শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

এখন থেকেই যত্নবান হোন

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

আমি একজন তালিবে ইলম। আল্লাহ তাআলা আমাকে তালিবে ইলম হিসেবেই জীবিত রাখুন। এই হালতেই যেন আমার মৃত্যু আসে এবং ইলমে নবুওয়তের তালিবদের সঙ্গেই যেন আমার হাশর হয়।

খুব সহজেই বলে ফেললাম যে, আমি একজন তালিবে ইলম, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন এবং সঠিক অর্থে তালিবে ইলম হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

একজন তালিবে ইলম হওয়ার সুবাদে আমি আমার তালিবে ইলম ভাইদের খিদমতে নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শুধু একটি আবেদন করতে চাই। তা এই যে, তারা যেন কিছু বিষয়ে এখন থেকেই যত্নবান হন। এই বিষয়গুলো অনতিবিলম্বে করণীয়, যাতে বিলম্ব করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি যে শ্রেণীরই তালিবে ইলম হন না কেন এবং যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন এ বিষয়গুলোর প্রতি এখন থেকেই মনোযোগী হওয়া আপনার কর্তব্য।

১. নিযামুল আওকাত

প্রতি ফাতরার (সেমিস্টার) জন্য আলাদা নিযামুল আওকাত থাকা উচিত। চবিবশ ঘন্টার পুরো সময় নিযামুল আওকাত-এর অধীনে নিয়ে আসুন। উত্তম হল, নিযামুল আওকাত তালীমী মুরববীকে দেখিয়ে সংশোধন করে নেওয়া। এরপর গুরুত্বের সঙ্গে তা অনুসরণ করা। প্রতি যুগের দরদী উস্তাদগণ তাদের ছাত্রদেরকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন এবং ছাত্ররাও গুরুত্বের সঙ্গে তা অনুসরণ করেছেন।

পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল ব্যবহার ছাড়া সময়ে বরকত হয় না। আর এটা ছাড়া সময়ের অপচয়ের ব্যাধি থেকে পরিত্রাণও পাওয়া যায় না। যার কাজকর্মের সময়সূচি নির্ধারিত নেই তার সময় হিসাব ছাড়া নষ্ট হতে থাকে। এর চেয়ে বড় ক্ষতির আর কিছু কি হতে  পারে?

শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর আপবীতী অধ্যয়ন করুন দেখুন তাঁর ওয়ালিদ ছাহেব নেযামুল আওকাতের বিষয়ে কত তাকিদ করতেন এবং সে সময়ের সচেতন তালিবে ইলমগণ কীভাবে তাদের কর্মসূচি তৈরি করতেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করতেন।

আমাদের বর্তমান আকাবিরও এ বিষয়ে সর্বদা তাকিদ করে থাকেন। হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম বলে থাকেন, সব সময় নিযামুল আওকাত মেনে চল। কারণ নিযামুল আওকাত ছাড়া কোনো তালিবে ইলমের যিন্দেগী তৈরি হতে পারে না।

২. কুররাসাতুল ফাওয়াইদ (নোটখাতা)

মুতালাআর সময় প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য নোট করার জন্য প্রত্যেক তালিবে ইলমের কাছে এক বা একাধিক খাতা/ডায়েরী থাকা খুবই প্রয়োজন।

العلم صيد والكتابة قيد

এই প্রসিদ্ধ উক্তি শুধু মৌখিক আলোচনা করার জন্য নয়; বরং এটা একটা নীতি, যা অনুসরণযোগ্য। বিশেষত যে তথ্যগুলো বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক স্থানে বিক্ষিপ্ত থাকে সেগুলো সঙ্গে সঙ্গেই শিকার করে ফেলতে হয়। কেননা প্রয়োজনের মুহূর্তে না এগুলো তালাশ করার সময় পাওয়া যায় আর না সংশ্লিষ্ট স্থানে তালাকের মাধ্যমে এগুলো আহরণ করা যায়। এই নোটখাতাগুলোই একসময় আপনার কর্মজীবনের বিকল্পহীন সহায়ক বলে প্রমাণিত হবে। পূর্বসূরীদের মধ্যে অনেক ব্যক্তিত্ব এমন ছিলেন যাদের নোটখাতাগুলো পরবর্তীদের জন্য রাহনুমা সাব্যস্ত হয়েছে। ইবনুল জাওযী রাহ.-এর সাইদুল খাতির এবং কাশকূল নামের অধিকাংশ গ্রন্থ এভাবেই তৈরি হয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক স্থান থেকে আহরিত তথ্য ও আলোচনার উত্তম সংকলনগুলোর  মধ্যে বদরুদ্দীন যারকাশী রাহ.-এর খাবায়া ফী যাওয়ায়া উল্লেখযোগ্য।

নোটখাতায় কী ধরনের বিষয় নোট করা হবে এটা রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা দ্বারা অনুধাবন করা যায়। তবে নোট করতে করতে এক সময় এই রুচি তৈরি হয়ে যায়। তাই কিছুদিন আনাড়ির মতোই নোট করতে থাকুন-এতে অসুবিধার তো কিছু নেই।

একটা খাতা থাকা দরকার মৃত্যুসন নোট করার জন্য। আকাবির হযরতদের মধ্যে যাঁরই মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে খাতায় তা নোট করে রাখা উচিত। তদ্রূপ তাঁদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তা-ও। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মৃত্যুসনও সেখানে নোট করা যেতে পারে।

একটা খাতায় নিজ এলাকার বা নিজ যুগের উলামা-মাশায়েখদের সম্পর্কে তথ্য সংকলন করা যায়। তাঁদের সম্পর্কে মুত্তাছিল সনদে বা প্রত্যক্ষভাবে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা নোট করা উচিত। ভবিষ্যতে কোনো সময় যদি আপনি জীবনী ও জীবনচরিত লিখতে চান কিংবা এ বিষয়ে কোনো ধরনের কাজ করতে চান তাহলে  দেখবেন বহু বিষয় প্রস্ত্তত হয়ে আছে।

৩. রোযনামচা

প্রতিদিন অন্তত এক ভাষায় যেমন মাতৃভাষা বাংলায় রোযনামচা লেখার পাবন্দী করুন। কোনো দিন ইচ্ছা না হলে এক দুলাইন হলেও লিখুন। রোযনামচায় বৈচিত্র থাকা চাই। প্রতিদিনের রোযনামচা একই ধরনের না হলে ভালো। এমন হওয়া উচিত নয় যে, শুধু একটা ঘটনা লিপিবদ্ধ করলেন। যা কিছু দেখলেন বা শুনলেন সে সম্পর্কে আপনার মতামতও লিপিবদ্ধ করুন।

কোনো চিন্তা যেহনে এসেছে নোট করুন। এটাকে কেন্দ্র করে রোযনামচার পুরা লেখাটাই প্রস্ত্তত হতে পারে। বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা নোট করার একটা উত্তম স্থান রোমনামচাও।

আপনার নিজের জীবনে বা অন্য কারো জীবনে আনন্দ-বেদনার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোও মন্তব্য ও অনুভূতিসহ নোট করতে পারেন।

কোনো নেক আমলের নিয়ত করেছেন বা ভবিষ্যতের জন্য কোনো করণীয় বিষয় চিন্তায় এসেছে-সবই লিপিবদ্ধ করতে পারেন।

মোটকথা, রোযনামচায় বৈচিত্র থাকা চাই। রোযনামচা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা লাভের জন্য পুষ্পসমগ্র মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ অধ্যয়ন ফলদায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।

৪. চিন্তাকে প্রসারিত করুন

এখন থেকেই এই সংকীর্ণ চিন্তা থেকে আল্লাহর দরবারে পানাহ চাইতে থাকুন যে, ভালো ছাত্র হওয়ার মাপকাঠি হচ্ছে পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া অথবা মোটামুটি কিতাবী ইসতিদাদ বিদ্যমান থাকা। এই ধারণা ঠিক নয়। ভালো ছাত্র হওয়ার জন্য আখলাক ভালো হওয়া অপরিহার্য।  সুস্থ  রুচি    উন্নত      চিন্তাশক্তির প্রয়োজন। সুন্দর হস্তলিপি এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার যোগ্যতাও চাই। বক্তৃতা ও উপস্থাপনাও সুন্দর ও মাধুর্য্যপূর্ণ হওয়া চাই।

শুধু পরীক্ষায় নম্বর পেয়ে যাওয়া বা শুধু কিতাবী ইসতিদাদ (যদি সঠিক অর্থে তা বিদ্যমানও থাকে)-এর উপর সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকা খুবই দুঃখজনক। ইসতিদাদসম্পন্ন তালিবে ইলমদের মধ্যে যখন আদাবুল মুআশারা সম্পর্কে অনুভূতিহীনতা, আখলাকের নীচুতা এবং চিন্তা-ভাবনার অগভীরতা দৃষ্টিগোচর হয় তখন খুবই কষ্ট হতে থাকে। মনে রাখবেন, এ বিষয়গুলোর প্রতি ভ্রূক্ষেপহীনতা উজব ও কিবরের ফলাফল। এজন্য খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

৫. সময়ের মূল্য দিন

হাসান বসরী রাহ-এর উক্তি স্মরণ রাখুন- হে আদম সন্তান, তুমি তো কিছু দিবসের সমষ্টি, একটি দিবস যখন গত হল তো তোমার একাংশ নিঃশেষিত হল।

সময় নষ্ট হওয়াকে সামান্য বিষয় বলে গণ্য করবেন না। আপনার পাঁচ মিনিট নষ্ট হলে মনে করুন আপনার একটা হাত কাটা গেল।

৬. তাকওয়া-পরহেযগারীর প্রতি মনোযোগী হোন

রোযানা তেলাওয়াত, ছয় তাসবীহ, ইশরাক ও আওয়াবীনের ব্যাপারে যত্নবান হোন। শেষ রাতে ওঠা সম্ভব না হলে বিতরের আগে দুই/চার রাকাত নামায পড়ুন। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করুন। তওবার পাবন্দী করুন এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সামান্য থেকে সামান্য কাজ এবং গুনাহ থেকে পূর্ণ হিম্মত ও দৃঢ়তার সঙ্গে নফসের মোকাবেলা করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করুন।

৭. ইলমের জন্য প্রতিবন্ধক বিষয় থেকে দূরে থাকুন

ইলমী মগ্নতায় বাধা সৃষ্টিকারী সকল বস্ত্ত থেকে দূরে থাকুন। বিশেষত মোবাইল ফোন-এটা তালিবে  ইলমের জন্য নির্মম ঘাতক সমতুল্য। এর কাছেও যাবেন না। মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর একটা কথা আমার কাছে খুব পছন্দনীয়। তিনি বলে থাকেন, তালিবুল ইলম-এর কাছে মোবাইল থাকার সর্বনিম্ন ক্ষতি হল এটা তালিবুল ইলমের মাঝ থেকে তলবের মাদ্দা খতম করে দেয়।

৮. ১ম জামাত থেকেই মেহনত করে পড়ুন

একদম প্রথম জামাত থেকেই মেহনত করে পড়ুন। ইলম হাসিল করা এমন একটা বিষয় যাতে প্রথম দিকে উদাসীনতার সঙ্গে সময় কাটিয়ে সফল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথম দিকের পড়াশোনা হচ্ছে পরবর্তী পড়াশোনার জন্য ভিত্তিস্বরূপ। আর ভিত্তি ছাড়া কোনো ইমারত কখনোই তৈরি হতে পারে না।

আততরীক ইলাল আরাবিয়্যা থেকে কাফিয়া পর্যন্ত জামাতগুলো ইসতিদাদ অর্জনে ভিত্তির মতো। এ সময়ের অসতর্কতা গোটা জীবনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে।

আমি পুনরায় দরখাস্ত করছি, প্রথম জামাত থেকেই মেহনত করে পড়ুন। কিরাআতে রাশেদাকিরাআতে ওয়াজিহার অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং নিজের মধ্যে কিতাবী ইসতিদাদ পয়দা করুন, যাতে আপনকে কানয বোঝার জন্য মাদিনুল হাকায়িক, শরহুল বেকায়া বোঝার জন্য আসসিকায়াহ, হিদায়ার জন্য আশরাফুল হিদায়া, নূরুল আনওয়ারের জন্য কূতুল আখয়ার, জালালাইনের জন্য কামালাইন এবং দাওরায়ে হাদীসের জন্য পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সম্বলিত নোটবুকস বা গাইডবুকসের কাছেও যেতে না হয়। ভালো ভাবে জেনে নিন,এই ইলম কোনো ইলমই নয়। আপনি আলেমে দ্বীন হতে চাচ্ছেন অথচ আশরাফুল হিদায়ার সাহায্য ছাড়া আপনি হিদায়া হল করতে পারেন না!

আমার কথায় মনে কষ্ট নিবেন না। আমি আপনাকে একদম প্রকৃত সত্য কথা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলে দিয়েছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রক্ষা করুন এবং প্রতি কদমে আমাদের সাহায্য করুন। #

 

 

advertisement