রমযান ১৪২৯   ||   সেপ্টেম্বর ২০০৮

স ং স্কৃ তি : এ কোন স্বর্গের (?) হাতছানি

ওয়ারিস রব্বানী

গত এক যুগের ঘটনা। এ দেশের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা স্টাইলে নতুন নানা দূষণের জন্ম হচ্ছে। ভালোবাসা দিবসের  মতো নষ্ট বিনোদন-প্রবণ বিচিত্র নতুন ও পশ্চিমানুকরণ ভিত্তিক সংস্কৃতির আমদানি এ দেশের শান্ত-শালীন জীবনাচারের শুভ্র চাদরটাকে কর্দমাক্ত করে চলেছে। সংস্কৃতির নামে বাজারে ছেড়ে দেওয়া এসব বিনোদনী নষ্টামির পেছনে একযুগে কাজ করছেন এদেশে সক্রিয় কোনো কোনো বহুজাতিক কোম্পানি আর মাথামোটা পুঁজির জোরে খুলে বসা কিছু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কর্ণধাররা। বুঝে, না বুঝে এবং অতি বুঝে এদেশের তরুণ-যুবক ও যুবতীদের শালীন জীবনের অঙ্গন থেকে টেনে নামানোর সব প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করা হয়েছে।

গত কয়েক বছর আগ থেকে শুরু হয়েছে ক্লোজ আপ-ওয়ান নামে সঙ্গীত তারকা খোঁজার প্রোগ্রাম। এর দুতিনটি পর্ব এ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আরো চলবে। এর সঙ্গে গাও বাংলাদেশ গাও, সেরা কণ্ঠ ইত্যাদি নামে গায়ক-গায়িকা তরুণ-তরুণী বাছাইয়ের দেশভিত্তিক আরো কিছু প্রোগ্রামও শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে দারুচিনি দ্বীপের নায়িকা খোঁজার নামেও এ ধরনের একটি প্রোগ্রাম দেশজুড়ে চালানো হয়েছে। এখন চলছে সুপার হিরো-হিরোইন প্রতিযোগিতা। দেশের প্রতিটি জেলা ও বিভাগ থেকে শত শত তরুণ-তরুণীর মধ্য থেকে বাছাই করে কজনকে ঢাকায় নিয়ে আসার কাজ চলছে। এখান থেকে নাকি ১০ জোড়া নায়ক-নায়িকা বেছে নেওয়া হবে। জেলাগুলো থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচিতদের সম্পর্কে বড় সাধ ও শখ করে বলা হচ্ছে এবং মিডিয়াগুলোতে প্রচারও করা হচ্ছে-টিকিট টু ঢালিউড পেলেন ... জন। বলা ও প্রচারের ভঙ্গিটি এমন, মনে হয় যেন কজন তরুণ-তরুণী হঠাৎ কোনো স্বর্গেরই বরাদ্দ পেয়ে গেলেন!

সংস্কৃতি, মিডিয়া ও বাণিজ্যের এই যুথবদ্ধ খেলায় গত কবছর ধরে এ দেশের তরুণ-তরুণীদের এ কোন খেলায় টেনে নামানো হচ্ছে- এ প্রশ্নটিকে এখন ছোট করে দেখা উচিত হবে না। রাজধানীর সীমিত পরিসর কিংবা অতি আধুনিক গোষ্ঠীবদ্ধ একটি চক্রের নিজস্ব বৃত্তের ভেতরে নয়, গোটা দেশ চষে ভালো কণ্ঠের, ভালো চেহারার, উজ্জ্বল, সম্ভাবনাময় এবং সৃজনশীলতার চেতনায় সমৃদ্ধ হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিনোদনের রঙিন হাতছানি দিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন জাগিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে! সুযোগ পাওয়া দু-দশজনের সঙ্গে দেশজুড়ে সৃষ্টি হবে অশালীন বিনোদনভিত্তিক ক্যারিয়ার তৈরির লাখো অদম্য প্রয়াসের ঘটনা। এতে ধর্মভিত্তিক জীবনাচারই কেবল ধ্বসে পড়বে না, ভেঙ্গে পড়বে পারিবারিক, সামাজিক ঐতিহ্যপূর্ণ শালীনতার সৌধটিও। সুখ ও প্রশান্তির পরিবর্তে অস্থির ও রিপুতাড়িত একটি নষ্ট সংস্কৃতির চক্রে পাঁক খেয়ে তলিয়ে যেতে থাকবে এদেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী। চিন্তাশীল অভিভাবক ও দেশের নীতি নির্ধারকদের তাই এদিকে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

আবহমান কাল থেকে এ দেশে এমন কিছু কিছু সংস্কৃতির চল পাওয়া যায় যার সঙ্গে ইসলামের অনুশাসনের তেমন কোনো মিল নেই। কোনো কোনোটির সঙ্গে রুসুম ও ধর্মীয় অবৈধতার সম্পর্কও বিদ্যমান। কোনো কোনো সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের

অস্তিত্বও পাওয়া যায়। সেগুলো নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে এ দেশটির সব পর্যায়ের তরুণ-তরুণীকে উদ্দাম ও বিনোদনমুখি ক্যারিয়ার গড়ার দিকে টেনে নেয়ার কোনো ঝুঁকিপূর্ণ আয়োজন থাকত না। যারা তা করত তারাই করত। কেউ কেউ দেখত দূর থেকে অথবা দূরেই থাকত। কিন্তু আধুনিক সংস্কৃতির  এই মরণখেলাটি যেন কোনো প্রাচীরই রাখতে চাচ্ছে না। খেলোয়াড় তো খেলোয়াড়ই, দর্শককেও খেলোয়াড় বানিয়ে ছাড়া হচ্ছে এতে। ধর্মপ্রাণ, মধ্যবিত্ত, শালীন, লাজুক, মফস্বলী, গ্রামীণ যে কোনো তরুণ-তরুণীকে ক্যারিয়ারের মাদকতাপূর্ণ এক মায়াবী টানে নামিয়ে আনা হচ্ছে ফ্লাশের সামনে, মঞ্চে, স্ক্রীনে। গ্লামার ও অর্থের জাদুতে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সব সংযমের দীক্ষা। এর ফল তো ভালো হতে পারে না।

এ দেশটাকে নিয়ে যারা ভাবেন, ভাবেন ভবিষ্যতপ্রজন্ম নিয়ে এবং কিছু করারও ক্ষমতা রাখেন দয়া করে তারা কিছু করুন।

 

 

advertisement