লেখা ও রচনা প্রসঙ্গে
নফসের সাথে বাহাছ বিষয়ে লেখা নিয়ে ভাবছিলাম। এ বিষয়ে কেন লিখব, কি কি প্রসঙ্গ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে, লেখার আঙ্গিক কি হবে, উপস্থাপন কি হবে, কোন প্রসঙ্গ দিয়ে লেখার সূচনা করব-এসব নিয়ে ভাবছিলাম। ব্যাস ভাবনা শুরু করতেই নফস দাঁড়িয়ে গেল।
নফসঃ এতসব লেখালেখি করে লাভ কী?
আমিঃ লাভ আছে। এ বিষয়ে লিখলে আশা করা যায় বহু মানুষ নফস ও শয়তানের প্রতারণার কৌশল এবং নফস ও শয়তানের সাথে মোকাবেলা করার পদ্ধতি সম্বন্ধে অবগত হতে পারবে এবং নফস ও শয়তানের প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়ার পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারবে। নফস ও শয়তানের প্রতারণা থেকে মুক্ত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী ও ধর্ম-কর্মে বেশি অগ্রসর হতে পারবে।
নফসঃ পূর্বেও তো এ শিরোনামে না হোক এর কাছাকাছি শিরোনামে অন্য অনেকে এ জাতীয় বিষয়ে লিখেছেন। তাতে কি নফস ও শয়তানের প্রতারণা থেকে মানুষ রক্ষা পেয়েছে। আল্লামা ইবনুল জাওযী লিখেছেন ‘‘তালবীসে ইবলীস’’, লিখেছেন, ‘‘সাইদুল খাতির’’। লেখা হয়েছে শয়তানের ডায়েরী, আরও কত কিছু। তাতে কি আগের চেয়ে ইবাদত-বন্দেগী ও ধর্ম-কর্মে মানুষ বেশি অগ্রসর হতে পেরেছে? নফস ও শয়তান দ্বারা প্রতারিত হওয়ার পরিমাণ বা সংখ্যা কি আগের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে?
আমিঃ হে শয়তান! দুআ করতে গেলেও তুমি এই যুক্তি দেখিয়ে থাক যে, এত দুআ করে লাভ কী? তুমি যা চাও তা তো পাও না! ওয়াজ-নসীহত করতে গেলেও তুমি এই যুক্তি দেখিয়ে থাক যে, এত ওয়াজ-নসীহত করে লাভ কী? মানুষ তো মানে না! তাই বলে কি তোমার যুক্তি মেনে আমরা আল্লাহর কাছে চাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি? ওয়াজ-নসীহত কি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? কেউ কোন বিষয়ে বই-পত্র লেখার মনস্থ করলেও তুমি তার সামনে এই যুক্তি প্রদর্শন করে তাকে লেখা থেকে নিবৃত্ত করতে চাও, তার লেখা বন্ধ করে দেয়ার প্রয়াস চালাও যে, এত লেখালেখি করে লাভ কী? তাই বলে কি বই-পত্র লেখা বন্ধ রয়েছে? অতএব আমার এ লেখাও বন্ধ হবে না। তোমার বক্তব্য সঠিক নয়।
দুআ করে লাভ কী-এ বক্তব্য বিভ্রান্তিকর। আমি দুআতে যা চাই সব সময় হুবহু আমাকে তা প্রদান করা হয় না বলে কি দুআ করাটা বেকার? অনেক সময়তো যা চাওয়া হয় আল্লাহ তাআলা হুবহু তা-ই প্রদান করেন। আবার কখনো কখনো যা চাওয়া হয় সেটা দুআকারীর জন্য মঙ্গল হবে না বিধায় যেটা তার জন্য মঙ্গল হবে সেটাই আল্লাহ তাআলা প্রদান করে থাকেন। এটাতেই কি লাভ নয় যে, মঙ্গলকরটাই পাওয়া গেল? আবার কখনো কখনো দুনিয়ার জন্য চাওয়া হলে আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়াতে না দিয়ে তার আখেরাতের জন্য সেটা রেখে দেন। এতেও তার জন্য মঙ্গল। কারণ দুনিয়ার পাওয়াটা ক্ষণস্থায়ী, আখেরাতেরটা চিরস্থায়ী। এটাই তো বড় লাভ! অতএব যেভাবেই দুআ কবূল হোক না কেন সর্বাবস্থায়ই কল্যাণ। সুতরাং যেভাবে চাওয়া হয় সব সময় সেভাবে কবূল হয় না বলে দুআ করে কোনো লাভ নেই-এ কথা বলা সর্বৈব ভ্রান্তিকর।
ওয়াজ-নসীহত ও উপদেশে কাজ হয় না-এ কথাও ঠিক নয়। মানুষ যা কিছু ধর্ম-কর্ম করছে তা তো ওয়াজ-নসীহত ও উপদেশ শুনেই করছে। ছোট্ট থাকতে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, বড় ভাই-বোন ও মুরব্বীগণ নসীহত উপদেশ করেছেন, ভাল হতে বলেছেন, গুরুজনকে মান্য করতে বলেছেন, নামায পড়তে বলেছেন, লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে বলেছেন ইত্যাদি। এসব নসীহত উপদেশ শুনেই তো আমরা যতটুকু পেরেছি তদনুযায়ী আমল করেছি এবং ভাল পথে অগ্রসর হয়েছি। এসব উপদেশ-নসীহত না শুনলে তো এই ভাল পথে এতটুকু অগ্রসর হওয়া আদৌ সম্ভব হত কি না ঘোর সন্দেহ রয়েছে। মানুষ যতটুকু দ্বীনের পথে অগ্রসর হয় তার পশ্চাতে কোন না কোন আলেম বা দ্বীনদার ব্যক্তির নসীহত-উপদেশের ভূমিকা থাকে। অতএব ওয়াজ-নসীহত ও উপদেশে লাভ কী-এ বক্তব্যও সঠিক নয়।
বই-পত্র লেখা দ্বারাও ওয়াজ-নসীহতের ভূমিকা পালিত হয়ে থাকে। বই-পত্র লেখা দ্বারাও দাওয়াত ও তাবলীগের ভূমিকা পালিত হয়ে থাকে। আরবীতে প্রবাদ আছে
القلم أحد اللسانين
অর্থাৎ কলম হল দুই জবানের একটি। অতএব বই-পত্র লিখে লাভ কী-এ বক্তব্যও সঠিক নয়। ‘‘তালবীসে ইবলিস’’, ‘‘সাইদুল খাতির’’, ‘‘শয়তানের ডায়েরী’’ প্রভৃতি বইয়ের ওছীলায় নফস ও শয়তান দ্বারা প্রতারিত হওয়ার পরিমাণ আগের চেয়ে হ্রাস পায়নি তা কী করে নিশ্চিতভাবে বলা যায়? এগুলি লেখার পূর্বে ইসলামী বই-পত্র পাঠকারীদের মধ্যে যে হারে লোক নফস ও শয়তান দ্বারা প্রতারিত হত এখন অন্ততঃ তাদের মধ্যেও সে হার হ্রাস পায়নি তা কি কেউ জরিপ করে দেখেছে? এগুলি পাঠ করা দ্বারা যে কয়জন পাঠক নফস ও শয়তানের প্রতারণা থেকে রক্ষা পেয়েছে এগুলি লেখা না হলে সে কয়জন তো প্রতারিতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হত। এগুলি লেখা দ্বারা অন্ততঃ তাদের সংখ্যা প্রতারিতদের তালিকা থেকে হ্রাস পেয়েছে। আর কেউ না হোক আমি তো অন্ততঃ এ লেখা দ্বারা উপকৃত হয়েছি। অতএব নিশ্চিতভাবে বলা যায় এগুলি লেখা দ্বারা লাভই হয়েছে। বস্তুত লেখালেখি কোনো অবস্থাতেই বেকার নয়। লেখালেখি দ্বারা কিছু না কিছু লাভ হয়েই থাকে। সুতরাং আমি তোমার এ কথায় লেখা থেকে নিবৃত্ত হব না। আমি আমার এ কাঙ্খিত লেখা সম্পন্ন করার চেষ্টা করেই যাব ইনশাআল্লাহ।
নফসঃ ঠিক আছে লিখতে পারেন। তবে পূর্বের চেয়ে আপনার ব্যস্ততা এখন অনেক বেড়ে গেছে। একটা সুন্দর লেখা দাঁড় করানোর জন্য যে পরিমাণ সময় ও এনার্জি দিতে হয় তা কি এখন আপনি দিতে পারবেন? না পারলে যেনতেনভাবে লেখা সম্পন্ন করবেন, এতে লেখার জগতে আপনার গুডউইল নষ্ট হয়ে যাবে, পাঠক মহলে আপনার সুনাম হ্রাস পাবে। ভেবে-চি্ন্তে পদক্ষেপ নেয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ।
আমিঃ বুঝলাম এটাও শয়তানের একটা কৌশল। যখন কোন লোক কোন নেক কাজের ইচ্ছা করে, তখন শুরুতে শয়তানের প্রচেষ্টা থাকে সে কাজটি যেন লোকটা শুরুই না করে। অবশেষে যখন সে লোক কাজটি করারই সংকল্পে উপনীত হয়, তখন শয়তানের প্রচেষ্টা থাকে যেন সে কাজের মধ্যে রিয়া এসে যায়, ইখলাস আসতে না পারে। তাই আমি বুঝলাম আমার পূর্বেকার লেখা বই-পত্রের গুডউইলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং পাঠক মহলে আমার সুনামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে একদিকে শয়তানের চেষ্টা হল আমার এই নতুন লেখাটিও যেন গুডউইল রক্ষার উদ্দেশ্যে ও সুনাম অর্জনের নিয়তে হয়ে যায় এবং এভাবে আমার এই নতুন রচনাকর্মে শুরু থেকেই রিয়া এসে যায়, কর্মটি ইখলাস শূন্য হয়ে পড়ে। সাথে সাথে পূর্বের রচনাকর্মের মধ্যে ইখলাস থেকে থাকলে সেই ইখলাসও যেন নষ্ট হয়ে রিয়া সে স্থান দখল করে নেয়। আর ব্যস্ততার যে দিকটি তুলে ধরা হয়েছে, তা এ কাজের প্রতিবন্ধক কোথায়? আমার ব্যস্ততার সিংহভাগ তো এই লেখালেখি ও রচনা নিয়েই।
নফসঃ তাহলে আপনি ইখলাসের সাথেই কাজ শুরু করুন। আল্লাহর শোকর আদায় করুন। আপনার মধ্যে ইখলাস এসে গেছে।
আমিঃ মনে মনে ভাবলাম আলহামদুলিল্লাহ! শয়তানের প্ররোচনা উপেক্ষা করে ইখলাসের সাথেই কর্মটি শুরু করতে যাচ্ছি। কিন্তু এ-ও বুঝলাম শয়তান সম্পর্কে যা শুনেছি যথার্থই শুনেছি। বুযুর্গানে দ্বীনের বাচনিক শুনেছি, যখন কেউ কোন নেক কাজ শুরু না করার শয়তানী ওয়াছওয়াছা উপেক্ষা করে এবং রিয়ার চেতনাকে প্রতিহত করে কাজ শুরুই করে দেয়, তখন শয়তান তার মনে ইখলাস এসে যাওয়ার চিন্তা এনে দেয়। এভাবেও সে ইখলাস নষ্ট করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে থাকে। কেননা, প্রকৃত ইখলাস হল সম্পূর্ণ আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাজ করা। ইখলাস আসল কি আসল না-এই চিন্তাও না থাকা। কেননা, ইখলাস এসে গেছে অর্থাৎ, রিয়া দূর করতে পেরেছি, শয়তানী ওয়াছওয়াছাকে প্রতিহত করতে পেরেছি-এই চিন্তাও এক ধরনের গায়রুল্লাহর চিন্তা তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর চিন্তা। এটাও কিছুটা রিয়া বিজড়িত চিন্তা। তাই ইখলাস এসেছে কি না-এদিকেও খেয়াল না দেওয়া চাই। খেয়াল থাকা চাই সর্বতোভাবেই আল্লাহর প্রতি। চিন্তা থাকা চাই পূর্ণটাই আল্লাহ কেন্দ্রিক। এটাই হল নির্ভেজাল ও নিরংকুশ ইখলাস। এ জন্যেই জনৈক বুযুর্গ বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ ইখলাস হল ইখলাসের চিন্তাও না থাকা। বুঝলাম আমার কর্মে ইখলাস এসে গেছে, অর্থাৎ, আমি মুখলিস তথা ইখলাসের অধিকারী হয়ে গেছি-এ চিন্তাও শয়তানের প্রক্ষিপ্ত একটা চিন্তা। এটাও শয়তানের শেখানো নফসের একটা কথা।
নফসঃ ঠিক আছে নফসের সব কথাই আপনি উপেক্ষা করতে পারলেন। এখন লিখুন। আমার কথায় না হোক নিজের ইচ্ছায়ই লিখুন এবং ভালভাবেই লিখুন। আপনি ইচ্ছা করলে ভালভাবেই লিখতে পারবেন। ভাল করে লেখার যোগ্যতা আপনার মধ্যে আছে।
আমিঃ এটাও একটা শয়তানী কথা। আমার মধ্যে মোটেই কোন যোগ্যতা নেই, বাহ্যিক দৃষ্টিতে ছিটেফোঁটা কিছু আছে বলে মনে হলেও তাতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই। আমার অল্প-বিস্তর কোন লেখা কিছু মানুষের কাছে ভাল বলে গৃহীত হয়ে থাকলেও তা আমার যোগ্যতায় হয়নি, আল্লাহর রহমতেই হয়েছে। এ সবকিছুর জন্য অহংকার বা গর্ববোধ নয়; বরং আল্লাহর শোকর। বুঝলাম, শয়তান আমার যোগ্যতার কথা তুলে ধরে আমাকে আত্মম্ভরী করে তোলার চেষ্টা করছে, এই নতুন রচনাকর্মে আল্লাহর উপর ভরসার কথা এবং আল্লাহ থেকে রহমত কামনা করার কথা বিস্মৃত হয়ে নিজের যোগ্যতার উপর ভর করে চলার মতো বিকৃত মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করছে। হে আল্লাহ! আমরা যেন আত্মম্ভরিতায় মাথা উঁচু করতে প্ররোচিত না হই, তাওয়াজু ও বিনয়ে মাথা অবনত করে তোমার দাসত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে যেন উদ্বুদ্ধ হই।
ভিতর থেকে একটা কথা এল-শয়তানের সব প্রক্ষেপণ উপেক্ষা করে এ লেখাটির জন্য সংকল্পই করে নিলাম। কি জানি এই সংকল্পের পেছনেও শয়তানের দখল রয়েছে কি না। কারণ, এ লেখাটি শুরু করলে ৫ খণ্ডে সমাপ্ত করার পরিকল্পনায় যে ‘‘ইসলামী ইতিহাস’’ সংকলনের কাজে হাতে দিয়েছি, সেই সাথে শুরু করেছি ‘‘ইসলামী ভূগোল ও মানচিত্রাবলী’’-এর কাজ, এ লেখার পেছনে সময় ব্যয় করলে সেই গুরুত্বপূর্ণ রচনা ও সংকলনের কাজ দুটো পিছিয়ে যাবে না তো? তাহলে এখন কোনটাকে প্রাধান্য দিব? কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কোনটার ফায়দা বেশি, কোনটা আগে করা চাই, কোনটা পরে করা চাই? নাকি সবগুলিই একসাথে চালিয়ে যাওয়া চাই?
একসাথে অনেকগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন! সিদ্ধান্ত গ্রহণে দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা। সবটাই যখন ভালো মনে হচ্ছে তখন কোন্টাকে প্রাধান্য দিব? সবটাই যখন গুরুত্বপূর্ণ ও ফায়দাজনক মনে হচ্ছে তখন তুলনামূলক কোনটার গুরুত্ব বা ফায়দা বেশি তা নির্ণয় করা কি এত সহজ? এক এক প্রেক্ষিতে এক একটার গুরুত্ব ও ফায়দা কম বেশী বিবেচিত হয়ে থাকে। এই প্রেক্ষিতগুলির মধ্যকার তারতম্য নির্ণয় করা কি গজ ফিতা দিয়ে পরিমাপ করার মত সহজ? এমতাবস্থায় কোন্ সিদ্ধান্তে উপনীত হব? মনে হল আমি এখন দিশেহারা পরিস্থিতির শিকার। সত্যিই নফস ও শয়তানের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক সময় এরকম দিশেহারা হয়ে যেতে হয়। অনেক সময় একারণেও দিশেহারা হয়ে যেতে হয় যে, কোনটা নফস ও শয়তানের কথা আর কোনটা বুদ্ধি-বিবেকের ফয়সালা তা পার্থক্য করা জটিল হয়ে পড়ে। বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, এরূপ মুহূর্তে সচেতন দ্বীনী মুরব্বী থেকে মশওয়ারা গ্রহণ পূর্বক আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে যে কোন একটি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হতে হয় কিংবা সবটা একসাথে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে সবটিই চালিয়ে যেতে হয়। সেমতে আমি তাওয়াক্কুলান আলাল্লাহ (আল্লাহর উপর ভরসা করে) উভয় কাজটিই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিশেষতঃ এ লেখাটি শুরু করার ব্যাপারে মুরব্বীর মশওয়ারা যেখানে রয়েছেই। বিগত (১৪৩০ হিজরী মোতাবেক ২০০৯ খৃষ্টাব্দ) হজ্বের সফরে মক্কার মসজিদে হারামের আন্ডারগ্রাউণ্ডে বসে হযরত মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবের সামনে এ লেখা সম্বন্ধে পরিকল্পনা পেশ করলে তিনি আশু এ লেখাটি শুরু করে দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে জোর মশওয়ারা দিয়েছিলেন। আমি তাঁকে দ্বীনী ও ইলমী বিষয়ে মুরব্বী পর্যায়েরই ব্যক্তিত্ব মনে করি। যাহোক, এসব কিছুর প্রেক্ষিতে আমি অন্যান্য লেখা ও রচনার সাথে সাথে এ লেখাটিও চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম।
ভিতর থেকে আরো একটা কথা এল-আপনি খুবই সতর্ক মানুষ। শয়তানের সব ধোকাই বুঝতে পারেন এবং যথাসময়ে সঠিক নিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সতর্কতা না থাকলে আপনি এত সূক্ষ্ম ওয়াছওয়াছা বুঝতে পারতেন না। ওয়াছওয়াছার শিকার হয়ে পড়তেন। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হতেন না। সতর্কতাই আপনাকেই রক্ষা করেছে।
বুঝলাম, এ-ও একটা শয়তানী কথা। সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে এবং শয়তানের প্রতারণার ব্যাপারে সদাসর্বদা সতর্ক থাকার হুকুমও রয়েছে। কিন্তু শুধু সতর্কতা দ্বারাই রক্ষা পাওয়া যায় না, যদি না আল্লাহ তাআলা তাঁর খাস রহমতে আমাদেরকে রক্ষা করেন। অতএব সতর্কতা দ্বারাই রক্ষা পেয়ে গেছি-একথাটি শয়তানী কথা। মনে পড়ে গেল এক বুযুর্গের একটা ঘটনা। একবার সে বুযুর্গের কাছে শয়তান আসল। বুযুর্গ দেখলেন উপরে শূন্যে বিরাট এক আসনে এক মহা বুযুর্গের আকৃতি নিয়ে একজন বসে আছেন। তিনি সে বুযুর্গকে সম্বোধন করে বলছেন, ‘‘আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছি। তোমার আর ইবাদত করার প্রয়োজন নেই।’’ এ ছিল শয়তান। উক্ত বুযুর্গ সাথে সাথে পড়লেন, ‘‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’’ এবং বললেন, দুনিয়ার চোখে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। কাজেই তুমি শয়তান। তখন শয়তান বলল, তোমার ইলম তোমাকে রক্ষা করেছে। বুযুর্গ বললেন, এটাও শয়তানী কথা। ইলম রক্ষা করতে পারে না, রক্ষা করেন আল্লাহ তাআলা।
কোন সাধারণ মানুষ হলে মনে করত স্বয়ং আল্লাহ তাআলা উপস্থিত হয়ে এ রকম বলছেন, আমি তো কামেল হয়ে গেছি। এভাবে সে ধোকা খেত। কিন্তু উক্ত বুযুর্গ বুঝলেন এটা শয়তান। তাই তিনি ‘‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’’ পড়ে শয়তানকে তাড়িয়ে দিলেন।
আমারও মনে হল এখন ‘‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’’ বা শয়তানকে তাড়াবার প্রসিদ্ধ বাক্য-‘‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’’ পড়ে নেই। তদুপরি লেখালেখির এ প্রসঙ্গটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ নফস ও শয়তানের সাথে বাহাছ চলছে। আর কতক্ষণ নফস ও শয়তানের সাথে বাহাছ করে কালক্ষেপণ করব। নফস ও শয়তান এভাবে কথা এবং চিন্তার আবর্তে ফেলেও কালক্ষেপণ করিয়ে নেক কাজ শুরু করাতে বিলম্ব ঘটিয়ে থাকে। কেউ যখন সব রকম ওয়াছওয়াছা ঝেড়ে ফেলে কোন নেক কাজ শুরু করবে বলেই স্থির করে নেয়, তখন সেটা শুরু করাতে বিলম্ব ঘটাতে পারলেও শয়তান কিছুটা সান্ত্বনা বোধ করে এই ভেবে যে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো তাকে কাজটা থেকে বিরত রাখতে পারলাম। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে না তো? অতএব এই বাহাছের আবর্তে পড়ে আর কালক্ষেপণ নয়। আমাকে এই কালক্ষেপণের চক্কর থেকে উঠে এসে কাজ শুরু করতে হলে এখনই শয়তানকে তাড়িয়ে দিয়ে কাজ আরম্ভ করে দিতে হবে। প্রয়োগ করলাম শয়তানকে তাড়াবার সেই প্রসিদ্ধ অস্ত্র। যে অস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে
وما ينزغنك من الشيطان نزغ فاستعذ بالله
অর্থাৎ যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোন উস্কানী তোমাকে পেয়ে বসে, তাহলে আল্লাহর কাছে (শয়তান থেকে) পানাহ চাও। (যেমন পাঠ কর ‘‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’’। তাহলে শয়তান ভেগে যাবে।)-সূরা হা-মীম-আসসাজদাহ : ৩৬
পাঠ করলাম, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম। শয়তান ভেগে গেল। সহযোগীর আকস্মিক অন্তর্ধানে নফসও আপাততঃ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থেমে গেল।
শয়তান কিভাবে ভেগে গেল, তা মনের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। নির্ভরযোগ্য হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী বিভিন্ন অবস্থায় শয়তান ভেগে থাকে। ‘‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’’ পড়লে ভেগে যায়, আযান হলে ভেগে যায়, ইকামত হলে ভেগে যায়, আল্লাহর যিকর করলে ভেগে যায়। কিন্তু কিভাবে ভেগে যায় তার একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীসে। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন নামাযের আযান দেওয়া হয় তখন শয়তান পায়ু পথে বায়ু নির্গমন করতে করতে (পাদতে পাদতে) পেছনে সরে যায়।’ (বোখারী ও মুসলিম)
এখানে ‘পাদতে পাদতে পেছনে সরে যায়’ কথাটির ব্যাখ্যায় কোন কোন মুহাদ্দিস রূপক অর্থ গ্রহণ করে বলেছেন, এর অর্থ হল আযানের শব্দ শোনা থেকে মনোযোগ হটিয়ে নেয়। যেমন বায়ু নির্গমনের শব্দ হলে অন্য শব্দ শোনা যায় না, অন্য শব্দ শোনা থেকে মনোযোগ হটে যায় তদ্রূপ। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হল আযানের শব্দের প্রতি সে অবহেলা প্রদশন করে। কিন্তু ‘পাদ’ কথাটিকে এখানে প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করাতে কোন বাধা নেই। কেননা, শয়তান পানাহার করে থাকে তা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অতএব শয়তানের পানাহার যখন প্রমাণিত তখন তার পাদ থাকাটাও স্বাভাবিক। আর কোন শব্দের প্রকৃত অর্থ যদি স্বাভাবিক হয়-অসম্ভব বা পরিত্যক্ত না হয় কিংবা প্রকৃত অর্থ গ্রহণ না করে রূপক অর্থ গ্রহণ করতে হবে-এমন কোনো লক্ষণ (করীনা)ও না থাকে, তাহলে প্রকৃত অর্থ গ্রহণ করাই রীতিসিদ্ধ। তদুপরি মুসলিম শরীফের এক রেওয়ায়েতে ‘হুসাস’ শব্দ বর্ণিত হয়েছে। এ শব্দের অর্থগুলির মধ্যে ‘দ্রুত ভেগে যাওয়া’ অর্থও রয়েছে। যা ‘পাদতে পাদতে পেছনে সরে যাওয়া’ কথাটার প্রকৃত অর্থ গ্রহণের পক্ষে বিশেষ লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এজন্যেই মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম এখানে প্রকৃত অর্থই গ্রহণ করেছেন। সেমতে মনের চোখে যেন দেখলাম শয়তান প্রকৃতই পাদতে পাদতে ভেগে যাচ্ছে। মনে হল, একসময়কার সদরঘাট থেকে পোস্তগোলা ও নারায়ণগঞ্জগামী কিংবা রামপুরা থেকে সদরঘাটগামী লক্কড়ঝক্কড় সেই পুরনো স্টাইলের মুড়ির টিন (বাস)-এর মতো, যা স্টার্ট দিলে পেছন থেকে কাল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এবং ধাওয়া খাওয়া বুড়ো মানুষের মতো কোঁকাতে কোঁকাতে দৌড় দিত। ছাত্রজীবনে মালিবাগ জামিয়ায় পড়াকালীন সময়ে বায়তুল মুকাররম বা গুলিস্তান যেতে রামপুরা থেকে ছেড়ে আসা সদরঘাটগামী সেই ঐতিহাসিক বাসে বহুবার চড়ার সৌভাগ্য(!) হয়েছিল। ফলে উপমার জন্য সহজেই এটি স্মরণে এল।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)