বাইতুল্লাহর মুসাফির-১৩
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মুআল্লিমের তাঁবুতে পৌঁছে হযরত সামান্য সময় বিশ্রা্ম নিলেন। তারপর প্রয়োজন থেকে ফারিগ হয়ে জামাতের সঙ্গে যোহর আদায় করলেন। তারপর সামান্য কিছু খাবার গ্রহণ করে তিলাওয়াতে মশগুল হলেন। হযরতের জগত ছিলো অন্য, আর পুরো তাঁবুর পরিবেশ ছিলো ভিন্ন। আরেকজন মানুষ ছিলেন অন্য রকম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিনি হযরত মাওলানা তাজাম্মুল আলী ছাহেব। দেশে তাঁর কথা অনেক শুনেছি আমার মুহসিন মাওলানা কাযি মু‘তাসিম বিল্লাহ ছাহেবের কাছে; দেখার সুযোগ হয়নি। আজ সৌভাগ্য হলো এমন পবিত্র স্থানে। হযরত কাযি ছাহেবের কাছে শুনে শুনে যে গায়েবানা আকিদত ও মুহববত দিলে পয়দা হয়েছিলো তা আরো পরিপুষ্ট হলো। তিনি মাদানী (রহ)-এর খলীফা। তিনি আগে বেড়ে হযরতের সঙ্গে মুছাফাহা করলেন। আমি মুছাফা করে আমার প্রতি মাওলানা কাযী মু‘তাছিম বিল্লাহ ছাহেবের শফকত ও স্নেহের কথা বললাম, শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি খাছ দুআ করবেন। কারণ কাযী ছাহেব তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র। আমার কৌশল সফল হলো, তিনি অত্যন্ত সস্নেহ আচরণ করলেন। দু‘আ দিলেন। তারপর তাঁবুর এক কোণায় গিয়ে এমনভাবে লুকোলেন এবং ডুবে থাকলেন যে, মনে হলো কোন কিছুর খোঁজে তিনি নিখোঁজ হয়ে গেছেন।
আছরের জামাতের পর হযরত কিছু নছীহত করলেন। যে সময় এখন আমাদের যিন্দেগি থেকে পার হয়ে যাচ্ছে তার গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করলেন। সময়ের অপচয় ও গাফলত সম্পর্কে সতর্ক করলেন এবং আগামীকালের অকূফে আরাফার মহান আমল সম্পর্কে হিদায়াত দান করলেন। আল্লাহর রহমতে হযরতের নছীহত সবার মাঝে বিরাট আছর করলো। অন্যান্য তাঁবু থেকেও বহু লোক হাযির হয়েছিলো, তাদের মাঝেও নতুন চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টি হলো। পর্দার ভিতরে আল্লাহর বান্দীরা ছিলো, তাদের কথার আওয়াযও বন্ধ হয়ে গেলো। সবাই নিজ নিজ ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হলো। আছরের আগের এবং পরের পরিবেশে আসমান-যমীনের পার্থক্য দেখা দিলো, আলহামদু লিল্লাহ।
হজ্বের সফরে আল্লাহর নেক বান্দাদের ছোহবত কত যে কল্যাণপ্রসূ তার চাক্ষুষ নমুনা যেন আল্লাহ আমাদের দেখালেন। হযরতের কথাগুলো ছিলো খুবই সাধারণ কিন্তু শ্রোতাদের অন্তরে তার প্রভাব ছিলো অসাধারণ ! এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী আল্লাহর এক নেক বান্দার নছীহতের মজলিস সম্পর্কে লিখেছেন (ভাব)-
‘কথার আছর ভাষার সৌন্দর্যে হয় না, দিলের দরদে হয়। তাঁর ভাষায় শব্দের কারুকাজ ছিলো না, কিন্তু প্রতিটি শব্দ ছিলো দিলের দরদে ভেজা, তাই ভেজা শব্দগুলো মজলিসের সবার চোখ ভিজিয়ে দিলো।’
মাওলানা আলী মিয়াঁ একথাগুলো লিখেছেন হযরত থানবী (রহ)-এর বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা ওছিউল্লাহ ফতেহপুরী (রহ) সম্পর্কে, যিনি হজ্বের সফরে রওয়ানা হয়ে পানির জাহাযে ইন্তিকাল করেছিলেন এবং তাঁর দাফন হয়েছিলো সাগরের তলদেশে। সেই মজলিস আমি দেখিনি, দেখার কথাও নয়। কিন্তু কিতাবে পড়া সেই মজলিসের বাস্তব নমুনা যেন আল্লাহ দেখালেন মিনার পবিত্র ভূমিতে হযরত থানবী (রহ)-এর আরেক খলীফা হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ)-এর মাঝে। চোখে পানি আসার মত কোন কথা তিনি বলেননি, অথচ মজলিসে প্রায় সবার চোখে পানি এলো। কেউ কেউ শব্দ করে কাঁদলো। কে জানে কিভাবে এটা হয়! কে জানে দিলের দরদ কেমন হয়! এবং দরদে ভেজা শব্দ কেমন হয়!
নয় তারিখের রাত্র মিনায় যাপন করা সুন্নত। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃহস্পতিবার ফজরের নামায মক্কায় পড়ে এশরাকের পর মিনায় রওয়া হয়েছেন এবং মিনায় রাত্র যাপন করেছেন। আর আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন শুক্রবার ফজরের নামায আদায় করে সূর্যোদয়ের পর। সুতরাং মিনায় পাঁচওয়াক্ত নামায আদায় করা হলো সুন্নত।
কিন্তু আফসোস! সারা জীবনব্যাপী একটি ফরয আদায় করার জন্য এত দূরদারাজ থেকে এত কষ্টের সফর করে মানুষ আসে, অথচ সামান্য একটু আরামের জন্য অনেকেই মক্কা থেকে সরাসরি, কিংবা মিনা থেকে রাত্রেই আরাফায় চলে যায়। এত কষ্টের সফর হলো, অথচ সুন্নতের উপর আমল না করে বিরাট ফযীলত থেকে বঞ্চিত হলো। কেন এমন হয়! কেন আমরা বুঝতে পারি না যে, হজ্বের সফর হচ্ছে ইশক ও মুহাববাতের সফর! এবং ত্যাগ ও কোরবানির (শিক্ষা গ্রহণের) সফর! অথচ বিনা ওযরে সুন্নত তরক করার কারণে ইবাদতের সফর হয়ে যায় গোনাহের সফর! মোল্লা আলী আলকারী লিখেছেন-
মক্কায় রাত যাপন করলে জায়েয তো হবে, কিন্তু সুন্নত তরক করার কারণে গোনাহগার হবে।
এ প্রবণতা সম্ভবত আরো আগে থেকেই চলে আসছে, যার কারণে তের শতকের সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ফাতাওয়া শামীতে বলা হয়েছে-
এ যামানার মানুষ যা করে- অর্থাৎ আট তারিখে (আগেভাগে) আরাফায় চলে যাওয়া- এটা ভুল এবং সুন্নাহর খেলাফ। এ কারণে তাদের বহু সুন্নত ছুটে যায়; তন্মধ্যে একটি হলো মিনার পাঁচওয়াক্তের নামায’
আমাদের মত গোনাহগারদের হজ্বের সফর কবুল হওয়ার ওয়াছিলা তো শুধু এই যে, অন্তত বাহ্যিকভাবে যেন তা আল্লাহর নবীর হজ্বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। কবুলিয়াতের এত বড় ওয়াছিলাকে যদি নিজের হাতেই আমরা নষ্ট করে ফেলি তো এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! অবশ্য যদি কঠিন কোন ওযর হয়, আর দিলে আফসোস থাকে তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ মাফ করবেন।
নয় তারিখে মিনার রাত বড় বরকতের রাত। হাদীছ শরীফে এর ফযীলতের কথা এসেছে। সুতরাং যথাসম্ভব বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগি ও দু‘আ-ইস্তিগফারে মশগুল থাকাই কর্তব্য। কিন্তু মিনার বরকত ও ফযীলতওয়ালা রাত বহু মানুষেরই উদাসীনতা ও গাফলত এবং বেহুদা গল্পগুজব ও অর্থহীন ব্যস্ততার মাঝেই কেটে যায়। তবে আশা ও সান্ত্বনার কথা এই যে, হযরত হাফেজ্জী হুযূরের মত আশিকদিল ও প্রেমিকহৃদয় বান্দারা তাঁদের আহাযারি ও রোনাযারি দ্বারা হজ্বের পুরো সফরকে যিন্দা-সজীব এবং জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে রাখেন এবং আল্লাহর গাফেল বান্দাদের হুঁশিয়ার করতে থাকেন। আল্লাহর এ সকল নেক বান্দার ফয়য ও বরকতেই হজ্ব এখনো যিন্দা রয়েছে; মিনা-আরাফা-মুযদালিফায় চৌদ্দশ বছরের নূরানিয়াত ও রূহানিয়াত ক্ষীণধারায় হলেও এখনো বহমান রয়েছে।
হযরত হাফেজ্জী হুযূর বলতে গেলে সারা রাতই মুছল্লায় নামাযে, কিংবা মুনাজাতে নিমগ্ন ছিলেন। আমার চোখে যখন ঘুম নেমে এলো তখনো তিনি মুছল্লায় নামাযে, আবার যখন চোখ খুললো তখনো তিনি মুছল্লায় মুনাজাতে। নামাযে দাঁড়িয়েছেন তো দাঁড়িয়েই আছেন; সিজদায় মাথা রেখেছেন তো পড়েই আছেন; আবার মুনাজাতে হাত তুলেছেন তো নীরব কান্নায় চোখের পানি ঝরছে আর ঝরছে। জীবনে এ আমার পরম সৌভাগ্য যে, হজ্বের সফরে হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ছোহবত নছীব হয়েছিলো। তাঁর ছোহবতের বরকতেই এ যুগের মানুষ হয়েও আমি দেখতে পেয়েছি অতীতের হজ্ব ও যিয়ারাতের কিছুটা ঝিলিমিলি! দেখতে পেয়েছি সে যুগের আলোর উদ্ভাস! আল্লাহর আশিক বান্দাদের মিনায় রাতযাপনের যে লেখাচিত্র কিতাবের পাতায় পড়েছি তারই
বাস্তব চিত্র যেন সবাই দেখেছে হযরত হাফেজ্জী হুযূরের মাঝে। আগামী যুগে যারা মিনা-আরাফায় হাযির হবে তারা কি শুনতে পাবে এমন কান্না! দেখতে পাবে এমন অশ্রু ঝরা! আল্লাহ যেন করেন; কিয়ামত পর্যন্ত যমযমের ধারা যেন বইতে থাকে এবং বইতে থাকে বিগলিত হৃদয়ের অশ্রুধারা। এখানে অশ্রু ঝরেছে আল্লাহর পেয়ারা হাবীবের! আখেরি যামানায় এখানে অশ্রু ঝরবে ইমাম মেহদীর! আমাদের দু'ফোটা অশ্রু যেন মিশে যায় সেই পবিত্র অশ্রুর ঝরণায়!
ফজরের পর সূর্যোদয় হলো, আমার জীবনের নতুন এক সূর্যোদয়। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব নয় তারিখ সূর্যোদয়ের পর তাঁর নূরানী কাফেলা নিয়ে আরাফার ময়দানে রওয়ানা হয়েছিলেন। গোটা মুসলিম উম্মাহ সেই নূরানী কাফেলাকে অনুসরণ করে চলেছে চৌদ্দশ বছর ধরে ভাষা, বর্ণ ও ভূগোলের সকল সীমানা অতিক্রম করে । সেই নূরানী কাফেলার অনুসারীদের জামাতে আমিও আজ শামিল হবো, এ সৌভাগ্যবার্তাই যেন বয়ে এনেছে আজ আরাফার দিগন্ত থেকে উঠে আসা লাল সূর্যটি। এই লাল সূর্যের উদয়ের প্রতীক্ষায় কত সূর্যোদয় আমি অবলোকন করেছি আমার জীবনের কত প্রভাতে! সেই নূরানি ফজর এবং সোনালী প্রভাত আমার জীবনে আজ সমুপস্থিত! শোকর আলহামদু লিল্লাহ!
মিনার সর্বত্র এখন অভূতপূর্ব এক সাজ সাজ ও চল্ চল্ চঞ্চলতা! অথচ কোথাও কোন গোলযোগ নেই! আয়োজন আছে, তোড়জোড় আছে, কিন্তু গোলযোগ ও শোরগোল নেই! এত লক্ষ মানুষের সমাবেশ যদি অন্য কোথাও হতো! যদি এভাবে একই সঙ্গে স্থান থেকে স্থানান্তরে ছুটে চলার হুকুম হতো তাহলে! কল্পনা করা যায়, কেমন হুলস্থুল অবস্থা হতো! শত শত গাড়ীর বহর রাস্তায়। হাজার হাজার মানুষ গাড়ীর অপেক্ষায়। একেকটা গাড়ী এসে দাঁড়ায়, চোখের পলকে ভর্তি হয়ে যায়। খালি গাড়ী দেখে হাজী ছাহেবান ছুটে যান, কিন্তু এটা তাদের গাড়ী নয়, শুনেই থেমে যান! জোর করে ওঠার কোন চেষ্টা নেই! ঘটনার ক্ষেত্র থেকে দূরে বসে মনে হতে পারে, খুব সামান্য কথা! কিন্তু মিনায়, আরাফায়, মুযদালিফায় যানবাহনের জন্য হাহাকার অবস্থায় এমন সংযম খুব সহজ কথা নয়। এই কাফেলা সেই কাফেলার অনুগামী বলেই এখনো তাতে রয়েছে সেই নূরানিয়াতের কিছুটা আলোকছায়া!
চোখের সামনে অভূতপূর্ব দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখছি, আর মনের ভিতরে বিভিন্ন ভাবনার তরঙ্গদোলায় দোল খেয়ে চলেছি।
হযরতের জন্য রাবেতার পক্ষ হতে গাড়ী নির্ধারিত রয়েছে, কিন্তু গাড়ীর দেখা নেই। বোঝাই যায়, জনসমুদ্র এবং গাড়ী-সাগর পাড়ি দিয়ে আমাদের তাঁবু পর্যন্ত আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। যারা এটা বোঝে না, তারা ক্ষুব্ধ হয়, যারা বোঝে তারা ক্ষুব্ধ না হলেও উদ্বিগ্ন হয়। হযরতের মাঝে অবশ্য উদ্বিগ্নতারও কোন ছায়া ও ছাপ নেই। তিনি শান্ত-নিরুদ্বিগ্ন এবং যিকির-তাসবীহাতের মাঝে আত্মসমাহিত! চারপাশের বিপুল চঞ্চলতার মাঝে এমন আত্মসমাহিত রূপ দেখতে কী যে ভালো লাগে! কিন্তু এমন রূপ খুব বেশী কি দেখা যায় আমাদের কোলাহলপূর্ণ জীবনের অঙ্গনে!
অবশেষে গাড়ী এলো এবং চালকের বক্তব্য হলো, শোকর করো যে, শেষ পর্যন্ত গাড়ী আনতে পেরেছি।
তার কথায় এমন একটা কিছু ছিলো যে, হযরতও মৃদু হাসলেন। আমরা প্রথমে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম, তারপর, এখন মনে নেই মিসরী না, ইয়ামানী, তাকে শুকরিয়া জানালাম।
মিনা ছেড়ে যাচ্ছি, কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ নেই। কারণ আবার আমরা ফিরে আসবো মিনায়। হৃদয়ে এখন শুধু আনন্দের তরঙ্গ; কারণ কাফেলা চলেছে আরাফার অভিমুখে! আমিও সেই কাফেলার যাত্রী এবং আরো সৌভাগ্য, আল্লাহর এক পেয়ারা বান্দার ‘সহযাত্রী’!
যে গাড়ীর চালক পথ চেনে না সে গাড়ী কীভাবে পৌঁছতে পারে মানযিলে? মিনা থেকে আরাফার পথে আমরা যে গাড়ীর যাত্রী হলাম, তার ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন যেমন সত্য তেমনি সত্য উম্মত আজ যে গাড়ীর যাত্রী তার ক্ষেত্রেও। একঘণ্টার পথ যখন চার ঘণ্টায়ও খুঁজে পাওয়া গেলো না, বরং ঠিকানা ছাড়াই গাড়ী থেকে নেমে যেতে হলো পথের উপর, তখন এ প্রশ্নটাই আমার
চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো দীর্ঘক্ষণ। উম্মতের গাড়ীর চালকেরাও যেন আজ পথ চেনে না, মানযিল জানে না। ছিরাতুল
মুস্তাকীম হারিয়ে এপথে সেপথে ঘুরে ঘুরে তারা হায়রান, আর ঠিকানাহীন পথের উপর নেমে গিয়ে উম্মত এখন পেরেশান।
নয় তারিখের ফজর থেকে তালবিয়ার সঙ্গে শুরু হয়েছে তাকবীরে তাশরীক। এটা চলবে তের তারিখের আছর পর্যন্ত। কিন্তু শরীয়তের আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞতা আমাদের কী পরিমাণ তার বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো আজ ফজরের সময়। আমাদের তাঁবুতে হযরতের কাফেলা ছাড়া আর কাউকে তাকবীরে তাশরীক পড়তে শোনা গেলো না। হযরত তখন তাশরীকের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং সম্ভবত আমীনী ছাহেব হযরতের বক্তব্য সবার কানে পৌঁছে দিলেন তখনই শুধু তাকবীরে তাশরীকের আওয়ায ধ্বনিত হলো। আমি কৌতুহলী হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্নজনকে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, অনেকেরই জানা নেই, তাকবীরে তাশরীক কী ও কেন? যারা জানেন তাদের কেউ কেউ যুক্তি দিলেন যে, আমাদের তো ঈদের জামাত নেই; সুতরাং তাকবীরে তাশরীক থাকবে কেন?
বাস যখন বিভিন্ন মোড় ঘুরছে এবং রাস্তা পরিবর্তন করছে, হযরত তখন উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়ছেন; আমরাও তাঁকে অনুসরণ করে সমবেত কণ্ঠে উচ্চারণ করছি-
লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শারীকা লাকা লাববাইক। ....
যেদিকে তাকাও শুধু হাজীদের কাফেলা! ইহরামের লেবাসে শুধু নূরানিয়াতের শুভ্রতা! যেদিকে কান পাতো শুধু তালবিয়ার সুমধুর ধ্বনি! শুধু লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইকের বন্দেগি ও হাযিরি!
আমি হাযির, হে আল্লাহ, আমি হাযির! গোনাহগার বান্দা তোমার, তোমার দুয়ারে হাযির!
অপূর্ব এক আনন্দের তরঙ্গ দোলায় আন্দোলিত আমার হৃদয় যেন গেয়ে উঠলো, আরাফা! আরাফা! আমার স্বপ্নের, আমার ভালোবাসার হে আরাফা! এসেছি! আমি এসেছি তোমার জাবালে রহমতের পাদদেশে তোমাকে ভালোবেসে তোমার নূরানিয়াতের পরশে ধন্য হতে!
আর তখন আমি যেন শুনতে পেলাম আরাফার আকাশ থেকে, আরাফার বাতাস থেকে আশ্চর্য মধুর এক অভিনন্দন, মারহাবা! মারহাবা! জাবালে রহমতের ভূমিতে তোমাকে মারহাবা!
আমি আপ্লুত হলাম, আমি কৃতার্থ হলাম! উদ্বেলিত হৃদয়ের সবটুকু কৃতজ্ঞতা নিবেদন করে বলে উঠলাম, তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
গোনাহগার নাফরমান বান্দাকেও তুমি স্বাগত জানাবে, এ আশাই তো করি হে আল্লাহ, তোমার রহমতের কাছে!
গাড়ীর চালক অবশেষে হতাশা প্রকাশ করে বললো, তোমাদের তাঁবু বের করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর আর কী বলা যায়! গাড়ী থেকে নামতে হলো দিকঠিকানাহীনভাবে। সূর্য তখন মাথার উপর। ছিলাম শীতাতোপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীর ভিতরে, এখন ....। গরমে আমাদের পর্যুদস্ত অবস্থা ছিলো দেখার মত! আর হযরত হাফেজ্জি হুযূরের সুকূন ও প্রশান্তির অবস্থাটি ছিলো আরো বেশী দেখার মত। জায়নামায বিছিয়ে তিনি পথের পাশে বসলেন। তিনি যেন পেয়ে গেছেন তাঁর ঠিকানা! পানির বোতল এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে। সামান্য পানি পান করলেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু মধুর হেসে বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাঁবু স্থাপন করা হয়েছিলো মসজিদে নামিরার কাছে। তিনি সেখানে গোছল করেছিলেন এবং ...।
আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম হযরতের নূরানী চেহারার দিকে! আমরা যখন তাঁবুর জন্য, একটু ছায়ার জন্য পেরেশান তখন তিনি সময়কে অতিক্রম করে পৌঁছে গেছেন সেই দূর অতীতে! কে জানে, তাঁর অর্ন্তচক্ষু তখন কী কী দৃশ্য অবলোকন করছিলো!
এখন তাঁবু তালাশ করা নিরর্থক, তবু সে চেষ্টা করা হলো কিছুক্ষণ। আশেপাশের তাঁবুতে গিয়ে খোঁজ নেয়া হলো। কেউ বলতে পারলো না আমাদের মুআল্লিমের ঠিকানা। এক তাঁবুওয়ালাদের কিসমত ভালো ছিলো। হযরতকে দেখতে পেয়ে এবং হয়ত বা চিনতে পেরে সাদরে ও সমাদরে নিজেদের তাঁবুতে নিয়ে গেলো। আর হযরতকে যারা বরণ করলো, আমাদেরও তারা গ্রহণ করলো। যিনি বরণীয় তাঁর পিছনে থাকলে তুমিও হবে গ্রহণীয়, একথা আরাফার তাঁবুতে যেমন সত্য হলো তেমনি তা সত্য হবে তোমার ইবাদতে, মুনাজাতে; তোমার যিন্দেগির সবকিছুতে; এমনকি তোমার আখেরাতের সব ঘাঁটিতে!
যিলহজ্বের নয় তারিখে যাওয়ালের পর মুহরিম অবস্থায় আরাফার হাযিরি হলো হজ্বের মূল রোকন। যে কোন কারণে এটা যদি ফওত হয়ে যায় তাহলে হজ্বই ফওত হয়ে গেলো। পরবর্তী কোন বছর অবশ্যই তা কাযা করতে হবে। এজন্য হাসপাতালের অজ্ঞান রোগীকেও বিশেষ ব্যবস্থায় আরাফার ময়দান ঘুরিয়ে নেয়া হয়, যাতে তার মূল হজ্ব আদায় হয়ে যায়। শরীয়তের পরিভাষায় এটা হলো অকূফে আরাফা (আরাফায় অবস্থান)।
আরাফার দিন উম্মতের জন্য বিশেষ রহমতের দিন; জাবালে রহমতের মাঠে রহমতের মোষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত হওয়ার দিন। সুতরাং আজ যেমন আল্লাহর গোনাহগার বান্দাদের পরম আনন্দের দিন তেমনি অভিশপ্ত শয়তানের চরম লাঞ্ছনা ও হতাশার দিন।
হযত তালহা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফার দিন শয়তানকে যেমন হীনতা, দীনতা ও তুচ্ছতায় ভারাক্রান্ত এবং ক্রোধান্বিত দেখা গেছে তেমন আর কখনো দেখা যায়নি। এটা শুধু একারণে যে, সে আল্লাহর রহমত নাযিল হতে দেখে এবং আল্লাহকে বান্দার বিরাট বিরাট গোনাহ মাফ করে দিতে দেখে; তবে বদরের দিন সে যা দেখেছে সেদিনটি ছাড়া। (অর্থাৎ তার সেদিনের লঞ্ছনা ও বিপর্যস্ততার অবস্থাও একই রকম)
হে বন্ধু! সমুদ্রের তুমি কূল পাবে, কিনারা পাবে; সমুদ্রের তলদেশও খুঁজে পাবে, কিন্তু পাবে না আরাফার ময়দানে আল্লাহর রহমতের কোন কূল-কিনারা, কিংবা তার তলদেশের ঠিকানা।
তুমি যদি এমন অপরাধ করে থাকো যাতে পাহাড় গুঁড়িয়ে যায়, আসমান ভেঙ্গে পড়ে এবং সাগরের পানি কালো হয়ে যায় তবু তুমি রহমত ও মাগফিরাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো। আরাফার ময়দানে তোমাকে হাযির করা হয়েছে বঞ্চিত করার জন্য নয়, অনুগ্রহ করার জন্য। জীবনে যার বরবাদি ছাড়া কিছু নেই, অনুতাপের দুহফোটা অশ্রু দ্বারা সেও আজ পেয়ে যাবে আল্লাহর রহমতের কোলে আশ্রয়।
আজ তো সেই দিন যেদিন স্বয়ং আল্লাহ নূরের শুভ্র ফিরেশতাদের সামনে বান্দার ইহরামের শুভ্রতা নিয়ে গর্ব করেন।
মুসলিম শরীফের এ হাদীছ বারবার পড়েছি; আজ হযরতের যবানে শুনলাম। শব্দ অভিন্ন, কিন্তু স্বাদ ও প্রসাদ ছিলো ভিন্ন। অন্তরে জাগ্রত হলো নতুন ভাব ও ভাবনা এবং নতুন চিন্তা ও চেতনা।
হযরত বললেন, মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফার দিন আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের যে পরিমাণে জাহান্নাম থেকে আযাদ করেন তেমন অন্য কোন দিন নয়। আর (এই দিন) আল্লাহ তা‘আলা বান্দার খুব নিকটে আসেন, তারপর ফিরেশতাদের মজলিসে বান্দাকে নিয় গর্ব করেন, আর বলেন, দেখো এই পাগল বান্দারা কী চায়!
হযরত আমাদের আরেকটি হাদীছ শুনালেন, যা আমার জানা ছিলো না। এ হাদীছ শুনে তো তাঁবুর গোটা মজলিস সুবহানাল্লাহর আনন্দধ্বনিতে দুলে উঠলো! আর আমার অন্তর্সত্তা আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো, পেয়ে গেছি! আমার রাবেব কারীমের মাগফিরাত আমি পেয়ে গেছি!
হযরত বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সবচে’ বড় গোনাহগার তো সে, যে আরাফার ময়দানে অকূফ করে, তারপরো ভাবে যে, আল্লাহ হয়ত তাকে মাফ করেনি।
সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লহ!! ছুম্মা সুবহানাল্লাহ!!! আর কী চাও তুমি হে ‘আলহাজ আব্দুল্লাহ’! লাববাইক বলে হাযির হলে, আর মাগফিরাতের খোশখবর পেয়ে গেলে! তারপর কেন তুমি তাওবা ইস্তিগফার করবে না! কেন দু‘আ ও মুনাজাত করবে না! কেন কাঁদবে না! কেন হাসবে না! আরাফার তপ্ত বালু কেন আজ তোমার একফোঁটা অশ্রুর সাক্ষী হয়ে থাকবে না! একফোঁট অশ্রু, অনুতাপের এবং আনন্দের!
আরাফার দিন হলো দু‘আ ও মুনাজাতের দিন, দিল খুলে চাওয়ার এবং অাঁচল ভরে পাওয়ার দিন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
‘শ্রেষ্ঠ দু‘আ হলো আরাফার দিনের দু‘আ।’
হে প্রেমিক! তোমার প্রেমাস্পদের পরম করুণায় জীবনের স্বর্ণসুযোগ এখন তোমার সামনে। সুতরাং অাঁচল বিছাও এবং ভিক্ষার পাত্র মেলে ধরো। যা কিছু চাওয়ার চেয়ে নাও এবং চাইতে থাকো; ক্লান্তিহীনভাবে চাইতে থাকো। অন্তরের যা কিছু কামনা-বাসনা, দিলের যা কিছু আরযু ও তামান্না মাওলার দরবারে পেশ করতে থাকো। আজ তো শুধু কবুলিয়াতের দিন! সুতরাং জীবনের এই দুর্লভ সুযোগ যেন অবহেলায় হাতছাড়া না হয়ে যায়।
হযরত বললেন, ‘আরাফার দিনের জন্য বিশেষ কোন দু‘আ অবশ্য নেই, তবে-
سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر
এই কালিমাগুলোর বড় ফযিলত এসেছে (এবং আরাফাতে এগুলো পড়ার কথাও হাদীসে এসেছে।) সুতরাং হাকীকত ও মর্ম বুঝে বুঝে হুযূরে কলবের সাথে এই কালিমাগুলো বারবার পড়া উচিত। অবশ্য তালবিয়াও যথানিয়মে চলতে থাকবে।’
আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম হযরতের নছিহতের উপর আমল করার।
আরাফার দিনে কিভাবে দু‘আ ও মুনাজাত এবং আহাযারি ও রোনাযারি করতে হয়! কিভাবে আবদিয়াত ও বন্দেগি এবং বিনয়কাতরতা ও দাসত্ব নিবেদন করতে হয়! কেমন ছিলো আরাফার ময়দানে আল্লাহর নবীর দু‘আ ও রোনাযারি! কেমন ছিলো ছাহাবা কেরামের এবং যুগে যুগে আল্লাহর পেয়ারা বান্দাদের মুনাজাত ও আহাযারি, তা কিতাবের পাতায় অবশ্যই পড়েছি এবং তাতে আপ্লুত হয়েছি। কিন্তু কিতাবের শুকনো পাতা, আর চোখের ভেজাপাতা তো এক নয়। দু‘আ ও মুনাজাতের এবং আহাযারি ও রোনাযারির বর্ণনা এবং তার যিন্দা নমুনা তো এক নয়! সেই যিন্দা নমুনা আরাফার ময়দানে আল্লাহ আমাদের দেখিয়েছেন হযরত হাফেজ্জি হুযূরের মাঝে।
ভিখারীর মত দু’হাত পেতে ‘মাওলা গো’ বলে ডাক দিয়ে তিনি যখন চোখের পানি ছেড়ে দিলেন, আর চারপাশে কান্নার রোল পড়ে গেলো তখন আমার চোখের সামনে থেকে সময়ের পর্দা যেন সরে গেলো! সেই আলোকিত অতীত যেন এখানে দৃশ্যমান হলো! আমি যেন দেখতে পেলাম সেই নূর-যামানার দু‘আ ও মুনাজাতের সামান্য কিছু আলোছায়া, যার চিত্র এঁকেছেন হযরত ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এভাবে-
‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি দেখেছি, আরাফার ময়দানে তিনি দু‘আ করছেন, উভয় হাত বুক পর্যন্ত তুলে রেখেছেন, যেন এক ভুখা মিসকীন! (দু’ লোকমা আহারের জন্য দাতার দুয়ারে হাত ছড়িয়ে রেখেছে।)
আজকের এই হযরত হাফেজ্জি তো বিচ্ছিন্ন কেউ নন! আজকের এই দু‘আ ও মুনাজাত এবং এই আহাযারি ও রোনাযারিও তো নয় বিচ্ছিন্ন কিছু! এটা তো স্মরণ ও অনুসরণের অটুট এক পরম্পরা, বর্তমান থেকে অতীত-অভিমুখে! এটা তো আলো ও নূরের অব্যাহত এক ধারা, অতীত থেকে বর্তমানের দিকে!
পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই নূরানী দু‘আ ও মুনাজাতের নমুনা দোহরানোর জন্যই তো এই দিনে এই পবিত্র ময়দানে আল্লাহর পেয়ারা বান্দাগণ প্রতিবছর হাযির হন! নবুয়তের যামানা থেকে দূরত্ব যত বিস্তৃত হবে, নূর ও নূরানিয়াত তত দুর্বল হবে, এটা স্বাভাবিক, তবু তো, এ দু‘আ সেই দু‘আরই প্রতিচ্ছবি! এবং এ কান্না সেই কান্নারই প্রতিধ্বনি!
হযরতের রোনাযারি আমাদেরও হৃদয় স্পর্শ করলো এবং তাতে আমাদেরও হৃদয় বিগলিত হলো। সামান্য একটু হলেও আমাদেরও চোখের পাতা ভিজে উঠলো। আমীন, আমীন বলে আমরাও শামিল হয়ে গেলাম যুগে যুগে আরাফার ময়দানে আল্লাহর পেয়ারা বান্দাদের আহাযারি ও রোনাযারির জামাতে!
তাঁবুর বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে এবং তপ্ত বালুর উপর দাঁড়িয়ে হযরতের মুনাজাত চলছে তো চলছে! ‘নিষ্পাপ’ দু’টি চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে তো ঝরছে! চোখের অশ্রুবর্ষণ যত বাড়ছে রহমতের বারিবর্ষণ তত যেন মোষলধারে চলছে! মুনাজাতের বিলাপ যেন থামবে না, রহমতের বারিধারাও বন্ধ হবে না! দিতে থাকো হে আল্লাহ! বান্দার যোগ্যতার মাপে নয়, দিতে থাকো তোমার রহমতের শানে! আমাদের অাঁচল ভরে, পাত্র উপচে পড়বে; নিতে নিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাবো, তবু তোমার দেয়া থামবে না, দানে তুমি তো কখনো ক্লান্ত হও না!
সময়ের অনুভূতি আমাদের কারো ছিলো না। আমরা নিমগ্ন ছিলাম, সমর্পিত ছিলাম এবং বিভোর ছিলাম প্রার্থনার মাধুর্যে এবং প্রাপ্তির তৃপ্তিতে। আমরা ডুবে ছিলাম মুনাজাতের মাস্তিতে এবং কবুলিয়াতের খুশিতে।
এক সময় মুনাজাত সমাপ্ত হলো, কিন্তু হযরতের দিলের আবেগ ও জাযবা যেন আরো উদ্দীপ্ত হলো; ইশক ও মুহাববাতের মওজ যেন আরো উচ্ছ্বসিত হলো। হযরত এলান করলেন, ‘আমি এখন আল্লাহর দরবারে সিজদায় যাবো, যাদের ইচ্ছা এবং যতক্ষণ ইচ্ছা তারা সিজদায় শরীক হতে পারে।’
হযরতের দিলের জাযবা যেন সবার মাঝে সঞ্চারিত হলো; ইশক ও মুহাববাতের মওজে সবাই যেন আন্দোলিত হলো। গরম ছিলো প্রচন্ড, বালু ছিলো উত্তপ্ত, কিন্তু হযরতের কলবের ‘গরমি’ এবং হৃদয়ের উত্তাপ ছিলো আরো তীব্র। উত্তপ্ত বালুর উপর হযরত সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। আহা! এ চোখ দুহটো দেখেছিলো সেই নূরানি মানুষটির ইশকের বেতাবি ও বেকারারিতে সিজদায় লুটিয়ে পড়া! কিছুক্ষণ ব্যাকুল হয়ে দেখলাম, তারপর বেকারার হয়ে শামিল হলাম সেই সিজদায়।
এ কিসের সিজদা, তা আমাদের জানা ছিলো না! উত্তপ্ত বালুর উপর কেন এ লুটিয়ে পড়া, তা আমাদের উপলব্ধিতে ছিলো না, তবু উত্তপ্ত বালুর উপর মাথা রেখে আমরাও শামিল হলাম হযরতের সিজদায় শুধু এ প্রত্যাশায় যে, এ সিজদা আল্লাহর দরবারে আল্লাহর এক পেয়ারা বান্দার আশিকানা সিজদা! এ সিজদায় মাওলার রহমতের দরিয়ায় অবশ্যই নয়া জোশ পয়দা হবে এবং দান ও বখশিশের ছয়লাব শুরু হবে। এ সিজদায় যদি শামিল থাকা যায় তাহলে কিছু না কিছু আসতে পারে আমাদেরও হিস্সায়!
হযরত সিজদায় পড়ে আছেন এবং ইশক ও মুহাববাতের ঊর্ধ্বজাগতিক রহস্যলীলায় ডুবে আছেন। হয়ত তাঁর আত্মা তখন দেহসত্তার জড়বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলো, কিংবা তাঁর দেহসত্তা বিলীন হয়ে গিয়েছিলো আত্মার আলোকসত্তায়! একটা কিছু হয়েছিলো! নইলে এমন তপ্ত বালুর উপর এমন দীর্ঘ সিজদা! সময় যে নিজস্ব গতিতে বয়ে চলেছে সে চেতনা হয়ত তাঁর লোপ পেয়েছিলো। আশেক-মজনু যারা, এরকম সময় থাকে না তাদের কোন সময়-চেতনা। কারণ সিজদা মানে তো পরম প্রিয়তমের নিকটতম সান্নিধ্য অর্জন! তখন হয়ত সময়ের গতি থেমে যায় এবং বাহ্যজগতের অনুভব-অনুভূতি লোপ পেয়ে যায়। কিন্তু যারা শুধু সঙ্গ-শিহরণে শিহরিত হয়েছিলো এবং হযরতের সঙ্গে সিজদায় গমন করেছিলো তারা কতক্ষণ বরদাশত করতে পারে এই রিয়াযাত ও মুজাহাদা! তারা আর কতক্ষণ প্রদর্শন করতে পারে ইশক ও মুহাববাতের চরম পারাকাষ্ঠা! তাই একজন দু’জন করে তাদের সংখ্যা কমে আসতে লাগলো। তবে সিজদা থেকে মাথা তোলার পর দেখা গেলো, সামান্য সময়ের ‘সিজদাসান্নিধ্যে’ তাদেরও চেহারা ছিলো নূর-ঝলমল! তারাও যেন মহাদাতার দানভান্ডার থেকে লাভ করেছে পাত্রের প্রশস্ততা অনুযায়ী, বরং তার চেয়ে বেশী!
একঘণ্টা পার হয়ে গেলো! হযরত তখনো সিজদায়! তপ্ত বালুর উপর মাথা রেখে তিনি জারজার হয়ে কেঁদে চলেছেন, কেঁদেই চলেছেন! চোখের পানিতে ভিজে উঠেছে তপ্ত বালু, তবু তাঁর কান্নার বিরাম নেই! তবু তাঁর অশ্রু ঝরার বিরতি নেই! ভিখারী যেভাবে লুটিয়ে পড়ে থাকে তেমনি তিনি পড়ে আছেন পরম দয়ালু দাতার শাহানশাহি দরবারে!
হযরত তখন সিজদায় একা! আমরা শুধু তাকিয়ে আছি সিজদায় লুটিয়ে থাকা মানুষটির দিকে অবাক বিস্ময়ে এবং আফসোস ও অনুতাপ নিয়ে । ইবাদত যেমন সৌভাগ্যের, প্রেমমুগ্ধ দৃষ্টিতে ইবাদতের দৃশ্য অবলোকন করাও তো সৌভাগ্যের! তুমি তো বলতে পারবে তোমার মাওলাকে, রাবেব কারীম! আমি হাযির ছিলাম আরাফার ময়দানে! আমিও দেখেছি তোমার আশিক বান্দার সেই দীর্ঘ সিজদা! কিছুক্ষণ আমিও শামিল ছিলাম! আমিও ভালোবেসেছিলাম সেই সিজদাকে এবং সিজদায় লুটিয়ে থাকা তোমার প্রেমিক বান্দাকে!
ইশক ও মুহাববাতের কী তরঙ্গজোয়ার জেগেছিলো তোমার আশিক বান্দার কলবে তা তো আমি জানি না! কী ছিলো তোমার কাছে তাঁর আবেদন ও নিবেদন এবং আকুতি ও মিনতি তা তো আমি শুনিনি! কেমন ছিলো তাঁর অন্তরের দহন ও জ্বলন তা তো আমি দেখিনি! আমি শুধু শুনেছি তাঁর জারজার কান্না, আর দেখেছি অঝোরধারে অশ্রু ঝরা! হে আল্লাহ, অক্ষম এক দর্শক হিসাবে আমিও সেই কান্নার, সেই অশ্রুনিবেদনের এবং সেই চাওয়া-পাওয়ার সামান্য কিছু হকদার! তোমার পেয়ারা হাবীব যে বলেছেন-
‘এরা তো এমন কাউম যাদের কাছে বসে থাকা মানুষও কখনো বঞ্চিত হয় না।’
তোমার সেই আশিক বান্দার কাছে আমি তো বসে ছিলাম হে আল্লাহ!
আরাফার ময়দানে সেদিন আমি আল্লাহর অন্য এক বান্দাকেও দেখেছিলাম! তিনিও এখন নেই দুনিয়ার বুকে। কাকরাইলের বড় হুযূর হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয ছাহেব (রহ)। মক্কা শরীফে তিনি আমাদের হযরতের অবস্থানক্ষেত্রে এসেছিলেন এবং কিছু সময় তাঁর সঙ্গে যাপন করেছিলেন। এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁকে প্রথম দেখে আমার অন্তরে যে কথাটি জাগ্রত হয়েছিলো! ‘যেন এই মাত্র জান্নাত থেকে নেমে এসেছেন জান্নাতি লেবাসে!’
আববাকে তিনি খুব মুহাববাত করতেন। আমাদের বাড়ীতেও এসেছেন একাধিকবার! আমি আববার পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে মুছাফাহা করেছিলাম। তিনি সস্নেহ আচরণ করেছিলেন এবং দু‘আ দিয়েছিলেন। তাঁর একটা কথা এখনো কানে বাজে, বলেছিলেন, ‘মিয়াঁ হজ্ব তো করবা তোমরা নওজোয়ানেরা! আমরা বুড়ারা তো শুধু আসি, আর হাযিরা দিয়ে যাই! আমি একটা উত্তর দিয়েছিলাম, তাতে তিনি এবং হযরত হাফেজ্জি হুযূর হেসেছিলেন, মৃদু হাসির চেয়ে একটু বেশী! আমি বলেছিলাম, হযরত! আপনাদের বার্ধক্যের সঙ্গে আমাদের জোয়ানি আমি বদল করতে তৈয়ার আছি এবং তাতে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।
যতক্ষণ ছিলেন হযরত হাফেজ্জি হুযূরের সামনে তিনি দু’যানু হয়ে বসেছিলেন যেন মক্তবের শিশু! হযরতকে সম্বোধন করে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে দাওয়াত ও তাবলীগের টুটাফাটা যা কিছু মেহনত ‘চলতেছে’ তা তো শুধু আপনার নেক তাওয়াজ্জুহের বরকত।
হযরত বলেছিলেন, ‘বহুত মোবারক মেহনত। তবে ‘গুলু’ হইতে বাচন চাই।’
হযরতের কামরা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি আমার হাত ধরে রেখেছিলেন, তাই আমি তাঁর সঙ্গে হাঁটছিলাম। তখন স্নেহ-মমতার অপূর্ব একটি প্রবাহ অনুভব করছিলাম, আর শিহরিত হচ্ছিলাম। আববাকে যারা ভালোবাসতেন, আববার পরিচয়ে তারা আমাকে স্নেহ করতেন। সেই সূত্রে দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষে আমি তাঁর স্নেহ লাভ করেছি। কিন্তু হজ্বের সফরে সবকিছু যেন অন্যরকম। কিছু কিছু মানুষ যেন তখন মাটির পরিবর্তে নূরের মানুষ হয়ে যায়! হয়ত তাঁদেরই বরকতে মাটির মানুষগুলোরও হজ্ব কবুল হয়ে যায়।
বড় হুযূর আমার হাত ‘বগলদাবা’ করে হাঁটছিলেন, কোন কথা নেই, শুধু নীরবে হাঁটা। আমি তখন রীতিমত ঘামতে শুরু করেছি। এ অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম! হঠাৎ তিনি বললেন, ‘তুমি তো হযরতের নাতিন জামাই হয়েছো, না! এই নাও শাদির মুখতাছার হাদিয়া!’ এই বলে তিনি দশটি রিয়াল আমার হাতে গুঁজে দিলেন। আমি তো থ! কী বলা উচিত! কী করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। তিনি বুঝতে দিলেনও না। সালাম দিয়ে আগে বেড়ে গেলেন! আমি নিশ্চল অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলাম এবং তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পরে হযরতকে ঘটনা জানালাম। তিনি কৌতুক করে চলতি আরবীতে বললেন, ‘মালেশ’, এটা বরকতের পঁয়সা। মুশাক্কাল খাবে, আমাকেও খাওয়াবে!
তাই করেছিলাম। সেই বরকতের পঁয়সা দিয়ে মুশাক্কাল খেয়েছিলাম, হযরতকেও খাইয়েছিলাম। হযরত যখনই মুশাক্কাল খেতেন, শেষটুকু আমাকে দিয়ে বলতেন এটুকু তুমি খেয়ে নাও। আমি খেতাম এবং বিশ্বাস করো ভাই, তাতে অন্যকিছু একটা স্বাদ যেন আমি অনুভব করতাম! একদিনের কথা মনে পড়ে, হজ্বের পরে হযরতকে হুইল চেয়ারে করে হারাম শরীফে নিয়ে যাচ্ছি, বাক্কালার সামনে এসে আমি বললাম হযরত মুশাক্কাল নিয়ে আসি! আমার কাছে ছিলো শুধু একটি রিয়াল। তাই একটি কৌটা এনে হযরতকে দিলাম। হযরত পরোক্ষ দৃষ্টিতে আমার হাতের দিকে তাকালেন, তারপর পকেট থেকে পঞ্চাশ রিয়াল বের করে বললেন, তোমার জন্যও আনো। আমি আনলাম এবং বাকি টাকা ফেরত দিতে চাইলাম। হযরত বললেন, এটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি বুঝলাম, তবু, ‘কৌতুক’ করে বললাম, হযরত! এটা কি আমানত! তিনি তাঁর সেই চিরপরিচিত হাসিটি উপহার দিয়ে বললেন,‘মুহাববাত কি আলামাত’!
হজ্বের সফরে হযরতের ‘ছোহবত’ ও সঙ্গ এমনই আশ্চর্য মধুর হয়েছিলো আমার জন্য! হায়, আবার যদি ফিরে আসতো সেই দিনগুলো, এমনকি জীবনের সবগুলো দিনের বিনিময়ে!
স্মৃতির তরঙ্গপ্রবাহে কোত্থেকে কোথায় চলে গিয়েছি! ফিরে আসি বড় হুযূরের প্রসঙ্গে। মক্কা শরীফে সেই একবার দেখেছিলাম বড় হুযূরকে, দ্বিতীয়বার দেখলাম আরাফার মাঠে। আমরা যে তাঁবুতে উঠেছিলাম তিনি অবস্থান করছিলেন তার পাশের তাঁবুতে।
আরাফার মাঠে তাঁকে দেখেছিলাম অন্য এক রূপে! যেন ‘প্রতিটি ফুলের রয়েছে আলাদা রঙ-সুবাস’-এর জীবন্ত ব্যাখ্যা!
একটা রুমাল ঢাকা হয়ে তাঁবুর এক কোণে তিনি বসেছিলেন। যেন সবার নযর বাঁচিয়ে পর্দার আড়ালে অভিসার! হঠাৎ হঠাৎ করে ভেসে আসছিলো কান্নার আওয়ায! এমন দৃশ্য আর দেখিনি কখনো! আরাফার ময়দানে তাঁর কাছে দু‘আ চাওয়ার বড় ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু রুমালের আড়াল থেকে তিনি বেরই হলেন না! তাই শুধু মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ! তোমার কাছে তোমার এ পেয়ারা বান্দার চাওয়া ও পাওয়ায় আমাকেও শামিল করো।
কিছুটা দূরে জাবালে রাহমাত দেখা যাচ্ছে! ইহরামের সাদা লেবাসে পুরো পাহাড় শুভ্র-সফেদ অপরূপ এক সাজ ধারণ করেছে, যেন রহমতের সাজ! প্রতিবছর এই দিনে একবার করে এ অপরূপ সাজ ধারণ করে জাবালে রাহমাত। এই পাহাড়ের পাদদেশেই তো সেই দূর অতীতে আজকের এই দিনে
ছাহাবা কেরাম জমায়েত হয়েছিলেন এবং আল্লাহর নবী তাঁদের সঙ্গে বিদায় হজ্বের অকূফ করেছিলেন। ‘বিদায় হজ্ব’! কত সহজ শব্দ! কিন্তু কত বেদনাদায়ক তার মর্ম! কার বিদায়! উম্মতকে দুনিয়ায় রেখে উম্মতের পেয়ারা নবীর বিদায়! বিদায় হজ্বের সবকিছুতেই ছিলো বিদায়ের সুর! এই আরাফা মাঠেই আল্লাহর নবী
ছাহাবা কেরামকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, আচ্ছা, আমি কি আমার রবের বাণী পৌঁছে দিয়েছি?
লক্ষ কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠেছিলো, অবশ্যই আপনি পৌঁছে দিয়েছেন ইয়া রাসূলাল্লাহ!
পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাঁর পবিত্র শাহাদাত আঙ্গুলি আসমানের দিকে তুলে আবেগময় কণ্ঠে বলেছিলেন, হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন! হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন!
কেমন ছিলো আরাফার আজকের দিনের সেই নূরানি মাজমার দৃশ্য!
আল্লাহর নবীর হজ্ব দেখেছেন ছাহাবা কেরাম। তাঁরা যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তার পূর্ণ বিবরণ রেখে গেছেন পরবর্তীদের জন্য, আমাদের জন্য। তাঁরা বলেছেন-
যখন সূর্য ঢলে পড়লো তখন তিনি রওয়ানা হলেন এবং বাতনুল ওয়াদিতে উপনীত হয়ে উটনীর উপর সওয়ার অবস্থায় লোকদের উদ্দেশ্যে এক মহান খোতবা দান করলেন। তারপর বিলালকে আদেশ করলেন, আর বিলাল আযান দিলেন। অনন্তর তিনি দু’রাকাত যোহর এবং দু’রাকাত আছর আদায় করলেন। একত্রিত উভয় নামায থেকে ফারিগ হয়ে তিনি কাছওয়া উটনীতে আরোহণ করলেন এবং মাওকিফে তাশরীফ আনলেন এবং কিবলামুখী হয়ে অকূফ করলেন। তাঁর মাওকিফ বা অবস্থানক্ষেত্র ছিলো জাবালে রাহমাতের পাদদেশে প্রস্তরখন্ডগুলোর নিকটে। অকূফের সময় তিনি দু‘আ-মুনাজাত ও সকাতর কান্নায় নিমগ্ন ছিলেন।
কী কী দু‘আ তিনি করেছেন মাওলার দরবারে, তার বিশদ বিবরণ এসেছে ছাহাবা কেরামের যবানে। আল্লাহর নবী আরাফার ময়দানে তাঁর উম্মতের সমস্ত গোনাহের জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফিরাতের দু‘আ করেছেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তা কবুল করেছেন, কিন্তু যালিমের জন্য মাগফিরাতের দু‘আ কবুল করেন নি। কেউ যদি কারো উপর যুলুম করে, কেউ যদি কারো হক নষ্ট করে, তা মাফ হবে না যতক্ষণ না মাযলূম নিজে তা মাফ করে দেয়।
কিন্তু উম্মতের দরদে দরদী নবী কি উম্মতের পূর্ণ মাগফিরাত ছাড়া শান্তি পেতে পারেন! আর আল্লাহ তা‘আলা কি পারেন তাঁর পেয়ারা হাবীবের আব্দার রক্ষা না করে!
মুযদালিফার রাতে আল্লাহর নবী আবার দু‘আ করলেন। আল্লাহর কাছে তিনি এই বলে আব্দার জানালেন, আয় রাবব, আপনি তো মাযলূমকে আপনার পক্ষ হতে খুশী করে দিতে পারেন এবং যালিমকে মাফ করে দিতে পারেন! উম্মতের জন্য পেয়ারা হাবীবের কত পেয়ারা আব্দার! এমনকি যালিম উম্মতির জন্যও ছিলো তাঁর কত দরদ-ব্যথা!
অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পেয়ারা হাবীবের এ দু‘আও কবুল করলেন এবং বললেন, আপনি শান্ত হোন হে নবী! আপনি আনন্দিত হোন হে রাসূল! আপনার উম্মতের যালিমকেও আমি মাফ করে দেবো (যদি সে অনুতপ্ত হয়ে মাফ চায়), আর মাযলূমকে আমি নিজের পক্ষ হতে খুশী করে দেবো।
জাবালে রাহমাত এখন আবছা হয়ে এসেছে। আমাদের হযরত তখনো সেই সিজদায়! সূর্য প্রায় অস্ত যাওয়ার সময় তিনি সিজদা থেকে মাথা উঠালেন। যেন অনেক দূরের অন্য কোন জগত থেকে ফিরে এলেন! আহ, তুমি যদি দেখতে তখন আমাদের হযরতকে! দীর্ঘ এক সিজদার মাধ্যমে ইশক ও মুহাববাতের রহস্যময় জগত থেকে ভ্রমণ করে আসা আমাদের হযরতকে! কী নূরঝলমল চেহারা! কী আলোকিত অভিব্যক্তি! সমগ্র মুখমন্ডলজুড়ে পরম মিলনের এবং পরম প্রাপ্তির কী অপূর্ব উদ্ভাস!
আরাফার দিনে সূর্যাস্তের সময় আল্লাহর পেয়ারা নবীর পবিত্র মুখমন্ডলের উদ্ভাস কেমন ছিলো তার সামান্য ছায়া, সামান্য আভাস তুমি যদি বুঝতে চাও তাহলে তোমাকে দেখতে হবে তোমার যুগে আরাফার ময়দানে আল্লাহর কোন নেক বান্দার চেহারা! সেই পবিত্র উদ্ভাসেরই ছায়া পড়েছিলো যুগে যুগে হাসান বাছরী, জোনায়দ-জীলানী এবং আল্লাহর অসংখ্য নেক বান্দার চেহারায়! যুগের ব্যবধান যত দূরবর্তী হোক, এখনো তুমি দেখতে পাবে তা, অবশ্য তুমি যদি দেখতে চাও। আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, সেই ছায়া সেদিন আল্লাহ আমাদের দেখিয়েছেন আমাদের হযরতের নূরঝলমল চেহারায়!
আমার বুক দুরু দুরু করছিলো, তবু একটু একটু করে সাহস সঞ্চয় করলাম। হযরতের একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখে আসে আসে করেও যেন আসে না। কারণ, জানি না, কিছু বলার এটা উপযুক্ত সময় কি না! হযরত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি কি তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা দেখতে পেলাম! নাকি এটা নূরের কোন উদ্ভাস! জানি না, তবে তাঁর চোখের মমতাপূর্ণ দৃষ্টিতে আমি প্রশ্রয়ের আভাস পেলাম। আমার সাহস এবার চূড়ান্ত হলো। আমি হযরতের আরো কাছে এসে একেবারে কানের কাছে মুখ এনে বললাম, হযরত! দু‘আ করুন, আল্লাহ যেন দ্বীনের এবং আরবীভাষার খেদমতের জন্য আমাকে কবুল করেন, আমার কলমকে যেন আল্লাহ শক্তি দান করেন। আমি নিজে তো আল্লাহর কাছে অনেক চেয়েছি, তবু আজকের এ সুযোগটি আমি হারাতে চাই না। আপনি খাছাভাবে আমার জন্য দু‘আ করুন।
হযরত হাসলেন তাঁর চিরকালের সেই মৃদু-মধুর সেই হাসি এবং বললেন-تقبل الله منك তুমভি কাহো-
ربنا تقبل منا انك انت السميع العليم
আমি বললাম এবং অন্তরের পরতে পরতে আশ্চর্য এক প্রশান্তি অনুভব করলাম।
হযরত বললেন, ভাই! আমি তো তোমার জন্য, তোমার বিবির জন্য, তোমাদের বাচ্চীর জন্য অনেক দু‘আ করেছি।
সূর্য অস্ত গেলো। সূর্য যতবার উদিত হবে ততবার অস্ত যাবে, দিনটি তোমার জন্য আনন্দের হোক, কিংবা বেদনার। কিন্তু আজকের সূর্যাস্ত কি সামান্য একটি সূর্যের সাধারণ কোন অস্ত যাওয়া! কত স্বপ্ন ছিলো আমার হৃদয়ে আজকের এই পবিত্র দিনটিকে কেন্দ্র করে! কত ব্যাকুলতা ছিলো! কত অস্থির প্রতীক্ষা ছিলো! কত আশা ও প্রত্যাশা ছিলো! আমার জীবনে আজ সেই স্বপ্নের সেই আশা ও প্রত্যাশার সূর্য উদিত হয়েছিলো এবং সেই সূর্য এই মাত্র অস্ত গেলো। আরাফার পবিত্র দিনটি আমার জীবনে এসেছিলো আমাকে নূরের স্নানে স্নাত করার জন্য, আমাকে ‘আলইয়াওমা আকমালতু লাকুম’-এর সেই নূরানি কাফিলায় শামিল করার জন্য এবং এভাবে আমাকে আমার রবের একান্ত সান্নিধ্য দান করার জন্য। মহাসৌভাগ্যের সেই পবিত্র দিনটি এই মাত্র গত হলো। আমি গাফিল ছিলাম, হয়ত গাফলাতের মাঝেই থেকে গেলাম। কারণ আজকের মহাসৌভাগ্যের দিনেও আমার ঘুম পেয়েছিলো। জাবালে রাহমাতের ময়দানেও আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই যে কবি বলেছেন, ‘অভাগী কী ঘুম পেয়েছিলো তোরে!’
কেউ আমাকে জাগায়নি। আজকের দিনে কে কাকে জাগাবে! সবাই তো মশগুল নিজ নিজ চিন্তায়, নিজ নিজ সওদায়! সবাইকে আজ চাইতে হবে এবং পেতে হবে। তোমার চাওয়া তোমাকেই চাইতে হবে এবং তোমার পাওয়া তোমাকেই পেতে হবে। সুতরাং তুমি যদি ঘুমিয়ে পড়ো, কে তোমাকে জাগাবে!
কিন্তু আমি পেয়েছিলাম একটি কোমল হাতের মধুর স্পর্শ, মায়ের কোমল হাতের মমতার স্পর্শ যেমন হয়! যে স্পর্শ
সন্তানকে ঘুম থেকে জাগায় না, আরো ‘আদুরে’ বানায়, আরো নিদ্রামগ্ন করে! আমারও তাই হলো, আমার নিদ্রার আবেশ আরো গাঢ় হলো। তবে আমার ঘুম ভাঙ্গলো, সেই কোমল স্পর্শের সঙ্গে যখন একটি কোমল ডাক কানে এলো। আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার হযরত আমাকে ডাকছেন- ‘থাক গায়ে হো! উট্ঠো! জাগো! ওয়াক্ত গুযার রাহা হায়!
(ক্লান্ত হয়ে পড়েছো! ওঠো, জাগো; সময় তো চলে যায়!)
আমার মনে হয়, এ ঘুমের মাঝেও আমার জন্য কিছু প্রাপ্তি ছিলো। ঘুম না হলে কি পেতাম এ কোমল স্পর্শ! এ কোমল ডাক! ঘুম না হলে কি দেখতাম আরাফার ময়দানে আমার হযরতের মাতৃমমতার এ অপূর্ব রূপ!
ইনি তো আল্লাহর নবীর ওয়ারিছ! ইনি সে যুগেও ছিলেন এ যুগেও আছেন, আগামী যুগেও থাকবেন। আর আল্লাহর নবীর ওয়ারিছ যারা তাদের দিলে থাকে উম্মতের প্রতি নবীওয়ালা দরদের কিছু না কিছু হিস্সা। তারা শুধু নিজের কথা ভাবেন না। তারা শুধু নিজের প্রাপ্তির চিন্তায় মশগুল থাকেন না। তাদের দরদী দিলে অন্যের কথাও জাগরূক থাকে। তাদের চোখ থেকে অন্যের জন্যও অশ্রু ঝরে। তারা নিজেরা যেমন জাগ্রত থাকেন, তেমনি ঘুমিয়ে থাকা গাফিলদেরও জাগাতে চেষ্টা করেন, দরদের সাথে, কোমলতা ও মমতার সাথে।
হে বন্ধু! গাফলতের যিন্দেগিতে কখনো তুমি যদি পাও এমন কোমল স্পর্শ এবং এমন মমতাপূর্ণ ডাক তাহলে সেই স্পর্শকে সম্মান করো, সেই ডাকে সাড়া দিও এবং জেগে ওঠার চেষ্টা করো।
পাকিস্তানী হাজীরদের দেখলাম, পরস্পর মোবারকবাদ বিনিময় করছে, হজ্বে মাবরূক, হজ্বে মাবরূর বলে। সবার চোখে-মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস। আরাফার ময়দান আসলেই তো একজন মুসলিমের নবজন্ম লাভের ক্ষেত্র। আরাফার অকূফের মাধ্যমে এখন সে ‘হাজী’ হয়ে গেলো। হজ্বের এই বিরাট মুজাহাদাপূর্ণ ইবাদতের মাধ্যমে সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেলো যে দিন তার মা তাকে জন্মদান করেছে। সুতরাং নবজন্ম লাভের আনন্দ খুবই স্বাভাবিক।
সেদিন সূর্য অস্ত যায় যায়, এমন সময় হযরত হাফেজ্জি হুযূর আমাকে যা বলেছিলেন, হয়ত আমি তা রক্ষা করতে পারিনি, তবু মনে হয়, হে প্রিয় পাঠক! তোমাকে তা জানানো দরকার, যাতে তুমি অন্তত আমল করতে পারো এবং তোমার আমলের ওছিলায় আল্লাহ তা‘আলা আমার বে-আমলি মাফ করে দেন। তিনি বলেছিলেন, মিয়াঁ আবু তাহের! এখন তুমি নতুন মানুষ; এখন তুমি হাজী আবু তাহের! হাদীছের খোশখবর অনুযায়ী হজ্বের মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকে নিষ্পাপ করে দিয়েছেন। এখন তোমার কর্তব্য হলো, হজ্বের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা এই যে এত বড় নেয়ামত দান করেছেন তার কদর করা। সারা যিন্দেগি ভর চেষ্টা করবা কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার এবং তাওবা ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেকে পাকছাফ রাখার।
এই আরাফার ময়দানে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব উম্মতের কাঁধে দ্বীনের আমানত রেখে গেছেন। আজ আরাফার ময়দানে হাযির হয়ে তুমিও এই নবুওয়তি আমানতের ‘হামিল’ হয়ে গেছো। সুতরাং এখান থেকে এই ‘আযম’ নিয়ে রওয়ানা হও যে, তোমার সারা যিন্দেগি তুমি আল্লাহর দ্বীনের জন্য ওয়াকফ করে দেবে। তা না হলে হজ্ব হয়ে যাবে শুধু রসমি হজ্ব।
হযরতের প্রতিটি কথা আমি আমার সমগ্র সত্তা দিয়ে গ্রহণ করার চেষ্টা করলাম এবং ভিতরে বিরাট এক আলোড়ন ও তোলপাড় অনুভব করলাম। এর মধ্যে হযরত বললেন, ‘তুমি তো আগেই আমার হাতে বাই‘আত হয়েছো; আজ নতুন করে বাই‘আত হও, বাইআত আলাল জিহাদ হাত্তাল মামাত।’
আসমান থেকে নেমে আসা সৌভাগ্যের হাতছানি মনে করে সঙ্গে সঙ্গে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। হযরত আমাকে বাই‘আত করালেন। তাঁর বলে দেয়া কথাগুলো আমি উচ্চারণ করে যাচ্ছিলাম। একটি একটি শব্দ যেন অন্তরসমুদ্রে এক একটি ঢেউ সৃষ্টি করছিলো। আমার কলবের জাহানে যেন নতুন এক ইনকিলাব পয়দা হলো; হৃদয়ের জগতে সৃষ্টি হলো নতুন এক বিপ্লব। যে জ্যোতির্ময়তা, যে নূরানিয়াত এবং তাজাল্লিয়াতের যে তরঙ্গপ্রবাহ হযরতের হাতধরা অবস্থায় সেদিন আমার অর্ন্তসত্তায় অনুভব করেছিলাম, হায় যদি আজো তা প্রবাহমান থাকতো, অন্তত তার একটি ক্ষীণ ধারা! সব কিছু কোথায় হারিয়ে গেলো! কিন্তু হে আল্লাহ আমি তোমার রহমত থেকে নিরাশ নই। তুমি আবার দিতে পারো এবং আরো বেশী দিতে পারো। তুমি দিলে বাধা দেয়ার কেউ নেই। তুমি বাধা দিলে দেয়ার কেউ নেই।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)