শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

শরীয়তের ওপর আমলই সব সমস্যার সমাধান

সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানী নদভী

মুসলমান ও মুসলিম শব্দদুটি অর্থগতভাবে ঐ ব্যক্তিকে নির্দেশ করে যিনি নিজেকে আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর সন্তুষ্টির সামনে সোপর্দ করে দেন। আরবী ভাষায় ইসলাম শব্দের আভিধানিক অর্থ সমর্পণ করা, সোপর্দ করা। তেমনিভাবে প্রকৃত মুসলিম ঐ ব্যক্তিকে বলে যিনি তার সত্তাকে আল্লাহর নির্দেশনার কাছে সোপর্দ করে দেন। তিনি এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, আমি তাই করব, আমার প্রভু যা চান। আমি সে কাজই করব, আমার প্রভু যা করার অনুমতি দিয়েছেন। যখন আমাদেরকে আত্মসমর্পণ বা নিজেকে আপন প্রভুর সন্তুষ্টির সামনে হাওয়ালা করে দেয়ার ব্যাপার রয়েছে, তখন আমাদের জানা প্রয়োজন আমাদের প্রভু কী বলেছেন? আর কোন ধরনের আমল তিনি আমাদের জীবনের জন্য পছন্দ করেছেন?

 

আমাদের সমাজে বাস্তবে যা হচ্ছে তা হল, নিছক মুসলিম ঘরে জন্ম নেয়ার দ্বারাই মুসলমান সাধারণত আশ্বস্ত হয়ে যায়। আর এতেই তারা মনে করে থাকে আমরা মুসলমান। যখন আমরা মুসলমান তখন আল্লাহ তাআলার ওপর যেন আমাদের এই হক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, তিনি আমাদের সঙ্গে রহম, দান ও সাহায্যমূলক আচরণ করবেন। কারণ আমরা মুসলমান। কিন্তু এ বিষয়টি সাধারণত ভুলে যাই যে, মুসলমান (মুসলিম) দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে, মুসলমান মা-বাবার ঘরে জন্ম হয়েছে। বরং মুসলমানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজেকে আল্লাহ তাআলার নির্দেশের কাছে সোপর্দ করে দেয়া।

 

সুতরাং আমরা আমাদের জীবনের হিসাব কষে বলি, আমরা কি আমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর নির্দেশের সামনে সোপর্দ করে দিয়েছি? মুসলমানদের শান এটা বলা হয়েছে, বরং তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে যেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গে এই পরিমাণ মহববত রাখে, যা তার পিতামাতা, সন্তান এবং আত্মীয়-স্বজনের চেয়েও বেশি হয়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা ঐ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে তোমাদের পিতামাতা, আপন সন্তান এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব। আর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে আমাদের এই পরিমাণ মহববত হবে তখন এটা স্পষ্ট যে, আমরা তাঁর ইরশাদাতের বিরোধিতা করতে পারব না। বরং আমাদের কারো জন্য এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না যা রাসূল সা. এর হিদায়াত ও ইরশাদের বিরোধী হয় কিংবা যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেননি। আর যদি আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পছন্দের পরিপন্থী কোনো কাজ করি তাহলে এর অর্থ হলো-প্রকৃত পক্ষে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঐ মহববত করি না যে মহববতের নির্দেশ আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। সে মহববত নিজের সন্তান-সন্তুতি এবং পিতামাতাকে মহববতের চেয়েও বেশি।

 

এ ব্যাপারে প্রথমত প্রয়োজন হল আমাদের ঐ আহকামসমূহ জানা যে আহকামের ওপর আমল করায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হুকুম বাস্তবায়ন করা হয়। আর যার ওপর আমল করা ব্যতিরেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে আমাদের প্রকৃত মহববত প্রমাণিত হবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহববতই যদি আমাদের জীবনে অর্জিত না হয় তাহলে আখেরাতে আমাদের কী ফায়দা হাসিল হবে?

 

শুধু আহকাম জেনে নেয়ার দ্বারাই কাজ চলবে না। মাসায়েল জেনে নেয়ার প্রয়োজন এজন্য যে, সে অনুযায়ী আমল করতে হয়। এটা বুঝা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর নুসরত ও মদদ, রহম ও করমের ওয়াদা করেছেন ভালো কাজের ভিত্তিতে। আর ভালো কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন করা। যখন এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে তখনই আল্লাহর সাহায্য ও দয়া আমাদের ওপর হবে। আল্লাহ না করুক, আমরা যদি আল্লাহর হুকুম পালন না করি এবং তাঁর অবাধ্যতা করি, আল্লাহর রাসূলের হিদায়াতের বিরুদ্ধাচরণ করি, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রহম ও করমের আশা আমরা করতে পারি না। আমরা তাঁর নাফরমানি করব আর তিনি আমাদের ওপর রহম করবেন-এটা কিভাবে হয়? এটা কি যুক্তিসঙ্গত কোনো কথা?

আমাদেরকে জীবনের প্রকৃত পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের দেখতে হবে আমরা আল্লাহর নির্দেশের ওপর কতটুকু আমল করছি? আমরা তাঁর মর্জিকে আমাদের মর্জির ওপর কোথায় কোথায় প্রাধান্য দিচ্ছি? তাঁর মর্জিকে যদি নিজেদের মর্জির ওপর প্রাধান্য না দেই তাহলে তাকে আনুগত্য বলবে না। আনুগত্য সেটাকেই বলবে যখন আমরা আল্লাহ ও রাসূলের মর্জিকে সব জিনিসের ওপর প্রাধান্য দিব। ব্যয়ের বিষয় হোক, আমদানি প্রসঙ্গ হোক, কারো সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপার হোক অথবা অন্য যেকোনো বিষয় হোক, জীবনের অসংখ্য দিক রয়েছে, আমাদেরকে প্রত্যেক দিকে এই খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিব। আমরা আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টিকে যে পরিমাণ প্রাধান্য দিব তাঁর নুসরত, মদদ এবং করমও আমাদের ততটুকুই হাসিল হবে। আমরা যদি ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানরা তাদের উত্তম জীবনের প্রমাণ পেশ করতে পেরেছে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর রহম, করম ও নুসরত তাদের সঙ্গী হয়েছে। কুরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ওয়াদা করেছেন, তোমরা যদি ভালো কাজ কর তবে আমি তোমাদেরকে পরিতৃপ্ত করে দিব, আর যদি মন্দ কাজ কর তাহলে তোমাদেরকে পাকড়াও করা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে।

মুসলমানদের অবস্থা বলে দেয়, তাদের সমস্ত বিপদাপদ, পেরেশানী, ক্ষয়ক্ষতি এবং তাদের অপদস্থতা আমরা যেখানেই তাদের নাফরমানি ও বদ আমলীর প্রতিদান। এখানে মানুষের সম্পর্ক সরাসরি তার প্রভুর সঙ্গে। সে যদি তার প্রভুর নাফরমানি না করে তবে তার হালত পাল্টে যায়। এ গোটা দুনিয়া আল্লাহ তাআলার গোলাম। এই দুনিয়া এবং সমস্ত বিশ্ব ঐ সময় যুৎসই হবে যখন আমরা আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক আমাদের জীবনকে যুৎসই বানাব। সুতরাং আমাদের জন্য উচিত হল, ওলামায়ে কেরামের কাছ থেকে মাসায়েল জেনে নিজেদের জীবনকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের মোতাবেক পরিচালিত করা।

আপনি ইতিহাস পড়ে দেখুন, দেখবেন উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস উত্থান-পতনের ইতিহাস। তাদের সামনে বড় সমস্যাও এসেছে আবার অত্যন্ত প্রাচুর্যপূর্ণ অবস্থাও হয়েছে। আপনি এগুলো পর্যালোচনা করলে দেখবেন, যখন আল্লাহর মর্জি মোতাবেক জীবন অতিবাহিত হয়েছে তখন আল্লাহর রহম ও বরকতের ধারা বর্ষিত হয়েছে, সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ হয়েছে।  পক্ষান্তরে যখন নাফরমানি করেছে তখন সমস্যা ও প্রতিকূলতা, বিপদ ও পেরেশানীতে চারদিক ছেয়ে গেছে।

বর্তমানে উম্মতের অবস্থা হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য এবং তার নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে  যে অবস্থানে থাকার কথা সে অবস্থান থেকে তারা আজ অনেক দূরে। এজন্য আমরা লক্ষ করছি, আমাদের জীবন আজ সমস্যাসঙ্কুল। এর ওপর যদি আমরা      চিন্তা করি তাহলে জানতে পারব এক্ষেত্রে আমাদের অমনোযোগিতার বেশ দখল রয়েছে। আমাদের উচিত নিজেদের জীবন পর্যালোচনা করে তাকে শরীয়তের মোতাবেক বানানোর প্রচেষ্টা করা। কারণ এছাড়া কোনো উপায় নেই।

ইসলামী শরীয়তের যে সমস্ত আহকাম রয়েছে এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব তো হচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা, মানুষকে তালীম দেয়া, এর প্রচার-প্রসারে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর মুসলিম জনসাধারণ তথা সকল মুসলমানের জিম্মাদারী হল সেসব আহকাম জেনে এর ওপর পরিপূর্ণভাবে আমল করা এবং নিজের বাস্তব জীবনে এগুলোর বাস্তবায়ন করা। কারণ এর বাস্তবায়নের ওপরই এ দুনিয়ায় ইজ্জত-সম্মান এবং পরকালে কামিয়াবী ও সমৃদ্ধি হাসিল হবে। আর সবচেয়ে বড় অর্জন তো হল আখেরাতে আমরা আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং আযাবে নিপতিত হব না। এর পাশাপাশি এই ইহজগতও সম্মান এবং প্রশান্তির সঙ্গে কাটবে। কিন্তু তা তখনই হবে আমরা যখন এর (শরীয়াত) ওপর আমল করব। আমাদের সকলের ফরজ একটিই-নিজের জীবনটাকে পর্যালোচনা করে দেখা যে, আমরা শরীয়াতে ইসলামীর ওপর কতটুকু আমল করছি? শরীয়াতে ইসলামী বলা হয় জীবনের জন্য ইসলামী আহকামকে। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের আহকামের নামই শরীয়াত। সুতরাং আমাদের দেখতে হবে, আমরা শরীয়াতে ইসলামীর ওপর কতটুকু আমল করছি। গোটা জীবনটাকে যাচাই-বাছাই করে এতে যে ত্রুটি ও বিচ্যুতি নজরে আসবে তা দূর করার প্রচেষ্টা চালানো। এর ফলাফল এই হবে যে, দুনিয়াতেও আমরা সম্মান, প্রতিপত্তি ও প্রশান্তি অর্জন করব আর পরকালেও হাসিল করতে পারব পরম কাঙ্ক্ষিত কামিয়াবী।

অনুবাদ : জহির উদ্দিন বাবর

 

 

advertisement