শাবান-রমযান ১৪২৯   ||   আগস্ট ২০০৮

সবাই যাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করে তাদের সঙ্গেও আমি ভালো ব্যবহার করব

ইবনে নসীব

আমরা সব সময় একটা কথা শুনে থাকি এবং পত্র-পত্রিকায় ও বইপত্রে পড়ে থাকি। কথাটা এই যে, আমরা সবাই মানুষ। আর মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু প্রায়ই এর বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাই। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি যে, গরীব মানুষকে যেন মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয় না। কাজের মানুষের সঙ্গে, দিনমজুর, ফেরিওয়ালা ও রিকশাওয়ালার সঙ্গে অনেক মানুষ কীভাবে যেন অমানুষের মতো আচরণ করে। প্রায়ই দেখা যায় রিকশা-ভাড়া নিয়ে অনেক ভদ্রলোকও বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরাও পিতার বয়সী রিকশাওয়ালাকে তুই-তোকারি পর্যন্ত করে বসে। এমন দৃশ্য আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি, তুমি দেখেছ কি না আমার জানা নেই।

এই তো সেদিন আমার প্রতিবেশী, যিনি খুব স্মার্টভাবে চলেন এবং মোবাইল ফোনে গান বাজাতে বাজাতে ঘরে প্রবেশ করেন, তিনি এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে লেগে পড়লেন। যেহেতু আমি তার প্রতিবেশী এবং ওই এলাকাটা আমারও পরিচিত তাই আমি জানি, যেখান থেকে তিনি এসেছেন সেখান থেকে এ বাসা পর্যন্ত ন্যায্য ভাড়া বারো টাকা। কিন্তু তিনি দিলেন আট টাকা। রিকশাওয়ালা প্রতিবাদ করায় তিনি খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন, আগে কেন বলনি ভাড়া বারো টাকা! শিক্ষিত মানুষের এহেন যুক্তিতে অবাক হয়ে অশিক্ষিত রিকশাওয়ালা বলল, ভাড়া ঠিক করে নেওয়া কি আমার কর্তব্য? কোনো কথা না বলে লাফ দিয়ে যিনি রিকশায় চড়ে বসেন তাকে কি আমিই বলব, ভাইজান, ভাড়া এত টাকা? তাছাড়া এই পর্যন্ত দূরত্বের ন্যায্য ভাড়াই তো বারো টাকা।

রিকশাওয়ালার মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনতে তিনি প্রস্ত্তত ছিলেন না। তিনি এবার এতই রাগান্বিত হয়ে ওঠলেন যে, এই মারেন কি সেই মারেন। আর ভাষা তো অনেক আগেই তুমি থেকে তুইতে নেমে এসেছে। এখানে বলে রাখি, রিকশাওয়ালা ছিলেন অত্যন্ত বয়স্ক, প্রায় তার পিতার বয়সী।

আরেক দিনের ঘটনা বলি। মসজিদে যাচ্ছিলাম। মসজিদের কাছেই একটি বাসার দরজায় একটি রিকশা এসে থামল। এবং চার-পাঁচ সেকেন্ড পরই তীক্ষ্ম চিৎকার শোনা গেল-একদম চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব।

প্রশ্ন হল, আমরা কি এই আচরণগুলো অনুসরণ করব? যদি বড়দেরকে এমন আচরণ করতে দেখি? পাশের বাসার ভাইয়া বা আপাকে যদি দেখি এভাবে রিকশাওয়ালার সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করতে?  আমরা কি ধারণা করে নেব যে, এমন আচরণই ভদ্রতা ও স্মার্টনেস!! না, আমরা কখনো এই ভুল ধারণার শিকার হব না। কখনো আমরা এই আচরণগুলো অনুসরণ করব না। এগুলো মন্দ আচরণ। বড়রা করেছে বলেই তা ভালো হয়ে যাবে না; বরং যিনি এ আচরণ করলেন তিনিই মন্দ হয়ে গেলেন। তার ব্যবহারটা অসুন্দর হয়ে গেল।

আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা ইম্মাআ হয়ো না। অর্থাৎ এমন হয়ো না যে, লোকে ভালো ব্যবহার করলে তোমরাও ভালো ব্যবহার করবে আর লোকে মন্দ ব্যবহার করলে তোমরাও (তাদের অনুসরণে) মন্দ ব্যবহার করবে; বরং তোমরা নিজেদেরকে অভ্যস্ত কর যে, লোকে যখন ভালো ব্যবহার করে তখনও তোমরা ভালো ব্যবহার করবে আর তারা যখন মন্দ ব্যবহার করে তখনও তোমরা জুলুম থেকে বিরত থাকবে। -জামে তিরমিযী, হা.২০৭৫

আমরা সব সময় গরীব মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব। তারা যদি বয়সে বড় হন তাহলে আপনি বলব, সমবয়সী বা ছোট হলে ভাই বা তুমি বলে সম্বোধন করব। আর রিকশা ভাড়া নিয়ে কখনো তর্কে লিপ্ত হব না। রিকশায় চড়ার আগেই রিকশা-ভাড়া ঠিক করে নেব, যাতে ঝগড়া-বিবাদের সুযোগই সৃষ্টি না হয়।

আর একথাটাই বা ভেবে দেখি না কেন যে, এই পরিশ্রমী মানুষগুলোকে যদি দুচার টাকা বেশি দিয়ে দিই তাহলে কি আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? মোটেই না। বরং হতে পারে এই ভালো ব্যবহার পেয়ে গরীব মানুষটি অত্যন্ত খুশি হবে। তার মন থেকে আমার জন্য দুআ ও শুভকামনা আসবে। আর তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যাবে। আমরা সবাই কি আল্লাহর রহমতেরই মুখাপেক্ষী নই?

এছাড়া আরেকটি কথাও আমরা মনে রাখতে পারি যে, রিকশাওয়ালাকে ইচ্ছা করেই যদি আমি দুটো টাকা বেশি দেই, এমনকি দুটো টাকা যদি ইচ্ছা করেই বেশি ধার্য করি তবে এটাও গোপন ছদকা হিসেবে গণ্য হয়ে যাবে। হাদীস শরীফে গোপনীয়তার সঙ্গে দান করার যে ফযীলত এসেছে তা জানার পর নিশ্চয়ই আমরা এ কাজটা করতে পারি। হাদীস শরীফে এসেছে- সাত ধরনের মানুষকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ার নিচে স্থান দান করবেন। তাদের মধ্যে একটি শ্রেণী হল, যারা এমন গোপনীয়তার সঙ্গে দান করে, যেন তার ডান হাত কী দান করল তা বাম হাতও জানতে পারে না।

তাই যে দূরত্বের ভাড়া আট টাকা কিন্তু রিকশাওয়ালা চাচ্ছে দশ টাকা, আমি জানি, চাপাচাপি করলে আট টাকাতেই সে রাজি হবে কিন্তু ওই গোপন ছদকার নিয়তে আমি আর চাপাচাপি না করে দশ টাকাতেই রাজি হয়ে গেলাম তাহলে-আল্লাহ চাহে-তো আমি দুই টাকা ছদকা করার ছওয়াব পাব। সঙ্গে সঙ্গে উত্তম ব্যবহার ও লেনদেনে উদারতার ছওয়াব তো রয়েছেই।

আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে অন্যের হক সবচেয়ে সুন্দরভাবে আদায় করে।-সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এই আদর্শের বাস্তব দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাঁর পবিত্র জীবনে অতুলনীয় উদারতা ও বদান্যতার ঘটনা রয়েছে। নবীজী সব সময় পাওনাদারকে সন্তুষ্টই করে দিতেন। এমনকি পাওনাদার তাঁর সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করলেও। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবীজীর কাছে একটি উট পাওনা ছিল। সে একদিন এসে কর্কশ ভাষায় কথা বলতে লাগল। তার এ অন্যায় আচরণ দেখে সাহাবীরা রাগান্বিত হলেন কিন্তু নবীজী তাদের সবাইকে থামিকে দিলেন এবং তার পাওনা পরিশোধ করতে আদেশ দিলেন। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, সে যে ধরনের উট পাবে তেমন উট এখানে নেই, তার চেয়ে ভালো উট আছে। নবীজী বললেন, তা-ই তাকে প্রদান কর। কেননা, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে পাওনা পরিশোধ করে। -বুখারী, মুসলিম

এ বিষয়গুলো যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারব যে, রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে যারা মন্দ ব্যবহার করে তাদের অনুসরণ করা আমাদের পক্ষে মোটেই উচিত নয়। আমরা নবীজীর শিক্ষার অনুসরণ করব এবং সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব।

 

 

advertisement