যিলকদ ১৪২৯   ||   নভেম্বর ২০০৮

ইনসাফ : প্রীতি ও ভালোবাসার সোপান

আবিদা

পিতা-মাতা কি পছন্দ করবেন যে, তাদের সন্তানরা পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করুক। নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন না। অথচ এই বিষয়টিই  সৃষ্টি হয় যদি পিতা-মাতা সন্তানদের মধ্যে পার্থক্যমূলক আচরণ করেন। অন্যদিকে সমতা ও ইনসাফভিত্তিক আচরণের  দ্বারা এটা দূর করা যায়। এজন্য প্রথমেই যে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া জরুরি তা হচ্ছে উপহার-উপঢৌকন এবং দান ও অনুদানের ক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা।

বিগত মজলিসে আমি আচরণগত ইনসাফ সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা আপনাদেরকে শুনিয়েছি। আমি বলেছি যে, এ বিষয়ে নানাজী অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। অতএব তাঁর কোনো দৌহিত্র বা দৌহিত্রী কখনও একথা ভাবার সুযোগ পেত না যে, সে তাঁর কাছে অবহেলার পাত্র কিংবা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। এই সমতা ও ইনসাফের মাধ্যমে নানাজী দুটো বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন : ১. তার সকল নাতী-নাতনী তাকে ভালোবাসত এবং তাঁর স্নেহ ও নিরপেক্ষতার উপর আস্থা রাখত। ফলে তাঁর নির্দেশ ও নির্দেশনা তারা খুশি মনে গ্রহণ করত।

২. ছোটদের মধ্যে একে অপরের প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না, যা সাধারণত আচার-ব্যবহারে পার্থক্য করা হলে সৃষ্টি হয়ে থাকে।

আচার-ব্যবহার ছাড়াও আরেকটি ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে সমতা রক্ষা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হল সব ধরনের দান ও উপহারের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা। নানাজী যেমন আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করতেন তেমনি উপহার-উপঢৌকনের ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করতেন। এ বিষয়েও কোনোদিন তিনি তার নাতী-নাতনীদের মধ্যে পার্থক্য করেননি। এ প্রসঙ্গে অনেক সুন্দর দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা যায়। কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।

তার দেরাজে সব সময় নতুন টাকা থাকত, মাঝে মাঝে তিনি তা ছোটদেরকে উপহার দিতেন। কখনও যদি তিনি আমাদের কিছু টাকা উপহার দিতেন তাহলে অন্যান্য নাতী-নাতনীদেরকেও সমান হারে দিতেন, অন্তত আমার অন্য দু বোনকে তো অবশ্যই দিতেন। তারা যদি উপস্থিত না থাকত তাহলে তাদের অংশ আমার কাছে রেখে দিতেন।

 

তিনি আমাদেরকে নিকটবর্তী ফলের দোকানে নিয়ে যেতেন এবং আমাদের প্রত্যেককে কিছু টাকা দিতেন সমান হারে। এরপর প্রত্যেককে স্বাধীনতা দিতেন যেন তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো  কেনাকাটা করতে পারে।

 

আমার বোন একদিন আবদার করল, তিনি যেন তার ডায়েরিতে কিছু লিখে দেন। তিনি তার লেখায় বহুবচন ব্যবহার করলেন যেন আমরা তিন বোনই এতে শামিল হয়ে যাই। কিন্ত আমি এতে সন্তুষ্ট না হয়ে আমার ডায়েরি নিয়ে হাজির হলাম এবং আমার বান্ধবীদের ও আমার শিক্ষিকার লিখিত শুভেচ্ছা-মন্তব্য তাকে দেখালাম এবং আবদার করলাম যেন তিনিও আমার ডায়েরিতে কিছু লেখেন। তিনি তখন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় যদিও কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন কিন্তু আমার আবদার রক্ষা করেছিলেন।

তিনি মক্কায় অবস্থানকালে দামেশকে আমাদের মাদরাসায়  আমাদের তিন বোনের নামে চিঠি পাঠাতেন। প্রত্যেকের জন্য আলাদা খাম ব্যবহার করতেন এবং খামের উপর তার নাম লেখা থাকত। কতবার যে এই চিঠিগুলো আমাদের আনন্দিত করেছে এবং একটা বিশেষ গুরুত্বের অনুভূতিতে আমাদের বুক ভরে উঠেছে তা কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? দেশের বাইরে থেকে আমাদের নামে আলাদা খামে চিঠি এসেছে-এই অনুভূতির স্বাদই ছিল আলাদা।

আমার বয়স যখন বারো তখন আমি একটা নতুন ঘড়ির আবদার করেছিলাম। আমার পুরনো ঘড়িটি চাবি দিলে চলত আর চাবি না দিলে বন্ধ হয়ে যেত। তাই তারিখের ঘরওয়ালা একটা ব্যাটারি চালিত ঘড়ির খুব শখ আমার ছিল, কিন্তু আববু একথা বলে তা প্রত্যাখান করে দিয়েছিলেন যে, আমি এখনো ছোট। গ্রীষ্মের ছুটিতে নানাজী যখন বাড়িতে এলেন তখন কীভাবে যেন আমার আগ্রহ সম্পর্কে জানতে পারলেন। তিনি আম্মুকে বললেন, আমাদের তিন বোনকে নিয়ে যেন ঘড়ির দোকানে যান এবং প্রত্যেকের পছন্দ মতো ঘড়ি কিনে দেন। আমার দুবোন কিন্তু ঘড়ির কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেনি এবং আমার ঘড়ি কেনার ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তিও ছিল না; বরং আমার ছোট বোনের বয়স তখন ছিল মাত্র আট বছর। ঘড়ি ব্যবহার করা সম্পর্কে তার কোনো ধারণাও ছিল না।

পরবর্তী জীবনে-যখন আমি মা হয়েছি-তরবিয়তের এই পদ্ধতি আমার দুসন্তানের মধ্যে প্রীতির বন্ধন স্থাপনে অনেক সাহায্য করেছে। যখনই আমি আমার বড় পুত্রকে কোনো কিছু দিয়েছি, ছোট পুত্র, যার বয়স দুই, পূর্ণ আদব ও ধৈর্য্যের সঙ্গে অপেক্ষা করেছে, কোনো রকম আপত্তি বা প্রতিযোগিতা ছাড়া। যখনই বড় পুত্রকে আমি কোলে নিয়েছি কিংবা তার সঙ্গে খেলা করেছি তো ছোট পুত্রও অনুরূপ আদরের জন্য অপেক্ষা করেছে। কেননা, সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, বড় ভাইয়ার পর অবশ্যই তার পালা আসছে। এমনকি এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, বড় ভাই খাওয়ার আগে সে খায় না এবং বড় ভাই দুধ পান করার আগে সে দুধ পান করে না। এভাবে দুই ভাইয়ের মধ্যে ঈর্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। #

 

 

advertisement