নবী-যুগে হাদীস-লিখনঃ চুক্তি, সন্ধিপত্র ও লিখিত ফরমান
১. মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের অধিবাসীদের জন্য লিখিত সনদ
হিজরতের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি নীতিমালা লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন, যা এখন ‘মদীনা-সনদ নামে পরিচিত। এতে মুহাজির ও আনসারীগণের দায়িত্ব ও অধিকার, মদীনা ও আশপাশের আরব ও ইহুদী কবীলাসমূহের সঙ্গে মিত্রতা এবং নাগরিক ও সামাজিক বিধানাবলি উল্লেখিত হয়েছিল। এই দলীলের বিভিন্ন অংশ হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে।(দেখুন : সহীহ মুসলিম হাদীস ১৭/১৫০৭; সুনানে নাসাঈ হাদীস ৪৮২৯; মুসনাদে আহমদ ১/২৭১, হাদীস ২৪৩৯, ২৪৪০) পূর্ণ দলীলটিও সংরক্ষিত আছে হাদীস, সীরাত ও তারীখের বিভিন্ন গ্রন্থে। দেখুন : আলআমওয়াল, আবু উবায়দ পৃ. ২৬০; সীরাতে ইবনে হিশাম (আররওযুল উনুফ) ৪/২৪০-২৪৩; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৬১৯-৬২২ (হিজরী প্রথম বর্ষের ঘটনাবলি)
২. হুদায়বিয়ার সন্ধি
৬ষ্ঠ হিজরীর যিলকদ মাসে এই সন্ধি লিপিবদ্ধ হয়েছিল। এর বিভিন্ন অংশ সহীহ বুখারীসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।দেখুন : সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪২৫১, ২৬৯৮, ২৬৯৯, ২৭৩১, ২৭৩২ পূর্ণ সন্ধিপত্রটির জন্য দেখুন : সীরাতে ইবনে হিশাম (আররওযুল উনুফ) ৬/৪৬২-৪৬৪; মুসনাদে আহমদ ৪/৩২৫, ৩২৮-৩৩১; তাফসীরে তবারী ১১/৩৫৮ (সূরা ফাত্হ)
৩. নাজরানবাসীকে প্রদত্ত ফরমান
এতে নাজরানবাসী ঈসায়ীদের উপর তাদের সকল শস্য ও সম্পদের বিপরীতে নির্ধারিত জিয্য়া আরোপ করা হয় এবং তাদের জান-মাল ও উপাসনালয়ের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ও তাতে রয়েছে।পূর্ণ দলীলটির জন্য দেখুন : কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসুফ পৃ. ৪১; কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়দ পৃ. ২৪৪-২৪৭
৪. আয়লাবাসীকে প্রদত্ত ফরমান
তাবুকের নিকটবর্তী একটি প্রাচীন জনপদ আয়লা। নবম হিজরীতে তবুক-অভিযানে আয়লার শাসক ইউহান্না ইবনে রূবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য স্বীকার করে জিয্য়া প্রদানে সম্মত হন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, সেসময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি লিখিত দলীল প্রদান করেছিলেন।দেখুন : সহীহ বুখারী হাদীস ১৪৮১; ৩১৬১; সহীহ মুসলিম হাদীস ১৩৯২/১১-১২; মুসনাদে আহমদ হাদীস ২৩৬০৪ এতে আয়লাবাসীর জন্য নিরাপত্তার ফরমান এবং তাদের কর্তব্য ও অধিকার উল্লেখিত হয়। পূর্ণ দলীলটির জন্য দেখুন : সীরাতে ইবনে হিশাম (আররওযুল উনুফ) ৭/৩১৭; আলআমওয়াল, আবু উবায়দ পৃ. ৫১৩তদ্রূপ ইসলাম গ্রহণকারী বহু কবীলাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখিত দলীল প্রদান করেছিলেন। এসব দলীলে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে ‘আমান’ ও ‘যিম্মা’ লিপিবদ্ধ থাকত। হাদীসের কিতাব থেকে একটি নমুনা পেশ করছি। আবুল আ’লা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনুশ শিখখীর রা. বলেন, ‘আমরা (বসরার) মির্বাদ নামক স্থানে ছিলাম। আমাদের কাছে একজন বেদুঈন এল। তার কাছে ছিল এক খণ্ড চামড়া। সে তা বের করে বলল, তোমাদের কেউ কি এই দলীলটি পাঠ করে শোনাতে পারে? তাতে লিখিত ছিল-
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে উকল-এর বনু যুহাইর ইবনে উকাইশ এর জন্য। তোমরা যদি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং নামায আদায় কর, যাকাত প্রদান কর, মুশরিকদের থেকে দূরে থাক, গনীমতের মাল থেকে এক পঞ্চমাংশ ও নবীর অংশ প্রদান কর তাহলে তোমাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে আমান (নিরাপত্তা)।-মুসনাদে আহমদ ৫/৭৭-৭৮; ৩৬৩; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ২৯৯২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৩৭৭৯০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৮৭৭; আল-আমওয়াল, আবু উবায়দ হাদীস ৩০; মুনাতাকা ইবনুল জারূদ ১০৯৯ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-গ্রন্থ ও জীবনী-গ্রন্থেও এরূপ অনেক দলীলের বিবরণ রয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত : ৭. দু’মাতুল জান্দালের গোত্রপতি উকাইদির ইবনে আবদুল মালিককে একটি লিখিত ফরমান প্রদান করা হয়েছিল।-ইসাবা ১/২৪৫ ইমাম আবু উবায়দ কাসিম ইবনে সাল্লাম রাহ. বলেন, ‘একজন শায়খ আমার নিকটে এই দলীলটি নিয়ে এসেছিলেন। আমি তা পাঠ করেছি এবং হুবহু নকল করেছি। দলীলটি সাদা চামড়ায় লিখিত ছিল।’ দেখুন : আল আমওয়াল ২৫২-২৫৩ ৮. কবীলায়ে ত্বইকে একাধিক ফরমান প্রেরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। জীবনীকারগণ আমির ইবনুল আসওয়াদ ত্বয়ী রা.-এর আলোচনায় একটি দলীলের কথা উল্লেখ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে যে, ভূমি ও পানির উপর তার ও তার কওমের অধিকার বহাল থাকবে যে পর্যন্ত তারা নামায আদায় করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং মুশরিকদের মিত্রতা থেকে বর্জন করবে।-দেখুন : উসদুল গাবাহ ২/৫১০; আল-ইসাবা ৩/৫৭৬ ৯. সইফী ইবনে আমির রা.-এর জীবনীতে একটি লিখিত দলীলের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে তার আমীর নিযুক্তির ফরমান ও কবীলার মুসলিমদের জন্য নিরাপত্তার ঘোষণা ছিল। তাতে সালাত ও যাকাত আদায় করা এবং গনীমতের নির্ধারিত অংশ প্রেরণের বিধান ছিল। -আল-ইসতীআব ২/৭৩৪; উসদুল গাবাহ ২/৪৬৪; আল-ইসাবা ৩/৪৫৩ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-গ্রন্থ ও জীবনী গ্রন্থে এ ধরনের অনেক সন্ধিনামা ও আমাননামার নমুনা বিদ্যমান রয়েছে। (চলবে ইনশাআল্লাহ)