠাট্টা ও অস্বীকারেরও কোনো কারণ থাকত না। তদ্রূপ বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে কাফেরদের জিজ্ঞাসাবাদেরও কোনো অর্থ থাকে না। কেউ যদি স্বপ্নে বায়তুল মুকাদ্দাস দেখার কথা বলে তবে এখানে অস্বীকৃতি জানানোরই কি আছে আর পরীক্ষা নেয়ারই বা কি আছে? (পৃ. ১৯)
(৪) তদ্রূপ এই ঘটনা শুধু রূহের সফর বলে ‘ব্যাখ্যা’ করাটাও হাস্যকর। ইবনে দিহয়া এ ‘ব্যাখ্যা’ সম্পর্কে উপহাস করে বলেন, ‘বোরাক আত্মার বাহন নয়, রক্ত-মাংসের শরীরের বাহন। অসংখ্য হাদীসে এ তথ্য এসেছে যে, ইসরা বোরাকের ওপর হয়েছিল, বাতাসে ভেসে নয়!’ (পৃ. ১৭)
(৫) ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কিংবা ভুল ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা-এর সঙ্গে একথা যুক্ত করেছে যে, মিরাজের ঘটনা রূহানী বিষয় ছিল, অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরীর মোবারক অন্য সময়ের মতোই গৃহে অবস্থান করছিল।
এই বর্ণনার ভিত্তিহীনতার উপর ইবনে দিহয়া সূত্র ও বক্তব্য দুই দিক থেকেই পর্যাপ্ত আলোচনা করেছেন এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে, এটা আম্মাজানের প্রতি মিথ্যারোপ। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবুল আববাস ইবনে সুরাইজ- এর এই মন্তব্যও উল্লেখ করেছেন -
هذا حديث لا يصح، وإنما وضع ردا للحديث الصحيح.
‘এই বর্ণনা সহীহ নয়। এটা তৈরি করা হয়েছে সহীহ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য।’
(৬) ৫৯ পৃষ্ঠায় তিনি মিরাজের হাদীসসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পেশ করেছেন। এই তালিকা যদিও পূর্ণাঙ্গ নয়, কিন্তু যে পরিমাণ বর্ণনা তিনি উল্লেখ করেছেন তাতেই দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মিরাজের হাদীস মুতাওয়াতির অর্থাৎ এত অধিক সনদে এবং এত বিপুল সংখ্যক রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত যে, ভুলক্রমেও তাদের ভুল হওয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের বর্ণনা একদম অকাট্য ও বিশ্বস্ততার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্তীর্ণ। আর তার বক্তব্য দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত, যা অস্বীকার করা কিংবা কোনো ‘ব্যাখ্যা’য় অবতীর্ণ হওয়া মানুষকে ঈমান থেকে খারিজ করে দেয়। ইবনে দিহয়ার ভাষায়-
فحديث الإسراء أجمع عليه المسلمون، واعترض فيه الزنادقة الملحدون، يريدون ليطفئوا نور الله بأفواههم، والله متم نوره ولو كره الكافرون.
(৭) ইবনে দিহয়া আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর এই আকীদার ওপর বিশদ আলোচনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা স্থান ও দিকের আবদ্ধতা থেকে পবিত্র। তিনিই স্থান-কালের সৃষ্টিকর্তা। স্থান ও কালের গন্ডির তিনি উর্ধ্বে। মিরাজের বিষয়টিকে এভাবে কল্পনা করা, যেমন কোনো কোনো জাহেল লোক মনে করে থাকে, যে, মি’রাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজ ঘরে দাওয়াত করেছেন! নাউযুবিল্লাহ! ইবনে দিহয়াহ এ কথাও অত্যন্ত শক্তিশালী আলোচনার মাধ্যমে খন্ডন করেছেন। (পৃ. ৯৩-১০১,৯১)
এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি আলোচনা (পৃ. ৫০-৫১) তালিবে ইলমদের মনে রাখা আবশ্যক।
ولا يلزم من موضع السؤال أن يكون المسئول فيه أو يكون حائزا له لتعالى الله جل وعلا وتنزيهه عن الجهة المكان فرجوع النبي صلى الله عليه وسلم إليه رجوع إلى السؤال في لشرف ذلك الموضع على غيره كما كان الطور موضع سؤال موسى في الأرض ومكة موضع حج الناس وعرفة موضع وقوف الناس للسؤال، فمكان سؤاله صلى الله عليه وسلم، فهو رجوع من مكان موسى إلى مكان السؤال لاستحالة المكان على من انفرد بالعظمة والجلال.
(৮) প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান বহু বিষয় এ গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আখিরাতে আল্লাহ তাআলার দীদারের আকীদা অন্যতম। (পৃ.৭৭-৯২)
(৯) এছাড়া মি’রাজের তত্ত্ব ও তাৎপর্য বিষয়ক আলোচনা এ কিতাবের বিশেষ প্রসঙ্গ। পৃষ্ঠা ৯৩ থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়েরই আলোচনা। বিষয়টি পাঠকের পাঠ-অনুরাগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
(১০) মি’রাজের ঘটনায় উর্ধ্বজগতে অনেক নবীর সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাত হয়েছে। তাঁরা তাকে ‘আল-আখুস সালিহ ওয়ান্নাবিয়্যুস সালিহ’ এবং ‘আল-ইবনুস সালিহ ওয়ান্নাবিয়্যুস সালিহ’ বলে সম্ভাষণ করেছেন। ‘আসসালিহ’’ শব্দের তরজমা সাধারণত ‘নেককার’ করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইবনে দিহয়া লিখেছেন-
فالرجل الصالح في اللغة هو المقيم لما يلزمه من حقوق الله سبحانه وحقوق الناس وهي كلمة جامعة لمعاني الخير كله.
আরবী ভাষায় ‘আররাজুলুস সালিহ’ তাকেই বলা হয়, যে তার সকল অপরিহার্য কর্তব্য-আল্লাহর হক ও বান্দার হক্ব-পূর্ণরূপে আদায় করে। এ শব্দটি সকল ভালো কাজে যত্নশীলতার অর্থকে ধারণ করে। (পৃ.৫১)
এই পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক অর্থেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘সালাহ’এর অনুপম দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার আদর্শ অনুসরণের তাওফীক দিন। আমীন।#