তালেবানে ইলমে নবুওয়তের প্রতি কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশনা
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ১৪২৪ হিজরীতে একবার মারকাযুদ দাওয়াহ থেকে শিক্ষা সমাপনকারী সকল তালিবে ইলমকে মারকাযে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল,তাদের কর্মজীবনের ব্যস্ততা সম্পর্কে অবগতি লাভ করা এবং তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। এ সময় মারকাযের আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু প্রয়োজনীয় কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। বিষয়টি জানার পর কিছু বন্ধু আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় তা প্রকাশ করার অনুরোধ করেন যেন মাদরাসার নেসাববদ্ধ পড়াশোনা সমাপ্ত করে কর্মজীবনে পদার্পণকারী তালাবায়ে কেরামের সামনে কথাগুলো থাকে। এ পরামর্শ আমাদের কাছেও মুনাসিব বলে মনে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে, সকল তালিবে ইলমকে এই বিষয়গুলোর ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আমীনুত তা’লীম
মারাকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঙ-আকাবির ও আসলাফের মিযাজের অনুসরণ
আকাবির ও আসলাফের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যাবে, আমরা শুধু তাঁদের নাম নিয়ে থাকি, তাঁদের রুচি ও বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা শত যোজন দূরে। আজ আমাদের মধ্যে তাঁদের মতো অধ্যয়নপ্রীতি কোথায়? তাঁদের তাহকীকের অনুরাগ, যাচাইয়ের মানসিকতা, ধীরতা ও স্থিরচিত্ততা, অন্তরের পরিশুদ্ধি ও তাকওয়া-পরহেযগারী, দায়িত্ব-সচেতনতা ও সময়ানুবর্তিতা, ইত্তিবায়ে সুন্নত, নাওয়াফেল ও আযকারের প্রাচুর্য, দ্বীনী গায়রত ও নাহী আনিল মুনকার, মাদরাসার আসবাবপত্র এবং সময় ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ইত্যাদি যা তাঁদের স্বভাবের অংশ ছিল তা আমাদের মধ্যে কোথায়?
যদি আমাদের আকাবির-
اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ هَدَی اللّٰهُ فَبِهُدٰىهُمُ اقْتَدِهْ ؕ
এর বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকেন এবং তাঁদের সঙ্গে সম্বন্ধকে আমরা গৌরবের বিষয় মনে করে থাকি তবে তাঁদের উপরোক্ত গুণাবলি অনুসরণ করাও আমাদের জন্য অপরিহার্য। আর তাদের সীরাত ও জীবনী সম্পর্কে অজ্ঞতা, নিজেদের গোয়ার্তুমি ও উদাসীনতা আর অনুভূতিহীনতাকে ইত্তিবায়ে আকাবিরের নাম দেওয়া আমাদের জন্য কোনোভাবেই উচিত নয়।
চ-আদাবে মুআশারা ও আখলাকে জাহেরা-র সংশোধন
আখলাকে জাহেরার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যবানের হেফাজত। যবানের গুনাহসমূহ, যার বিস্তারিত বিবরণ ‘ইহইয়াউ উলূমিদ দ্বীন’ বা ‘তাবলীগে দ্বীন’ প্রভৃতি কিতাবে উল্লেখিত আছে তা থেকে পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা অতি জরুরি। বিশেষত গীবত থেকে বেঁচে থাকা খুবই জরুরি, যা আজকাল ব্যাপক রোগে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন যুক্তি ও কৌশলে আলিম, তালিবে ইলম, এমনকি পীর-মাশায়েখের হালকাতেও একে বৈধতার সনদ দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহ তাআলাই হেফাজতের মালিক।
আলেমগণ বলেছেন, ‘আদাবুল মুআশারা’র সার-নির্যাস-
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। এর বিস্তারিত জ্ঞান লাভের জন্য আবুল হাসান মাওয়ারদী রাহ-এর ‘আদাবুদ দুনয়া ওয়াদ দীন,’ ইবনে মুফলিহ-এর ‘আল আদাবুশ শরইয়্যা’, হাকীমুল উম্মত রাহ-এর এই বিষয়ক রাসাইল, মাওয়াইয ও মালফুযাত অধ্যয়ন করা উচিত। বুখারী রাহ-এর ‘আলআদাবুল মুফরাদ’ ও মাওলানা ইউসুফ কান্দলভী রাহ-এর ‘হায়াতুস সাহাবা’ ও (বিশেষভাবে আল বাবুল আশির) মৌলিক অধ্যয়নের অন্তর্ভুক্ত রাখা উচিত।
মাদারিস ও মাসাজিদের দায়িত্বশীলদের জন্য আদাবে মুআশারা সম্পর্কে প্রখর ও সুবিস্তৃত জ্ঞান অর্জন করা এবং কার্যক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা অতি প্রয়োজন।
আসাতিযা, তালাবা এবং সঙ্গী-সাথীদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, কার কী হক রয়েছে, তদ্রূপ সাধারণ মানুষ ও সাধারণ শিক্ষিত মানুষের সাথে মেলামেশার আদব ও রীতি কেমন হবে, তাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট কিতাবাদি অধ্যয়নের পাশাপাশি আকাবির ও মুছলিহীনে উম্মতের এই বাক্য থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করা যেতে পারে-
السعيد من وعظ بغيره
কেননা, অন্যের যে কথা, কাজ ও আচরণ আমার জন্য কষ্টদায়ক হয় আমার এ জাতীয় কথা, কাজ ও আচরণও অন্যের জন্য কষ্টদায়ক হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, শান্তিপূর্ণ ইজতিমায়ী জীবন যাপনের জন্য তিনটি জিনিসের কোনো বিকল্প নেই : উদাসীনতা পরিত্যাগ করা, তাওয়াজু’ ও বিনয় অবলম্বন করা এবং আকলে সালীম ব্যবহার করা। এছাড়া অনর্থক কাজকর্ম পরিত্যাগ করা, দায়িত্ব বহির্ভূত ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কাজকর্মে হস্তক্ষেপ না করা, যে বিষয়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই তা থেকে দূরে থাকা, দায়িত্বশীলদের প্রতি অনুগত থাকা, তাঁদেরকে সম্মান করা এবং না-হক, অনর্থক বা উল্লেখযোগ্য ফায়েদা ছাড়া তাদের সাথে বিতর্কে না জড়ানো, ঝাগড়া-বিবাদ থেকে দূরে থাকা, বড়ত্ব ও উন্নাসিকতা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি সবগুলোই হল ‘আদাবুল মুআশারা’র অপরিহার্য বিষয়। অথচ দুঃখজনক সত্য এই যে, এসব বিষয়ে চরম অবহেলা প্রদর্শন করা হয়। আপনাদের কর্তব্য হল আপনারা এই প্রচলিত ধারার অনুগামী হবেন না।
জনসাধারণের সাথে আপনাদের আচরণ কেমন হবে তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া শুধু তালিকা আকারে নিম্নে উল্লেখিত হল :
* আম মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যাবে না। অনেক সময় তারাই অধিক উত্তম ও অধিক পরহেযগার হয়ে থাকেন। এ ছাড়া এমনিতেও কোনো মানুষকে তুচ্ছ মনে করা, সে যে ধরনের মানুষই হোক না কেন, অবশ্যই নিন্দনীয়।
* কথা ও কাজে তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও ধারণক্ষমতার দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
كلموا الناس على قدر عقولهم
উক্তিটি সবার জন্য। এর যথাযথ মর্ম অনুধাবনের জন্য ইমাম গাযালী রাহ.-এর ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন-গ্রন্থের ‘কিতাবুল ইলম’ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
* তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া যাবে না।
* তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না।
* সহজ, সুমধুর এবং শক্তিশালী বর্ণনার মাধ্যমে তাদের সংশয়-সন্দেহের উত্তর দিতে হবে।
* কোনো বিষয়ে আলোচনার সময় খোঁচা দেওয়া, কটাক্ষ করা বা কষ্ট দেওয়ার পথ পরিহার করতে হবে। কেননা প্রত্যেক মুসলিমই ইজ্জত ও সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে। তাছাড়া নসীহত ও উপদেশ দানের জন্য দয়া ও প্রজ্ঞা ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত কোনো বৈধ পেশা বা বৈধ শিক্ষার নিন্দা করা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। বৈধ শিক্ষার ভুল ব্যবহার বা ভুল পদ্ধতি, তদ্রূপ বৈধ পেশায় অত্যধিক নিমগ্নতা, যার ফলে ফরয বিধানও ছুটতে থাকে- এটা অবশ্যই ভুল। তবে হেকমত ও কৌশলের সাথে সে ভুল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। কোনো বৈধ পেশা বা বৈধ শিক্ষা সম্পর্কে যা পার্থিব জীবনের জন্য জরুরি এবং শরীয়তেও যার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত, নিন্দা সমালোচনা করা কোনো সচেতন আলেমের কাজ হতে পারে না।
* দ্বীন বোঝাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কোনো অশালীন উপমা দেওয়া কিংবা কোনো মন্দ পদ্ধতি অনুসরণ করা মোটেই উচিত নয়। কেননা মন্দ ও অশালীনতার প্রচার-প্রসার ঘটানো আমানত ও দ্বীনদারী পরিপন্থী কাজ। আর সামান্য বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ শিক্ষিতদের বৈঠকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে। নতুবা খোদ আলেমেরই বুদ্ধিহীনতা ও রুচিহীনতা প্রকাশ পাবে এবং তার ভদ্রতা ও শালীনতাবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মনে রাখতে হবে, আম মানুষের বিচার-বুদ্ধি সম্পর্কে নীচু ধারণা পোষণ করা আত্মঘাতী হয়ে যেতে পারে।
৭. বর্তমানে গবেষক নামধারী প্রগতিবাদী ব্যক্তিদের সাথে উপযুক্ত পন্থায় আলোচনায় বসা যেতে পারে যদি মনে হয় যে, তাদের মধ্যে শোনার ও বিবেচনা করার অভ্যাস আছে। অন্যথায় তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করাই বাঞ্ছনীয়। মূলত এধরনের লোকদের সম্পর্কে কুরআনে কারীমের নিম্নোক্ত বাণী প্রযোজ্য :
وَّ اِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلٰمًا۶۳
বিশেষত যার সম্পর্কে বোঝা যায় যে, সে হটধর্মিতার বশবর্তী হয়েই প্রশ্ন করছে তার পিছনে সময় ব্যয় না করাই বাঞ্ছনীয়।
* তাদের থেকে বে-নিয়াজ থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিম্নোক্ত বাণী সামনে রাখা জরুরি-
ازهد في الدنيا يحبك الله وازهد فيما في أيدي الناس يحبك الناس
* তাদের সমস্যা ও প্রবণতা এবং ভাষা ও পরিভাষা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
তারা আমাদের দয়া ও অনুকম্পার পাত্র, ঈর্ষার পাত্র নয়।
* ইলমের মর্যাদা এবং এর হুকুক ও আদাব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এ বিষয়টাই সাধারণ মানুষের অন্তরে আলেমদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা বিদ্যমান থাকার (যা শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকেও কাম্য) অন্যতম উপায়।
* তাদের সাধারণ প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনে রাখতে হবে। হাকীমুল উম্মত রাহ-এর আশরাফুল জাওয়াব এ প্রসঙ্গে অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
* উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও সাধারণ শিক্ষিতদের মাঝে বহু ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া উলামায়ে কেরামের ব্যাপারে তাদের অভিযোগ ও আপত্তির কোনো শেষ নেই। এর মধ্যে কিছু তো হল ভিত্তিহীন, যা বেদ্বীনী ও বদ দ্বীনীর কারণে সৃষ্টি হয়েছে। আর কিছু পয়দা হয়েছে মূর্খতার কারণে। কিন্তু এমন কিছু অভিযোগও রয়েছে যেগুলো যথার্থ; এগুলো এমন কিছু আলেমেরই ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে যারা ইলমের দাবি ও মর্যাদা এবং ইলমের আদব ও শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ রাখে না এবং নিজেদের আখলাক-চরিত্রের উন্নতির দিকেও মনোযোগ দেয় না।
সাধারণ মানুষ ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের সাথে এ সম্পর্কে আলোচনা উঠলে হক্কানী উলামায়ে কিরামের পক্ষ থেকে সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করা দ্বীনী দায়িত্ব। তবে এক্ষেত্রেও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। তেমনিভাবে ধৈর্য্য ও প্রজ্ঞারও পরিচয় দিতে হবে। এই ব্যাখ্যা যেন এমন না হয় যে, কতক আলেমের সুস্পষ্ট বিচ্যুতিরও পক্ষাবলম্বন করা হল কিংবা ব্যাখ্যার ভিত্তিটি খুবই দুর্বল বা বাস্তবতাবিরোধী হল যে, খোদ শ্রোতারাও এর দুর্বলতার দিক ধরতে পারে।
এসব বিষয়ের জন্য বিচক্ষণ আহলে ইলম এবং প্রজ্ঞাবান অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত এবং হযরত থানভী রাহ. ও অন্যান্য আকাবিরের মালফুযাত ও মাওয়ায়েয পড়া কর্তব্য।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)