শিক্ষা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ বনাম নগ্নতা ও বিলাসিতার সয়লাব
আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজেদের স্বার্থের জন্য যেকোনো কাজ করতে কুণ্ঠিত না হওয়া। তারা তাদের অপকর্মসমূহ ঢাকার জন্য এ বিষয়টাকেই ভালো কোনো নামে অভিহিত করে থাকে। যেমন নিজেদের আধিপত্য খাটিয়ে অন্যকে তাদের গোলাম বানিয়ে বলতে থাকে, আমরা তো তাদেরকে সুসভ্য বানানোর জন্য এমন করেছি। ইংরেজরা হিন্দুস্তান দখলের পর বারবার এ বুলি আওড়িয়েছে। এই চাকচিক্যময় কর্মটির পেছনে লুকায়িত থাকে স্বার্থ ও প্রবৃত্তির তাড়না। আজও বিশ্বব্যাপী এ ধরনের হীন কর্মকান্ড অব্যাহত আছে। উপমহাদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবীদেরও বড় একটি অংশের মধ্যে বর্তমানে এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত যে, সমগ্র বিশ্বের মুসলমান, বিশেষত উপমহাদেশীয় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সমস্যা কোনটি? এ ব্যাপারে তাদের অধিকাংশের মত হচ্ছে, মূর্খতা, শিক্ষার অভাব এবং মাদরাসার আধিক্য এর মূল কারণ। তারা মনে করেন, বিগত দু শতক ধরে এতদঞ্চলে মুসলমান ব্যাপকভাবে মৌলবীদের প্রভাবে প্রভাবিত ছিল। এজন্য এ অঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। মুসলমানদেরকে উৎকর্ষ সাধন করতে হলে এসব মোল্লা-মৌলবীদের সংসর্গ ছাড়তে হবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একথাও বলে বসে যে, পশ্চিমা সংস্কৃতিকে মোকাবেলা করার পরিবর্তে সেগুলো সাদরে গ্রহণ করার মধ্যেই মুসলিম উম্মাহর মঙ্গল নিহিত, যেমনটা অন্য জাতি-গোষ্ঠীগুলো করছে।
বাস্তবেই কি মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী ওলামায়ে কেরাম? বিগত দু’শতক ধরে, এমনকি আজ পর্যন্ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলমানদের উন্নতি-অগ্রগতির জন্যই কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের ওপর নির্লজ্জ হস্তাক্ষপ করে চলেছে?
ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিন এবং বর্তমান পরিস্থিতিটা পর্যবেক্ষণ করুন, তাহলে পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ মূলত তাদের লোলুপ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য সেবাদাস প্রজন্ম সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই কেবল উন্নয়নশীল মুসলিম দেশসমূহে নখর থাবা বিস্তার করে চলেছে। অন্যথায় কয়েক দশকের বরং কয়েক শতকের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য সত্ত্বেও কেন অধিকাংশ মুসলিম দেশ পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর থাকবে? অধিকৃত দেশসমূহের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে মিশনারী স্কুল খোলা হয়েছে, নগ্ন বিনোদন চালু করা হয়েছে, মদ ও যিনার সংস্কৃতিকে ব্যাপক করে দেওয়া হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে পশ্চিমা কু-সংস্কৃতির প্রচলন ঘটানো হয়েছে। খাদ্য, বিলাসিতা ও আচরণগত পরিবর্তনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও উঁচু মানের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে না। কিংবা করা হলেও এতে আকীদা-বিশ্বাস পরিপন্থী এমন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যেগুলো বর্জনীয়।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের প্রমাণিত সত্যকে অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করা উচিত নয়। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, দু’শ বছর পূর্বে এবং আজও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা শুধু নিজেদের লুটতরাজ চালিয়ে যেতে, প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করতে, পণ্যের বাজার বিস্তৃতকরণের সুবিধার্থে এবং খ্রিষ্টবাদের প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যেই দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে নিজেদের শ্যেণদৃষ্টি রেখেছে। প্রয়োজন সাপেক্ষে এখানেও কিছু শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে খয়রাত বিলানো হচ্ছে, যাতে স্থানীয়ভাবে একটি তল্পিবাহক শ্রেণী গড়ে ওঠে। বর্তমানের দু-একটি উদারহণই এই ষড়যন্ত্রেও স্বরূপ বোঝার জন্য যথেষ্ট।
আফগানিস্তানে আমেরিকার দখলদারিত্বের পর সেখানে সর্বপ্রথম পৌঁছেছে মদ, ফিল্ম ও সস্তা বিনোদনসামগ্রী। বিউটি পার্লার এবং সিনেমা হল খোলা হয় পয়লা ধাপেই। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে হিন্দুস্তান টাইমসে ইসনুত রাজ লিখেছেন-‘এখানে সেখানে মোবাইল ফোন, থাই ফুড, শরাব ও নারী খুবই সহজলভ্য। যৌন উদ্দীপক ওষুধের ব্যাপক ছড়াছড়ি। আমি ইংরেজির অধ্যাপক কুদরতউল্লাহর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার কোনো মেয়েবন্ধু (গার্লফ্রেন্ড) আছে কি না? তৎক্ষণাৎ তিনি মোবাইল ফোন দিয়ে তার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেন। সম্পূর্ণ নতুন এক আফগানিস্তান গড়ে উঠছে, যা ধন-দৌলত, নারী ও স্বপ্নের পেছনে অবিরত দৌড়াচ্ছে।’
একই অবস্থা ইরাকেও । আমেরিকা ইরাক দখল করার প্রথম দিনই সি এন এন এর এক সাংবাদিক এক ইরাকীকে জিজ্ঞাসা করেছিল-‘এখন অবস্থা কী দাঁড়াবে?’ সে উত্তরে বলেছিল, এখন সেক্স, মদ ও সম্পদ উপার্জন লাগামহীন হয়ে যাবে।’
পশ্চিমা মানদন্ডে বর্তমানে দুবাই হচ্ছে সবচেয়ে উন্নত ও আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র। প্রশ্ন এই যে, দুবাইয়ে বড় কলকারখানা কয়টি আছে? বড় স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার কয়টি রয়েছে? প্রযুক্তির উন্নতি সেখানে কতটুকু সাধিত হয়েছে? অত্যাধুনিক হাসপাতাল কয়টি গড়ে উঠেছে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই হবে নেতিবাচক। ১৩ জানুয়ারী ২০০৬ তারিখে বিদেশী দুই সাংবাদিকের বরাতে টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি খবর প্রকাশ করেছে। সে তথ্য অনুযায়ী দুবাইয়ে কর্মরত প্রবাসীরা যখন বিনোদনকেন্দ্রসমূহ আবাদ করল তখন শাসকশ্রেণী ভাবল যে, এটাকে উপার্জনের একটি খাত বানানো যেতে পারে। বর্তমানে সেখানে আবাসিক হোটেলে ত্রিশ হাজার কামরা রয়েছে। ২৭০টি হোটেল রয়েছে এবং ১২০ টি বিশ্রামাগার রয়েছে। এগুলো ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সর্বদা বুক্ড থাকে। দুবাইয়ের সমুদ্রের ভেতরে পাঁচ কিলোমিটারব্যাপী মানুষের তৈরি দীর্ঘতম উপকূল গড়ে তোলা হয়েছে। এ দ্বীপে দু’হাজার ভিলা, দেড় হাজার এপার্টমেন্ট এবং চল্লিশটি লাক্সারী হোটেল তৈরি করা হবে। অত্যাধুনিক নকশা অনুযায়ী সমুদ্রের গভীরে একটি এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে ২৫০ টি ব্যক্তি মালিকানাধীন দ্বীপ থাকবে। জার্মান প্রযু&&ক্তর দ্বারা তীর থেকে তিনশত মিটার দূরে পৃথিবীর প্রথম পানির ওপর ভাসমান হোটেল গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে গলফ ক্লাবসহ বিনোদনের যাবতীয় উপকরণ মজুদ থাকবে।
এছাড়া অন্যান্য মুসলিম দেশের অবস্থাটাও দেখুন। সবখানেই আমরা ব্যয় নির্বাহক, ট্রেড সহায়ক বা কমিশন এজেন্ট হয়ে আছি। শিল্পের কারিগর শিক্ষিত শাসকশ্রেণীকে অত্যাধুনিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা এবং প্রযুক্তিকেন্দ্র গড়ে তুলতে কে বারণ করল? কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠা করেছে শপিং মল, ট্যাক্স ফ্রি ট্রেড জোন, পাঁচতারা হোটেল, শরাবখানা, গলফ-ক্রিকেট-ফুটবল মাঠ। তারা শিক্ষা, শিল্প, গবেষণার ওপর কোনো সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে না। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় চিত্রজগতের নায়ক-প্রযোজকদের পুরস্কার বিতরণী শো, অন্য দেশের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, হলিউড-বলিউডের নাইট শো এবং এ জাতীয় বিলাসী ও বিকৃত রুচির অনুষ্ঠানসমূহ। দুবাই ও অন্যান্য মুসলিম দেশের শাসকবর্গ কি দ্বীনী মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপণকারী? তাদের কি একথা জানা নেই যে, পর্যটন সবচেয়ে অরক্ষিত ও বিনাশী শিল্প? শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উপকারিতার কথা কি তারা জানে না? কৃষি কি তাদের অর্থনীতির বড় একটা অংশ নয়? একটাও চিন্তার বিষয় যে, সেখান থেকে আগত ভারতীয়,পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী মুসলমানরাও এই ধ্যান-ধারণার শিকার হয়ে বসে আছে। তারা তাদের সম্পদ উৎপাদনশীল কোনো খাতে ব্যয় করার পরিবর্তে ভোগ-বিলাসের উপকরণের পেছনে খরচ করে। এমনকি তারা তাদের সন্তানদের উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা পর্যন্ত করে না।
এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুসলিম উম্মাহর উত্তরণের জন্য জাতির নেতৃস্থানীয়, সাধারণ ও বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রয়োজন হল নিজেদের প্রয়োজনগুলো কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নির্ধারণ করা, যার ওপর আমল করে এ জাতি দুনিয়ার প্রতিটি শাখায় নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়েছিল। আজও এ নির্দেশনার আলোকে আমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমোট স্থান থেকে নেতৃত্বের সম্মানীয় স্থানে পৌঁছতে পারব।
অনুবাদ : জহির উদ্দীন বাবর