প্রাণের আগমন ও পরিচর্যায় নারীর ভূমিকা
পৃথিবীতে একটি শিশুর আগমনে নারীর যে ভূমিকা তা তো অতি স্পষ্ট। সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব, দুগ্ধদান ইত্যাদি সবগুলো পর্যায়ে নারী একক ভূমিকা পালন করে। এ সময় একজন নারীকে অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সাধারণ গৃহস্থালী কাজকর্মে পর্যন্ত অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই নাযুক মুহূর্তে নারীর দায়িত্বও অনেক বেড়ে যায়। গর্ভস্থিত সন্তানের যথাযথ দৈহিক ও মানসিক গঠনের জন্য মাকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। মায়ের এসময়ের চিন্তা-ভাবনা, কাজ-কর্ম ওআচরণের গভীর প্রভাব গর্ভের সন্তানের উপর পড়ে। সকল যুগের অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ এ সময় মাকে অতি সংযত জীবন যাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ইউরোপে বহু মানুষের আচার-আচরণ, মেজাজ-মর্জির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে মায়ের এসময়ের আচরণই এখানে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। ফ্রান্সে এক সাদা দম্পতির কালো সন্তান জন্মগ্রহণ করলে চিকিৎসকগণ খুব আশ্চর্য হলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সন্তান মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মায়ের সম্মুখস্থ টেবিলে একটি কালো হাবশীর মূর্তি ছিল। মূর্তিটি মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে তার চিন্তাভবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ফলে সন্তান পিতামাতার মতো না হয়ে সেই মূর্তির মতোই হয়েছে। -মুসলমান আওরাত, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ২১
যখন সন্তান প্রসবের সময় আসে তখন নারী মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। সন্তান প্রসবের পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার মধ্যে তার সময় কাটে। এ সময় তার প্রয়োজন হয় বিশেষ পরিচর্যার। সন্তানকে দুগ্ধদানের সময়টিও মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর পরিচর্যার বিষয়টি তো আছেই এসময়ে মায়েরও বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। মাতৃদুগ্ধের মধ্য দিয়ে শিশু মায়ের অনেক কিছুই এ সময় গ্রহণ করে। এজন্য মাকে পূর্ণ সংযম ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
সন্তানের জীবন গঠনে নারী
একটি সুন্দর শিল্পকর্ম দর্শককে আনন্দ দেয়। সবাই এর কারিগরের প্রশংসা করে। কেননা, এতে তার শিল্পী মনের আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে। আছে সৃজনশীলতার স্পর্শ। কারিগর তার মনের মাধুরী মিশিয়ে সামান্য একটি মূল্যহীন মাটির টুকরোকে একটি মূল্যবান শিল্পকর্মে পরিণত করেছে। তার আন্তরিকতা, অধ্যবসায় আর অটুট মনোযোগের কারণে শিল্পকর্মটি সুন্দর ও মনোরম হয়েছে।
একজন সুন্দর ও পরিণত মানুষ নির্মাণের জন্য আরো অনেক বেশি যত্ন, আন্তরিকতা ও অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন। পাশাপাশি পিতা-মাতার আচরণ, ঘরের পরিবেশ এসবও সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও অভ্যাস গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। শিশু অর শৈশবে যেহেতু পুরোপুরি মায়ের সান্নিধ্যেই থাকে; তাই মায়ের আচার-আচরণ, ভাব-ভঙ্গি, ভাষা-অভ্যাস সব কিছুই শিশুরা অনুকরণ করার চেষ্ট করে। একজন ভালো মা-ই সমাজকে একজন ভালো মানুষ উপহার দিতে পারেন।
এজন্য মায়ের দায়িত্ব অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অতি নাযুক। সন্তানকে ভালো ও পরিণত মানুষরূপে গড়ে তোলার জন্য যেমন মায়ের নিজের ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ অপরিহার্য, তেমনি সন্তানের জন্য একটি ভদ্র ও শালীন পরিবেশ নিশ্চিত করাও মায়ের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। ঘরের পরিবেশ যদি আল্লাহমুখিতার নূরে নুরান্বিত হয় নামায, তেলাওয়াত, তালীম, যিকির-আযকার, সুন্নতের পাবন্দী ইত্যাদিতে বরকতপূর্ণ হয় তবে তার প্রভাব শিশুর কচি মানসে না পড়ে পারে না। শিশুও তখন আল্লাহ-ভীরুতা আর ইবাদত-বন্দেগীর প্রেরণা নিয়েই বেড়ে উঠবে। ঘরের পরিবেশে যদি সত্যবাদিতা, সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, মায়া-মমতা, ভদ্রতা ও নম্রতার প্রকাশ থাকে তবে সবার অজান্তেই শিশু ওইসব মহৎ গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হতে থাকবে। এজন্যই ইসলামী শরীয়তে পুরুষের প্রতি সন্তানের জন্য দ্বীনদার মা নির্বাচনের তাগিদপূর্ণ আদেশ করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাহেচ্ছু ‘নারীকে চারটি বৈশিষ্ট্যের কারণে বিবাহ করা হয়- সম্পদের কারণে, আভিজাত্যের কারণে, সৌন্দর্যের কারণে, আর দ্বীনদারীর কারণে, তবে তুমি যেন দ্বীনদার স্ত্রী লাভেই সমর্থ হও।’ -সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম -মেশকাত ২৬৭
দ্বীনদার স্ত্রী লাভের প্রতি পুরুষকে উদ্বুদ্ধ করার মূল কারণ দু’টি; প্রথমত এতে পুরুষের জন্যও দ্বীনের পথে অগ্রগামী হওয়া সহজ হবে। দ্বিতীয়ত দ্বীনদার মা থেকে দ্বীনদার সন্তান জন্মলাভ করবে।