তালেবানে ইলমে নবুওয়তের প্রতি কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশনা
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ১৪২৪ হিজরীতে একবার মারকাযুদ দাওয়াহ থেকে শিক্ষা সমাপনকারী সকল তালিবে ইলমকে মারকাযে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল,তাদের কর্মজীবনের ব্যস্ততা সম্পর্কে অবগতি লাভ করা এবং তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। এ সময় মারকাযের আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু প্রয়োজনীয় কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। বিষয়টি জানার পর কিছু বন্ধু আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় তা প্রকাশ করার অনুরোধ করেন যেন মাদরাসার নেসাববদ্ধ পড়াশোনা সমাপ্ত করে কর্মজীবনে পদার্পণকারী তালাবায়ে কেরামের সামনে কথাগুলো থাকে। এ পরামর্শ আমাদের কাছেও মুনাসিব বলে মনে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে, সকল তালিবে ইলমকে এই বিষয়গুলোর ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আমীনুত তা’লীম
মারাকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ছ-এলমের পরিপক্কতা ও ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’ অর্জন
ইলমের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হল ‘অল্পেতুষ্টি’ এবং ‘আছা’ ও ‘ছাওফা’ (পরে করব)-এর প্রবণতা। এর চেয়েও বড় প্রতিবন্ধক হল ইলমের স্বরূপ তথা এর বিস্তৃতি ও গভীরতা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ত্যাগ ও আত্মনিবেদনের মানসিকতা না থাকা।
আরেকটি বড় ব্যাধি হল, তাহকীক ও মুতালাআর জন্য প্রস্ত্তত না হওয়া। আবার শুধু প্রয়োজনের সময়ে প্রয়োজন পরিমাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা। এটি ইলমের দৃঢ়তা ও তাফাক্কুহ পয়দা হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।
এ ব্যাপারে কয়েকটি বিষয়ে যত্নবান হওয়া অতি জরুরি :
১. শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. এর ‘ছাফাহাতুম মিন ছাবরিল উলামা’, ‘কিমাতুয যামান ইনদাল উলামা’, মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শিরওয়ানী রাহ.এর ‘না-বীনা উলামা’ ইত্যাদি রচনায় উল্লেখিত ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নিয়ে ইলমের অনুরাগ ও ইলমের জন্য জ্বালা পয়দা করা উচিত। এসব কিতাব থেকে সময়ের মূল্যায়নের শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়ের শিক্ষাও গ্রহণ করা উচিত। এতে উল্লেখিত কিছু ঘটনা মানসপটে খোদাই করে নেওয়া উচিত। তাহলে যেমন সময় নষ্ট করার দুঃসাহস হবে না তদ্রূপ (যদি আল্লাহ তাআলা আকলে সালীম ও লজ্জাবোধ দান করে থাকেন) উপকরণের অপ্রতুলতা এবং বিভিন্ন অসুবিধা ও পেরেশানি ইলমের পথে বড় বাধা মনে হবে না।
২. ‘মুতালাআ’ শুধু দরস ও প্রয়োজনের মুহূর্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মুতালাআর সকল প্রকারের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। যথা- ক) দরসের জন্য মুতালাআ খ) সাময়িক প্রয়োজনের জন্য মুতালাআ গ) মওসুমী মুতালাআ ঘ) নিয়মিত মুতালাআ। এই মুতালাআর উদ্দেশ্য হবে ইলম তাজা রাখা ও তাফাক্কুহ ফিদ্দীন অর্জন করা এবং রূহের খোরাক যোগানো। (কুরআন, হাদীস, অতপর নির্বাচিত রচনাবলী, রাসাইল, মালফুযাত ও মাকতুবাতে আকাবির থেকে এ মুতালাআ অব্যহত থাকবে)। ঙ) প্রচলিত বা সম্ভাব্য ফিতনাসমূহ মুকাবিলার জন্য মুতালাআ, নিজের ও সাধারণ মুসলমানের ইমান-আক্বীদা সংরক্ষণের জন্য অন্যভাষায় :
ينفون عنه تحريف الغالين وتأويل الجاهلين وانتحال المبطلين.
এর দায়িত্ব পালনের জন্য। চ) বিষয়ভিত্তিক মুতালাআ (অজানা বিষয়াবলি বা একজন আলেমের জন্য যে সব বিষয় জানা অপরিহার্য তার তালিকা প্রস্ত্তত করে।)
এ সবের মধ্যে আসল প্রকার হল,‘নিয়মিত মুতালাআ’ ও ‘ফিতনাসমূহের মুকাবিলার জন্য মুতালাআ।’ এর জন্য যতটুকু সময় হোক না কেন নির্ধারণ করতে হবে। এরপর অবস্থা ও ব্যস্ততার ভিত্তিতে যে দিন যে পরিমাণ সময় যোগ করা যায় আলহামদুলিল্লাহ।
মুতালাআর সর্বশেষ প্রকার অর্থাৎ অজানা ও অপরিহার্য বিষয়াদির তালিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী মুতালাআ আরম্ভ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। চিন্তা করলে দেখা যাবে অনেক প্রয়োজনীয় ইলম ও ফনের ব্যাপারে (যার কিছু বিষয়ের অল্প কিছু কিতাব আমরা দরসে নেযামীর নির্ধারিত নেসাবে চেখেও দেখেছি) বর্ণমালা পর্যায়ের প্রাথমিক জ্ঞানও আমাদের নেই। তদ্রূপ যেকোনো জরুরি ফনের অধ্যায় ও পরিচ্ছেদসমূহ এবং অন্যান্য বিষয়ের হিসাব করা হলে দেখা যাবে আমাদের অর্জিত জ্ঞানের পরিমাণ প্রায় শূণ্যের কোঠায়।
অজানা বিষয়াদির এক বিশাল অংশ বর্তমান যুগের প্রয়োজনীয় মাসাইল ও বিষয়াদির সাথে সম্পৃক্ত যা থেকে অজ্ঞ থাকা সমাজে অবস্থানকারী একজন আলেমের জন্যও কখনই শোভনীয় নয়। কেননা-
من لم يعرف أهل زمانه فهو جاهل
এসব বিষয়ের সংক্ষিপ্ত তালিকা এখানে উল্লেখ করার পরিবর্তে এ বিষয়টি আপনাদের দায়িত্বে সোপর্দ করছি। একজন আলেমের জন্য অপরিহার্য বিষয়াদির একটি তালিকা এবং সেসব বিষয়ে জ্ঞানলাভের প্রয়োজনীয় উৎস সম্বলিত একটি প্রবন্ধ প্রস্ত্তত করে পাঠাবেন। এরপর প্রয়োজন হলে তালিকাটি পূর্ণ করে অধ্যয়নের ক্রম ও ধারাবাহিকতা আপনাদের উস্তাদগণ নির্ণয় করে দেবেন ইনশাআল্লাহ। গত কয়েক বছর যাবত ‘আল-মাওয়াদ্দুল ইযাফিয়া’ শিরোনামে এ জাতীয় একটি তালিকা শিক্ষার্থীদেরকে প্রদান করা হয়। এ থেকেও কিছুটা সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
ইমাম শাবীর কথা স্মরণ করুন :
العلم ثلاثة أشبار، فمن لم نال منه شبرا شمخ أنفه وظن أنه ناله، ومن نال الشبر الثاني صغرت إليه نفسه وعلم أنه لم ينله، وأما الشبر الثالث فهيهات، لا يناله أحد أبدًا. (أدب الدنيا والدين صـ 81)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আববাস রা. এর বাণী এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যার মর্ম হল, ইলম যত বাড়বে বিনয় ততই বৃদ্ধি পাবে। আর জাহালত যত বেশি হবে অহঙ্কারও তত বাড়বে। তাঁর এ বাণী থেকেও আমরা আমাদের ভয়ঙ্কর পর্যায়ের জ্ঞানহীনতা সম্পর্কে অনুমান করতে পারি।
৩. সাধ্যমত তাসনীফ, দরসে হাদীস, দরসে তাফসীর, সাপ্তাহিক দরস ও মাসিক মুহাজারার ব্যবস্থা করা এবং এ ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। কেননা এতে বাধ্য হয়েই মুতালাআ ও তাহকীকের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৪. মারকাযের বা আপনার নিকটবর্তী কোনো মুহাক্কিক আলেমের সাথে পরামর্শ করে তাহকীকযোগ্য বিষয়াদির একটি তালিকা তৈরি করে বিশেষত সমসাময়িক বিষয়াদির একটি তালিকা প্রস্ত্তত করে গুরুত্ব অনুপাতে ক্রমিক নম্বর দিয়ে এর উপর তথ্য সংগ্রহ ও সংগ্রহিত তথ্যের আলোকে তাহকীক ও তানকীহের কাজ আরম্ভ করা উচিত। কেননা এতে অপরিহার্যভাবে অধ্যয়নের প্রয়োজন দেখা দেবে।
৫. দরসী কিতাবসমূহের কঠিন স্থানগুলো যা প্রতি বছর অস্পষ্ট রেখেই সামনে অগ্রসর হতে আমরা অভ্যস্ত, এক এক করে সেসব স্থান হল করার মানসিকতা তৈরি করা উচিত। এভাবেও বাধ্য হয়েই মুতালাআর ব্যাপারে যত্নবান হওয়া যাবে।
৬. মুতালাআ, তাহকীক, তাসনীফ ও তালীফের ব্যাপারে কিতাবের অপর্যাপ্ততা বা কিতাব না থাকার অভিযোগ কাজে প্রতিবন্ধক না হওয়া উচিত।
প্রথমত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীলগণকে আদবের সাথে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে আস্তে আস্তে কিতাব সংগ্রহ করতে থাকা উচিত। দ্বিতীয়ত প্রত্যেক আলেমেরই একটি ছোটখাটো কুতুবখানা থাকা উচিত। এ উদ্দেশ্যে দু’টি একটি করে কিতাব খরিদ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত আশপাশের লোকদের নিকটে বিদ্যমান বিক্ষিপ্ত কিতাবসমূহ থেকে উপকৃত হওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থত উপরোক্ত কোনোটাই সম্ভব না হলে যে দু’একটি কিতাব আছে তা সম্বল করেই কাজ আরম্ভ করতে হবে। এটা শুধু সম্ভব তাই নয়; বরং অতি সহজ কাজ। শুধু আকলে সালীম ও চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন।
হযরত হাকীমুল উম্মত-এর শত শত রচনা রয়েছে অথচ তাঁর কুতুবখানায় বিদ্যমান কিতাবের সংখ্যা হয় তো তাঁর রচনাবলির চেয়েও কম হবে।
জ-তায়াক্কুয ও যুগসচেতনতা
সাধারণভাবে সজাগ ও সচেতন হওয়া যদিও একটি স্বভাবগত গুণ, কিন্তু তাতেও কাসব বা অর্জনের প্রভাব রয়েছে। সজাগ ও সচেতন ব্যক্তিবর্গের সোহবত অবলম্বন করা ও তাঁদের সাথে সম্পর্ক কায়েম করা এ বিষয়ে ফলদায়ক হয়ে থাকে। সালাফের মধ্যে যারা এ সব গুণের অধিকারী ছিলেন তাঁদের জীবন-চরিত, মালফুযাত ও মাকতুবাত মুতালাআ করা উচিত এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে বিনয় ও নম্রতার সাথে দুআ করা উচিত।
যুগকে জানার দু’টি ভাগ রয়েছে। প্রথমত সাধারণ দ্বীনী প্রশ্ন ও সমস্যার জওয়াব দানের জন্য যে সব বিষয়ের জ্ঞান লাভ করা অত্যাবশ্যকীয় বা সাধারণ মানুষের প্রশ্নাবলীর জওয়াব প্রদান করা যে সব বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এসব বিষয়ের জ্ঞান লাভ করা ফরয। এর একটি অংশ ইফতা বিভাগের নেসাবের অন্তর্ভুক্ত। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় এবং এর অপর বিশাল অংশ এমন, যার উপর দাওয়াত ও ইরশাদ এবং যুগের চাহিদা অনুযায়ী কলমী জিহাদ নির্ভরশীল।
দ্বিতীয় ভাগ হল, যে সব বিষয়ে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞান না হলে সাধারণ শিক্ষিতদের মধ্যে অপরিচিত ও বোবা হয়ে বসে থাকতে হয় অথবা তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়। যথা- ভূগোল, ইসলামী ইতিহাস, সাধারণ ইতিহাস, সাধারণ বিজ্ঞান ও অন্যান্য কিছু সমসাময়িক শাস্ত্রের প্রাথমিক জ্ঞান।
এই দুই বিভাগই অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং দু’টোর ব্যাপারেই ফকীহগণ বলেছেন-
من لم يعرف أهل زمانه فهو جاهل
যদিও প্রথম বিভাগই তুলনামূলক অধিক গুরুত্বপূর্ণ। উপরোক্ত বাক্যটির মর্ম আলেমগণ এরূপ বলেছেন-
من لم يعرف مصطلحات أهل زمانه ومعاملاتهم وأعرافهم ومشكلاتهم وحلول تلك المشكلات فهو جاهل.
(চলবে ইনশাআল্লাহ)