মেরী ‘ইলমী ও মুতালা‘আতী যিন্দেগী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান ছাহেব নদভীর রচনাবলির পরিচয় দুই বৈশিষ্ট্যে উল্লেখ করা যায় : পর্যালোচনার তুলাদন্ড এবং ভাষা ও সাহিত্যের মানদন্ড। তবে এই অধমকে যে জিনিস সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে তা হল ‘খুতবাতে মাদরাছ’। এই এক রচনাই তার রচয়িতাকে অমরত্ব দান করতে পারে। আর যদি মকবূল হয় (বিভিন্ন আলামত থেকে যা প্রকাশিতও বটে) তবে এটিই তার মুক্তি ও নাজাতের জন্য যথেষ্ট হতে পারে। বারবার রেখে চেখে অধ্যয়ন করেছি। সীরাতের বহু নতুন দিক চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে এবং এই পরিবর্তনের যুগে আহলে ইলম ও শিক্ষিত অমুসলিমদের সামনে হাদীস ও সীরাত পেশ করার পন্থা খুঁজে পেয়েছি।
মাওলানা সাইয়েদ মানাযির আহসান গীলানী রাহ.-এর রচনাবলিতে প্রচুর তথ্য ও জানার বিষয় রয়েছে। তাঁর বিশেষ রচনাভঙ্গি এবং প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে বিচরণের কারণে অনেক পাঠক তার আলোচনায় আগ্রহ ধরে রাখতে পারেন না, কিন্তু আমি সর্বদাই আগ্রহ অনুভব করেছি এবং অনেক নতুন বিষয় জানতে পেরেছি। বিশেষত তাঁর ‘আননাবিয়্যুল খাতাম’ সীরাতের এক অভিনব কিতাব।
এছাড়া ‘হিন্দুস্তান মে মুসলমানোঁ কা নেযামে তা’লীম ওয়া তারবিয়াত’ রচনাটিও অত্যন্ত তথ্যবহুল ও প্রেরণা সঞ্চারক। তৃতীয় কিতাব ‘তাদবীনে হাদীস’ গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ ও প্রাঞ্জল গ্রন্থ।
‘মুজাদ্দিদে আলফে ছানী কা তাজদীদী কারনামা’ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধটিও অসামান্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছে। তাঁর এই প্রবন্ধ এবং ‘আলফুরকান শাহ ওয়ালিউল্লাহ নাম্বার’-এ প্রকাশিত তাঁরই আরেকটি প্রবন্ধ থেকে হিন্দুস্তানের ইতিহাসের অনেক দিক আমার সামনে স্পষ্ট হয়েছে। ‘হায়াতে জাবীদ’, ‘ওয়াকারে হায়াত’ ও ‘তাহযীবুল আখলাক’-এর পুরানো সংকলনগুলো থেকে হিন্দুস্তানী মুসলমানদের রুচি ও মেযাজ সম্পর্কে জানতে পেরেছি এবং শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ে তাদের বর্তমান চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। তবে এই পরিচয় পূর্ণতা লাভ করেছে ‘হায়াতে শিবলী’ অধ্যয়নের মাধ্যমে।
মৌলভী সাইয়েদ তোফায়েল আহমদ ছাহেবের ‘হুকূমতে খোদ এখতিয়ারী’ ও ‘মুসলমানোঁ কা রওশন মুসতাকবিল’ শীর্ষক গ্রন্থ দু’টো থেকে ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক পরাজয় ও মনস্তাত্বিক পরিবর্তনের ব্যাখ্যা পেয়েছি।
ভারতবর্ষের ধর্মীয় ও শিক্ষা-দীক্ষার ইতিহাস এবং ইসলামী পরিচয়ের সবচেয়ে বড় তথ্যসম্ভার নিজ গৃহেই বিদ্যমান ছিল, কিন্তু কখনো তা চিন্তায় আসেনি। যখন হায়দারাবাদ থেকে তা প্রকাশের তোড়জোড় শুরু হল তখন ওয়ালিদে মারহুমের ওই রচনা ও জীবন-সাধনা-‘নুযহাতুল খাওয়াতির’-এর আট জিলদ একাধিক বার অধ্যয়ন করেছি। এই গ্রন্থের সাহায্যে হিন্দুস্তানের আট শ বছরের ইতিহাস চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। উলামা-মাশায়েখ, লেখক-সাহিত্যিক এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি সুলতান-উযীর, আমীর-রঈস, মোটকথা ভারতবর্ষের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসের এমন মূল্যবান ও দূর্লভ বিষয়াদি বিনা খরচে লাভ করি, যা শত শত কিতাবের পাতা উল্টিয়ে এবং হাজার হাজার পৃষ্ঠা চালুনি দিয়ে চেলেও বের করা সম্ভব ছিল না। গ্রন্থটি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে এত বৃহৎ তথ্যসূত্র যে, ইলমের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে এমন কোনো ভারতীয় ছাত্র কখনো এ গ্রন্থকে অবহেলা করতে পারবে না এবং যার সাহায্য ছাড়া মানুষ নিজ দেশেই অন্ধকারের মধ্যে বিচরণ করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো গ্রন্থের তথ্য ও জ্ঞান-ভান্ডার থেকে এতখানি সাহায্য গ্রহণ করিনি যতটা ‘নুযহাতুল খাওয়াতিরে’র বৃহৎ বৃহৎ আট খন্ডের ঐতিহাসিক তথ্যসম্ভার থেকে, যা তালাশ করার জন্য তারীখ ও তাসাওউফের কিতাবাদির হাজার হাজার পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করার না সুযোগ ছিল, না সামর্থ্য। আর না এই ধারণা যে, এগুলো কোথায় তালাশ করা উচিত এবং কোথা থেকে আহরণ করা সম্ভব। আমার দুর্ভাগ্য যে, বয়সের স্বল্পতার কারণে আমি ওয়ালিদ ছাহেব থেকে সরাসরি উপকৃত হতে পারিনি, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে রহমত ও মাগফিরাতে সুসিক্ত করুন তিনি এমন জ্ঞান-ভান্ডার রেখে গিয়েছেন, যা থেকে সারা জীবন উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
জীবনের সুদীর্ঘ সময়জুড়ে চিন্তা ও চেতনায় আল্লামা ইকবাল মরহুমের গভীর প্রভাব ধারণ করেছি। এবং কোনোরূপ অতিশয়তা ছাড়াই এ কথা বলা যায় যে, সমকালীন কোনো ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা দিল-দেমাগে এতটা গভীর ছাপ অঙ্কন করেনি যতটা আল্লামা ইকবালের পংক্তিমালা। সম্ভবত এর কারণ এই যে, হৃদয় ও শরীরের রক্ত কণিকায় প্রবাহিত ভাষাহীন ভাবনা ও কামনাগুলো ইকবালের কবিতায় বাঙময় হয়ে ওঠেছে। ইকবাল ও তার কবিতা প্রসঙ্গে উর্দূ ভাষায় এত বেশি লেখালেখি হয়েছে যা সমকালীন আর কোনো ব্যক্তির চিন্তা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সম্ভবত হয়নি। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সারগর্ভ ও প্রাণপ্রদ রচনা আমার কাছে ড. ইউসূফ হুসাইন-এর ‘রূহে ইকবাল’ কেই মনে হয়েছে।
আল্লামা মরহুমের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাত হয়েছিল ১৩৫৬ হিজরী/১৯৩৭ ঈসাব্দে। কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত তাঁর আলোচনা ও অভিনিবেশ দ্বারা সিক্ত হই, যার সারসংক্ষেপ পাঞ্জাবের এক সাময়িকীতে ‘আরেফে হিন্দী কি খিদমত মে চান্দ ঘনটে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
আরব দেশগুলোর মুসলিম পাঠকদের উদাসীনতা ও অজ্ঞানতা এবং ‘টেগোর’-এর জনপ্রিয়তা দৃষ্টে ক্রোধের সঞ্জার হত। আল্লামা মরহুমের ইন্তেকালের পর তার জীবন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তবে আরব বিশ্বে তাঁকে পরিচিত করার সবচেয়ে সফল প্রয়াস ‘রাওয়াইয়ে ইকবাল’-এর মাধ্যমে গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল, যা আরবী নওজোয়ানদের মধ্যে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়।
প্রথম দিকে যখন তাঁর কবিতায় মগ্ন ও সমাহিত হয়ে আছি, তখনই চেতনা হয়েছে যে, কোনো মানুষের বাক্যে এতখানি মগ্নতা ভালো নয়। পরম নিমগ্নতার একমাত্র দাবিদার হল আল্লাহ তাআলার শাশ্বত বাণী ও পয়গাম, যা কুরআন মজীদের আকারে সংরক্ষিত ও বিদ্যমান। জগতের যে যা কিছু লাভ করেছে এখান থেকেই লাভ করেছে। ইকবালের পংক্তিগুলো এখনো রক্ত-কণিকায় শিহরণ জাগায় এবং আবেগ ও অনুভূতিকে উদ্দীপ্ত করে। মুসলিম নওজোয়ানদের জন্য এখনও তাকে শক্তি ও স্বনির্ভরতার অনেক বড় উৎস মনে করি।
অধ্যয়নের ধারাবাহিকতায় মাওলানা আবদুল বারী ছাহেব নদভী-এর একটি ছোট পুস্তিকা-‘মাযহাব ওয়া আকলিয়াত’ চোখে পড়েছিল, যা আয়তনের বিচারে ক্ষুদ্র হলেও মূল্যের বিচারে অনেক বড়। এই পুস্তিকা থেকে বুদ্ধি ও বিচারের সীমারেখা, মনুষ্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা আর আম্বিয়া কেরাম আলাইহিমুস সালামের ইলমের অকাট্যতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জিত হয়েছিল, যা পরবর্তী অধ্যয়নে প্রচুর সহায়তা করেছে। এরপর প্রাচীন ও আধুনিক বহু দার্শনিক মতবাদ, যা হাতের কাছে পেয়েছি, পড়েছি, কিন্তু সেই প্রথম চিন্তায় সামান্যতমও কম্পন সৃষ্টি হয়নি। বরং যতই পড়েছি ততই بَلْ كَذَّبُوْا بِمَا لَمْ یُحِیْطُوْا بِعِلْمِهٖ وَ لَمَّا یَاْتِهِمْ تَاْوِیْلُهٗ ؕ ও وَ اِنْ هُمْ اِلَّا یَخْرُصُوْنَ۱۱۶ –এর যেন বাস্তব দৃষ্টান্ত প্রকাশিত হয়েছে।
হাফেয ইবনে তাইমিয়ার ‘তাফসীরে সূরা ইখলাস’ ও ‘কিতাবুন নুবুওয়াত’ এর বিভিন্ন আলোচনা থেকেও অনেক সাহায্য পেয়েছি। তবে চিন্তার রেখাগুলোকে গভীর ও গভীরতর করেছে হযরত মুজাদ্দেদে আলফে ছানী রাহ-এর ‘মাকতূবাত’।
আমার শিক্ষক ও মুরববী বড় ভাইজান ড. সাইয়েদ আবদুল আলী মরহুম, যার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞা ও স্থিরচিত্ততা জীবন-পথের প্রতিটি মোড়ে এবং জীবন-সফরের প্রতিটি মনযিলে আমার রাহবরী করেছে। তিনি সব সময় মুজাদ্দেদে আলফে ছানী রাহ-এর ‘মাকতূবাত’ (পত্রাবলি) ও হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ-এর ‘ইযালাতুল খাফা’ অধ্যয়নের তাকীদ করতেন। কিন্তু কৈশোরের চাপল্য ও চঞ্চলতার কারণে কখনো এ অধ্যয়ন দু’চার পৃষ্ঠার অধিক অগ্রসর হয়নি। দফতরে আওয়াল-এর প্রথম পত্রটিই, যা মুজাদ্দিদ রাহ. তাঁর মুরশিদ হযরত খাজা বাকী বিল্লাহকে লিখেছিলেন এবং যে পত্রে তাঁর অনেক অনুভূতি ও সুলূকের পথের অনেক অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছিলেন, বরাবর হতাশার কারণ হয়ে যেত। শেষে একবার দৃঢ় সংকল্প করলাম যে, মকতূবাত-এর প্রতিটি শব্দ অধ্যয়ন করব এমনকি অধিকাংশ কথা বোধগম্য না হলেও। এই সংকল্পের পর তিন দফতরই পড়লাম। প্রতিটি ছত্র মনোযোগ দিয়ে এবং স্বাদ নিয়ে নিয়ে। আমার অযোগ্যতা, অধ্যয়ন-শক্তির সীমাবদ্ধতা এবং ‘উলূমে আকলিয়া ও আলিয়া’র সঞ্চয়হীনতা যদিও পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তবুও এক নগণ্য আম মানুষের হিস্যায় যা কিছু এসেছে, এর ওপরও আল্লাহর হাজার হাজার শোকর।
এর বহুদিন পর হযরত শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মুনীরী রাহ-এর ‘মাকতূবাত’ অধ্যয়নের সৌভাগ্য হল। হযরত মুজাদ্দিদ রাহ. ও হযরত মাখদূম বিহারী রাহ-এর ‘মাকতূবাত’ অধ্যয়নে ইলমের এক নতুন জগৎ দৃষ্টিপথে উন্মোচিত হল। ওহী ও নবুওয়তের অকাট্যতা, মাকামে রিসালাতের সমুচ্চতা, নবুওয়ত ও নবীগণের বৈশিষ্ট্য এবং নবুওয়ত ও বেলায়াত-এর বিশিষ্টতা সম্পর্কে যে তত্ত্ব ও তথ্য সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে, তুলনা করতে বললে বলব, চিন্তার সূক্ষ্মতার বিচারে প্রাচীন গ্রীক দর্শন এগুলোর ওপর শত বার উৎসর্গিত আর চিত্তের আবেশ ও উদ্দীপনা সৃষ্টির বিচারে কবি সাহিত্যিকদের কাব্য ও সাহিত্যও হাজার বার কোরবান!
হযরত মুজাদ্দিদ রাহ-এর ‘মাকতূবাত’-এ সুন্নত ও বিদআত সম্পর্কে যে মুজাদ্দিদানা আলোচনা প্রকাশিত তা থেকে অত্যন্ত প্রশান্তি অর্জিত হয়েছে। তদ্রূপ আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে দ্বীনের নুসরত ও সাহায্যের প্রসঙ্গে তার পত্রাবলি দ্বীনী চেতনা ও গায়রতকে উদ্দীপ্ত করেছে এবং শরীর ও হৃদয়ের নিস্তেজ শিরা-উপশিরায় দ্বীনের উত্তাপ সরবরাহ করেছে।
এই দুই বুযুর্গের ‘মাকতূবাতে’ প্রাণ ও প্রেরণার যে ধারা বহমান তা প্রাচীন মনুষ্য রচনায় খুব কমই পাওয়া যায়। কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও ওই প্রভাব ও প্রাণময়তা তাতে অনুভূত হয় যা সাধারণত লেখার সময় হয়ে থাকে।