শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠন
আপনার সন্তানের যোগ্যতাগুলো বিকশিত করুন এবং যেসব কাজের মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে সেগুলোর সঙ্গে তাকে সংশ্লিষ্ট করুন। এক্ষেত্রে ধৈর্য্য ও সহনশীলতার প্রয়োজন হবে। কেননা, শিশুরা প্রথম বারই কোনো কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। তাই তার চেষ্টা পুরোপুরি সফল না হলেও তাকে ভৎর্সনা
করা থেকে বিরত থাকুন। সাহস দিন ও শেখাতে থাকুন।
আমরা ছোট থেকেই ঘরের কাজে অভ্যস্ত ছিলাম। এটাকে আমরা প্রতিদিনের জীবনের অংশ বলেই গ্রহণ করেছিলাম। এতে যেমন বড়দের অনেক সহযোগিতা হয়েছে তেমনি আমরাও ওই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে শিখেছি। পরবর্তী জীবনে এটা আমাদেরকে অনেক সুফল দান করেছে।
এ বিষয়েও নানাজীর কিছু নিজস্বতা ছিল। তিনি আমাদেরকে এমন কাজের দায়িত্ব দিতেন যা আমাদের মধ্যে কর্মের যোগ্যতা তৈরি করত। বয়সের তুলনায় কিছু্টা কঠিন দায়িত্ব দিলেও এমন একটা আনন্দের আবহ সৃষ্টি করতেন যার কারণে কাজটা সহজ হয়ে যেত এবং ক্লান্তিকর দায়িত্ব আনন্দের বিষয়ে পরিণত হত।
আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম যখন নানাজী আমাকে ডেকে ‘গাহওয়া’ বানাতে বললেন। আমি বললাম, আমি তো গাহওয়া বানাতে পারি না। তিনি তখন বললেন, এটা খুবই সহজ, কয়েকটা কাজ করলেই গাহওয়া প্রস্ত্তত হয়ে যায়। এরপর আমার হাত ধরে আমার আঙ্গুলে গুণে গুণে বলতে লাগলেন-
প্রথম কাজ : গাহওয়ার পট নিয়ে আস।
দ্বিতীয় কাজ : পাতিলে এক চামচ গাহওয়া দাও।
তৃতীয় কাজ : এক চামচ চিনি দাও।
চতুর্থ কাজ : এক কাপ পানি দাও।
পঞ্চম কাজ : চুলার ওপর রাখ।
ষষ্ঠ কাজ : পানি ফু্টতে দাও। ফুটতে থাকুক, ফুটতে থাকুক ...। পাক্কা ছিয়াত্তর বার! ব্যাস হয়ে গেল চমৎকার গাহওয়া।
আমি গাহওয়া বানাতে গেলাম এবং তাঁর কথামতো পানিতে কতবার বলক আসছে তাও গুনতে আরম্ভ করলাম। আম্মা তখন হেসে বললেন, ওটা ছিল নানাজীর রসিকতা। বেশি জ্বাল দিলে গাহওয়ার স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।
এটা একটা দৃষ্টান্ত। এরকম দৃষ্টান্ত আরো রয়েছে। কখনও কখনও তিনি আমাদেরকে রান্না করতেও আদেশ দিতেন। বলাবাহুল্য যে, মায়েরা এতে জোর প্রতিবাদ জানাতেন। কেননা, আমাদের রান্না সমাপ্ত হওয়ার পর তা আহারযোগ্য করতে তাঁদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হত, কিন্তু নানাজী এ দিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না।
তিনি নাতীদেরকে নামাযে ইমামতী করতে দিতেন। কিশোর ইমাম, যে সবেমাত্র বালেগ হয়েছে, কুরআন- কিরাতের পুঁজি যার নিতান্তই সামান্য, তাকে ইমাম বানিয়ে নিজে মুকতাদী হয়ে যেতেন। লজ্জায় ও ভয়ে বেচারা ইমামের নামাযে-কেরাতে ভুল হয়ে যেত। নানাজী তাকে মোটেও লজ্জা দিতেন না; বরং বাহবা দিতেন ও সাহস দিতেন। এভাবে ধীরে ধীরে সে পূর্ণ ইমামে পরিণত হত।
নাতীদের তিনি ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পাঠাতেন। ছোটদের জন্য খেলনা কিনতে পাঠাতেন। তাদেরকে নির্দিষ্ট করে বলে দিতেন না-তারা কী কিনবে। তাদেরকে চিন্তা করার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতেন। তারা যখন কোনো কিছু কিনে আনত তখন, ভুল হলেও, বেশি দামে কেনা হলেও, তাদেরকে বাহবা দিতেন। তাদেরকে সাধারণত বেশি টাকা দিতেন, যা তারা ইতোপূর্বে নাড়াচাড়া করেনি। ফলে তারা যখন বাজারে যেত তখন তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার অনুভূতি সৃষ্টি হত আর ওই একদিনেই যেন তাদের বয়স কয়েক বছর বেড়ে যেত।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, তিনি শুধু দায়িত্বই দিতেন না, বরং দায়িত্ব পালনের পর বাহবা দানের মাধ্যমে তার সুন্দর সমাপ্তিও ঘটাতেন। তিনি এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন যে, ছোটদের কোনো ভুল সিদ্ধান্ত, বা ভুল পদক্ষেপের কারণে তাদেরকে বিদ্রূপ করা হলে গোটা আয়োজনটার উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়ে যায়। তরবিয়াত বিষয়ে তার বিচক্ষণতার কারণেই তিনি জানতেন যে, কাউকে কোনো কাজের দায়িত্ব অর্পণের মধ্যে এই প্রতিশ্রুতিও থাকে যে, তার ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হবে।
এই পদ্ধতির সঙ্গে অনেক বাবা-মার ওই আচরণটা তুলনা করুন, যা তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে করে বসেন। বাবা তার ছেলেকে একটি পত্রিকা কিনতে পাঠিয়েছেন, ছেলে ভুলক্রমে অন্য পত্রিকা নিয়ে এসেছে। বাবা এতে রাগান্বিত হয়ে বকাঝকা আরম্ভ করলেন।
মা তার মেয়েকে থালা-বাটি ধুতে বলেছেন, কাজটা করতে গিয়ে সে একটি বাটি ভেঙ্গে ফেলেছে। তখন মা তাকে বিদ্রূপবাণে জর্জরিত করতে আরম্ভ করলেন!
এই দুটো পন্থার বিপরীতমুখী ফলাফল সম্পর্কে আমরা চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। #