এক মহিয়সী মুমিনার শেষ সফর
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
উনিশ শ পঞ্চাশ থেকে চৌষট্টি সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল দুর্দিন ও অভাবের সময়। কয়েক মাস যাবত আববার বেতন আসত না। কিন্তু সেসময়েও তিনি অভাবীদের দরাজ হস্তে সাহায্য করতেন। খানা খাওয়ার সময় কেউ এসে গেলে চেহারা দেখেই তিনি বুঝে ফেলতেন যে, আগন্তুক ক্ষুধার্ত। তারপর তাকে যেকোনো ভাবে খানা খাওয়াতেন। শুধু তাই নয়, ঐ আগন্তুকের ঘরেও খানা পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। এরকম মানুষ এখন আর দুনিয়াতে নেই, কিন্তু তাদের উসিলায় আল্লাহ তায়ালা এমন বরকত দিয়েছেন যে, সামান্য আয় সত্ত্বেও কখনও অভাব অনুভূত হয়নি। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, আমার মা এমন কাপড়ও অভাবীকে দান করে দিয়েছেন যা তিনি মাত্র একবার কিংবা দুইবার ব্যবহার করেছেন। কেউ এব্যাপারে কিছু বললে তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বড় দাতা, তিনি আমাদেরকে দান করবেন।’ তিনি সেসব নিকটাত্নীয় এবং অভাবীদেরও দেখাশোনা ও সাহায্য করতেন যারা এখানে আসতে পারত না। তিনি কোনো না কোনোভাবে তাদের বাড়িতে খাদ্য ও সাহায্য-সামগ্রী পাঠাতেন।
তিনি সাধারণত দুই জোড়া কাপড় ব্যবহার করতেন। যখনই কোনো নতুন কাপড় এসে যেত পুরাতন কাপড় দান করে দিতেন। খাদ্য-শস্যের বেলায় সর্ব প্রথম এক দশমাংশ আলাদা করে রাখতেন। এর বাইরে অতিরিক্ত দানও করতেন। আমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে কিংবা সফরে বের হলে তিনি তার সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য সদকা দিতেন এবং মান্নত করতেন। বিপদের সময় নিম্নোক্ত আয়াত বার বার পাঠ করতেন :
لا إله الإ الله، أفوض أمري إلى الله، سبحانك إني كنت من الظالمين، ألا بذكر الله تطمئن القلوب.
আববা মারা যাওয়ার পর মানুষের খেদমত করার আরেকটি পন্থা তিনি এই বেছে নিয়েছিলেন যে, যাদুগ্রস্ত ও দুর্ঘটনার শিকার লোকদেরকে কুরআনের আয়াত পড়ে দম দিতেন। লোকজন তেল ও পানি পড়া নিয়ে যেত। কোনো কোনো সময় তাবিজও দিতেন। আল্লাহ তায়ালা তার মাধ্যমে অনেক ভেঙে যাওয়া সম্পর্কও জোড়া লাগিয়েছেন। এগুলোও তিনি তাবিজের সাহায্যে করতেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর মনোযোগহীনতা, খরচ না দেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি সমাধানের চিন্তা করতেন। তার অন্তরে বহু মানুষের গোপন দুঃখ-বেদনার কথা সংরক্ষিত ছিল। অথচ ঘরের লোকজন সেসবের বিন্দুমাত্র অনুমান করতে পারত না। অমুসলিম নারীরাও তার দুআয় লাভবান হত।
আমার মায়ের তৃতীয় গুণ ছিল বাচ্চাদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি। তিনি তাদের উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। তার মতে বাচ্চাদের তরবিয়তের সূচনা হয় বিশুদ্ধ আকীদা ও হালাল খাবারের মাধ্যমে। একথা বলব না যে, আমরা তার তরবিয়াত অনুযায়ী পূর্ণভাবে নিজেদের জীবন সাজাতে পেরেছি। তবে একথা ঠিক যে, তার স্নেহপূর্ণ দীক্ষা আমাদের যিন্দেগীতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। নামায ও তা’লীমের বিষয় দুটি এমন, যার কারণে সাধারণত পিতা মাতাকে অনেক কিছু বরদাশত করতে হয়, কিন্তু আমাদের পরিবেশ সম্পূর্ণ দ্বীনী পরিবেশ হওয়ায় তাদেরকে এ নিয়ে কোনোরূপ ঝামেলা পোহাতে হয়নি। অবশ্য স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণ শেখানোর জন্য অত্যন্ত স্নেহ-মহববত ও হেকমতের সাথে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এ সংক্রান্ত দীর্ঘ চিঠি এর বাস্তবতা বহন করে।
জীবনের শুরুতেই তিনি আমাদের মন-মস্তিষ্কে পিতামাতার ভক্তি-শ্রদ্ধা এমনভাবে গেঁথে দিয়েছিলেন যে, তাদের আনুগত্যই ছিল আমাদের সর্বদার আদর্শ। এ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াত, হাদীস শরীফ এবং বুযুর্গদের ঘটনা অনুসন্ধান এবং সেখান থেকে আদর্শ গ্রহণ করাকে আমরা মুক্তির উপায় বলে মনে করতাম। পিতামাতার তিল পরিমাণ অবাধ্যতার কল্পনা করাকেও আমরা গুনাহ মনে করতাম। দুই তিনটি ঘটনা এমন ঘটেছিল, যাতে মায়ের অবাধ্যতার কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলাম।
একবার তার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও লক্ষ্ণৌ রওয়ানা হয়েছিলাম। সেটা ছিল আমার ছাত্র যমানার ঘটনা। রাস্তায় আমরা দু’টি ট্রেন ফেল করি, আমার নতুন জুতা চুরি হয়ে যায় এবং তিন দিন পর লক্ষ্ণৌ পৌঁছতে সক্ষম হই।
আমার বয়স তখন দশ/বার বছর । ইংরেজি ষ্টাইলে চুল কেটে এলে তিনি সাথে সাথে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন- আগে চুল কামিয়ে আস, তারপর খানা মিলবে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)