যিলকদ ১৪২৯   ||   নভেম্বর ২০০৮

তালেবানে ইলমে নবুওয়তের প্রতি কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশনা

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ১৪২৪ হিজরীতে একবার মারকাযুদ দাওয়াহ থেকে শিক্ষা সমাপনকারী সকল তালিবে ইলমকে মারকাযে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল,তাদের কর্মজীবনের ব্যস্ততা সম্পর্কে অবগতি লাভ করা এবং তাদের  সঙ্গে মতবিনিময় করা। এ সময় মারকাযের আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু প্রয়োজনীয় কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। বিষয়টি জানার পর কিছু বন্ধু আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় তা প্রকাশ করার অনুরোধ করেন যেন মাদরাসার নেসাববদ্ধ পড়াশোনা সমাপ্ত করে কর্মজীবনে পদার্পণকারী তালাবায়ে কেরামের সামনে কথাগুলো থাকে। এ পরামর্শ আমাদের কাছেও মুনাসিব বলে মনে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে, সকল তালিবে ইলমকে এই বিষয়গুলোর ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 আমীনুত তালীম

মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তাসনীফ প্রসঙ্গ

দাওয়াত, তাবলীগ এবং তারবিয়াতের ক্ষেত্রে তাসনীফ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এরও কিছু নীতিমালা রয়েছে। তাসনীফ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। প্রত্যেক প্রকার তাসনীফের জন্য পৃথক মূলনীতি এবং স্বতন্ত্র পন্থা রয়েছে।

আবু বকর ইবনুল আরাবী রাহ. আরিযাতুল আহওয়াযী-এর মুকাদ্দিমায় যে কথাটা বলেছেন অর্থাৎ বিষয়বস্ত্ত কিংবা আঙ্গিক কোনো না কোনো দিক থেকে নতুন কিছু যিনি প্রদান করতে পারবেন শুধু তারই উচিত রচনার অঙ্গনে প্রবেশ করা।

তার এ কথায় অনেকে হিম্মত হারিয়ে ফেলেন এবং কোনো না কোনো ধরনের তাসনীফের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এ অঙ্গনে প্রবেশ করেন না। আবার অনেকের অবস্থা এর সম্পূর্ণ উল্টো। তারা উপরোক্ত মূলনীতির কোনো পরোয়াই করেন না। ফলে তাদের রচনা আক্ষরিক অর্থেই শুধু কাগজ কালো করার শামিল হয়ে থাকে।

বস্ত্তত তাসনীফের বেশ কিছু প্রকার রয়েছে। যথা-

১. দাওয়াত বিষয়ক বা আম-জনগণের উদ্দেশ্যে তাসনীফ।

২. দরসী তাসনীফ।

৩. শাস্ত্রীয় তাসনীফ, যার পাঠক উলামা ও মুহাক্কিকীন।

৪. অনুবাদ।

৫. তথ্য ও উপাত্ত সংকলন।

৬. অপ্রাসঙ্গিক স্থান থেকে কাওয়াইদফাওয়াইদ আহরণ।

৭. দীর্ঘ রচনাবলির সার-সংক্ষেপ প্রস্ত্ততকরণ (বিশেষ কোনো ফায়েদার উদ্দেশ্যে এবং নতুন কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হওয়ার শর্তে)।

৮. তুলনামূলক বিশ্লেষণধর্মী তাসনীফ।

৯. মুনাজারাধর্মী তাসনীফ।

১০. মুখস্থ করা বা পাঠদানের উদ্দেশ্যে মৌলিক বা সংক্ষিপ্ত তাসনীফ।

১১. ব্যাখ্যামূলক তাসনীফ।

১২. টীকা।

১৩. তাহকীক ও তালীক।

১৪. নির্ঘন্টায়ন।

১৫. প্রবন্ধ-নিবন্ধ।

১৬. তালেবে ইলমের উদ্দেশ্যে তাসনীফ।

১৭. অনুশীলনমূলক রচনা ইত্যাদি।

এরপর রচনার ভাষা আরবী হতে পারে, লেখকের মাতৃভাষা হতে পারে অথবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক ভাষা হতে পারে।

এরপর যেকোনো ধরনের রচনার বিষয়বস্ত্ত যে কত বিচিত্র হতে পারে তা তো একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। সব প্রকারের তাসনীফের ভাষা ও উপস্থাপনা এক হয় না। এছাড়া সকল বিষয়ও এমন নয়, যার উপর একই ধরনের বা একই মাপের একাধিক তাসনীফ থাকা দোষের ব্যাপার। অতএব এ বিষয়ে একটি রচনা বিদ্যমান আছে বলেই আপনি নতুন তাসনীফ থেকে বিরত থাকবেন এটা ঠিক নয়; বরং যে সব তাসনীফ সাধারণ মানুষের জন্য  হয়ে থাকে তার অধিকাংশই এমন, যাতে একাধিক রচনা থাকাটা দোষনীয় তো নয়ই; বরং খুবই দরকার এবং কাম্য। এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বলুন তাখাসসুসকারীদের মধ্যে কয়জন  এমন আছেন, যিনি কোনো প্রকারের তাসনীফে সক্ষম নন?

 

২. বস্ত্তত ইলমী তরক্কী এবং তাসনীফ ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে কাজ করার একটি বড় প্রতিবন্ধক হল, আমরা মা-লা ইউদরাকু কুল্লুহু লা ইউতরাকু কুল্লুহু নীতির উপর আমল করতে জানি না। অল্প সময় ও অল্প উপকরণ থেকে কীভাবে অধিক কাজ করা যায়-এই ফিকির আমাদের মধ্যে নেই। সময় বা উপরণের স্বল্পতা বা পরিবেশের প্রতিকূলতা কাজে প্রতিবন্ধক না হওয়া উচিত। এগুলোকে প্রতিবন্ধক মনে করা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের উদাসীনতা ও চিন্তা-ভাবনার সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক। চিন্তা করুন তো তালিবে ইলমের জন্য পথনির্দেশিকা প্রস্ত্তত করা কার পক্ষে অসম্ভব? অনেক বন্ধু এমন আছেন যারা হিম্মত করলে দরসী তাসনীফের কাজেও হাত দিতে পারেন। আর কেবল সাধারণ মানুষের উপযোগী তাসনীফই নয়; অনেক ইলমী তাসনীফের জন্যও কুতুবখানার প্রয়োজন হয় না; শুধু কুরআনে কারীম, সাথে একটি নির্ভরযোগ্য সংক্ষিপ্ত তাফসীর এবং মিশকাতুল মাসাবীহ এ বিষয়ে যথেষ্ট। শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর   তাকবিয়াতুল ঈমান ওয়া তাযকীরুল ইখওয়ান দেখুন, যা একটি অতুলনীয় কিতাব। কিন্তু এর তথ্য-উৎস এই দুইটিই। দরসী কিতাবসমূহের টীকাগুলোতে যে উলূম ও মাআরিফ, ফাওয়ায়িদ ও কাওয়ায়িদ বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে তা একত্র করলেও কয়েকটি কিতাব রচিত হতে পারে এবং আরো কয়েক কিতাবের জন্য তথ্য সংগ্রহ হতে পারে। হাদীসের অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় যুক্ত বন্ধুরা শুধু এক ফাতহুল বারী-এর সাহায্যেই কত কাজ করতে পারেন। উসূলে হাদীস, উসূলে জারহ ওয়া তাদীল, কাওয়ায়িদে শরহে হাদীস, কাওয়ায়িদে ফিকহ ও শরীয়ত, আকাইদ ও কালাম সম্পর্কীয় কাওয়ায়িদ ও ফাওয়ায়িদ, ইলমী ইসতিদরাকাত, ফাওয়ায়িদে হাদীসিয়্যাহ, অন্যান্য উলূম ও ফূনুনের মাসায়িল, হানাফী মাযহাবের মুআইয়িদাত ইত্যাদি এই কিতাবে বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্যমান রয়েছে। এসব বিক্ষিপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একেকটি কিতাব রচনা করা যেতে পারে।

ইফতার তালিবে ইলমগণ শামী ও বাহর থেকে অনেক  বিষয়ের তথ্যাবলি সংগ্রহ করতে পারেন। উসূলে ফিকহ, কাওয়ায়িদে ফিকহ, উসূলে ইফতা এবং বিভিন্ন অধ্যায়ে প্রসঙ্গত উল্লেখিত অন্য বিষয়ের মাসাইল এবং ফিকহ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের তথ্যাবলিও এ দুই গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। আর এ ওসীলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব আদ্যোপান্ত মুতালাআ হয়ে যাবে। এতে কয়েক বছর লেগে গেলেও ক্ষতি নেই। কারণ কয়েক বছরেও পূর্ণ কিতাব মুতালাআ হওয়াটা এক বিরাট নিয়ামতের বিষয়।

বয়ানুল কুরআন, মাআরেফুল কুরআন, তাফসীরে ইবনে কাসীর, রূহুল মাআনী, মাআরিফুস সুনান, ফয়যুল বারী ইত্যাদি কিতাবগুলোর প্রতিটি থেকে একাধিক গ্রন্থ রচিত হতে পারে। মাওলানা মনযূর নুমানী রাহ.-এর রচনাবলি দেখুন। তার কাছে কতইবা মাসাদির ছিল। আর তার কুতুবখানাই বা কত বড় ছিল। আর মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর আলোচনা তো ইতিপূর্বে হয়েছে।

একজন বন্ধু কুরআনে কারীমের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কিছু সহজ রচনামূলক কাজের নির্দেশনা চেয়েছিলেন। তাকে আমাদের এখান থেকে প্রায় ত্রিশটি বা এরও বেশি কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যার অধিকাংশ কাজের জন্য শুধু কুরআনে হাকীম এবং সহায়ক হিসেবে কোনো নির্ভরযোগ্য সংক্ষিপ্ত তাফসীর কাছে রাখাই যথেষ্ট।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement