শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

প্রশান্তির ভুবনে

আবদুল্লাহ মালিক

লেডি বার্নস্ একজন নতুন মুসলমান, যার স্বামী ছিলেন একজন ইংরেজ আর্মি অফিসার। উভয়ই একটা মামলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন, যা ছিল মিথ্যায় ঠাসা। যথাসময়ে মামলাটির নিষ্পত্তি হল এবং তাঁরা যাবতীয় অভিযোগ থেকে মুক্ত হলেন।

আমি যেহেতু তাদের উকিল ছিলাম তাই একবার লেডি বার্নস্ লাহোরে আসলেন আমাকে ধন্যবাদ জানাতে। আমি সে সুযোগে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী তাকে মুসলমান হতে উদ্বুদ্ধ করেছে? তিনি বলেছিলেন, মুসলমানদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখে। তারপর তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এভাবে : আমি কোনো জাতিকে মুসলমানদের মতন দৃঢ় বিশ্বাসের অধিকারী হতে দেখিনি। এটাই একমাত্র কারণ যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি! কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বলতে লাগলেন, ‘‘আমি একটি রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলাম। সেখানে আমার এক মুসলমান কর্মচারী ছিল, যার বয়স ছিল ৭০ বছর। তার এক সুদর্শন যুবক সন্তান ছিল। কিন্তু তার সেই ছেলে কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আমি লোকটির জন্য খুবই মর্মাহত হলাম। সহমর্মিতা প্রদর্শনের জন্য আমি তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমি তাকে সমবেদনা জানিয়ে বললাম, আমি তার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারি। আমি তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। সে আমার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল, কিন্তু আমার কথা তাঁর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল না। একপর্যায়ে যখন আমি কথা শেষ করলাম, সে তাঁর একটা আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে ইশারা করে বলতে লাগল, ম্যাডাম, এটাতো তা-যা আল্লাহ তাআলার পরিকল্পনায় ছিল। আমার সন্তান আল্লাহ তাআলারই মালিকানাধীন। আমার কাছে তাকে দেওয়া হয়েছিল শুধু দেখাশুনার জন্য। এখন আল্লাহ তাআলা তাঁর জিনিস নিয়ে গেছেন। আমি এ ব্যাপারে এত দুঃখিত হব কেন? আমাদের তো সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতে হবে।

আমি তার আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে ইশারা করার ভঙ্গিটা  ভুলতেই পারিনি । আমি তার কথাগুলি মনে করে সেগুলি নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। প্রতিবারই আমি এই সমাপ্তিতে পৌঁছতাম যে, পৃথিবীতে এমন কৃতজ্ঞ ও ধৈর্যশীল জাতিও আছে!

যেহেতু তার ধৈর্য্য দেখে আমি অবাক হয়েছি তাই আমি তার ছেলের পরিবারের খবর নিলাম। জানতে পারলাম যে, তার ছেলের রয়েছে স্ত্রী ও একটি পুত্রসন্তান। তখন আমি ধারণা করলাম যে, বৃদ্ধ তো এজন্যই বেশি দুঃখিত হয়নি, কারণ তার নাতি এখনও জীবিত, যে তার জন্য অবলম্বন ও ভালবাসার কেন্দ্রও বটে!

কিছুদিন পর আমি জানতে পারলাম, তার সেই পুত্রবধূও মারা গেছে। আমি ধারণা করলাম, এবার তো সে নিশ্চয়ই খুব দুঃখিত ও একাকী অনুভব করছে। সান্ত্বনা দেবার লক্ষ্যে আমি তার গ্রামে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি, সে কিছু মানুষের মাঝে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়া শুরু করলাম। যখন আমি থামলাম, সে আবার তার আঙুল আকাশের দিকে উঠিয়ে বলল, ম্যাডাম! সে তো আল্লাহরই ছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁর জিনিসই উঠিয়ে নিয়েছেন। কেউ তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। আমাদের উচিত প্রতি মুহূর্তে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।

যতক্ষণ আমি তার নিকট সেখানে ছিলাম আমি লক্ষ করলাম, না একটা সামান্য রুদ্ধশ্বাস তার ঠোঁট দিয়ে বের হল, আর না তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু পড়ল! সে মানুষের সাথে খুব শান্তভাবে কথা বলছিল। যেন সে যে তার ছেলে আর ছেলের স্ত্রীকে দাফন করেছে-এটা তার জন্য স্বাভাবিক করণীয়ই ছিল। আমি কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরে এলাম, কিন্তু এই চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন থাকলাম  যে, কীভাবে একজন মানুষ এত দুঃখ  বেদনা ও কষ্টের মধ্যেও ধৈর্যশীল থাকতে পারে?

 

আবার কিছুদিন পর তার নাতিটাও মারা গেল। এই সংবাদ পাওয়ার পর আমি আমার সমস্ত       চিন্তা জড়ো করলাম। মনে করলাম, এইবার বৃদ্ধ নিশ্চয়ই ভেঙ্গে পড়েছে। কারণ, এখনতো তার জন্য এই দুনিয়াতে আর কেউ বেঁচে নেই। আমি এই আশা নিয়েই যেন তার নিকট গেলাম যে, তাকে বিমর্ষ ও ভেঙ্গে পড়া অবস্থায়ই পাব, কিন্তু আমি বিস্মিত ও অত্যাশ্চর্য হলাম এবং আমি যা দেখলাম তা আমার মস্তিষ্ক ধারণ করতে অক্ষম। এই ৭০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধটি শান্তভাবে বসে রয়েছে। মানুষজন তাকে  সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি আমার পক্ষ থেকে সান্ত্বনা দিলাম। সে মাথা নিচু করে আমার কথাগুলো শ্রবণ করল। কখনো কখনো একটা শ্বাস তার ঠোঁট দিয়ে বের হচ্ছে। তার মন যে খুব খারাপ সেটাও বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমি যখন কথা শেষ করলাম, সে পূর্বের ন্যায় শান্তভাবে আমাকে বলল, ম্যাডাম, আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে।

যা তিনি আমাকে কিছু সময়ের জন্য দিয়েছেন তা এখন নিয়ে গেছেন। সবই তাঁর। তাহলে অন্যের জিনিস অন্যে নিয়ে গেলে আমাদের অন্তর ভেঙ্গে যাবে কেন? প্রত্যেকের উচিত সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। আমাদের মুসলমানদের বলা হয়েছে যে, আমরা যেন আল্লাহ তায়ালার ফয়সালায় ধৈর্যশীল থাকি। লেডি বার্নস্ ইতোমধ্যে খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি তার ডান হাতটা উপরে উঠিয়ে বললেন, বৃদ্ধের সেই জবাব আমাকে হত্যা করেছে। সেটা তো বাহ্যিকভাবে শুধু আকাশের দিকে হাতের একটা ইশারা ছিল, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, যেন সেটা একটা তীর, যা আমার হদয়ে বিদ্ধ হয়ে তাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছে। আমি তার এই দৃঢ় বিশ্বাসের সামনে পরাজিত হয়েছি। আমি নিশ্চিতভাবে বুঝেছি যে, তাঁর এই নীরবতা কোনো লৌকিকতা ছিল না; বরং তা সবদিক থেকেই আন্তরিক ছিল। সে তখন তার গ্রামে একা হয়ে পড়েছে, তাই আমি তাকে আমার রেস্টুরেন্টে গিয়ে থাকতে বললাম। এতে সে রাজী হল। সে দিনের বেলা কাজ করত আর রাতে তার স্রষ্টার সামনে দাঁড়িয়ে কাটাত।

কিছুদিন পর সে কবরস্থানে যেতে মনস্থ করল। সেখানে গিয়ে সে কী করে তা দেখার জন্য আমি খুব উৎসুক ছিলাম। তার পরিবারের সদস্যদের কবর দেখতে গিয়ে তার অনুভূতিটা কেমন হয়, সেটা আমার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল । তাই আমি তাকে অনুসরণ করেছি। যখন সে কবরস্থানে পৌঁছল তখন সে কবরগুলো ঠিক করতে শুরু করল, মাটি খুঁড়ে ভালোভাবে কবরগুলো ঠিক করে দিল। পানি এনে কবরগুলোতে ছিটিয়ে দিল। তারপর সে হাত মুখ ধুয়ে দুআ করল। সবশেষে সে ফিরে এল।

পুরো সময় আমি তার প্রতিটা কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছি। তার মধ্যে বিদ্যমান  প্রশান্তির অনুভূতি এবং বিশ্বাসের আলো আমি উপলব্ধি করতে শুরু করলাম । যে আগুন আমার অন্তরে জ্বলছিল তা হঠাৎ  ঝলসে উঠল। আমি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি তখন বুঝতে পারলাম  যে, প্রশান্তির সেই অনুভূতি আসলে ঐ বৃদ্ধের গুণ নয়, তা হল ঐ ধর্মেরই গুণ, যে ধর্মে সে দীক্ষিত। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, একজন মুসলমান মহিলা এনে দিতে যে আমাকে ইসলামের শিক্ষা দান করবে। সে সাথে সাথে আমার কথা মান্য করল এবং একজন মুসলমান মহিলা নিয়ে এল, যিনি আমাকে ইসলামের মৌলিক বিষয় এবং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ শিক্ষা দিলেন।

উৎস: http://muftisays.com/nti.php?article=88

 

 

advertisement