যিলকদ ১৪২৯   ||   নভেম্বর ২০০৮

স ং স্কৃ তি : ভাষ্কর্যের বিকল্প হতে পারে বৃক্ষ

ওয়ারিস রব্বানী

জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের গোলচত্বরে নির্মাণাধীন বাউল ভাষ্কর্য সরানো নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর শিক্ষক-ছাত্রসহ সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রচন্ড ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। তারা মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ করে দাবি জানিয়েছেন, বিমান বন্দরের সামনেই বাউল ভাষ্কর্য পুনঃস্থাপন করতে হবে। ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি ও ক্ষোভের মুখে ভাষ্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্তটি সরকারের পক্ষ থেকে স্থগিত  হয়ে যাওয়ায় ব্যর্থ বাম  ও উগ্রপ্রগতিশীল চক্রের গায়ে যেন জ্বালাই ধরে যায়। মসজিদের পাশে, হাজ্বী ক্যাম্পের প্রবেশপথে নির্মীয়মান ভাষ্কর্যটিকে সরিয়ে নেওয়ায় ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বস্তি নেমে আসলেও ভাষ্কর্যপ্রেমীদের ক্ষোভ সকল সীমা অতিক্রম করার পর্যায়ে চলে গেছে। তারা এ জন্য সরকারকে চাপ দিয়ে কথা বলছেন এবং ক্ষোভ ও অভিমানমাখা শব্দমালার তুবড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছেন। 

ভাষ্কর্যের পক্ষে দরদ প্রকাশ করতে গিয়ে তারা বলেছেন-এটা অশুভ লক্ষণ। এই আক্রমণ কোনো একটা ভাষ্কর্যের ওপর নয়, এটা আমাদের শিল্পচর্চা, সংস্কৃতি, অগ্রগতির যে আকাঙ্খা তার ওপর, এটা করছে ধর্মব্যবসায়ী এবং রাজনীতিতে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যবসা করে, তারা। আর তাদের মদদ দিচ্ছে সরকারেরই একটি অংশ। এটা মেনে নেওয়া হবে না। অবিলম্বে ওই জায়গায় বাউল ভাষ্কর্য পুনঃস্থাপন করতে হবে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন-যারা বাউল ভাষ্কর্য ভেঙ্গেছে, তারা সেটিকে মূর্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু একে মূর্তি হিসেবে উল্লেখ করে শিল্পকে অপমান করা হয়েছে। মূল বিষয়টি তাদের কাছে শিল্প। সে শিল্প যদি কখনও অশ্লীল হয়, কখনও অমানবিক হয়,  কখনও শিরিকের প্রকাশ্য প্রতীক হয়, কখনও মুসলিম ধর্মীয় চেতনার প্রচন্ড পরিপন্থীও হয়, তাহলেও তারা শিল্পের পক্ষে অনঢ়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উত্তেজক ও অস্থিরতা সৃষ্টিকারী শিল্পকে বাদ দিলে কি মানবতার বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে?  তারা কি বলবেন

ভাষ্কর্য কী কারণে মূর্তি হিসেবে গণ্য হবে না? কেবল এ মূর্তিটি এখনই পূজার জন্য বানানো হচ্ছে না বলেই? মানুষ কিংবা প্রাণীর মূর্তির বদলে যদি বৃক্ষ, ফুল, পাতা, নদী, পাহাড় কিংবা সুন্দর হস্তাক্ষরের ক্যালিগ্রাফির কোনো পাথর খোদাই ভাষ্কর্য বানানো হয় তাহলে কি তাতে শিল্প থাকে না?

এরচেয়েও দরকারি যে ভাবনাটি ভাবা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে-এসব মূর্তিময় ভাষ্কর্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে মহানগরীর মোড়ে মোড়ে ফল-ফুল ও ছায়া বিস্তারকারী দুর্লভ ও আকর্ষণীয় বৃক্ষ রোপনের ব্যবস্থা করা যায় না? মূর্তি ও বিভিন্ন জড় পদার্থের প্রতি পূজা-বন্দনার ইতিহাসটিই এমন যে, তা প্রথম দিনই শুরু হয়ে যায়নি। প্রথমে কেবল স্মৃতি রক্ষার কথাই বলা হয়েছে। এরপর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, এরপর চালু হয়েছে পূজা। সুতরাং এটি ভাষ্কর্য, মূর্তি নয়-এধরনের স্ববিরোধী কথার ভেতরে কোনো সারবত্তা নেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি বিশেষ সুনাম আছে। বৃক্ষ নিধনের প্রস্ত্ততি দেখলে তিনি সদলবলে সেখানে গিয়ে মানববন্ধন করেন। বৃক্ষের প্রতি তার এই ভালোবাসাকে তিনি ইট-পাথর, রড-সিমেন্টের দিকে না ঘুরিয়ে দিয়ে বরং জোরেশোরে বলতে পারেন, ঢাকা মহানগরের মোড়ে মোড়ে বেশি করে বৃক্ষ রোপন করতে হবে। মহানগরীর পরিবেশ ও সুস্বাস্থ্যের জন্য এরচেয়ে ভালো পদক্ষেপ আর কিছু হতে পারে না। প্রবীণ এই বৃক্ষপ্রেমীর কাছ থেকে এ ধরণের কোনো কল্যাণকর পদক্ষেপের ঘোষণা শোনার অপেক্ষা করতে দোষ কি?

দেড়-দুমাস পরেই জাতীয় নির্বাচন। সেটির জন্য টানটান টেনশন। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। তার জন্য দেশবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দা। তার জেরের আশংকায় দেশ এখনই কম্পমান। এ রকম একটি অবস্থায় একটি ভাষ্কর্য নিয়ে দেশের কিছু এক্টিভ মানুষের এত ব্যস্ত ও বিরক্ত হয়ে যাওয়া কতোটা প্রাসঙ্গিক?

যাই হোক বিমানবন্দর গোল চত্বর থেকে ভাষ্কর্য সরানোর বিক্ষুব্ধ দাবি ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ জানানোর পর সে ভাষ্কর্য সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সরকার অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে। বলেছে-নকশা ও নির্মাণের ত্রুটির জন্য এটা স্থগিত করা হয়েছে। কারো দাবির মুখে নয়। মুখে যাই বলুক, কাজটি সরকার ভালো করেছে এবং সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছে। ভবিষ্যতেও সরকারের কর্তব্য হবে যে কোনো উত্তেজক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শিল্পের মায়াবী হাতছানি থেকে বেঁচে থাকা। #

 

 

advertisement