যিলকদ ১৪২৯   ||   নভেম্বর ২০০৮

বাইতুল্লাহর মুসাফির-১৫

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

নূরানি চেহারার বৃদ্ধ আরব, উট- দুটিকে সাদরে নহর করার স্থানে নিয়ে গেলেন এবং সত্যি বলছি, আল্লাহর নামে কোরবান হবে বলে, মনে হলো, ওরা খুব খুশী! আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। বৃদ্ধ উটদুটিকে বসালেন, গলায়-পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করলেন এবং ওরা যেন সে আদর গ্রহণ করলো!

বৃদ্ধ বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে উটদুটিকে নহর করলেন। গল গল করে রক্ত প্রবাহিত হলো। দুটি উটের একটিও নড়াচড়া করলো না; হাঁটু গেড়ে গলা উঁচিয়ে বসেই থাকলো। তারপর শুধু কাত হয়ে পড়ে গেলো। আমি অভিভূত দৃষ্টিতে দেখলাম আল্লাহর নামে কোরবান করা এবং আল্লাহর নামে কোরবান হওয়ার অভূতপূর্ব দৃশ্য! আমার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। আমি কাছে গিয়ে উটদুটির গায়ে হাত বুলালাম।  ভাবতে ইচ্ছা করলো, এরা আমার চেয়ে ভাগ্যবান, কিন্তু ভাবলাম না, কারণ সকল অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও আমি যে ইনসান!

এক বাঙ্গালী হাজী, পশ্চিম বঙ্গের, বেদুঈন উটওয়ালাকে কাকুতি মিনতি করে কী যেন বোঝাতে চাচ্ছেন, কিন্তু কেউ কারো বক্তব্য বুঝতে পারছে না। আমি এগিয়ে গেলাম। হাজী ছাহেব বলতে চাচ্ছেন, উটটি তার খুব পছন্দ। এত পছন্দের উটটিকে কোরবানি করতে না পারলে তার  আফসোসের সীমা থাকবে না । উটওয়ালা যা চায় তাই সে দিতে রাজী, কিন্তু তার কাছে যে অত টাকা নেই! হাজী ছাহেব কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, ভাই! উটওয়ালাকে বুঝিয়ে বলুন, যেন একটু দয়া করে।

বাঙ্গালী হাজী ছাহেবের এ অভিব্যক্তি আমার ভালো লাগলো। আমি বেদুঈনকে বুঝিয়ে বললাম। এই সরল বেদুঈন যেন সে যুগের আরব বেদুঈন! তিনি হাজী ছাহেবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন, যাও, তুমি যা পারো তাই দিয়ে নিয়ে যাও।

আল্লাহর শোকর! কোরবানি করার জন্য না হলেও আজ আমি এসেছিলাম কোরবানির দৃশ্য অবলোকন করার জন্য! এমন দৃশ্যের দর্শক হতে পারাও কি কম সৌভাগ্যের!

হঠাৎ কানে এলো উচ্চ স্বরে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার! আমি চমকে উঠলাম, ভীষণভাবে চমকে উঠলাম! এ আওয়ায তো আমার আববার আওয়ায! এমন আবেগ ও জাযবায় উদ্দীপ্ত কোরবানির তাকবীর তো আমি শুনেছি শুধু আমার আববার কণ্ঠে! পিছনে ফিরে তাকালাম। বিরাটদেহী এক আলহাজ কোরবানি করছেন বিরাট কোন উট নয়, গরু নয়, ছোট্ট একটি দুম্বা! জবাই শেষে ছুরি হাতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। ছুরির ডগা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে, আর চোখের পাতা থেকে ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু! এমন আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য সারা জীবনে কি দুবার দেখা যায়! আজ যদি এখানে আসা না হতো তাহলে কি এমন দৃশ্য দেখার নছীব হতো আর কখনো!

জান্নাত থেকে বিরাট এক উট আসতে পারতো, আসতে পারতো মোটাতাজা গরু, অথচ এসেছিলো ছোট্ট একটি দুম্বা! কারণ আল্লাহর কাছে তো পৌঁছে না রক্ত বা গোশত, পৌঁছে শুধু কলবের তাকওয়া।  জানি না কোন্ দেশের হাজী তিনি! তবে তার আবেগময় কণ্ঠের তাকবীর এবং ছোট্ট দুম্বার কোরবানি আমাকে সেকথাই যেন আবার স্মরণ করিয়ে দিলো।

মিনার কোরবানিগাহে সেদিনের দেখা আরো অনেক দৃশ্যের কথা আমি এখানে লিখতে পারি। সেদিন আমি কোরবানি করার দৃশ্য যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি অনেক জবাই করার দৃশ্য।

প্রিয় পাঠক, জবাই করার দুএকটি ঘটনা কি লিখবো? থাক! আমাদের তো কর্তব্য হলো জীবনে যখন যেখানে যা কিছু সুন্দর দেখি তা কুড়িয়ে নেয়া এবং সবার সামনে তুলে ধরা, আর যা কিছু অসুন্দর তা আড়াল করে রাখা। কবির ভাষায়-

 

গোলাবের খোশবু ছড়িয়ে পড়ুক তোমার গানের সুরে/ কাঁটার আঘাতে রক্ত ঝরা লুকিয়ে থাকুক বুকে।

মানহার থেকে বের হওয়ার সময় আমার হৃদয় অত্যন্ত আপ্লুত ছিলো। আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ যেন সবাইকে কোরবানি করার তাওফীক দান করেন এবং সবার কোরবানি কবুল করেন। পশুর গলায় যখন ছুরি চালাই তখন আমরা যেন আল্লাহর মুহববত ছাড়া অন্যসব মুহববতের গলায় ছুরি চালাতে পারি। পশুকে জবাই করার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের পশুটিকেও আমরা যেন  জবাই করতে পারি। সেই যে আমাদের কাজী কবি বলেছেন তার কোরবানি কবিতায়!

তাঁবুতে ফিরতে ফিরতে মাগরিবের পর হয়ে গেলো। নম্বর ও চিহ্ন মনে থাকার পরো তাঁবুর এই বিশাল রাজ্যে নিজের তাঁবুটি খুঁজে বের করতে অনেক ধকল পোহাতে হলো। তাঁবুতে প্রবেশ করে যা দেখবো ধারণা ছিলো তাই দেখলাম; হযরত তাঁর মুছল্লায় যিকির-তাসবীহাতে মশগুল। দেখা করলাম। হযরত আমার আগে খোঁজ নিলেন আমার নামাযের; জিজ্ঞাসা করলেন, আছর ও মাগরিব জামাতের সাথে পড়েছি কি না! এভাবে পুরো সফরে হযরত সবার খবর রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় তারবিয়াত করতেন।

হযরতকে আমি মানহারের বিভিন্ন ঘটনা বললাম; সেই আরব ও তার উটদুটির কথাও বললাম। হযরত খুব আশ্চর্য প্রকাশ করে বললেন, হতে পারে তোমার ধারণাই সত্য! হতে পারে এগুলো সেগুলোরই বংশধর।

মানুষকে আল্লাহ এত দুর্বলতা দিয়ে কেন তৈরী করেছেন কে জানে! মানুষের অনেকগুলো দুর্বলতার মাঝে একটি হলো ক্ষুধা। হৃদয়ের একটু  নীচেই তো উদরের অবস্থান; তাই ভাবের রাজ্যেও ক্ষুধা এসে হানা দেয় অবলীলাক্রমে! আমারও ভাবের রাজ্য উধাও হয়ে গেলো ক্ষুধার হামলায়। সম্ভবত আজ সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি।

 

 হযরতের বিছানার চারপাশে তাকালাম। অন্যসময় কিছু না কিছু থাকে; এখন কিছু নেই। থাকলে হয়ত হযরতকে বলতাম ক্ষুধার কথা। এখন কিছু বলা মানে তাঁকে পেরেশান করা। তাই কিছু না বলেই তাঁবু থেকে বের হলাম। বরং বলা ভালো, কেউ যেন আমাকে বের করলো! আমার ভিতরের আমি যেন বললো, তাঁবু থেকে বের হও, তোমার কারীম মেযবান তোমার জন্য দস্তরখানের ইনতিযাম করে রেখেছেন। দুকদম  হেঁটে তোমাকে শুধু পৌঁছতে হবে দস্তরখান পর্যন্ত।

তাঁবু থেকে বের হয়ে অনির্দিষ্টভাবে হাঁটছি, আর মনে মনে বলছি, হে আল্লাহ, তোমার বান্দার ক্ষুধা পেয়েছে, ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। তুমি ছাড়া কে পারে বান্দার ক্ষুধার কষ্ট দূর করতে!

হাঁটতে হাঁটতে কত দূর এসেছি খেয়াল ছিলো না, হঠাৎ কে একজন হাত ধরে কোমলভাবে আকর্ষণ করলো! পিছনে ফিরে দেখি, এক আরব হাজী একটু দূরে তাদের

দস্তরখান দেখিয়ে ইশারায় দাওয়াত দিচ্ছেন। আমার মুখে বিশুদ্ধ আরবী শুনে তিনি কিছুটা অবাক হলেন এবং আমার পরিচয় নিলেন এবং আরো অন্তরঙ্গভাবে দাওয়াত দিলেন। কৃত্রিম সংকোচ বাঙ্গালীর একটি স্বভাবদোষ। ভিতরে হাঁ, হাঁ করলেও মুখে বলবে, না, না! আমিও না, না করে বললাম, আপনাদের দস্তরখানে আল্লাহ বরকত দান করুন, আপনারা খেতে থাকুন, আমার শরীক হওয়ার ইচ্ছে নেই।

আসলে এটা ছিলো অসত্য কথা; আমার তো শরীক হওয়ার ষোল আনা ইচ্ছে ছিলো। ভাগ্য ভালো, তিনি ছিলেন আরব! আর কালের ব্যবধান স্বীকার করে নিলেও সে যুগের আরবরক্ত তো এ যুগের আরবদের শিরায়ও প্রবাহিত। পথের মেহমানকে একজন আরব সহজে হাতছাড়া করে না। তিনি আমাকে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলেন।

দস্তরখানের অন্য সকলে এমনভাবে আহলান ওয়া সাহলান বলে স্বাগত জানালেন যে, মুহূর্তে অপরিচয়ের সব সংকোচ দূর হয়ে গেলো।

 রুটি ছিলো, আস্ত ভুনা দুম্বা ছিলো এবং তা ছিলো আজকের কোরবানির দুম্বা। তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম।

এরা ছিলেন ইয়ামানের হাজী এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। পাশেই তাদের তাঁবু। ভিতরে যথেষ্ট গরম, তাই তারা তাঁবুর বাইরে খোলা জায়গায় দস্তরখান বিছিয়েছেন। কিন্তু মেহমান না হলে তো আরবদের দস্তরখান পূর্ণতা লাভ করে না! তাই দূর থেকে দেখে আমাকে তারা ধরে এনেছেন!

এসব কেন হলো, কীভাবে হলো! আমি কেন তাঁবু থেকে বের হলাম এবং এদিকেই হেঁটে এলাম! তারা কেন তাঁবুর বাইরে দস্তরখান বিছালেন এবং আমাকে দেখে ডেকে আনলেন! এসব প্রশ্নের জবাব আমিও খুঁজে পাবো না, তুমিও পাবে না। শুধু বলতে পারি, তিনি বিশ্বজাহানের রিযিকদাতা; তদুপরি এখানে এই পাক ভূমিতে যাদের তিনি ডাক দিয়ে এনেছেন, আরব কিংবা আজম, নেককার কিংবা বদকার, সবাই তাঁর মেহমান এবং তিনি তাদের মেযবান!

আমি শুধু আসমানের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার ক্ষুধা দূর হয়েছে হে আল্লাহ! বড় তৃপ্তির খাবার খেলাম; তুমি খাওয়ালে! কীভাবে কোন্ ভাষায় তোমার শোকর আদায় করবো, আমি জানি না হে আল্লাহ! কবি কত না সত্য কথা বলেছেন- খোদা তোমায় ডাকতে জানি না/ ডাকার মত ডাকলে খোদা কেমনে শোনে না!

আমি তো ডাকার মত ডাকিনি, তবু তিনি ডাক শুনেছেন এবং দস্তরখানে ডেকে এনেছেন। শোকর আহামদু লিল্লাহ!

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে এবং খাওয়ার পর গাহওয়া-এর মজলিসে অনেক কথা হলো। তাদের আরবী বোঝা আমার জন্য কষ্টকর ছিলো, তবে আমার আরবী তারা স্বচ্ছন্দে বুঝতে পারছিলেন। অধিকাংশ আরব এখন বিশুদ্ধ আরবী বলতে পারেন না, তবে মোটামুটি বুঝতে পারেন। আলোচনা হয়েছিলো ফিলিস্তীন সম্পর্কে, ইরাক-ইরান যুদ্ধ সম্পর্কে এবং মুসলিম উম্মাহর বর্তমান ও ভবিষ্যত বিষয়ে। আলোচনা যদিও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, কিন্তু হজ্বের সাথে সম্পর্কিত নয় বলে এখানে থাক সে প্রসঙ্গ। তবে গাহওয়া সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। আরবদের খুব প্রিয় পানীয় এবং আপ্যায়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ছোট ছোট কাপে সামান্য পরিমাণ করে পরিবেশন করা হয়। সঙ্গে গোলমরিচের গুঁড়াজাতীয় কোন মশলা মেশানো হয়। তেতো, তবে স্বাদু, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। শরীরও বেশ সতেজ বোধ হয়। এখনো গাহওয়া আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু মাঝে মধ্যে কোন আরবের সান্নিধ্য ছাড়া পান করার সুযোগ বড় একটা হয় না।

যাই হোক, বড় তৃপ্তির সঙ্গে গাহওয়ার কাপে শেষ চুমুকটি দিয়ে আমি তাদেরকে জাযাকাল্লাহু বলে নিজের তাঁবুর দিকে রওয়ানা হলাম। আমার অন্তর তখন আল্লাহর প্রতি শোকরের অনুভূতিতে ছিলো গভীরভাবে আপ্লুত। শোকর ও কৃতজ্ঞতার এমন অনুপম অনুভূতি হৃদয়ের গভীরে জীবনে খুব কমই হয়েছে। কারণ এমন ক্ষুধাও জীবনে খুব কমই লেগেছে। ক্ষুধার্ত মানুষের দেখা তো অনেক পেয়েছি, ক্ষুধার পরিচয় এমন করে আর কখনো পাইনি। সারা জীবন ক্ষুধার আগেই আল্লাহ আমার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন; সম্ভবত আজই প্রথম ক্ষুধার পরে খাদ্যের ব্যবস্থা হয়েছে। তাই আজ অন্যরকম এক উপলব্ধির সঙ্গে বুঝতে পারলাম রিযিক ও রায্যাকের পরিচয়।

তাঁবুতে ফিরে আসছি, হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সেই হাদীছ- পাখীরা সকালে খালি পেটে নীড় ছেড়ে বের হয়, আর সন্ধ্যায় নীড়ে ফিরে আসে ভরপেটে। আমি তো কিছুটা সেই পাখীদের মতই হলাম! ক্ষুধার্ত পেটে তাঁবু থেকে বের হলাম, আর তৃপ্ত উদরে তাঁবুতে ফিরে এলাম! তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!

মিনায় যে কদিন ছিলাম, আমি ও মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ তাঁবুর বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নীচেই রাত যাপন করেছি। মিনার সেই রাতগুলোর সুখস্মৃতি কখনো ভোলবার নয়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ এবং মিটিমিটি অল্পকটি তারকার দিকে তাকিয়ে কত রকম ভাব ও ভাবনার উদয়-অস্ত যে হতো আমাদের মনের আকাশে! সব যদি ধরে রাখা যেতো! সব যদি আজ তুলে আনা যেতো কলমের কালিতে!

মনে পড়ে, তখন আমরা ভেবেছিলাম, ঠিক এই চাঁদ-তারাদেরই তো দেখেছিলেন আমাদের বাবা আদম! এই চাঁদ-তারারই আলোকসজ্জায় মুগ্ধ হয়েছিলেন আমাদের মা হাওয়া, যখন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর আদমকে, এই পবিত্র ভূমিতে! নির্জন মক্কাভূমিতে খোলা আসমানের নীচে শুয়ে থাকা শিশু ইসমাঈল এই চাঁদ-তারাদের দেখেই তো অবাক হয়েছিলেন! এই চাঁদ-তারাদের সঙ্গেই তো খেলা করেছিলেন! এই চাঁদ-তারাদের সম্পর্কেই তো শিশুসুলভ কত প্রশ্ন তিনি করেছিলেন মা হাজেরাকে! কিংবা হয়ত শিশু ইসমাঈলের জিজ্ঞাসা ছিলো শিশু ইসমাঈলেরই মত এবং মা হাজেরার উত্তর ছিলো মা হাজেরারই মত; অন্য শিশুদের মত নয় এবং নয় অন্য মায়েদের মত!

 

হয়ত শিশু ইসমাঈল জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আম্মা! কোত্থেকে এসেছে এই চাঁদ-তারা? কীভাবে ভেসে বেড়ায় এগুলো আসমানে? মা হাজেরা হয়ত বলেছিলেন, বাবা! এগুলো সব আল্লাহর সৃষ্টি; এগুলো সব আল্লাহর কুদরত! আল্লাহর হুকুমে এভাবে আসমানে ভেসে বেড়ায়।

ঠিক এই চাঁদ-তারাগুলোই তো আমাদের পেয়ারা নবী ও তাঁর ছাহাবাগণ দেখেছিলেন এখানে এই মিনার আসমানে! এই চাঁদ ছিলো এবং ছিলো চাঁদের জোসনা! এই তারকারাজি ছিলো এবং ছিলো তাদের মিটিমিটি আলো! এই চাঁদেরই জোসনায় আল্লাহর নবী স্নাত হয়েছিলেন এখানে এই মিনার রাতে! আজ আমি- আমার মত তুচ্ছ এক উম্মতি- সেই চাঁদ-তারাদেরই  তো দেখছি এই চাঁদ-তারাদের

মাঝে, এই মিনার মরুভূমিতে, এই উন্মুক্ত আকাশের নীচে শুয়ে শুয়ে! এই চাঁদের জোসনার মাধ্যমে আমি তো আজ অবগাহন করছি সেই চাঁদেরই জোসনায়! ধন্য আমি, ধন্য আমার জীবন! কত দয়াবান তুমি হে আল্লাহ! কত মেহেরবান তুমি হে কারীম! তোমার পাক কালামে তুমি বলতে বলেছো, আমি বলছি হে আল্লাহ!

.....

আমার ছালাত এবং আমার হজ্ব এবং আমার জীবন, আমার মরণ সবই রাববুল আলামীন আল্লাহর জন্য!

 হে আল্লাহ, আমরা তো বলেছি আমাদের মত, তুমি কিন্তু কবুল করে নাও তোমার মত! যেমন তোমার শানে করম! যেমন তোমার শানে রহম!

রাতের মিনায় আসমানের চাঁদ-তারাদের দেখে আমি অপূর্ব এক সান্ত্বনা লাভ করতাম। মধুর এক আবেগে আপ্লুত হয়ে ভাবতাম, আমি তো শুধু বর্তমানের নই; আমি তো অতীতেরও! মিনার আকাশের এই চাঁদ তো আমার কালিমালিপ্ত বর্তমানকে আড়াল করে আমাকে দেখায় আমার সুন্দর সমুজ্জ্বল অতীতকে। আজকের এই চাঁদের জোসনার মাঝে আমি তো অনুভব করি আমার সেই অতীতের স্নিগ্ধতা! আধুনিক জীবন এবং আধুনিকতার কোন বিড়ম্বনা আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না সেই স্নিগ্ধ সমুজ্জ্বল অতীত থেকে! যত দিন এই মিনার প্রান্তর আছে, এই আকাশ আছে, এই চাঁদ আছে এবং আছে চাঁদের জোসনা তত দিন আছে অতীতের সঙ্গে আমার এই পবিত্র বন্ধন।

প্রিয় পাঠক! এবার একটি স্বপ্নের কথা শোনো। অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছিলাম মিনার ময়দানে। আমার সামনে, পিছনে এবং ডানে,বাঁয়ে ধু-ধু প্রান্তর। কোথাও না আছে কোন তাঁবু, না তাঁবুবাসী। এমন সময় দেখি, আমার সামনে একটি ...

না, থাক; হযরত বলেছিলেন, বহুত মোবারক খাব, এ খাবের কথা কথা কাউকে বলো না। আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি।

স্বপ্নটা এখানে লিখেছিলাম, মনের সঙ্গে মুজাহাদা করে আবার তা মুছে   ফেললাম। আমার আম্মা বারবার  সতর্ক করে বলছেন, সব কথা তো কাগজে লেখার বিষয় না।

আসলে লেখার চেয়ে না লেখার জন্য যে কত বেশী শক্তির প্রয়োজন তা এ সফরনামায় বারবার আমি অনুভব করছি।

যারা লেখেন তারা জানেন, কখনো একটি শব্দের, একটি বাক্যের,  কখনো একটি তথ্যের, একটি বক্তব্যের লোভ সম্বরণ করা সত্যি  কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ তা সম্বরণ করার মাঝেই সুপ্ত থাকে লেখার প্রকৃত সৌন্দর্য! আমার কলমের এই ক্ষুদ্র জীবনে না লেখার জন্য আফসোস করেছি কম, লেখার জন্য আফসোস করেছি এবং লজ্জা পেয়েছি অনেক বেশী। প্রসঙ্গ থেকে সরে গেলাম, তবে আশা করি আল্লাহর কোন না কোন বান্দার উপকারে আসবে।

ফিরে আসি আসল প্রসঙ্গে। এগার তারিখে যোহরের পর হযরতের সঙ্গে রামী করতে রওয়ানা হলাম।  হযরত বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তাঁকে বলা হলো, আপনি তাঁবুতে থাকুন, আমরা আপনার পক্ষ হতে রামী করে নেবো।

আমাদের নিয়ত ছিলো ভালো, কিন্তু বুঝ ছিলো কম। আসলে অনেক সময় আমাদের মনে থাকে না, ইনি হযরত হাফিজ্জী হুযূর! ইনি এ যুগের মানুষ, কিন্তু সে যুগের সত্তা! আমরা ইবাদতে শক্তি ব্যয় করি, ইনি ইবাদতে শক্তি সঞ্চয় করেন!

মনে থাকে না বলেই হযরতকে আমরা যখন ভালো কথা বলি তখনো নিজেদের মত করেই বলি। আল্লাহর শোকর, হযরত সম্পর্কে অন্তত এ অনুভূতিটুকু আমার ছিলো। তাই বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি, কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং  সেটাই হলো। হযরতের চোখে পানি এসে গেলো। অন্যরকম

এক আবেগের উথাল-পাতাল যেন তাঁর ভিতরে শুরু হলো, তবে তাঁর গলার আওয়ায ছিলো শান্ত-সংযত। তিনি শুধু জানতে চাইলেন- কী ছিলো তাঁর গলার আওয়াযে এবং মুখের অভিব্যক্তিতে, এখনো তা ভেবে আমি অবাক হই- তিনি  জানতে চাইলেন, আমি কি খুব বুড়া হয়ে গেছি! আমি কি তোমাদের উপর বোঝা হয়ে গেছি!

তারপর কিছুটা তিরস্কারের স্বরে বললেন, আমাকে মাসআলা শেখাও কেন! আমি কি মাসআলা জানি না!

হযরতের কথায় আমাদেরও চোখে পানি এসে গেলো। কেউ কিছু বলার আগে আমি আগে বেড়ে বললাম, না দাদা! আপনি তো এই নাতির চেয়ে জোয়ান! আপনি তো আমাদের সঙ্গে যাবেন না, আমরা আপনার সঙ্গে যাবো, বরং আপনার পিছনে পিছনে যাবো।

হযরত খুশী হলেন, আমাকে আলিঙ্গন করলেন এবং কপালে চুমু খেলেন। তাতে আমার যেন কপাল খুলে গেলো।

মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ সম্ভবত সেই পবিত্র চুম্বনের স্নিগ্ধতাটুকু গ্রহণ করার জন্য আমার কপালে চুমু খেলেন, তারপর বললেন, আপনি তো খুব চালাক মানুষ আছেন! আমরা কী বললাম, আর আপনি কী বললেন!

আমি মৃদু হেসে বললাম, এতে অবাক হওয়ার কী আছে! আপনারা  হলেন মুরীদানের ভূমিকায়, আমি  নাতির ভূমিকায়!

হযরতকে খুশী করার মত কথা বলতে পেরেছি বলে মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেবও আমাকে অনেক দুআ দিলেন।

মানুষের ঢল বা স্রোত যাই বলি তার মাঝে আমাদের ছোট্ট কাফেলাও শামিল হয়ে গেলো। জামারামুখী জনস্রোতের গতি ছিলো প্রবল; প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ আমাদের অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। অভূতপূর্ব  এক জোশ ও জাযবা সবার মাঝে। আমরা অবশ্য চলছি ধীর গতিতে হযরতকে মাঝখানে রেখে। বিপুল চঞ্চলতার মাঝে যেন একখন্ড  অচঞ্চলতার অন্য রকম সৌন্দর্য!

যদিও হযরতের হিম্মত ও জাযবা ছিলো আমাদের জন্য অনুকরণীয়, তবু বয়সের নির্মমতাকে একদম অস্বীকার তো আর করা যায় না! কিছু দূর যাওয়ার পর হযরত বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। কিছু বলছেন না, কিন্তু বোঝা যায়, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তবু যে হাঁটছেন সেটা হযরত বলেই সম্ভব হচ্ছে!

মক্কায় আসার পরপর আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলাম, হযরতের জন্য একটি হুইল চেয়ার সংগ্রহ করার কথা, যাতে তাঁর হারাম শরীফে আসা-যাওয়ায় কষ্ট কম হয় এবং মিনা-আরাফায়ও আসানি হয়, কিন্তু বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনও বলেছিলাম, সম্ভব হলে আমি একাই চিন্তা করতাম; এখন আসুন, সবাই মিলে ব্যবস্থা করি। মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব আমাকে জোরদার সমর্থন করলেন। তারও খুব বেশী সামর্থ্য ছিলো না,  আমি জানতাম। হযরতের সঙ্গে যারা ইরান সফর করেছেন তাদের সঙ্গতি ছিলো, কর্তব্যও ছিলো, কিন্তু হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা হলো না। তখন আমার খুব আফসোস হলো যে, লিবীয় দূতাবাসের দেয়া রাহাখরচ কেন গ্রহণ করিনি! আসলে আমি তো জানতাম না, এমন অবস্থা হবে, আর আমাকে তা অসহায়ভাবে দেখতে হবে।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করে হযরত আরো কিছু দূর হাঁটলেন; তারপর ..। তখন হযরতের ছোট ছাহেবযাদা মাওলানা আতাউল্লাহ এমন এক কাজ করলেন যা মিনার প্রান্তরে পৃথিবীর সকল সন্তানের জন্য গৌরবের ইতিহাস হয়ে থাকলো।  জীবনে সুখের ও আনন্দের যত দৃশ্য আমি দেখেছি, নিঃসন্দেহে এটি তার মাঝে অন্যতম। এমন ঘটনা আগে ও পরে হয়ত আরো কিছু ঘটেছে, কিন্তু আমার জীবনে দেখা এটাই প্রথম ঘটনা এবং হয়ত বা শেষ ঘটনা।

কাউকে কিছু না বলে এবং হযরতকেও কিছু বুঝতে না দিয়ে তিনি তার বুড়ো বাবাকে, আমাদের প্রিয় হযরতকে কোলে তুলে নিলেন। এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে চললেন রামী জামারার দিকে। মনেই হলো না যে, তার কোন কষ্ট হচ্ছে। হয়ত আসমান থেকে কোন শক্তি তখন তার উপর ভর করেছিলো, কারণ আসমানেরও তো ভালো লেগে থাকবে যমিনের উপর এবং বিশেষ করে মিনার ময়দানে এমন পবিত্র দৃশ্য অবলোকন করে। মিনার ময়দান তো ..!

প্রিয় পাঠক, আবেগের আতিশয্যে এখানে আমি একটি উপমা লিখেছিলাম, কিন্তু ভিতর থেকে কেউ যেন আমাকে আদবের খেলাফ বলে সতর্ক করলো, তাই তা মুছে  ফেললাম।

এমন হয়, উচ্ছ্বাসের প্রবাহে অনেক সময় আমরা সংযম হারিয়ে ফেলি। শরিয়ত কিন্তু সর্বক্ষেত্রে আমাদেরকে সংযম শিক্ষা দেয়, এমনকি নবীপ্রশস্তিরও ক্ষেত্রে!

আমরা সবাই অবাক বিস্ময়ে এবং মুগ্ধ দৃষ্টিতে এ দুর্লভ দৃশ্যটি দেখছি। হযরত কিছু বলছেন না, কিন্তু তাঁর চোখের পানি ও মুখের উদ্ভাস অনেক কিছুই বলছিলো। অশ্রুর প্রতিটি ফোঁটা ভাগ্যবান পুত্রের জন্য যেন একটি করে দুআ হয়ে ঝরছিলো!

প্রিয় পাঠক, মিনার মাঠের সেই দৃশ্য সেদিনও আমাকে মুগ্ধ করেছিলো, এখনো মুগ্ধ করে, যখন কল্পনায় দেখি সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যটি। তোমার কি খুব আফসোস হচ্ছে নিজের চোখে তা দেখতে পাওনি বলে! কেন, আফসোস হবে কেন! তুমি নিজেই তো পারো তোমার বাবার চোখে, মায়ের চোখে এমন অশ্রুজল আনতে, যা দ্বারা লেখা হতে পারে শুধু তোমার নয়, তোমার আগামী প্রজন্মেরও সৌভাগ্যের কাহিনী। যদি পারো তো চেষ্টা করো মা-বাবার চোখে এরকম অশ্রুজল আনতে এবং তাদের চোখের অন্যরকম অশ্রুজল থেকে বেঁচে থাকতে। আল্লাহ তাওফীক দান করুন আমাকে, তোমাকে, আদমের প্রত্যেক পুত্রকে এবং হাওয়ার প্রতিটি কন্যাকে। আমীন।

হযরত কিছুক্ষণ পুত্রের কোলে, কিছুক্ষণ পায়ে হেঁটে, আর আমরা সেই পবিত্র দৃশ্য দেখে দেখে অবশেষে পৌঁছে গেলাম রাময়ুল জামারার স্থানে।

আগের দিন দেখার সুযোগ হয়নি, আজ দূর থেকে দেখতে পেলাম মসজিদে খায়ফ। মিনার দিনগুলোতে আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানেই অবস্থান করেছেন এবং জামাতে নামায পড়িয়েছেন। তাই মিনায় অবস্থানকালে এই মসজিদের জামাতে নামায পড়া অতি উত্তম, তবে তাঁবু যাদের দূরে এবং যাদের পথ হারিয়ে ফেলার আশংকা তাদের জন্য নয়। তারা নিজ নিজ তাঁবুতে নামায পড়লেই ভালো। মনের নিয়তের বরকতে তাঁবুর নামাযেও তাদেরকে আল্লাহ তাআলা এই মসজিদে নামায পড়ার, এমনকি সেই জামাআতে শামিল হওয়ার ফযিলত দান করতে পারেন। ভান্ডার তো আল্লাহর! তুমি যত আকুতি ও মিনতি জানাবে তাঁর দানের ভান্ডারে তত জোশ আসবে। তুমি যত চাইবে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী পাবে। আল্লাহর নবী যে বলেছেন, তুমি চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু তোমাদের রাব দিতে দিতে ক্লান্ত হবেন না-এ পবিত্র বাণীর ভাব ও মর্ম কিছুটাও কি আমরা উপলব্ধি করতে পারবো না!

তবে অলসতা করা ভালো নয়; যদি সুযোগ ও সামর্থ্য হয় তাহলে মসজিদে খায়ফের জামাআতে শামিল হওয়ার চেষ্টা করাই উত্তম।

জনতরঙ্গ গতকালের চেয়ে কম নয়, বরং বেশী। তবু আল্লাহর রহমতে হযরত নির্বিঘ্নে ছোট জামারার রামী সম্পন্ন করলেন। মসজিদে খায়ফের দিক থেকে যেটি প্রথম, তাকেই বলা হয় ছোট জামারা।

প্রতিটি জামারার সামনে পরিচয় ফলকে আরবীর পাশাপাশি উর্দু এবং ফারসিতে লেখা রয়েছে যথাক্রমে ছোটা শয়তান, দরমিয়ানা শয়তান এবং বড়া শয়তান। বড় জামারার ফারসি নাম হলো, শয়তানে বুযুর্গ। অনেক বাঙ্গালী হাজী অবাক হয়ে জানতে চান, ছোট শয়তান, মেঝো শয়তান এবং বড় শয়তান তো বুঝলাম, কিন্তু শয়তান আবার বুযুর্গ হয় কীভাবে! আসলে এটা আমাদের উপমহাদেশীয় বুযুর্গ নয়, ফারসি ভাষায় বড় যে কোন কিছুকেই বলা হয় বুযুর্গ। যাক এখন অবশ্য  বুযুর্গের ঝামেলা নেই। কারণ পরিচয়ফলকগুলো অপ্রয়োজনীয় মনে করে অনেক আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবু অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো কেন যে কলমে এসে গেলো!

ছোট জামারা থেকে ফারিগ হয়ে একটু সরে এসে খালি জায়গা দেখে হযরত দাঁড়ালেন এবং কিছুক্ষণ দুআ করলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই জামারার মাঝে দুআ করেছেন। সুতরাং এখানে দুআ করা সুন্নাত এবং এটা দুআ কবুল হওয়ার স্থান। কিন্তু শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সঙ্গত তাগাদার কারণে এখানে বেশীক্ষণ দাঁড়াবার সুযোগ নেই।

এরপর হযরত মধ্যবর্তী জামারার রামী সম্পন্ন করলেন এবং কিছুটা সরে এসে এখানেও দুআ করলেন। এটাও সুন্নত। আমরা পরম সৌভাগ্য জ্ঞান করে হযরতের দুআ ও মুনাজাতে শরীক হলাম। আল্লাহর কাছে তাঁর চাওয়া আমরা শুনতে পাইনি এবং আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর পাওয়া দেখতে পাইনি। আমরা শুধু বলেছি, হে আল্লাহ! এই মুনাজাতের মাধ্যমে আমরা তো শুধু সাদৃশ্য গ্রহণ করলাম সেই মুনাজাতের। এখন তুমি আছো, তোমার ভান্ডার আছে, আর আছে আমাদের ভাঙ্গাচুরা ভিক্ষার পাত্র! কবির ভাষায়-

 যারা তোমার দুয়ারের ভিখারী/ হাত পেতেছি তাদেরই মত/ দীনতায় হীনতায় শরমে মরি/ দানের অসীমতায় তবু নই আশাহত।

মুনাজাত শেষ হলো এবং হযরতের মুখমন্ডলকে প্রাপ্তির উদ্ভাসে উদ্ভাসিত মনে হলো। ধীরে ধীরে তিনি তৃতীয় জামারার দিকে অগ্রসর হলেন।

এটি বড় জামারা বলে পরিচিত। গতকাল শুধু এই জামারায় রামী করা হয়েছে। আল্লাহ আল্লাহ করে এটাও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো। এখানে আর দাঁড়িয়ে মুনাজাত করা নেই। আল্লাহর নবী করেননি, আমরাও করবো না। তোমার অন্তরে যদি আকুতি জাগে এখানেও একটু মুনাজাত করার, করো না। কেন করবে না, সে প্রশ্নও করো না। হজ্ব  তো প্রশ্ন করার নাম নয়, শুধু আত্মসমর্পণ করার নাম! তুমি আশিক, তুমি কৃতার্থ প্রেমিক, তুমি অনুগত বান্দা। তুমি প্রশ্ন করবে না, শুধু পালন করে যাবে। প্রশ্নই যদি করবে তাহলে তুমি এখানে কেন! এখানে যিনি এসেছিলেন তিনি তো পুত্রের গলায় ছুরি বসিয়েছিলেন কোন প্রশ্ন না করে!

হযরতের সঙ্গে এখান থেকে আমরা মক্কা শরীফে এলাম এবং তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করলাম। আজকের তাওয়াফ হলো হজ্বের ফরয তাওয়াফ। এই ফরয তাওয়াফ গতকালই অনেকে আদায় করেছেন। অনেকে আগামীকাল আদায় করবেন। দিন-রাত চলছে তাওয়াফ। কিন্তু জনসমুদ্রে এবং ইশকের দরিয়ায় কোন ভাটা নেই, শুধু জোয়ার, আর জোয়ার! আল্লাহ না করুন, ইশকের জোয়ারে যেদিন ভাটা আসবে সেদিন তো কেয়ামত শুরু হবে।

তাওয়াফের সেই বিপুল

জনতরঙ্গে বিসমিল্লাহ বলে আমরা যখন শামিল হলাম তখন হৃদয়সমুদ্রে যে তরঙ্গদোলা অনুভূত হলো তার বর্ণনা দেয়ার শক্তি এই দুর্বল কলমের কোথায়! শুধু বলতে পারি, সেই তাওয়াফ ছিলো অন্য কিছু! সেই ঘুর্ণনের স্বাদ ছিলো অনন্য! কল্পনায়  শুধু ভাবতে চেষ্টা করেছি, আল্লাহর নবী মিনা থেকে মক্কায় এসেছেন দশ তারিখে যোহরের আগে এবং তাওয়াফে যিয়ারাত করেছেন অগণিত ছাহাবাকে সঙ্গে নিয়ে। সেই তাওয়াফেরই তো ধারবাহিকতা আমাদের হযরতের আজকের এই তাওয়াফ! এখানেও সেই একই কথা, শুধু সাদৃশ্যের জন্যই যা কিছু আশা ও প্রত্যাশা!

তাওয়াফ সম্পন্ন হলো। একে একে সাত প্রদক্ষিণে আমরা হয়ে পড়লাম দুর্বল, নিস্তেজ; হযরত হলেন আরো সবল, আরো সতেজ।

প্রিয় পাঠক, আমার কথাকে যদি মনে হয় অতিশয়োক্তি, তোমাকে দোষ দেবো না। তুমি তো ছিলে না সেখানে! তুমি তো দেখোনি আশি বছরের সেই বৃদ্ধকে! কাকে বলে ইশকের জোয়ানি, তা বুঝতে হলে দেখতে হবে এমন কোন বৃদ্ধকে! কিন্তু হায়, হযরতের পরে যে নেই আর কোন হযরত!

তাওয়াফের শেষ প্রদক্ষিণের পর মাকামে ইবরাহীম থেকে অনেক দূরে  দাঁড়িয়ে হযরত তাওয়াফের দুরাকাত আদায় করলেন। অনেক দূরে বললাম আমার চোখের দেখা থেকে। কিন্তু নামাযের পর সংক্ষিপ্ত মুনাজাতেও হযরতের চোখ থেকে যেভাবে অশ্রু ঝরলো তাতে মনে হলো দূরে থেকেও  মাকামে ইবরাহীমের তিনি অনেক নিকটে! আসলে দূর ও নিকটের রহস্য তো আজো উদ্ধার করতে পারেনি মানুষ! কাছে থেকেও কতজন থাকে কত দূরে, আবার দূরে থেকেও কতজন থাকে কত কাছে!

এরপর যমযম। কয়েকবার বলা হয়েছে যমযমের কথা, কিন্তু যমযমের কথা বলা কি শেষ হয়েছে! যমযমের কথা বলা কি শেষ হবে! যমযমের পানি কি শেষ হয়েছে! যমযমের পানি কি শেষ হবে! যত দিন আছে পিপাসা তত দিন আছে যমযম! শুধু প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ, চিরকাল যেন থাকে আমাদের পিপাসা এবং যমযমের তৃপ্তি! চিরকাল যেন থাকে তোমার দানের প্রবাহ এবং আমাদের প্রাপ্তি!

হযরতের পিছনে পিছনে সিঁড়ি বেয়ে আমরা নীচে নামলাম, কাছে গেলাম এবং দেখলাম যমযমের পানির আগে হযরতের চোখের পানি! যমযমের পাড়ে দাঁড়িয়ে এভাবে কাঁদতে হয়, এভাবে কেউ কাঁদতে পারে, জানতাম না! কে জানে কী রহস্য হৃদয় থেকে উৎসারিত চোখের এ ঝরণাধারার! ইচ্ছে হলো, এ পানির স্বাদ একটু চেখে দেখি! কেমন লাগে জিহবায় যমযমের প্রেমিকের চোখের পানি!

হযরত আগে নিজে পান করলেন না; মায়ের মত মমতায় আগে আমাদের পান করালেন, তারপর নিজে পান করলেন।

প্রিয় পাঠক! যদি পারো, আল্লাহর কোন প্রেমিক বান্দার হাতে যমযমের পানি খেয়ে দেখো, এত স্বাদের যমযম তখন হয়ে যায় আরো স্বাদের যমযম! কত বছর হলো, জীবনের কত কিছুর কত পরিবর্তন হলো, কিন্তু সেই স্বাদ এখনো আমি ভুলিনি! যমযমের পানিতে ঠোঁট ভেজালে এখনো তা অনুভব করি! আমি আশা করি এবং প্রার্থনা করি, (ইনশাআল্লাহ) হযরত যখন আলকাউছারের পানি পান করবেন, তখন তাঁর যেন মনে পড়ে তাদের কথা, যমযমের পাড়ে যারা ছিলো তাঁর সঙ্গে! আমীন।

শিক্ষা এখানেও একটা ছিলো আমাদের জন্য! বয়স্ক, তবে হযরতের চেয়ে অনেক কম। জানি না কোন দেশের হাজী, যমযমের পাড়ে হযরতের সঙ্গে একটি অপ্রয়োজনীয় আচরণ করে বসলেন। আমরা তো সবাই থ! হঠাৎ একি হলো! এমন ঘটনাও সম্ভব! কিন্তু হযরত! যেন সত্যি সত্যি বড় কোন অন্যায় হয়ে গেছে, এভাবে কাকুতি মিনতি করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন।

আসলে হযরত আমাদেরকে শিক্ষা দিলেন, আনানিয়াত ও আমিত্বকে ফানা করার শিক্ষা! কিন্তু এত বড় শিক্ষা এত সহজে পাওয়া গেলে তার মূল্য কমে যায়। তাই তো অনেক কিছু দেখেও আমরা মূল্য বুঝিনি, না হযরতের, না তাঁর শিক্ষার। এখন ভাবি, হযরতের সঙ্গ ও সাহচর্যের জন্য যদি বেছে নেয়া হতো অন্যরকম কিছু মানুষ! এবং আশ্চর্য! ঠিক একথাটাই হজ্বের সফরে এক প্রসঙ্গে হযরত বলেছিলেন তাঁর সময়ের ছদর ছাহেব সম্পর্কে। আর নিজের সম্পর্কে! নূরিয়ায় শিক্ষকদের মজলিসে অনেক বার তিনি বলেছেন-

হাকীমুল উম্মত (রহ) বলতেন, তোম লোগোঁনে মুঝে পাঁহচানা নেহী, কিন্তু নিজের সম্পর্কে এই কথা বলতে আমার শরম লাগে।

হযরতের এ মন্তব্য যারা শুনেছেন তাদের অনেকে এখনো জীবিত আছেন।

হযরতের শরম লাগতো, তবে এটাই ছিলো তিক্ত সত্য; খুব কম মানুষ হযরতকে চিনতে পেরেছেন এবং আরো কম মানুষ হযরতের কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছেন।

 সেদিন মাতাফে দাঁড়িয়ে হযরতকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, লোকটা এমন অন্যায় আচরণ করলো, অথচ আপনার ...

হযরত বাধা দিয়ে বললেন, তুমি যদি মনে করো, হয়ত তোমার সামনের মানুষটি জান্নাতী তাহলে তো তার প্রতি নারায না হয়ে তাকে তুমি খুশী করারই কোশিশ করবে! সুবহানাল্লাহ! যারা জান্নাতী, হয়ত তারাই শুধু ভাবতে পারেন এমন জান্নাতী ভাবনা!

রাত্রি যাপনের জন্য হযরতের সঙ্গে আমরা আবার ফিরে এলাম মিনায়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফে যিয়ারাতের পর রাত্রি যাপনের জন্য মিনায় ফিরে এসেছিলেন।

যাদের ওযর আছে তাদের কথা ভিন্ন, কিন্তু অনেকেই বিনা ওযরে শুধু আরাম ও অলসতার কারণে মক্কায় রাত যাপন করে, আর দিনে গিয়ে রামী করে আসে। এটা বড় অন্যায়।

মিনায় ফেরার পথে হযরত আমাকে বলেছিলেন, মওলভী আবু তাহের! আমি তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মুহাববাত করি। আমার মউতের পরে তুমি যখন আল্লাহর ঘরে আসবা তখন আমার নামে তাওয়াফ করবা।

বুড়ো মানুষটির এ আব্দার আমি রক্ষা করেছি। যখনই বাইতুল্লাহর যিয়ারাত নছীব হয় তাঁর নামে আমি তাওয়াফ করি।

প্রিয় পাঠক, আমার মওতের পর  তুমি যদি আমার জন্য তাওয়াফ করো তাহলে আল্লাহ যেন তোমার সব গোনাহ মাফ করে দেন, হাশরের মাঠে তোমার পিপাসা যেন তিনি দূর করে দেন, আমীন।

বার তারিখে ফজরের পর আমি ও মাওলানা মিছবাহ, তাঁবু থেকে কিছু দূরে বড় যে পাহাড়, সেটার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পবিত্র ভূমিতে জীবনের প্রথম পর্বত-আরোহণ! অনভিজ্ঞদের কাছে দূর থেকে মনে হয়, পর্বত-আরোহণ এমন কী আর কঠিন! তরতর করে উঠে যাবো, কিন্তু উঠতে গিয়ে দেখা গেলো, শরীর রীতিমত তরতর করছে এবং দরদর করে ঘাম ঝরছে! কখনো বড় কোন পাথরখন্ড  পথ রোধ করে দাঁড়ায়, ফলে পথ ঘুরে যেতে হয়; কখনো এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে যেতে হয়; কখনো ভয়ে বুক কাঁপে, এই বুঝি পা পিছলে পড়ে গেলাম, আর শরীরটা একেবারে থেতলে গেলো! কিন্তু যৌবনের যা ধর্ম, ভয়ের মাঝেও অজানা একটি রোমাঞ্চ

সর্বসত্তাকে যেন আচ্ছন্ন করে

রেখেছিলো। ভীতি ও ক্লান্তি উপেক্ষা করে একটু একটু করে উপরে উঠতে লাগলাম। একসময় দেখি, হাঁটু  ভেঙ্গে আসছে; এবার একটু জিরিয়ে নিতে হয়। এখন এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে বলতে লজ্জা করে, কিন্তু তখন সত্যি সত্যি আমি ছিলাম টগবগে এক যুবক! তাই ক্লান্তি আমাকে ততটা কাবু করতে পারেনি, কিন্তু যৌবনের শেষ প্রান্তের মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহর হলো নাজেহাল অবস্থা। আগে বুঝতে পারলে হয়ত তিনি এ সাহস করতেন না।

চূড়া এখনো অনেক উপরে, তবু যত দূর উঠেছি সেখান থেকে সমগ্র মিনা ভূমি দেখা যায়, বিশাল প্রান্তর উঁচু-নীচু ঢেউয়ের মত। তাঁবু আর তাঁবু! যেন তাঁবুর বিশাল রাজ্য! এত উঁচু থেকে সাদা তাঁবুর সারিগুলো দেখতে বড় সুন্দর! যেন ছেলে-মেয়েদের ছোট ছোট খেলনাঘর! মানুষগুলো যেন এ যুগের এবং এ জগতের নয়, অন্য কোন যুগের, অন্য কোন জগতের!

মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ বললেন, আমি আর পারবো না, এখান থেকেই নেমে যাবো। কিছুক্ষণ আমরা সেখানে বিশ্রাম নিলাম এবং কথা বললাম, নানান কথা; হজ্বের অনুভূতির কথা, সে যুগের এবং এ যুগের হজ্বের পার্থক্যের কথা। হযরতের তাওবার রাজনীতির এবং আমাদের ভবিষ্যতের কথা। তাঁর এ মন্তব্য এখনো আমার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন-

অন্য দেশের কথা জানি না, আমাদের দেশে তো হযরত হাফেজ্জী হুযূর একজনই। তিনি এখন জাতির একমাত্র অভিভাবক। তাঁর অবর্তমানে জাতি সত্যিকার অর্থেই হয়ে যাবে অভিভাবকহীন, এতীম। কোথায় তাঁর শূন্যস্থান কিছুটা হলেও পূরণ করার মত ব্যক্তিত্ব?! জাতির দুর্যোগে পথ দেখাতে পারেন, অভিভাবকের উচ্চ আসন থেকে জাতিকে উপদেশ দিতে পারেন, প্রয়োজনে তিরস্কার করতে পারেন এমন দ্বিতীয় আর কে আছেন?! তখন আমাদের কী অবস্থা হবে?! কার হাত ধরে আমরা পথ চলবো?!

বড় তিক্ত প্রশ্ন এবং জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা; উত্তর তারও জানা নেই, আমারও না। তাই সেই নির্জন পাহাড়ে অনেক্ষণ আমরা চুপচাপ বসে ছিলাম।

তিনি আরো বলেছিলেন, এ তো পরের কথা, আমি কিন্তু এখনই ফেতনার কালো থাবা দেখতে পাচ্ছি!

তিনি কোন ফেতনার কথা বলছেন তা বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছিলো না। আমি শুধু বললাম, আসলে রাজনীতির পথ বড় পিচ্ছিল। সে পথে চলার যোগ্যতা আমাদের এখনো হয়নি। এ জন্য যে প্রশিক্ষণ, তারবিয়াত ও মোজাহাদার প্রয়োজন তা আমাদের নেই। সম্ভবত পূর্বপ্রস্ত্ততি গ্রহণ না করেই আমরা মাঠে নেমে পড়েছি। রাজনীতিতে লোভ আছে, প্রলোভন আছে; আছে প্রতারণার বিভিন্ন রকম জাল। হযরত পর্যন্ত তো ঠিক আছে; তারপর? আমার তো মনে হয়, হযরত নিজেও এখন নিঃসঙ্গ বোধ করছেন। তিনি তো তাঁর জিহাদের আজর আল্লাহর কাছে পেয়ে যাবেন, দুর্গতি যা হবে, পরবর্তীদের।

আমি জানি, মিনার নির্জন পর্বতে এটা ছিলো আমাদের নিষ্ফল আলোচনা, তবু মনে হলো, লিখে রাখি কাগজের পাতায়।

 হজ্বের সফর থেকে ফেরার পর সেই ফেতনা এমন অন্ধকার ঝড় হয়ে এসেছিলো যে, সবকিছু উড়ে গিয়েছিলো খড়কুটোর মত। হযরত শুধু দাঁড়িয়ে ছিলেন নিঃসঙ্গ অবস্থায়।  কেউ করেছিলো চালাকি, কেউ বোকামি; দুহটোরই দায় বহন করতে হয়েছে বুড়ো মানুষটিকে। সামান্য দয়া করেনি একজন বৃদ্ধের প্রতি কেউ; না যারা দূরের, না যারা কাছের!

মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ সেখান থেকে নেমে গেলেন, পানির বোতলটা আমি রেখে দিলাম। উপর থেকে আমি তার নেমে যাওয়া দেখতে থাকলাম। উপরে ওঠা কত কঠিন এবং নেমে যাওয়া কত সহজ! হয়ত এ জন্যই আমরা শুধু নামছি আর নামছি, উপরে ওঠার চেষ্টা করছি না।

মিনার পাহাড়ে আমি এখন একা। এ নিঃসঙ্গতা বড় ভালো লাগলো। নিঃসঙ্গতা সবসময় আমার ভালো লাগে। পাহাড় বেয়ে বেয়ে আমি আরো উপরে উঠলাম। চূড়ার প্রায় কাছাকাছি এসে দম ফুরিয়ে গেলো। তাছাড়া আর উপরে ওঠার  উপায়ও নেই। চূড়া একেবারে খাড়া। জানি না, এখানে এর আগে আর কোন মানুষ এসেছিলো কি না! হয়ত সত্য নয়, তবু ভাবতে ভালো লাগলো, এখানে এই পাহাড়ের নির্জনতায় আমিই প্রথম মানুষ!

চারদিকে অসীম নির্জনতা। নীচের কোলাহল এখান থেকে কিছুই শোনা যায় না। কোথাও কোন শব্দ নেই। তবে বড় মধুর নৈঃশব্দ! জীবনে অনেক নির্জনতার মাঝে আমি সময় যাপন করেছি; নদীর নির্জনতা,

প্রান্তরের নির্জনতা, অরণ্যের নির্জনতা এবং প্রতিটি নির্জনতা থেকে আমি প্রশান্তি লাভ করেছি। কিন্তু পর্বতের নির্জনতা যে এমন ভাবগম্ভীর ও রহস্যময় তা আমার জানা ছিলো না। আমি মুগ্ধ হলাম, অভিভূত হলাম। ইচ্ছে হলো, পবিত্র ভূমির পর্বতের এ নিঝুম নির্জনতায়  আমি হারিয়ে যাই, সারা জীবনের জন্য হারিয়ে যাই। এভাবে যারা হারিয়ে যায় তারাই তো পথ খুঁজে পায়!

 সেদিন মিনার সেই পর্বতে অনেকক্ষণ বসেছিলাম নৈঃশব্দের মাঝে এবং ডুবে ছিলাম নির্জনতার সাগরে। কত হাজার বছরের প্রাচীন মিনার এই পাহাড়!

তুমি কি কথা বলতে পারো হে পাহাড়! তুমি কি দেখেছিলে মিনা প্রান্তরে চার হাজার বছর আগের সেই অনন্য ঘটনা! প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর নামে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে এখানেই তো এসেছিলেন আল্লাহর খলীল সেদিন! তুমি কি দেখেছিলে পিতাকে পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে আল্লাহু আকবার বলে!

তুমি কি দেখেছিলে আল্লাহর নবী ও তাঁর প্রিয় ছাহাবাদের এখানে এই প্রান্তরে!

 হে নিষ্প্রাণ প্রস্তর! হে নির্বাক পর্বত! তুমি কি আমার প্রশ্ন শুনতে পাও? তুমি কি কথা বলতে পারো? হয়ত পারো, হয়ত তুমি কথা বলো, কিন্তু আমি মানুষ তোমার কথা শুনতে পাই না; তোমার ভাষা বুঝতে পারি না। হায়, তোমার সঙ্গে যদি আমার বন্ধুত্ব হতো! তোমার কোলে যদি আমার একটু আশ্রয় হতো!

এতো কালো কেন পাহাড়ের পাথরগুলো! তাহলে কি পাহাড়ও ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হয়, কোন ব্যথায়, কোন বেদনায়!

কিসের ব্যথা! কিসের বেদনা!  কোরবানির শিক্ষা ভুলে যাওয়ার! প্রেম ও ভালোবাসার দীক্ষা বিস্মৃত হওয়ার!

এখানে কি আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়? এখন যদি মুষলধারে বৃষ্টি হতো! বৃষ্টি তো সবকিছু ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়; আমার সকল পাপ ও পঙ্কিলতা তাহলে কি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যেতো বৃষ্টির পানিতে?

আকাশের দিকে তাকালাম, না কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। স্বচ্ছ নীল আকাশ। এখন যদি রাত হতো, পূর্ণিমার চাঁদ হতো, ফকফকে জোসনা হতো, কত ভালো হতো! আমার হৃদয়সাগরে আনন্দের কেমন ঢেউ-তরঙ্গ জাগতো!

হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে অবাক হলাম। একটি ক্ষুদ্র পোকা পাথরের গা বেয়ে বেয়ে উপরে উঠছে; আশ্চর্য! এখানেও তাহলে প্রাণ আছে! আমি ছাড়া আরো প্রাণী আছে! পোকাটির জন্ম কি এখানে এই পাহাড়ের কোলে! এখানেও কি জন্ম আছে, মৃত্যু আছে! জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে

জীবন এবং জীবনের প্রয়োজন

আছে! এই পোকাটিরও নিশ্চয় রিযিক আছে!  আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে, রিযিকদাতা কীভাবে এখানে পাহাড়ের চূড়ায় এই ক্ষুদ্র প্রাণীর রিযিক পৌঁছে দেন!

সূর্য পাহাড়ের মাথার উপর উঠে এসেছে। এখন আমাকে অবতরণ করতে হবে। পর্বতের নৈঃশব্দ ও নির্জনতার মায়া ত্যাগ করে আবার আমাকে যেতে হবে মানুষের কোলাহলের মাঝে। অবশ্য এই পর্বতের নির্জনতা যেমন মধুর তেমনি মিনা প্রান্তরের কোলাহলও আনন্দমধুর! কারণ এ কোলাহল আল্লাহর মেহমানদের কোলাহল! তবু মন আমার বড় বিষণ্ণ হলো পর্বতের সঙ্গ ছেড়ে নেমে যেতে। আর কি কখনো আসা হবে এখানে আমার, কিংবা আমার রক্ত ধারণকারী কোন উত্তর পুরুষের!

বিদায় হে প্রিয় পর্বত, বিদায়! শুধু এই মিনতিটুকু জানাই, আমাকে মনে রেখো; তোমার অসীম নির্জনতার মাঝে আমার কয়েকটি শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ তুমি মনে রেখো। তুমি সাক্ষ্য দিও, এখানে আমি এসেছিলাম, এখানে আমি দুফোঁটা চোখের পানি ফেলেছিলাম!

ধীরে ধীরে অবতরণ করলাম সেই নাম না জানা পর্বত থেকে, সেখানে কিছু স্মৃতি রেখে এবং কিছু স্মৃতি বুকে নিয়ে।

নিজের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা হলো; উপরে ওঠা কত কঠিন! নীচে নামা কত সহজ! জীবনভর আমি যেন সাধনা করে যেতে পারি উপরে ওঠার, সকল নীচতা ও ক্ষুদ্রতা থেকে। যারা উপরে ওঠে আমি যেন তাদের সঙ্গে থাকি, যারা নীচে নামে আমি যেন তাদের সঙ্গ বর্জন করি।

দ্বিতীয় দিন কোরবানি করে এসে জনাব আখতার ফারূক ছাহেব বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। তিনি রসপ্রিয় মানুষ। যেমন পারেন রস আহরণ করতে তেমনি পারেন বিতরণ করতে; যেমন মক্কা-মদীনায় তেমনি মিনা-আরাফায়। যতটা পারেন হাসতে, প্রায় ততটা পারেন হাসাতে। অবশ্য হযরতের অগোচরে। তবু দুএকবার তাকে হযরতের মৃদু তিরস্কার হযম করতে হয়েছে। একবার হযরত বলেছিলেন, ভাই, হাঁসি-মাযাক কে লিয়ে তো পুরী যিন্দেগী পড়ী হ্যায়; ইয়ে তো রোনে কা মাকাম হ্যায়।

তো আখতার ফারূক ছাহেব বললেন, কোরবানি করেছি অর্ধেকটা, কিন্তু কোরবানি হয়ে গেছি পুরোটা।

 কথাটা বলে তিনি হাসলেন যদ্দুর, অন্যরা হাসলো তার অর্ধেক। আমিও রাজী ছিলাম তাদের হাসিতে যোগ দিতে, কিন্তু হাসির কারণটা তো বুঝতে হবে! তাই জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কী?

তিনি বললেন, এ তো আর দুম্বা ছিলো না, ছিলো আস্ত গরু। গলায় ছুরি চালালাম, অর্ধেকটা কাটা হলো, অমনি খেলাম এক লাথি। গিয়ে পড়লাম মড়া-পচা আরেক গরুর গায়ে। এরপর ছুরি হাতে নিলো সেই বেদুঈনের বাচ্চা, যে কিনা আগেই আমাকে জবাই করেছিলো অতিরিক্ত একশ রিয়াল খসিয়ে।

 বুঝলাম, তিনি গরু জবাই করেছেন অর্ধেকটা, আর গরুওয়ালা তাকে জবাই করেছে পুরোটা।

এরপর তার বক্তব্য হলো, অন্তত  পঞ্চাশ লাখ পশু জবাই হচ্ছে. যার অর্থমূল্য কয়েকশ কোটি রিয়াল। তাহলে কত শত টন গোশতের অপচয় হবে!  তার চেয়ে যদি পরিকল্পিত উপায়ে গোশত আহরণ  করে আমাদের মত গরীব দেশে বিতরণ করা হতো তাহলে কত উপকার হতো!

আমি মৃদু হেসে বললাম, একে তো একশ রিয়াল, তার উপর গরুর লাথি! ব্যথা বলুন, কষ্ট বলুন, কিছুটা হতেই পারে, তাই বলে কোরবানিতে অপচয় হবে কেন! ফসলের জন্য মাটিতে ফেলা বীজ কি অপচয়? মিনার কোরবানি তো সেই বীজ আল্লাহর হুকুম মেনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য! কোরবানি কবুল হলে তো উম্মতের রিযিকে বরকত হবে! পক্ষান্তরে কোরবানি ভুলে আমরা যদি গোশতের ফিকিরে লেগে যাই, আর আল্লাহ রিযিক সংকীর্ণ করে দেন!

তাছাড়া এ অপচয় তো চলেই আসছে! আল্লাহর নবীর যামানায় কি গরীব মিসকীন ছিলো না? তিনি কি  আহরণ ও বিতরণের চিন্তা করেছিলেন?

আখতার ফারূক ছাহেব, তখন মনে হলো, আমার বক্তব্যের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেছেন।

আসল কথা, বস্ত্ততান্ত্রিক চিন্তা ও প্রবণতা আমাদের মনমানসকে এমনই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে, এমনকি ইবাদতের ক্ষেত্রেও চলে আসে জাগতিক লাভলোকসানের মানদন্ড । তাই নামাযের মাঝে সন্ধান করি শরীরচর্চার উপকারিতা; রোযার মাঝে তালাশ করি স্বাস্থ্যগত সুফল; যাকাতের মাঝে শুরু করি অর্থনৈতিক গবেষণা, আর বেচারা হজ্ব তো এখন লাভজনক পর্যটন! যাদের বুদ্ধি উর্বর তারা অবশ্য বলেন, হজ্ব হলো বার্ষিক বিশ্বমুসলিম সম্মেলন।

হয়ত এসব জাগতিক উপকার ইবাদতের মাঝে রয়েছে; হয়ত রয়েছে আমাদের অজানা আরো অসংখ্য উপকার । কিন্তু এগুলো  তো গৌণ, অথচ এগুলোই যেন এখন মুখ্য!

 আমরা ভুলে যাই যে, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম ও হজ্ব, এগুলো  হচ্ছে ইসলামের স্তম্ভ ও বুনিয়াদ। ইবাদতের রূহ ও প্রাণ হলো আবদিয়াত ও দাসত্ব এবং আল্লাহ ও বান্দার মাঝে প্রেম ও মুহববতের সম্পর্ক এবং আত্মসমর্পণ ও আত্মনিবেদনের আকুতি; সর্বোপরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে ঘোষিত আজর ও পুরস্কারের বিশ্বাস।

এটাই হলো ইসলামের ইবাদত-ব্যবস্থার প্রকৃতি। ইবাদতের নববী আকৃতি যেমন অটুট রাখা জরুরি তেমনি তার প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ রাখাও অপরিহার্য। কিন্তু আফসোস, কিছু চালাক দুশমন এবং বহু নাদান দোস্ত আজ উঠে পড়ে লেগেছে ইবাদতের রূহ ও হাকীকতকে বিকৃত করার কাজে। অবশ্য আল্লাহর দ্বীন কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ নিজেই হিফাযত করবেন, এটা স্বয়ং আল্লাহর ওয়াদা।

জনাব আখতার ফারূক ছাহেবকে সেদিন আরো বলেছিলাম, আপনি যাকে ভালোবাসেন, যার সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টির জন্য আপনি ব্যাকুল সেই  প্রেমাষ্পদ যদি আপনাকে বলেন, আমার সঙ্গে মিলনের জন্য প্রতিদিন পাঁচবার তুমি আমার কাছে এসো।

আপনি গেলেন; তারপর বলতে লাগলেন, এতে আমার চমৎকার শরীরচর্চা হচ্ছে। (কিংবা একমাসের উপবাসে পাকস্থলীর যথেষ্ট উপকার হচ্ছে) তাহলে? তাহলে কি অপদার্থ প্রেমিক বলে আপনাকে তিনি খারিজ করে দেবেন না?

তারপর ধরুন, প্রেমাস্পদ বললেন, তুমি মুহববতের পরীক্ষা দাও আমার নামে একটি পশু কোরবানি করে। আপনি বললেন, কোরবানি তো হবে, কিন্তু গোশতের অপচয়? তো এ পরীক্ষার ফল কী দাঁড়বে?

তাছাড়া আপনি আজ গোশতের অপচয়ে পেরেশান, কাল যখন আপনার শত্রু বলবে, পশুহত্যার নিষ্ঠুরতা, তখন?

আসলে যুক্তি ও বুদ্ধি সর্বদা প্রেম ও ভক্তির শূন্যস্থান পূরণ করে। কিন্তু বান্দার কাছ থেকে আল্লাহ তো  যুক্তি ও বুদ্ধির ইবাদত চান না, তিনি তো চান আবদিয়াত ও দাসত্বের, প্রেম ও মুহববতের এবং আনুগত্য ও আত্মনিবেদনের ইবাদত।

বার তারিখে দুপুরের পর হযরতের সঙ্গে রওয়ানা হলাম রামী জামারার উদ্দেশ্যে। এগার ও বার তারীখের রামী হলো বাধ্যতামূলক, ওয়াজিব। পক্ষান্তরে তের তারিখের রামী হলো ঐচ্ছিক (এবং সুন্নত)। তবে প্রায় সকল হাজী বার তারিখের রামী করেই মক্কায় চলে যান। বার তারিখের সন্ধ্যায় মিনা প্রায়

জনশূন্য হয়ে পড়ে। অথচ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তের তারিখে মিনায় রাত্রি যাপন করেছেন এবং পরবর্তী দিন রামী করে মক্কায়  ফিরেছেন। (মাযূর ব্যক্তি ছাড়া) ছাহাবা কেরাম সকলেই তাঁর সঙ্গে মিনায় অবস্থান করেছেন। মিনার প্রান্তর সেদিন এমন জনশূন্য হয়ে পড়েনি। সুতরাং ঐচ্ছিক হলেও যে অল্প কজন তের তারিখে মিনায় রাত যাপন করেন এবং পরবর্তী দিন রামী করেন তারা উত্তম কাজই করেন।

হযরত আজ বেশ সতেজ ছিলেন এবং পুরো পথ হেঁটেই অতিক্রম করেছেন। তবে ভিড়ের চাপ ছিলো অকল্পনীয়।

জামারায় বার তারিখের ভিড় হয় প্রচন্ড , শুনেছি। কিন্তু সেটা যে কত প্রচন্ড  তা আজ প্রত্যক্ষ করলাম। যাকে বলে ভিড়ের চাপে পিষ্ট হওয়া তেমন অবস্থা কয়েকবারই হলো। জামারার প্রবেশমুখের কাছাকাছি এসে তো আমি বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়লাম। কোনভাবেই আর হযরত বা তাঁর অনুগামীদের হদিস পেলাম না। ভীষণ পেরেশান অবস্থায় একপাশে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, তারপর বিষণ্ণ মনে  একাই রামীর উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলাম।

হযরত দোতালার পরিবর্তে নীচ দিয়ে রামী করা পছন্দ করেন। কেন করেন জানি না। দশ ও এগার তারিখে হযরতের সঙ্গে নীচে দিয়েই রামী করেছি। আজ ভাবলাম, উপর দিয়ে করি। মুক্ত আকাশ ও মুক্ত বাতাসে রামী করতে মনে হলো ভালোই লাগবে; নতুন অভিজ্ঞতাও  হবে। এবং জীবনের ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা হলো, যা মনে পড়লে এখনো বুক কেঁপে ওঠে। সেদিন যে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলাম, তা শুধু  তাকদীরের দয়ায়।

উপরে উঠেই আটকা পড়ে গেলাম প্রচন্ড ভিড়ের দ্বিমুখী চাপে। অর্থাৎ  একদল রামী করতে যাচ্ছে, আরেকদল রামী করে ফিরছে একই পথে এবং দুদিক থেকেই পিষে ফেলার মত চাপ। মনে হলো মানুষের মাঝে নয়, আমি চাপা পড়েছি দুদিকের শক্ত দুই পাথরের মাঝখানে। শাব্দিক অর্থেই তখন আমার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা! পিছনে ফিরে আসার কথা হয়ত কল্পনা করা যায়, কিন্তু বাস্তবে তা আর সম্ভব নয়। জীবনে এই দ্বিতীয়বার মৃত্যুর শীতল স্পর্শ আমি অনুভব করলাম এবং সত্যি সত্যি মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেলাম। মুখে কালিমা শরীফ জারি হয়ে গেলো। স্মরণ করতে চেষ্টা করলাম হজ্বের সফরে মৃত্যুর কী ফযিলত হাদীছ শরীফে এসেছে! হে আল্লাহ, মৃত্যুর কষ্ট থেকে হেফাযত করো এবং ঈমানের সঙ্গে, আসানির সঙ্গে খাতেমা করো।

 মনে হলো, আমি যখন পড়ে যাবো, হাজার হাজার হাজীর পদতলে আমার দেহ এমনভাবে পিষ্ট হবে যে, আমাকে চেনার কোন উপায় থাকবে না।

এ অবস্থা আমার একার নয়, নাইজিরিয়ান পুরুষ ও মহিলাদের ছাড়া আর সবার প্রায় একই অবস্থা। ইয়া নাফসী, ইয়া নাফসীর সে এক করুণ দৃশ্য! তবে সেটা কেয়ামতের ইয়া নাফসী ছিলো না। কারণ, দেখতে পেলাম, হতভাগিনী এক মা,  হঠাৎ তার কোলের সন্তান কোল থেকে ছুটে গেলো এবং পড়ে গেলো!  আর হতভাগিনী মা মেরী বাচ্চী! মেরী বাচ্চী বলে কলিজার টুকরোকে তুলে নেয়ার চেষ্টা করলো এবং .. এবং নিজেও পড়ে গেলো।

সবকিছু ঘটে গেলো চোখের পলকে এবং আমার একেবারে সামনে! যাদের পদতলে পিষ্ট হলো হতভাগিনী মা ও তার কোলের

সন্তান তাদেরও তখন কিছু করার ছিলো না।

 আজ মনে হয়, হতভাগিনী মায়ের ঐ মর্মান্তিক মৃত্যুই তার জন্য ভালো ছিলো। কারণ যদি সে বেঁচে যেতো তাহলে সন্তানের শোকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিদিন তার মৃত্যু হতো, কিংবা হয়ত পাগলিনী হয়ে জীবন-মৃত্যুর অনুভবের উর্ধ্বে চলে যেতো।

 মায়েরা এমনই হয়! আমার মা, তোমার মা, সকলের মা! কেয়ামতের ভয়াবহতা ছাড়া অন্য কিছু মায়ের মমতাকে পরাস্ত করতে পারে না, মৃত্যুভয়ও না। সেই মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের হাতে কত নিগ্রহ ভোগ করে! এক মায়ের কথা জানি, আগুনে ঝাঁপ দিয়ে তিনি তার শিশুপুত্রকে রক্ষা করেছিলেন। সারা শরীর তার ঝলসে গিয়েছিলো বীভৎসরূপে। সেই পুত্র এখন সেই মাকে ...। হায়রে মা! হায়রে সন্তান!

রামীর সময় উন্মুক্ত আকাশ এবং খোলা বাতাস চেয়েছিলাম, তাই নীচের পরিবর্তে উপরে এসেছিলাম, এখন মনে হলো, পৃথিবীতে কোথাও কোন বাতাস নেই। দম বন্ধ হয়ে এখনই বুঝি মারা যাবো! এমন সময়  গায়বি কুদরতে যেন একটু ফাঁক হলো এবং আমি রাজ্যের বাতাস পেলাম শ্বাস নেয়ার জন্য। বাতাস তাহলে এত মূল্যবান! বাতাস তাহলে এত বড় নেয়ামত! আমরা যখন আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হই তখন কি এই বাতাসেই শ্বাস গ্রহণ করি!

শ্বাস নিতে পেরে তো বেঁচে গেলাম, কিন্তু দেখা দিলো ছোট্ট একটি বিপদ। আমার চোখের চশমাটি যে এতক্ষণ নাকের ডগায় বহাল ছিলো সেটাই তো আশ্চর্য! এবার তা ছিটকে পড়ে গেলো এবং আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে চশমাটা হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম এবং পড়ে যেতে যেতেও বেঁচে গেলাম। বেঁচে গেলাম শুধু এজন্য যে, সেটা আমার মৃত্যুর নির্ধারিত সময় ছিলো না। নির্ধারিত সময় ছাড়া মৃত্যু আসে না, এক মুহূর্ত আগেও না, পরেও না। মৃত্যুর যখন সময় হয়, জীবনরক্ষার সকল ব্যবস্থা তখন অকার্যকর হয়ে পড়ে, সকল প্রচেষ্টা তখন মুখ থুবড়ে পড়ে।

.......

(মৃত্যুর তীর যখন ছুটে আসে তখন তা লক্ষ্যচ্যুত হয় না।)

কিন্তু মৃত্যুর সময় না হলে একেবারে অরক্ষণীয় অবস্থায়ও মানুষ বেঁচে যায়। ছুটে আসা তীর মাথার চুল ছুঁই ছুঁই করে চলে যায়। মৃত্যুর তীর ছুটে এসেছিলো ঐ হতভাগিনী মাকে লক্ষ্য করে এবং তা লক্ষ্যচ্যুত হয়নি, অথচ আমার মাথার চুল ছুঁই ছুঁই করে পার হয়ে গেলো।

এটা যদি হয় বিশ্বাস তাহলে কি মৃত্যুর ভয়ে কোন মুমিন সত্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে?! তবু হয়, কারণ বিশ্বাস আমাদের হৃদয়ের গভীরে নয়, বিশ্বাস আমাদের দুই ঠোঁটের মাঝে।

চশমা হারিয়ে আমার চোখের সামনে  যেন অন্ধকার নেমে এলো । চশমা ছাড়া আমি, বলতে কষ্ট হলেও, প্রায় অন্ধ। কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না; সবকিছু আবছা, সবকিছু ঝাপসা! তবে যেহেতু আমাকে এখন চলতে হচ্ছে না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে সেহেতু আপাতত তেমন কোন সমস্যা হলো না। দেখে দেখে এবং না দেখে দেখে একসময় পৌঁছে গেলাম প্রথম জামারার কাছে। সামনের স্তম্ভটি দেখতে পেলাম অস্পষ্ট। তবু রামী করতে অসুবিধা হলো না। পরের দুটি রামীও সম্পন্ন হলো নির্বিঘ্নে।

আজ আমি হযরতের ইচ্ছাকে অমান্য করলাম এবং তার উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করলাম, কিন্তু শিক্ষা কি আমার হবে?! হয়ত এ ভুল আবার হবে। একই ভুল আমাদের বারবার হয়; ঠিক সময়ে বুদ্ধি-বিবেচনা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। শুধু আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন সে-ই রক্ষা পায়, আর আল্লাহ তাকেই রক্ষা করেন যে প্রার্থনা করে। কিন্তু আমরা যে প্রার্থনা করতে জানি না! প্রার্থনায় বিশ্বাসই বা করি কজন!

 সেদিন আমি বড় অসহায় অবস্থায় প্রার্থনা করেছিলাম, হে আল্লাহ! আমি দেখি না, তুমি তো দেখো! তুমি তোমার খাছ কুদরত দ্বারা আমাকে আমার

মানযিলে পৌঁছে দাও।

কঠিন সংকটের সময় তোমার ভিতরে যে তুমি আছে, সে তোমাকে আওয়ায দেয় এবং পথ বলে দেয়, কিন্তু তুমি, আমি- আমরা আমাদের ভিতরের আমিকে গুরুত্ব দেই না। অথচ ভিতরের সেই আমিই প্রকৃত আমি, ভিতরের সেই তুমিই প্রকৃত তুমি। বাইরের যে আমি এবং তুমি সেটা শুধু ভিতরের আমি এবং তুমি-এর খাঁচা। সেদিন মিনার ময়দানে জামারার সামনে একান্ত নাচার অবস্থায় যখন কী করবো কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না তখন আমার ভিতরের আমি যেন আমাকে এই বলে সান্ত্বনা দিলো, ভয় কি! তুমি তো আল্লাহর মেহমান! আল্লাহ তোমাকে পথ দেখাবেন।

আমি তখন এই ভেবে আশ্বস্ত হলাম যে, যা ঘটেছে নিশ্চয় আমার ভালোর জন্য ঘটেছে। হয়ত বান্দাকে আল্লাহ প্রতিকূলতা দ্বারা তারবিয়াত করছেন। যথাসময়ে বান্দাকে নিশ্চয় তিনি সাহায্য করবেন।

 যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে আসছে সেহেতু তাঁবুতে ফিরে যাওয়াই সহজ ও নিরাপদ মনে হলো।

জনতরঙ্গের তখন শেষ প্রবাহটা চলছে। কারণ সন্ধ্যায় রামী করে সূর্যাস্তের আগেই মিনার সীমানা অতিক্রম করতে হবে, অন্যথায় তের তারিখের রামী ওয়াজিব হয়ে যাবে।

পথ সম্পর্কে আমি শুধু এতটুকু জানি যে, এখান থেকে সোজা বেশ কিছু দূর গেলে যে ওভার ব্রিজ সেটা ছাড়িয়ে সামান্য আগে বেড়ে হাতের ডান দিকে যেতে হবে। তারপর একটি তাঁবুমহল্লা পার হলেই আফগান হাজীদের মহল্লা। তারপর বাংলাদেশী হাজীদের মুআল্লিম সেলিম মুনশির তাঁবুমহল্লা। তাঁবুর নাম্বারও মনে ছিলো।

আল্লাহর উপর ভরসা করে রওয়ানা হলাম। আল্লাহ যে বান্দার সহায় সেটা প্রকৃতরূপে উপলব্ধি করা যায় যখন বান্দা একেবারে একা হয়ে যায়। মানুষের ঢল তখন জামারা অভিমুখে, আমি এবং আরও দুএকজন মাত্র চলছি বিপরীত দিকে। পিপাসায় আমার তখন লবেজান অবস্থা। সামান্য এককাতরা পানি যদি পাওয়া যেতো! এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে শুনতে পেলাম একটি আপ্যায়নের কণ্ঠ, তাফায্যাল

মেহেরবান আল্লাহর এই মেহেরবান বান্দাকে আমি কখনো দেখিনি, সম্ভবত আর কোনদিন দেখবো না। বড় কঠিন পিপাসার সময় তিনি আমার দিকে ঠান্ডা পানির বোতল এগিয়ে দিয়েছিলেন, আমি তার শোকর আদায় করলাম এবং অশ্রুসিক্ত চোখে আসমানের দিকে তাকালাম। এভাবেই আল্লাহ সাহায্য করেন বান্দাকে। প্রতিকূল অবস্থা দ্বারা বান্দার তারবিয়াত করেন, আবার প্রয়োজনের সময় গায়ব থেকে সাহায্য করেন। অবশ্য পুরোটাই হলো অনুভবের বিষয়। হৃদয়ে যদি অনুভব না থাকে তাহলে সবই ঘটনাচক্র, পক্ষান্তরে হৃদয় যদি অনুভব করতে পারে তাহলে সেই ঘটনাচক্রই হলো গায়বি নেযাম, গায়বি তারবিয়াত এবং গায়বি মদদ। যত গোনাহগার বান্দাই হও তুমি, আল্লাহর গায়বি মদদ সবসময় আছে তোমাকে ছায়াদানের জন্য।

সূর্য ডুবে গেছে। অল্প কজন রাস্তার উপরই মাগরিবের জামাত করছেন, কারণ রাস্তা এখন জনশূন্য। আমিও সেই জামাতে শরীক হলাম।

আবার পথ চলা এবং একা একা। ওভার ব্রিজ দেখতে পেলাম। অর্থাৎ আমি পথ হারাইনি। আরো কিছু দূর গিয়ে ডানে মোড় নিলাম এবং আফগান-তাঁবু পেয়ে গেলাম, তবে আফগানী ভাইয়েরা নেই। এরপর সহজেই পৌঁছে গেলাম নিজেদের তাঁবুতে। আল্লাহর শোকর, আল্লাহ আমাকে পৌঁছে দিলেন।

জীবনের বড় অদ্ভুত একটি রাত অতিবাহিত হলো মিনার ময়দানে। বিশাল তাঁবুতে আমি একা। অন্যান্য তাঁবুতে একজন দুজনের আওয়ায শোনা যায়, আর শোনা যায় মুআল্লিমের কর্মীদের তাঁবু গুটানোর আওয়ায।

মুআল্লিমের প্রধান তাঁবুতে দশবারো জনের জামাতে এশার নামায আদায় করলাম। তারা বললো সেখানেই রাত যাপন করতে, কারণ অন্যান্য তাঁবু ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। বেঁচে যাওয়া খাবার ছিলো, সেগুলো খেতে বলা হলো বেশ অনুরোধ করে, না খেলে নষ্ট হবে। আল্লাহর নেয়ামত মনে করে সবাই সে খাবার খেলাম। এমন সময় এমন খাবার যেমন স্বাদের হয় তেমন স্বাদ অন্য সময় অন্য খাবারে হয় না। এটা সেই শুধু বুঝতে পারে যার জীবনে কখনো এমন মুহূর্ত এসেছে।

এই তিনদিন মিনা প্রান্তর ছিলো যেন লক্ষ লক্ষ মানুষের জাঁকজমকপূর্ণ এক শহর; দেখতে দেখতে এখন তা জনমানবশূন্য এক বিরান ভূমি। অসংখ্য তাঁবু এখনো আছে, কিন্তু নেই তাঁবুর বাসিন্দারা। তাঁবুগুলোও থাকবে না আগামীকাল। পড়ে থাকবে খোলা প্রান্তর। পাহাড় থাকবে, প্রান্তর থাকবে, থাকবে না শুধু মানুষ! চোখের সামনে এভাবে জনপদ আবাদ হওয়া এবং বিরান হওয়ার এমন শিক্ষণীয় দৃশ্য আর কোথাও পাবে না তুমি। এ যেন জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের জ্বলন্ত এক উদাহরণ! দুনিয়ার জীবন যে মাত্র দুদিনের তা নিজের চোখে দেখা যায় যদি মিনায় আজকের রাতটি যাপন করা যায়। যদি আজ হারিয়ে না যেতাম তাহলে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেতো এমন একটি মূল্যবান শিক্ষার রাত। এ শিক্ষার প্রয়োজন ছিলো আমার। শিক্ষা তো তিনিই দেবেন যিনি সৃষ্টি করেছেন। তাঁর চেয়ে উত্তম শিক্ষা আর কে দিতে পারে! জনশূন্য মিনা প্রান্তরের আজকের এ নিঃসঙ্গ রাত যেন আমার রবের পক্ষ হতে আমার জন্য সর্বোত্তম এক শিক্ষক। আমি চেয়েছিলাম পর্বতের গভীর নির্জনতায় একটি রাত যাপন করতে; সেই রাত, সেই নির্জনতা মিনা

প্রান্তরেই আল্লাহ আমাকে দান করলেন তের তারিখে।

কালকের জাঁকজমকপূর্ণ রাত এবং আজকের এই সুনসান রাতের পার্থক্য যেন আমার সামনে তুলে ধরলো জীবনের ভিন্ন দুই রূপ। একই প্রান্তরে ভিন্ন দুই রাতে আমি দেখতে পেলাম জীবনের জোয়ার ও ভাটা।

রাত যত গভীর হলো নির্জনতা তত নিবিড় হলো এবং নিঃসঙ্গতা তত গাঢ হলো, আর হৃদয়ের প্রশান্তি তত যেন প্রগাঢ় হলো! বিশাল প্রান্তরে কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই; যেন আমি ছাড়া কেউ নেই। না, তিনি আছেন আমার সঙ্গে। যখন কেউ থাকে না তখন তিনি থাকেন বান্দার সঙ্গে, বান্দার অতি নিকটে।

আজকের নির্জন রাতের পরিপূর্ণ চাঁদকে যত কাছের, যত আপন মনে হলো তেমনটি আগে কখনো মনে হয়নি। স্রষ্টা তো বান্দার কাছে আসেন সৃষ্টিকে আড়ালরূপে গ্রহণ করে। এই যে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো, সে তো তাঁরই জামাল ও সৌন্দর্যের পর্দা। এই পর্দার আড়ালে আমি তো আসলে তাঁর সৌন্দর্যকেই অবলোকন করছি! এ পরম সত্য কি হৃদয় আমার এমন করে উপলব্ধি করতো যদি আজকের এই নির্জন রাত না হতো!

হাঁ, জান্নাতে যখন বান্দাকে আল্লাহ আপন তাজাল্লি দান করবেন, যখন আল্লাহ তাঁর পূর্ণ জালাল ও জামালসহ আত্মপ্রকাশ করবেন তখন বান্দার সামনে কোন আড়াল থাকবে না।

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement