তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার (যা বর্তমানে ভারতের একটি জিলা) জকিগঞ্জ থানাধীন বারঠাকুরী গ্রামে ৯ জিলকদ ১৩৪৬ হিজরী মোতাবেক ২ মে ১৯২৮ ঈসায়ী শুক্রবার কোনো এক শুভ মুহূর্তে হযরত থানবী রাহ.-এর খলীফা হযরত মাওলানা জহুরুল হক ওরফে উরফিজ আলীর ঔরসে জন্ম নিয়েছিল যে পুত্রসন্তান, কালের পরিক্রমায় তিনি আজ বাংলাদেশের মুসলিম জনতা বিশেষ করে আলেমসমাজের দরদী অভিভাবক পরিচয় নিয়ে এ দুনিয়া ছেড়ে মাওলার সান্নিধ্যে চলে গেছেন।
আশরাফুল উলূম বড় কাটরা মাদরাসা, শাহজাহানপুর ভারত, দারুল উলুম করাচী, মাদরাসা ই আলিয়া ঢাকা, মাদরাসা ই আলিয়া সিলেট, ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদরাসা, যমীরিয়া পটিয়া মাদরাসা, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামপুর ঢাকা, মাদরাসায়ে ফয়জুল উলূম আজিমপুর ঢাকা ও জামিয়া কাসিমুল উলূম দরগাহ মাদরাসা সিলেট এ ইলমে হাদীসের দরস দেওয়া ছাড়াও মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মাদরাসার মজলিসে শুরা ও আমেলার সদস্য হিসেবে তাঁর অবদান অপরিসীম। আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ, পাটুয়াটুলি মসজিদ ও তেজগাঁও মসজিদে একযুগের অধিক কাল তিনি পূর্ণ কুরআন মাজীদের তাফসীর পেশ করে গেছেন। জাতীয় মসজিদের খতীব নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে তিনি পাটুয়াটুলি মসজিদেরও খতীব ছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁর কর্মকান্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস রচিত হলে মাদরাসা, মসজিদ ও ইসলামী শিক্ষার উন্নয়নে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার বিশদ বিবরণ জাতি জানতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
তিনি যেহেতু আমার শ্রদ্ধেয় পিতা ছিলেন, তাই বাবা হিসেবে এবং পরিবারের একজন কর্ণধার হিসেবে তাঁকে আমি যেভাবে দেখেছি, যেভাবে পেয়েছি, তার কিঞ্চিত অবতারণাই আমার এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য। পাঠকও আমাদের কাছ থেকে এ জাতীয় লেখা আশা করে থাকবেন। উল্লেখ্য, এখানে আমি যেসব বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করব তা দু’ভাগে বিভক্ত : প্রথমত ঐসব বিষয় যা আমি পরিবারের মুরববী সদস্যদের থেকে জানতে পেরেছি। দ্বিতীয়ত ঐসব ঘটনা যা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। অন্যদের থেকে পাওয়া ঘটনাবলিতে ভুলত্রুটির সম্ভাবনা থাকতেই পারে। কেননা, আববাজান রাহ. আত্মপ্রচারবিমুখ চাপা স্বভাবের ছিলেন বলে তাঁর কাছ থেকে তাঁর নিজের ঘটনা খুব কমই জানতে বা সত্যায়ন করতে পেরেছি।
উপরের শিরোনামে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই আমি তাঁকে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। বাস্তবিকই তিনি আমাদের মতো রক্ত-মাংসের মানুষই ছিলেন। তিনি কোনো অতিমানব ছিলেন না। মানুষ হিসেবে ভুলত্রুটির উর্ধ্বেও ছিলেন না, রাগ-অনুরাগ, আবেগ-উচ্ছাস এবং কঠোরতা ও নমনীয়তা ইত্যাদি সকল উপাদানই তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন কিছু গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল, যা সাধারণের মধ্যে সচরাচর নজরে আসে না। এসকল গুণাবলির কারণেই মানবিক দুর্বলতা ও দোষত্রুটি ছাপিয়ে আমাদের অন্তরে তিনি শ্রদ্ধার স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছিলেন। পাঠক ধৈর্য্যচ্যুত হবেন না। আমি একটু পিছন থেকে আবার শুরু করছি।
ডানপিটে বালক :
মুরববীদের কাছে জেনেছি যে, তিনি ছোটবেলায় খুবই চঞ্চল, দুরন্ত ও ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। পড়ালেখা ছাড়া অন্য সব কাজেই ছিল তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কিতাব কারো কাছে গছিয়ে দিয়ে মাছ ধরতে চলে যাওয়া, গাছের মগডালে চড়ে বসা বা খেলার সাথীদের সাথে ম্যারাথন আড্ডায় মেতে উঠাই ছিল তার নিত্যকর্ম। সূফীসাধক দাদাজান রাহ. এতে বিচলিত হয়ে পড়েন। ঘোষণা করেন, মাদরাসা ফাঁকি দিয়ে যে মাছ সে শিকার করে আনবে, তা যেন আমার ঘরে না রাখা হয়। তাতে কি! তিনি মাছ ঘরের কাছে ফেলে রেখে চলে যেতেন। দাদীজান যখন দাদাজানকে বলতেন, মাছ তো নষ্ট হয়ে যাবে এখন কী করা? তখন দাদাজান বলতেন, কী আর করা! মূল্য দিয়ে তা কিনে নাও।
বাল্যবন্ধুদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের উদ্দেশ্যে দাদাজান তাঁকে নিয়ে কখনো মুন্সিবাজার, কখনোবা গোঙ্ঘাদি আবার কখনো হবিগঞ্জের পাইলে চলে যান। কিন্তু এত কসরতের পরও তাঁকে যথোচিত পড়ামুখী করতে পারেননি। দুআ করা ছাড়া আর কীইবা করার ছিল। ছোট চাচা হযরত মাওলানা আবদুল হক আমাদেরকে বলেন, ‘তোমাদের আববা ছোটবেলা খুবই চঞ্চল ছিলেন বিধায় তোমাদের দাদাজান তাঁর সুমতির জন্য সব সময় দুআ করতেন। তাঁর জন্য এতই দুআ করতেন যে, তিনি আজ আমাদের সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন।’
হাজার মাইল দূরে গিয়ে পড়বেন
সব রকম চেষ্টা তদবীরের পরও যখন পুরোপুরি সফল হতে পারলেন না, তখন দাদাজান রাহ. আববাজানের ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজনকে বললেন যে, তাকে জিজ্ঞেস কর তো সে কী চায়? সে করবেটা কী? তখন বালক উবায়দুল হক যাকে মুরববীরা স্নেহ করে ‘উবই’ বলে ডাকতেন, ঘোষণা দিলেন, ‘এদেশে আর নয়। আমাকে দারুল উলূম দেওবন্দে পাঠিয়ে দিন! সেখানে গিয়ে পড়ব।’ ঘটনাক্রমে অত্র এলাকার একছাত্র তখন দেওবন্দে ছিল। দাদাজান রাহ. তার সাথে চৌদ্দ বছরের বালক উবায়দুল হককে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় দুআ দিয়ে দেওবন্দ পাঠিয়ে দিলেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এ ইলমী সফরই ছিল তাঁর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের বাহ্যিক ওসিলা।
শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ
দারুল উলূম দেওবন্দে দীর্ঘ আট বছর অবস্থানকালে তিনি মেধা ও মনোযোগের মাধ্যমে উস্তাদদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। বিশেষ করে শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হোসাইন আহমাদ মাদানী রাহ., শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ মাওলানা এযায আলী রাহ. ও হাকীমুল ইসলাম মাওলানা কারী তাইয়্যিব রাহ.-এর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়।
হযরত মাদানী রাহ. এর খিদমতের উদ্দেশ্যে তাঁর সাথে তিনি অনেক দ্বীনী সফরে গিয়েছেন। তাঁরই স্বহস্তে লিখিত অনুমতি নিয়ে তিনি মাদরাসা ই আলিয়া ঢাকার সিনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হযরত মাদানীর প্রতি তাঁর যে ভালবাসা দেখতে পাই, তা এ যুগে সত্যিই বিরল। তার একটি মাত্র দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। আমি যতটুকু আঁচ করতাম তিনি প্রায় প্রতি বছর শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হযরত মাদানী রাহ. এর পক্ষ থেকে কুরবানী দিতেন। ইন্তিকালের পর তাঁর ডায়েরী পাঠে জানতে পারি শুধু হযরত মাদানী রাহ. ই নন, হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ. স্বীয় পিতা-মাতা ও আরো অনেক আকাবিরের পক্ষ থেকে তিনি কুরবানী করতেন।
আল্লামা এযায আলী রাহ. তাঁকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন তার প্রমাণ পাই এভাবে যে, তিনি খতীব রাহ. কে প্রথমে আশরাফুল উলূম বড়কাটরায় শিক্ষক নিয়োগ করে পাঠান। গ্রামের জনৈক হজ্জযাত্রী হজ্জের সফরে হযরত খতীব রাহ.-এর সঙ্গ কামনা করেন। তখন মুম্বাই থেকে হাজীদের জাহাজে উঠতে হত। যেহেতু রাস্তাঘাট তাঁর পরিচিত ছিল, তাই তাঁকে নিয়ে ঐ ব্যক্তি মুম্বাই যাত্রা করেন। সেখানে পৌছার পর সেই ব্যক্তি একটি স্বার্থপর আচরণ মাওলানা উবায়দুল হকের জীবনে খ্যাতি ও উন্নতির সোপান রচনা করে। সে তাঁকে না নিয়ে জাহাজে রওয়ানা হয়ে যায়। এতে তিনি মনক্ষুণ্ণ হয়ে দেশে না ফিরে প্রিয় উস্তাদ আল্লামা এযায আলী রাহ. এর খিদমতে দেওবন্দ চলে যান। হযরত তাঁকে কিছু দিনের জন্য শাহজাহানপুর মাদরাসায় শিক্ষকতার জন্য প্রেরণ করেন। পরে সেখান থেকে ডেকে পাঠান এবং মুফতীয়ে আযম পাকিস্তান, হযরত মুফতী মুহাম্মদ শফী রাহ. এর নব প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম করাচীতে হাদীসের খেদমতে প্রেরণ করেন।
হাকীমুল ইসলাম আল্লামা ক্বারী তাইয়্যেব রাহ.-এর সাথে তাঁর ঘনিষ্টতা এতই নিবিড় ছিল যে, হযরতের বাংলাদেশ সফরে তিনিই তাঁর প্রতিনিধি ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ ঈসায়ী সনে দেওবন্দের শতবর্ষ দস্তারবন্দী উপলক্ষে বাংলাদেশী ফুযালাদের মাঝে সমন্বয় সাধনের জন্য রাবেতা কমিটির সেক্রেটারী হযরত খতীব রাহ. কেই নিয়োগ করা হয়। উক্ত জলসায় বাংলাদেশের উলামায়ে কিরামদের পক্ষ থেকে হযরত মাওলানা উবায়দুল হককে বিশ্বের লাখো আলিমের সমাবেশে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এসবই ছিল দারুল উলূম দেওবন্দের যোগ্য ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাঁর অনন্য-সাধারণ অবদানের স্বীকৃতি।
পরিবারের ঐক্যের প্রতীক
হযরত খতীব র. সম্পর্কে দেশের আলিম সমাজ ও প্রচারমাধ্যম একবাক্যে বলেছিল যে, তিনি ছিলেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। এটা যেমন এক বাস্তব সত্য, তেমনি একথাও প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি ছিলেন আমাদের বাপ-চাচাদের পরিবারের ঐক্যের প্রতীক। তাঁর কয়েকটি নমুনা পেশ করছি।
আববাজান রাহ. এর ইন্তেকালের পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ আয়োজিত বায়তুল মুকাররম মসজিদ চত্বরের আলোচনা সভায় আমাদের ছোট চাচা হযরত মাওলানা আবদুল হক স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন যে, আমার ও আমার বড় ভাইয়ের মধ্যে কোনো কারণে মনোমালিন্য হয়ে যায়, তাঁর বিরুদ্ধে আমি মেঝভাই খতীব রাহ. এর কাছে অভিযোগ করি। তিনি আমাকে বলেন, বড় ভাই হলেন আমাদের মাথা। মাথায় ব্যথা হলে তা কেটে ফেলা যায় না; বরং তার চিকিৎসা করাতে হয়। আমি জিজ্ঞেস করি, চিকিৎসা কীভাবে করব? তিনি বলেন, তুমি তাঁকে হাদিয়া পাঠাও। এটাই এ মুহূর্তের চিকিৎসা। ছোট চাচা বলেন, আমি খতীব সাহেবের এ ব্যবস্থাপত্রের উপর আমল করে আজীবন তার ফায়দা পেয়েছি।
পারিবারিক মতানৈক্যে হযরত খতীব রাহ. অনেক সময় বড় ভাইয়ের পক্ষাবলম্বন করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনও হয়েছেন। তাঁর জমির বৃক্ষ নিধনও করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর অবস্থানে ছিলেন দৃঢ় ও অবিচল। এ বিপদে ধৈর্য্যধারণের পুরস্কার হিসেবে তিনি আম্মাজানকে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে দোতলার অসম্পূর্ণ কাজ করে দেন। ভাইদের মধ্যে সৌহার্দ্য রক্ষার্থে শহরের মূল্যবান জমির তাঁর হিসসা থেকে কিছু অংশ তাদেরকে নিঃসংকোচে দিয়ে দেন। এ জাতীয় অনেক ঘটনা আছে যা এ মুহূর্তে উল্লেখ করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না।
কথায় নয় কাজে
তিনি শুধু কথা দিয়ে নয়, কাজের মাধ্যমে আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেছেন। আমরা তাঁর সাথে একত্রে বসে খেতাম। তিনি আমাদের বেশি বেশি করে দিয়ে নিজে কম নিতেন। কখনো জগ তাঁর পাশে থাকত। আমাদেরকে পানি ঢালার জন্য কসরত করতে দেখে নিজেই জগ থেকে পানি ঢেলে দিতেন। এই তো গত রমযানে আমাদের সাথে জীবনের শেষ সেহরীতে আমার মেয়ে আতিয়্যাহ গোশতসহ হা্ড্ডি দস্তরখানে ফেলে দেয়। তিনি মুখে কিছু না বলে নিজে হাড্ডি উঠিয়ে দাঁত দিয়ে টেনে টেনে গোশত খেয়ে হাড্ডি পরিষ্কার করে আতিয়্যাহকে দেখিয়ে দেন যে, এভাবে হাড্ডি পরিষ্কার করে ফেলতে হয়। ছোটবেলা তিনি আমাদেরকে নিয়ে মিরপুর চিড়িয়াখানায় সারা দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। মাঠে বসে বাদাম ছিলে খাইয়েছেন। তাঁকে কখনো খাওয়ার কোনো কিছু এনে দিলে খুবই ক্বদর করে খেতেন, তারিফ করতেন। তাঁর প্রতিটি আচরণে শোকর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেত। এভাবে তিনি আমাদেরকে কতকিছুই না শিক্ষা দিয়েছেন।
কারো বিপদের সুযোগ গ্রহণ না করা
বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে সকলের বিপদে সাহায্য করা তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপদে পড়ে ঢাকার অনেক নাগরিক যখন নিজের মালপত্র-অলঙ্কারাদি বিক্রি করে ঢাকা ত্যাগে বাধ্য হচ্ছিল, তখন তিনি এসব সামগ্রী বিক্রি করতে তাদের সহযোগিতা করেন। তখন নামমাত্র মূল্যে এসব অলঙ্কার বিক্রি হচ্ছিল। আমাদের ঘরের কেউ কেউ তা ক্রয়ের আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের জন্য কম মূল্যে এসব অলঙ্কার কিনতে সম্মত হননি। তাঁর বক্তব্য ছিল এরূপ যে, অন্যের বিপদের সুযোগ গ্রহণ করতে নেই। জনৈক অবাঙ্গালী শিল্পপতিকে তিনি ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌছে দেন। শিল্পপতি নিজের গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট যান। বিদায় বেলা আববাকে তার গাড়ি দান করে দিতে চাইলে তিনি তা গ্রহণ করেননি। উল্টো প্রস্তাব করেন যে, গাড়িটি আপনার শুভাকাঙ্খী ড্রাইভারকে দিয়ে দিন।
তাঁর চাকরি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে গত আওয়ামী শাসনামলে জনৈক ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে অবদান রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনিই সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গিয়ে একবার সমস্যায় পড়েন এবং আববাজানের সাহায্য কামনা করেন। আববাজান নির্দ্বিধায় বিভিন্ন কাগজপত্র দিয়ে তাকে সহযোগিতা করেন।
বে মৌসুমী ফল
হযরত খতীব রাহ. বড় আলিম এবং গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন কিন্তু সুবক্তা ও আকর্ষণীয় ওয়াযেয ছিলেন না। এটা তিনি স্বীকারও করতেন। তাঁকে কেউ ওয়াযের দাওয়াত দিলে তিনি বলতেন, আমি হলাম বে-মৌসুমী ফল, যার দাম বেশি, কিন্তু স্বাদ কম। আমাকে ঢাকা থেকে সিলেট আনতে হলে আপনাদের অনেক খরচ হবে। অথচ আমি এমন সুবক্তা নই যে, কেউ আমার বক্তৃতা শুনে তৃপ্তি পাবে বা আপনার প্রতিষ্ঠানে দু’পয়সা চাঁদা দিবে। তাই আকর্ষণীয় কোনো বক্তাকে দাওয়াত করুন।
একবার আমার উপস্থিতিতে বিশ্বনাথ থেকে একদল লোক তাঁকে দাওয়াত দিতে এলেন। তিনি শারীরিক দুর্বলতার ওযর পেশ করলেন। তাদের সাথে আসা জনৈক ব্যবসায়ী হেলিকপ্টারে করে তাঁকে নেয়ার প্রস্তাব করলেন। তিনি এটাকে অপচয় মনে করে সবিনয়ে তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
আমার এক আত্মীয় তার নবপ্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় বার্ষিক ওয়াযে দাওয়াত দিয়ে বললেন, ঢাকা-সিলেট বিমানের টিকেটের ব্যবস্থা তিনি করবেন। আববাজান বললেন, আপনার ছোট মাদরাসার পক্ষে এত পয়সা খরচ করা সমীচীন নয়। আমি দরগাহ মাদরাসায় পড়ানোর র্ফঁাকে কোনো একসময় আপনার মাদরাসায় আসব। তিনি এ ওয়াদা রক্ষাও করেছিলেন। এই একই মাদরাসার আরেক বার্ষিক মাহফিলে তাঁর দৃষ্টিতে আপত্তিজনক বক্তার নাম শুনে তিনি মাহফিলে হাযির হতে অস্বীকার করেন।
একদিকে তিনি যেমন নিজেকে বড় বক্তা বা আকর্ষণীয় ওয়ায়েয ভাবতেন না, তেমনি আত্মসম্মানের প্রতি তিনি ছিলেন প্রবল সচেতন। কোনো হাদিয়া গ্রহণ না করে ওয়ায করতে তিনি আনন্দ পেতেন। কিন্তু অবহেলা ও অনিয়ম কখনো সহ্য করতেন না। অনেক ক্ষেত্রে মাহফিলের ব্যবস্থাপনার সাথে অমত পোষণ করে তাতে অংশগ্রহণ না করেই নিজ খরচে ফিরে এসেছেন। এমন অনেক নযীর রয়েছে।
মুরববীদের প্রতি সম্মান
মুরববীদের সম্মান প্রদানের প্রতি তিনি খুবই গুরুত্বারোপ করতেন। আমরা দেখেছি কোনো কারণে দাদীজান তাঁকে বকা দিলে তিনি নীরবে মাথা নিচু করে তা মেনে নিতেন। চাচা ও আম্মার সম্মানের প্রতি মৌখিক ও বিভিন্ন পত্রে তিনি আমাদেরকে তাগিদ দিয়ে যেতেন। বেয়াদবীর পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতেন। তিনি বলতেন, বেতনের টাকা এনে মায়ের হাতে তুলে দিবে। এ থেকে তিনি যা দেবেন তা খরচ করবে। বাজার থেকে এসে বউ-বাচ্চাদের হাতে কোনো কিছু না দিয়ে মায়ের হাতে দিবে। তিনি তাদেরকে দিবেন। স্বয়ং আববাজান যা কিছু আনতেন, তা দাদীজীর হাতে তুলে দিতেন। এভাবে তিনি আদব-কায়দার অনেক পাঠ আমদের শিখিয়ে গেছেন।
জীবনসঙ্গিনীর সাথে আচরণ
আম্মাজানকে আমরা কীভাবে শ্রদ্ধা করব তা তিনি প্রায় চিঠিতে এবং কথার ফাঁকে ফাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। আম্মার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও স্নেহ ছিল অভাবনীয়। আম্মাকে চিঠিতে লেখতেন যে, আমার মায়ের ইন্তেকালের পর তুমিই আমার দুআ চাওয়ার স্থান। বিপদে-আপদে তাঁকে ফোনে এবং পত্রের মাধ্যমে দুআর জন্য বারবার বলতেন। মৃত্যুর মাত্র ১২ ঘন্টা পূর্বেও আমাকে ফোনে বলেছেন, তোমার আম্মা মনে হয় এবার আমার জন্য জোরদার দুআ করছেন না, তাই অসুস্থতা ও দুর্বলতা বেড়ে গেছে। তাঁকে জোরদার দুআ করতে বলবে। এটিই ছিল এ জীবনে আমার সাথে তাঁর শেষ কথা।
পুত্রবধুদের স্নেহ করা
আমাদের চার ভাইয়ের স্ত্রীদের তিনি খুবই স্নেহ করতেন। প্রত্যেকের দাবি ছিল, তিনি তাকেই বেশি স্নেহ করেন। একবার জানতে পারলেন, টাকার অভাবে আমার স্ত্রীর পক্ষ থেকে কুরবানী দিচ্ছি না। শুনে তিনি খুবই ব্যথিত হন এবং বলেন, এখন হতে আমার খরচে আফিয়ার পক্ষ থেকে কুরবানী দেবে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি বছর তিনি তা-ই করে গেছেন। ছোট ভাই হাফেয মাওলানা একরামুল হকের বিয়েতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় যাই। গাড়ি পৌঁছার ঘন্টাখানেক আগ থেকেই তিনি প্রাইভেটকার নিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন।
আমার প্রতি তাঁর ব্যবহার, আচরণ ও অবদান কী ছিল তার বর্ণনা শুরু করলে এ প্রবন্ধের কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই আগামী কোনো সুযোগে বিস্তারিত আলোচনার আকাঙ্খা পোষণ করে আজকের মতো এখানেই ইতি টানছি। পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আরয, আপনারা আমার মরহুম আববাজানের মাগফিরাত ও দরজা বুলন্দির জন্য দুআ করবেন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা যেন সুখে-শান্তিতে সিরাতে মুস্তাকীমের উপর চলতে পারি, এ দুআরও দরখাস্ত রইল।