শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

উ ম্মা হ : মোড়লের নতুন খায়েশ

খসরূ খান

২০০১-এর এগারই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আফগানিস্তানে সন্ত্রাস দমনের নামে হামলা চালায় মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনী। আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের মার্কিনী পলিসির সঙ্গে ঐকমত্য ঘোষণাকারী যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের সৈন্যদের অংশগ্রহণে তৈরি মিত্র বাহিনীর আগ্রাসী হামলা আকাশ ও স্থলপথে এক সঙ্গে রচিত হয়। এ হামলায় তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুতুল কারজাই সরকারকে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসানো হয়। আফগানিস্তান দখলের এ যুদ্ধের নাম দেওয়া হয়-সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ। সন্ত্রাস বিরোধী এ যুদ্ধে গোড়া থেকেই সহযোগিতা করে যায় প্রতিবেশী পারমাণবিক বোমার অধিকারী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সদ্য বিদায়ী সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। মার্কিন জোটের কাছে আত্মসমর্পণ করায় তখন

মোশাররফকে বরণ করা হয় সন্ত্রাসী বিরোধী যুদ্ধের অন্যতম মিত্র বা সহযোগী হিসেবে। মোশাররফ একজন সামরিক শাসক হওয়া সত্ত্বেও এ কারণেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী মার্কিনী প্রশাসন তার দীর্ঘ মেয়াদের দুঃশাসন ও বিদায় বেলার বেকায়দা অবস্থায় তাকে রক্ষা ও সহযোগিতা দিয়ে আসে। আগ্রাসন বিরোধী পাক জনগণের তীব্র ক্ষোভ ও অনাস্থার মুখে সেসব সহযোগিতা মোশাররফের মসনদ রক্ষায় কোনো ফল দেয়নি। মোশাররফ বিদায় নেন এবং সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পর্যায়ক্রমে পিপিপির ইউসুফ রাজা গিলানী প্রধানমন্ত্রী ও আসিফ আলী জারদারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। অপরদিকে মুসলিম লীগের (নওয়াজ) প্রধান নওয়াজ শরীফ পিপিপি সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণের কথা ঘোষণা দেন।

পাকিস্তানে মার্কিনীদের উপর নির্ভরশীল জনবিচ্ছিন্ন একনায়ক সরকারের পতন ও নির্বাচিত সরকারের এই যাত্রার সূচনাতেই মার্কিনীদের পক্ষ থেকে শুরু হয় উস্কানিমূলক ও বর্বর কিছু আচরণ। একের পর এক আফগান-পাক সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসা মার্কিন বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিরীহ নাগরিককে হত্যা করার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই এ ধরনের হামলা চালানো হতে থাকে। সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে চালানো হয় এ সময়ের সবচেয়ে বড় ধরনের হামলা। উত্তর

ওয়াজিরিস্তানের মিরণ শাহের কাছে এক মাদরাসায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে নারী-শিশুসহ নিরীহ ১৬ জন নাগরিককে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম এক সপ্তাহেই মোট চারটি হামলায় নিরীহ গ্রামবাসী  পাক নাগরিক নিহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক। পাক সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের হামলার কঠোর প্রতিবাদ জানানো হলেও আফগানিস্তানে মোতায়েন মার্কিন বাহিনী তাতে কর্ণপাতই করেনি। উল্টো কোনো কোনো মার্কিন কর্মকর্তা সন্ত্রাসীদের সন্ধান পেলে যে কোনো রাষ্ট্রের ভেতরে গিয়ে হামলা চালাতে মার্কিনীদের কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করেন। আলকায়েদা বা তালেবান সদস্যদের নিধনের স্বঘোষিত বৈধ মিশনের অংশ হিসেবেই পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের বর্বর হামলা চালানো হয়েছে বলে কোনো কোনো সূত্র উল্লেখ করেছে। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ এ ধরনের হামলা এ অঞ্চলে বড় ধরনের কোনো সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়ার পূর্বপ্রস্ত্ততি কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় সীমান্ত অঞ্চলসহ গোটা

পাকিস্তানেই মার্কিন বিরোধী ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের

অভ্যন্তরে অন্য কোনো দেশের যে কোনো ধরনের সামরিক অভিযান চালানো

আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন হলেও বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেসবের তোয়াক্কা না করে আলকায়েদা দমনের অজুহাতে

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একের পর এক নতুন নতুন বর্বর অধ্যায় রচনা করে যাচ্ছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বর্তমান পাক সেনাপ্রধান আশরাফ কিয়ানী বহিরাগত যে কোনো সামরিক অভিযান মোকাবেলা করে দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গিলানী সেনাপ্রধানের ওই বক্তব্যকে সরকারের অবস্থানেরই প্রতিচ্ছবি হিসেবে ঘোষণা করেন। এরকম পরিস্থিতিতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে পাকসেনাদের গুলির মুখে আক্রমনোদ্যত মার্কিন বাহিনীর পিছু হটার ঘটনা ঘটে। সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত পার হয়ে অনুপ্রবেশের এক মার্কিন চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে।

মোশাররফ বিহীন পাকিস্তানের এই ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনায় কিছুটা থমকে যায় মার্কিন প্রশাসন। তাই কৌশল পরিবর্তন করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান এডমিরাল মাইকেল মুলেন এক অঘোষিত সফরে ইসলামাবাদে পৌঁছেন। এর মধ্যেই তিনি

আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় মার্কিন ও পাক সামরিক অভিযান প্রসঙ্গে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কিয়ানীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। মুলেন কোন্ কৌশলী বার্তা চালাচালির জন্য

পাকিস্তানে ছুটে এসেছেন তা এখনও প্রকাশ না হলেও পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল আতহার আববাসের একটি সাহসী বক্তব্য মুলেনের আলোচনার প্রাক্কালেই মিডিয়ায় চলে এসেছে। তিনি বলেছেন, সীমান্ত রক্ষায় পাকিস্তানের নীতি পরিষ্কার। তিনি আরো বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি আমাদের ভূখন্ড আমরা রক্ষা করব এবং যে কোনো রকম আগ্রাসনের মুখে আমাদের প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার রয়েছে।

আফগানিস্তান এখন আগ্রাসী ও দখলদার মার্কিন সৈনিকদের ঘাঁটি। সেখান থেকে নতুন করে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে সন্ত্রাসীদের নিধন করার অজুহাতে হামলা চালানো এবং মসজিদ-মাদরাসা কমপ্লেক্সে নিরীহ নাগরিকদের হত্যার এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থানকে বিলম্বে হলেও সময়োচিত ও সাহসী বলে আখ্যায়িত করতে চাই এবং একই সঙ্গে এ ইস্যুটিকে কেবল

পাকিস্তানের ইস্যু মনে করে অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি সরিয়ে রাখার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। যে মোড়ল রাষ্ট্রটির চোখে ইসলাম ও মুসলমানের প্রতীক মানেই সন্ত্রাসের প্রতীক, সে রাষ্ট্রকে যদি সন্ত্রাসী ধরার অজুহাতে যে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে অভিযান চালানোর মৌন সম্মতি জানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কোনো মুসলিম দেশেরই সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবে না। এ ধরনের বর্বর হামলার বিষয়টিকে আমরা ওআইসি ও জাতিসংঘের জরুরি পদক্ষেপের ইস্যু বলে মনে করি। সর্বোপরি এ ধরনের ক্ষেত্রে সব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নৈতিক, পদ্ধতিগত, সামাজিক ও সামরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করি। 

 

 

advertisement