মেহরে নবুওয়ত
‘মোহরে নবুওত’ কাযী মুহাম্মাদ সুলায়মান সালমান মানসুরপরী রাহ. রচিত একটি সীরাত পুস্তিকা। সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাষায় তিনি নবীজীর সীরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
সীরাত বিষয়ে তাঁর দ্বিতীয় ও বিখ্যাত রচনা- ‘রহমাতুল্লিল আলামীন।’ আলকাউসারের পাঠকবন্ধুদের জন্য প্রথম পুস্তিকার ধারাবাহিক অনুবাদ পেশ করা হচ্ছে।
আমাদের নবীর নাম ও বংশধারা এই -মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মানাফ।
তিনি আদনানের একুশতম অধস্তন পুরুষ। আর আদনান ছিলেন হযরত ইসমাঈল আ.-এর ৪০তম নামজাদা উত্তরপুরুষ। ইসমাঈল আ. ছিলেন হযরত ইবরাহীম আ.-এর বড় পুত্র।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৯ রবীউল আউয়াল সোমবার মক্কা নগরীতে জন্মলাভ করেন। তিনি পৃথিবীতে আসার আগেই তাঁর পিতার ইন্তেকাল হয়ে গিয়েছিল। ছয় বছর বয়স হওয়ার পর মা-ও ইন্তেকাল করেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমেনা। তিন পুরুষ উপরে গিয়ে তাঁদের বংশ এক হয়ে যায়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স যখন আট বছর দুই মাস দশ দিন তখন তাঁর দাদাও ইন্তেকাল করেন। দাদার ইন্তেকালের পর চাচা আবু তালিব তাঁর দেখাশুনার ভার গ্রহণ করেন। আবু তালিব ছিলেন নবীজীর পিতা আব্দুল্লাহর আপন ভাই।
বার বছর বয়সে চাচার সঙ্গে শাম দেশের উদ্দেশ্যে সফরে গিয়েছিলেন, কিন্তু পথিমধ্যে সফর সমাপ্ত করে মক্কায় ফিরে আসেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যৌবনে কিছু দিন ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। পঁচিশ বছর বয়সে মক্কা নগরীর অত্যন্ত সচ্ছল ও বিদুষী নারী হযরত খাদীজা রা.-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর তাঁর পূর্ণ সময় আল্লাহ তাআলার ইবাদত এবং মানুষের সেবায় অতিবাহিত হতে থাকে।
নবুওত লাভের পাঁচ বছর আগে, যখন তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর, তখন কাবা শরীফে হজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশ গোত্রের লোকদের মধ্যে বড় ধরনের ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়েছিল। সবাই তখন সত্যবাদী ও আমানতদার জেনে তাঁর ওপরই মীমাংসার ভার অর্পণ করেছিল। তিনি এত সুন্দর সমাধান দিয়েছিলেন যে, সবাই খুশি মনে তা মেনে নিয়েছিল।
নবুওয়ত লাভ
যখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর এক দিন হল তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসল যে, আপনি আল্লাহর নবী। স্ত্রী-খাদীজা রা., ভাই আলী মুরতাজা (বয়স দশ বছর), বন্ধু আবু বকর সিদ্দীক ও মাওলা যায়েদ ইবনে হারিছা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি ঈমান আনলেন। এরপর হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর প্রচেষ্টায় উছমান গনী, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ, তলহা, যুবায়ের মুসলমান হলেন। রাযিয়াল্লাহু আনহুম। এঁদের পরে আবু সালামা, আরকাম, উছমান, সায়ীদ ইবনে যায়েদ, ইয়াছির, আম্মার, বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহুম ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদীজা রা. ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কন্যাদের পর উম্মুল ফযল (হযরত আববাস রা.-এর স্ত্রী) নবীজীর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। এরপর আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর কন্য আসমা রা., এরপর উমর ফারুক রা.-এর বোন ফাতিমা রা. ইসলাম গ্রহণ করলেন।
তিন বছর পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনে লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। এরপর আল্লাহর আদেশে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন। যার সঙ্গেই তার সাক্ষাত হত তাকেই তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতেন।
মক্কার লোকেরা দেখল, যারা ইসলাম গ্রহণ করে তারা মূর্তিপূজা ছেড়ে দেয়। তারা তখন মুসলমানদেরকে কষ্ট দিতে শুরু করল। দুই বছর পর্যন্ত মুসলিমগণ অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। এরপর অতিষ্ঠ হয়ে তারা মক্কা নগরী ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাওয়ার সংকল্প করলেন।
নবুওয়তের ৫ম বর্ষ
নবীজীর দ্বিতীয় কন্যা রুকাইয়া ছিলেন উছমান রা.-এর স্ত্রী। রজব মাসে হযরত উছমান রা. সর্বপ্রথম স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে হাবাশার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নবী হযরত লূত আ.-এর পর উছমানই হল প্রথম ব্যক্তি, যে আল্লাহর রাস্তায় ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করেছে।
সমুদ্রের উপকুলে পৌঁছতে পৌঁছতে আরও পাঁচজন নারী ও বারোজন পুরুষ তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। তাদের পরে আরো অনেক মুসলিম হাবশায় হিজরত করেছেন, যাদের মধ্যে হযরত জা’ফর তয়্যার রা.ও ছিলেন। ইনি হযরত আলী রা.-এর আপন ভাই।
নবুওয়তের ৬ষ্ঠ বর্ষ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা হামযা রা. ইসলাম গ্রহণ করলেন। তাঁর ইসলামগ্রহণের তিন দিন পর উমর ফারুক রা.ও মুসলমান হলেন। এতদিন পর্যন্ত মুসলিমগণ গোপনে নামায পড়তেন, এবার প্রকাশ্যে কা’বা শরীফে গিয়ে নামায আদায় করতে থাকেন।
নবুওয়তের ৭ম বর্ষ
কুরাইশ গোত্রের লোকেরা নিজেদের মধ্যে একটি শপথনামা তৈরি করল যে, কেউ মুসলমানদের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক ও লেনদেন করবে না। হাশেমী বংশের লোকদের সঙ্গেও সব ধরনের মেলামেশা বন্ধ। কেননা, তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেনি। তাদের এই বয়কটের কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হাশেমী বংশের লোকেরা একটি পাহাড়ের উপত্যকায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এই উপত্যকার নাম শি’বে আবী তালিব। মক্কার লোকেরা সেখানে কোনো খাদ্যদ্রব্যও পৌঁছতে দিত না। ক্ষুধার কষ্টে শিশুরা যখন চিৎকার করত তখন সে আওয়াজ শহর থেকেও শোনা যেত। কারো মনে কিছু মায়ার সঞ্চার হলে সে কিছু তরিতরকারি রাতের অাঁধারে ওই উপত্যকায় পৌঁছে দিত। এতসব কষ্ট ভোগ করেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার পবিত্র নাম ও সত্য দ্বীন প্রচার করতে থাকলেন। (চলবে ইনশাআল্লাহ)