ইসলামী জ্ঞান আহরণে বইপত্র পাঠ : পরামর্শের ভিত্তিতে বই নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা
ইসলামী জ্ঞান শেখা ও আহরণের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি হল, সনদ ও সূত্র ধরে সরাসরি শিক্ষা লাভ করা। এ পদ্ধতি খালেস ও বিশেষায়িত দ্বীনী উলূম শেখার ক্ষেত্রে এখনও অনুসরণীয় ও অপরিহার্য। তবে সাধারণভাবে ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, জ্ঞান ও ধারণা লাভের জন্য এ যুগে বইপত্রের সাহায্যও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বইপত্র মন্থন, পাঠ, চর্চা করে ইসলামী বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আহরণেরও বহু উপকার ও কল্যাণ রয়েছে। কল্যাণকর জ্ঞানের বৃদ্ধিও যেকোনো উপায়েই মঙ্গলজনক, কিন্তু কল্যাণকর জ্ঞান আহরণে কেবল বইপত্রকে যথেষ্ট বিবেচনা করা কিংবা বাজারে প্রকাশিত ও বিদ্যমান ইসলাম বিষয়ক গ্রন্থাবলি থেকে সহীহ পদ্ধতিতে জ্ঞান অর্জন না করতে পারলে সমূহ ক্ষতি হওয়ার আশংকাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পদ্ধতি ভুল হওয়ার কারণে কল্যাণকর জ্ঞানের সন্ধানে গিয়ে অকল্যাণের চোরাবালিতে দেবে যাওয়া কারো কাম্য হতে পারে না। এজন্যই বাজারে বিদ্যমান অনূদিত, মৌলিক, সংকলিত বিভিন্ন ধরনের ইসলাম বিষয়ক গ্রন্থ থেকে কিছু আহরণের জন্য একটি নিরাপদ, অপরিহার্য-আত্মরক্ষামূলক নীতির অনুসরণ দরকার। ইসলামকে জানতে কোন পর্যায়ে কোন বই কখন কার জন্য পড়া মুনাসিব এসব বিষয়ে সবিস্তার নীতিমালা উপস্থাপন একটি দীর্ঘ নিবন্ধের ব্যাপার হলেও এখানে সংক্ষেপে নীতি-নির্যাসটুকু তুলে ধরা হচ্ছে।
এক. কোন বই বা কিতাব আমার জন্য কখন পড়া উচিত বা আদৌ উচিত কি না-এ বিষয়ে যোগ্য ও বিষয়-পারদর্শী কোনো আলেমের পরামর্শ গ্রহণ হচ্ছে এ বিষয়ের প্রথম করণীয়। আলেমের পরামর্শে কিতাব ও পাঠ্যবই নির্বাচন করতে হবে। পাঠক হিসেবে আমার স্তর, মানসিকতা এবং উদ্দিষ্ট কিতাবের বক্তব্য, উপস্থাপনাভঙ্গি ও গভীরতা বিবেচনা করে এ বিষয়ে উপকারী পরামর্শ দিতে পারেন একজন যোগ্য আলেম। একজন যোগ্য আলেমের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো স্তরের বইপত্র ধরেই পড়তে শুরু করা আমার জন্য চরম ক্ষতির কারণও হয়ে যেতে পারে। অনেকের মাঝে কুরআন শরীফের তরজমা ও তাফসীর পাঠের আগ্রহ লক্ষ করা যায়। অনেকেই আবার হাদীসের তরজমা ও ব্যাখ্যা পাঠে মনোনিবেশ করতে চান। তাদের এই আগ্রহ ও প্রবণতা নিঃসন্দেহে শুভ। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এর জন্য তারা কোনো আলেমের পরামর্শ গ্রহণের কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই মনে করেন না। যেখানে স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যায় ছোট থেকে ছোট কোনো রোগের ঔষধ বাছাইয়ের জন্যও অনুমোদিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না নিয়ে ঔষধ সেবন করার অনুমোদন দেওয়া হয় না, সেখানে হৃদয়-মন ও আত্মার শুশ্রূষা ও পরিচর্যা এবং ঈমান-বিশ্বাস ও জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালা হওয়ার মতো বিষয়েও বিষয়-পারদর্শী কোনো আলেমের পরামর্শ না নেওয়ার পেছনে পঠিত বিষয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বোধহীনতাকেই বড় কারণ মনে করা যেতে পারে। মাসআলা-মাসায়িলের কিতাব পড়ার ক্ষেত্রেও একইভাবে পরামর্শ ভিত্তিক নির্বাচনের দরকার অনুভব করা হয় না। অথচ এর সঙ্গে হালাল-হারামের প্রশ্নটি গভীরভাবে জড়িত। ওই কিতাবে কোনোভাবে হালালের মাসআলাকে হারাম কিংবা তার বিপরীত বলা হলে পাঠক বেচারার সে ক্ষেত্রে কিছুই বোঝার কথা নয়। এ পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে তাসাওউফ। তাসাওউফ মানুষের জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। জীবন পরিচালনায় বড় ভূমিকা রাখে, অথচ দেখা যায়, এই তাসাওউফ বিষয়ক কোনো কিতাব পড়তেও কোনো বিজ্ঞ আলেমের পক্ষ থেকে নির্বাচনের কোনো প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা অনেকেই মনে করি না। এ বিষয়ক পঠিত বইটি যথার্থ নীতি অনুসরণ না করে থাকলে এটি পাঠকের জীবনে বড় বিশৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পারে। তাই পাঠের জন্য গ্রন্থ নির্বাচনে সহীহ পরামর্শ দরকার। বিজ্ঞ মুশীরের পরামর্শ দরকার।
দুই. দ্বীন শেখার জন্য বাছাইকৃত যে কিতাবটি পড়া হবে তা সর্বাত্মক বুঝে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে কিতাবটি যতটুকুই বুঝে আসুক, সে কিতাব থেকে অর্জিত নিজের বুঝ ও উপলব্ধির ওপর প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরসা পোষণ করা যাবে না। প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরসা না পোষণের অর্থ দুটি। ১. সে কিতাবটি পড়তে গিয়ে কোথাও কোনো কিছু অস্পষ্ট মনে হলে নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে, নিজের বুঝ অনুযায়ী তার সমাধান বের করার চেষ্ট না করা। বিষয়টির অস্পষ্টতা দূর করতে বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হওয়া এবং তাঁর বাতলে দেওয়া সমাধানটাকেই গ্রহণ করে নেওয়া। ২. এভাবে নিজ মুতালাআ ও অধ্যয়নে অর্জিত বুঝ ও উপলব্ধি থেকে কারো সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে না পড়া। কোনো আলেমের বক্তব্য নিজ বুঝ ও উপলব্ধির খেলাফ হলে তার সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ না করা চাই। অনূদিত ও সংকলিত কোনো একটি বই থেকে উড়ন্ত পাঠের মাধ্যমে আহরিত জ্ঞান ও বুঝ আসলে অন্য কোনো আলেমের বক্তব্যকে অপছন্দ করার মতো যোগ্যতার ধারক হয় না। তাই এই অপ্রয়োজনীয় নির্ভরতা বাদ দেওয়াই সমীচীন।
তিন. আরো একটি বিষয়ে পাঠকের লক্ষ রাখতে হবে যে, নিজের অনুভব-উপলব্ধির স্তর-এর উর্ধ্বের কোনো অনূদিত কিংবা সংকলিত কিতাব পেয়ে গেলেও তা পাঠ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, কোনো একটি বিষয় পড়ে ফেলাই ওই পর্বের সমাপ্তি নয়, সেটি হজম করার বিষয়ও তার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি অনেকটা খাবারের মতো। গলাধঃকরণ করা গেলেই গিলে ফেলা ঠিক হবে না যদি তা হজম করা না যায়। এ বিবেচনাটুকু না করে গিলে ফেললে সমূহ ক্ষতির আশংকাই প্রবল হয়ে ওঠে। অনেকেই ইসলামী বিষয়ে নিজের জ্ঞানের স্তর সম্পর্কে ধারণা না রেখেই দাবি করেন, বিষয়টির আরো ‘ডিটেইলসে’ যেতে চাই, আরো ডীপে গিয়ে বুঝতে চাই। ‘সংক্ষিপ্ত’ ও ‘ভাসন্ত’ বিষয়ের সবটুকু বুঝার পর ‘ডিটেইলসে’ এবং ‘ডীপে’ যাওয়ার প্রশ্ন আসে। আসলে ইসলামী উলূম ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাছ বিচারহীন বিচরণ কিংবা অসতর্ক মন্থনের ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকা সচেতন প্রত্যেকের দায়িত্ব।
চার. গাযালী রাহ.-এর কিমিয়ায়ে সাআদাত, মুকাশাফাতুল কুলুব, দাকায়েকুল আখবার পড়তে অনেকেই খুব পছন্দ করেন। অথচ এই কিতাবগুলোতে ভিত্তিহীন বহু বর্ণনা রয়েছে। এছাড়াও এসবের মাঝে যে ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনা বিদ্যমান অনেকের জন্যই তা নতুন সন্দেহ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি অনূদিত এসব কিতাব পড়ার পর অনেক সময় দেখা যায়, অনেকের চিন্তার ভারসাম্যও বিঘ্নিত হয়ে যায়। অপরদিকে এসব কিতাবের পেছনে ছুটে চলা মানুষের অনেককে আবার দেখা যায়- কুরআন শরীফ সহীহভাবে তেলাওয়াত করতে শেখেননি, বেহেশতী জেওর পড়ে জরুরি দ্বীনী মাসআলা জানার চেষ্টা করেননি, হযরত থানভী রাহ.-এর ‘ইসলাহী নেসাব’ভুক্ত কিতাবগুলো পড়ে দ্বীন-দুনিয়ার নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শেখার পথে এখনো হাঁটেননি।
এবিষয়টি নিয়ে আলোচনা নানা কারণে দীর্ঘ হওয়া স্বাভাবিক। এখানে প্রাথমিক ও মৌলিক কিছু নীতি ও আদব তুলে ধরা হয়েছে। মূল কথা হচ্ছে পড়ার পর্যায় ও ধাপ সুবিন্যস্ত হতে হবে। ‘আলআহাম ফাল আহাম’ বা ‘অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আগে, পরেরটা পরে’ এই নীতি অনুযায়ী আলেমদের নির্বাচনের ভিত্তিতে বইপত্র পড়তে হবে।
এ প্রসঙ্গে আলোচিত ও প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় নিয়ে কিছু নিবেদন করা যায়। সেটি হচ্ছে, অনেকে বলে থাকেন ‘পড়াশোনা উন্মুক্ত থাকতে পারে। পড়তে পড়তে একসময় সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।’ এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত নিবেদনটি হচ্ছে, এভাবে ঢালাও পাঠের অনুমোদন কেবল একটি বিশেষ স্তরের জন্য থাকতে পারে, যে স্তরের রয়েছে সত্য-মিথ্যাকে সূক্ষ্মভাবে পৃথক করার ক্ষমতা। ইসলাম বিষয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠকের জন্য এ ঢালাও পাঠ ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারো কোনো তিরষ্কার ও ভ্রু কুটিকে গুরুত্ব না দিয়েই এ প্রসঙ্গে দরকারী যে কথাটি বলা যায়, সেটি হচ্ছে অনুবাদনির্ভর পড়াশোনার দ্বারা কখনো ইলমী বিষয়ের তমিজজ্ঞান বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ের স্তর অর্জিত হয় না। এটি কেবল দ্বীনী ইলমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সব বিষয়েই প্রযোজ্য। স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রাথমিক পড়াশোনায় যার আগ্রহ, তিনি যদি বিষয়-পারদর্শী কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওই বিষয়ে উন্মুক্ত পড়াশোনায় ডুবে যান তাহলে সমস্যা ও জটিলতার অন্ধকার পাঁকেই তিনি ডুবে যাবেন। প্রাথমিক জ্ঞানের আহরণ তার হবে না। দ্বীনী বিষয়েও ব্যাপারটি অভিন্ন। এক্ষেত্রে যথার্থ উপলব্ধি ও সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। #
[মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের নির্দেশনা ও পরামর্শে ‘আলকাউসার ডেস্ক’ কর্তৃক প্রস্ত্তত]