আমার আম্মা আজীবন কবরের চিন্তায় বেকারার ছিলেন
এরপর আম্মাকে আর দেখিনি। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আম্মা কোনো কথা বলেননি। কাউকে জিজ্ঞেস করেননি, ‘আমার আবদুল হাই কেমন আছে?’ এর আগ পর্যন্ত আম্মার মুখে একটি অস্থির প্রশ্ন শোনা যেত, ‘আমার আবদুল হাই কেমন আছে?’ বিছানায় পড়ে আছেন। কষ্টে কাতরাচ্ছেন। মাথা এদিক ওদিক করছেন। অর্ধেক দেহ অবশ। স্পন্দনহীন। অর্ধেক দেহে অসামান্য কষ্ট। পিঠের নিচে বিদ্যুতচালিত বিছানা। ডান দিকে জানালা। বা দিকে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত চেয়ার। দক্ষিণের জানালায় তাকালে বড় উঠান পেরিয়ে দূরে বাড়ির বড় দরজা দেখা যায়। কেউ যখন বিদায় নেয়, আম্মা তাকে বিদায় দেন। বড় কষ্টে জানালার শিক ধরে মাথাটা তোলেন। জানালার কাছে মাথা নিয়ে বড় দরজা পর্যন্ত যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে থাকেন। তারপর আবার শুয়ে পড়েন। আবার সেই তুমুল যন্ত্রণার মাঝে পড়ে থাকেন। সবর করতে থাকেন এবং করতেই থাকেন। এত কষ্টের মাঝেও আম্মার এক প্রশ্ন-‘আমার আবদুল হাই কেমন আছে?’ আম্মা এখন নেই। তিনি চলে গেছেন তাঁর ঠিকানায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাতরাতেন এবং কাতর কণ্ঠে যাকে ডাকতেন, তিনি এখন আম্মাকে ডেকেছেন। তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা। মাগরিবের নামাযের জন্য অযু করছি। অযু প্রায় শেষ। ডান পা ধুচ্ছিলাম তখনই খবর এল-আম্মা ইন্তেকাল করেছেন। ডান পা ধুচ্ছিলাম। বারবার একথাই মনে হতে থাকল, ডান পা ধুচ্ছিলাম। খবরটা আরেকটু আগেও আসতে পারত। আরেকটু পরেও আসতে পারত। ডান পা। ডান। ইয়ামীন। আসহাবুল ইয়ামীন। মনে পড়তে থাকল কুরআনের আয়াত, যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে নীরব সুসংবাদ। মনের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আশ্বস্তি অনুভব করলাম। খুব কাছ থেকে খুব সাফভাবে যেন শুনতে পেলাম-‘আসহাবুল ইয়ামীন’। এরপর শুনতে থাকলাম আরো আশ্বাসবাণী। যেন কেউ প্রশ্ন করল, জান, তোমার আম্মা কোথায় গেছেন? ‘মা-আসহাবুল ইয়ামীন’? এরপর সেখান থেকেই জবাব এল-
في سدر مخضود، وطلح منضود، وظل ممدود، وماء مسكوب وفاكهة كثيرة لا مقطوعة ولا ممنوعة وفرش مرفوعةএকে একে উপলব্ধি আসতে থাকল। আম্মার জন্য এত কালের জমে থাকা এত কষ্ট, এত দিনের এত উৎকণ্ঠা, নিমিষে সব দূর হয়ে গেল। মনের অনেক গভীর থেকে নীরব সাক্ষ্য পেলাম, আম্মা আমার এখন অনেক আরামে আছেন।
***
আম্মা শুয়ে আছেন। সাদা কাপড়ে ঢাকা। পবিত্র মুখমণ্ডল অনাবৃত। আমি বসলাম আম্মার মাথার কাছে। খাটিয়ায় দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরলাম। আমি বসলাম যমীনের উপর। আম্মার মুখ পশ্চিম দিয়ে হেলানো। আমাকে কিছু বলবেন। আম্মাকে আজ এমন অপূর্ব সুন্দর লাগছে কেন? আম্মার কপালে এটা কীসের উজ্জ্বলতা? আগে তো দেখিনি। খাটিয়ার চারপাশে কত মানুষ! সবাই কি দেখছে এই উজ্জ্বল রৌশনী? আমার দু’ চোখে পানি। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা। হাহাকার করা শূন্যতা। এর মাঝেও, আমার অস্তিত্বের গভীরে অনুভব করলাম একটি অন্য রকম আনন্দ। এক অভূতপূর্ব সান্তনা। আমার আম্মাকে আমি দেখলাম আনন্দিত। আমি খাটিয়া আরো শক্ত করে ধরলাম এবং অনেক অনেক দূর থেকে আম্মারই কণ্ঠ যেন শুনতে পেলাম।
الحمد لله الذي أذهب عنا الحزن، إن ربنا لغفور شكور
আল্লাহ! সত্যি যেন এমন হয়। সত্যিই যেন আমার আম্মা আপনার হামদ ও প্রশংসায় এমনই মাতোয়ারা হন। ‘আমার যত কষ্ট, যত বেদনা, হে আল্লাহ, আপনার প্রশংসা, আপনি সব দূর করে দিলেন। আল্লাহ, আপনি এত সুন্দর পুরস্কার দিতে জানেন!’
***তারপর আমি বের হয়ে এলাম। আব্বার কাছে যাব। মাদরাসার উত্তর-পূর্বে ছোট্ট একটি ঘর। ছোট একটি জানালা। দক্ষিণমুখী। জানালা খুললেই মাদরাসার মাঠ। তারপর পুকুর। মাঠের পশ্চিমে মসজিদ। আব্বার কাছে গেলাম। বসলাম। আব্বা চোখ মুছলেন। আমাকে দেখলেন। হয়ত সান্তনা খুঁজলেন এবং হয়ত সান্তনা পেলেন। এবং চোখ নামিয়ে নিলেন। আমি বসে থাকলাম আব্বার সামনে। কত কথাই তো বলার ছিল। কত কথাই তো জমা হয়েছিল। বুকের ভিতর অনুভব করলাম গলে যাচ্ছে সব কষ্ট, সব ব্যথা। যা বলতে চেয়েছিলাম বলতে পারলাম না। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি বলা হয়ে গেল।
***আমার আম্মা। আমার জীবনের প্রথম পাঠশালা। আমার মনে পড়ে, জীবনের সেই দিনগুলো-আম্মার কাছে লাভ করলাম জীবনের প্রথম সবক। কায়েদা বোগদাদী। আম্মা বললেন, আলিফ, বা, তা। আমি আমার মায়ের প্রথম সন্তান-আম্মার সুরে সুর মিলাতাম-আলিফ, বা, তা। আমার জীবন শুরু হল। আমার আম্মা রোপন করলেন আমার জীবনের বীজ। মনে পড়ে সেদিনের দুনিয়ার কথা। আমাদের গ্রাম। আমাদের ছোট্ট পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে আমি ছিলাম, আমার আব্বা ছিলেন, আর ছিলেন আমার আম্মা। সেই পৃথিবীর প্রশস্ততা বেড়েছে। অনেক ফুল অনেক ফলের সমারোহ হয়েছে। পৃথিবীর সেই প্রশস্ততা দেখে আমার মা খুশি হয়েছেন। আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হয়েছেন। নিজ হাতে তিনি সাজিয়েছেন একটি বাগান। বাগানে পানি দিয়েছেন। বাগানের সজীবতা দেখে পুলকিত হয়েছেন। এই বাগান সাজাতে সয়েছেন অনেক কাঁটার আঘাত। তারপরও তিনি অবিরাম সাজিয়ে গেছেন তাঁর বাগান। বাগান সাজানো যখন তার শেষ হল, তিনি পরিতৃপ্ত হলেন এবং তাঁর জন্য যে বাগান সাজানো হয়েছে অন্যজগতে, তিনি সেখানে চলে গেলেন।
***আমার আম্মার জীবন ছিল আমাদের জন্য জীবন্ত শিক্ষা। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল সবর এবং শোকর। আম্মার সবরের যিন্দেগী বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। আমরা যারা আম্মাকে দেখেছি এবং দেখার মতো দেখেছি তারা হয়ত কিছুটা অনুভব করতে পারব। আমাদের সংসার ছিল অত্যন্ত অভাব-অনটনের সংসার। আব্বাজানের সামান্য আয় দিয়ে বহু কষ্টে সংসার চলত। আম্মাজান ছিলেন ধামতির পীর মাওলানা আজীমুদ্দীন রাহ.-এর বড় মেয়ে। আমাদের নানার বাড়ির যিন্দেগী ছিল আমিরানা যিন্দেগী। সেখানে কোনো কিছুর অভাব ছিল না। আর আমাদের বাড়ির অবস্থা ছিল ঠিক বিপরীত। অথচ আম্মার মুখে কোনো দিন কোনো না-শোকরের কথা আমরা শুনিনি। বহু কষ্টে সংসার গুছিয়ে রাখলেন। আমীরানা যিন্দেগী ছেড়ে ফকিরানা যিন্দেগী আম্মা খুশি মনে বরণ করে নিয়েছিলেন। বাড়িতে খানেওয়ালা ছিল অনেক। কিন্তু এক পাতিল ভাত রান্না করার মতো অবস্থা আমাদের ছিল না। আম্মা কী করতেন! ভাতের চাউলের সাথে কাউন মিলিয়ে পাতিল পূর্ণ করতেন। এ দিয়েই আমাদের ক্ষুধা কোনো মতে নিবারণ হত। একদিন আমাদের বাড়িতে মেহমান এলেন। মুআযযায মেহমান। এর মধ্যে ভাত রান্না হয়ে গেছে। ভাত মানে কাউন মেশানো ভাত। এ ভাত তো মেহমানকে দেওয়া যাবে না। আম্মা পেরেশান হয়ে গেলেন। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি এল। আমি বললাম, আম্মা চালুনি দিয়ে ভাতগুলো চালুন। কাউনগুলো নিচে পড়ে যাবে। ভাতগুলো উপরে থাকবে। সেই ভাত মেহমানকে পরিবেশন করা যাবে। নতুন করে ভাতও রান্না করা লাগবে না। মেহমানেরও বে-কদর হবে না। আম্মা ভীষণ খুশি হলেন এবং বললেন, ‘তোর বুদ্ধি তো খুব সুন্দর।’ আমাদের রান্নাঘরের আরেকটি দৃশ্য আমার মনে পড়ে। আলু কুচি কুচি করে চাউলের মতো বানানো হত। চুলা থেকে ভাত নামানোর একটু আগে আলুগুলো ভাতের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হত। ভাতের পরিমাণ বেড়ে যেত। পাতিল পূর্ণ হত। অনেক সময়তো আটা সেদ্ধ করেও খেয়েছেন। এভাবে আম্মা কষ্ট করতেন এবং সবর করতেন। আম্মা জানতেন, মুমিনের কোনো কষ্টই বৃথা যায় না। আল্লাহর ইচ্ছার উপর তিনি নিজের সকল ইচ্ছাকে কুরবান করতে পেরেছিলেন। ধন-সম্পদ কোনো দিন আসেনি তাঁর হাতে। তবুও তিনি ধনী ছিলেন। পিত্রালয়ের আমীরানা যিন্দেগী আর শ্বশুরবাড়ির ফকীরানা যিন্দেগী কোনোটাই আম্মাকে মূল মাকসাদ থেকে একটুও বিচ্যুত করতে পারেনি। সব কিছুর মাঝে তিনি মাওলার রেযামন্দী তালাশ করেছেন। প্রাচুর্যের মাঝেও আল্লাহকে খুঁজেছেন, অভাবের মাঝেও মাওলাকেই তালাশ করেছেন। শ্বশুরালয়ের এমন কষ্টের কথা আম্মা কোনোদিন পিত্রালয়ে প্রকাশ করেননি। রেযা বিল কাযার জীবন- প্রতিচ্ছবি ছিলেন আমার আম্মা। আহ্! কী কষ্টের যিন্দেগী তিনি অতিবাহিত করেছেন! তবুও কী বিস্ময়কর স্থিরতা তাঁর মাঝে দেখেছি।
***পর্দার ব্যাপারে আম্মা অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। নিম্ন স্বরে কথা বলতে বলতে আম্মার অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, পরে তিনি আর উঁচু স্বরে কথাই বলতে পারতেন না। মুখের কাছে কান নিয়ে কথা শুনতে হত। পৃথিবীর কোনো পরপুরুষ বলতে পারবে না, সে আমার আম্মার কথা শুনেছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলতেন। আমার নানীর এই অভ্যাস ছিল। নানীর বড় মেয়ে তার মায়ের এই স্বভাব পুরোপুরি পেয়েছিলেন। কুরআন তিলাওয়াত করতেন এত আস্তে যে, পাশের মানুষও অনেক সময় বুঝতে পারত না। ধামতি নানার বাড়ি থেকে পাহাড়পুর পর্যন্ত তখন নৌকার পথ ছিল। নৌকায় উঠার আগে ঘাটের দুই দিকে প্রায় সোয়া মাইল পর্যন্ত নানাজান দু’জন লোক দাঁড় করিয়ে রাখতেন। আম্মা নৌকায় উঠা পর্যন্ত এদিকে যেন কেউ না আসে। বোরকার উপর দিয়েও যেন আম্মাকে কেউ না দেখে।
***তরবিয়তুল আওলাদ-আম্মার খুসুসী ছিফাত ছিল। তরবিয়তের স্বার্থে যখন আদর প্রয়োজন আদর করেছেন। যখন শাসন প্রয়োজন শাসন করেছেন। আম্মা ছিলেন নরম দিলের মানুষ। শত কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করতেন। কিন্তু সন্তানের সামান্য কষ্টে তাঁর চোখে পানি এসে যেত। আমাকে একবার কোনো কারণে সামান্য মেরেছিলেন। আল্লাহ আমাকে তাওফীক দিলেন, আমি সাথে সাথে আম্মার কাছে মাফ চাইলাম। আম্মার চোখে পানি এসে গেল। যে ভুলের জন্য আম্মা মেরেছিলেন, আমি অনিচ্ছায় করেছিলাম। আম্মা কাঁদলেন এবং আফসোস করলেন, কেন মারলাম। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আম্মার এ শাসন থেকে এ শিক্ষাই লাভ করেছিলাম-অনিচ্ছায়ও যেন ভুল না হয়।
***যিকরুল মাওত। মৃত্যুর স্মরণ। আম্মার যিন্দেগীর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল।
أكثروا ذكر هاذم اللذات الموت
এ হাদীসের আদর্শ নমুনা ছিলেন আমার আম্মা। প্রত্যেকটা কথা মেপে মেপে বলতেন। প্রতিটি কদম খুব সাবধানে ফেলতেন। প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুর প্রস্তুতির জন্য ব্যয় হত। কবরে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব তো, হাশরের ময়দানে শাফায়াত নসীব হবে তো-এইসব চিন্তায় আম্মা সব সময় বে-কারার থাকতেন। আম্মার এ বে-কারারী যারা দেখেছে হাদীসের যিন্দা নমুনা দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়েছে।
আমার ছোট ভাই আবদুল ওয়াহহাব। আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে সেই হাফেযে কুরআন। আম্মা একদিন তাকে কোনো কারণে শাসন করার জন্য ধরলেন। আবদুল ওয়াহহাবের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। সে জানত, একজন হাফেযে কুরআন দশজনকে সুপারিশ করতে পারবে। আম্মার মনের অবস্থাও সে জানত। সে বলে উঠল, আম্মা! মারবেন না। মারলে কিন্তু আমি সুপারিশ করব না। আল্লাহু আকবার! এ কথা শোনার সাথে সাথে আম্মা তাকে ছেড়ে দিলেন। কেমন বিমর্ষ হয়ে গেলেন। আখেরাতে পার পাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা! আম্মার মৃত্যু পর্যন্ত এই আবদুল ওয়াহহাবই আম্মার খিদমত করেছে। সে ও তার বিবি-বাচ্চারা মিলে আম্মার যে খিদমত করেছে আল্লাহ অবশ্যই এর জাযা তাদেরকে দিবেন, দুনিয়াতেও, আখিরাতেও। জীবনের শেষ পাঁচটি বছর আম্মাতো এত বে-কারার হয়ে গিয়েছিলেন, যাকে দেখতেন তাঁকেই প্রশ্ন করতেন, কবরের অন্ধকারে কীভাবে থাকব?
***আম্মার অনেকগুলো সুন্দর গুণের মধ্যে একটি ছিল মুশায়াআত। মেহমানকে এমনভাবে বিদায় দিতেন যে, মেহমান কখনো তা ভুলতে পারত না। মেহমান যেই হোক, বিদায়ের সময় আম্মা বড় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। বার্ধক্য ও অসুস্থতার ভারে নুয়ে পড়ার পরও আম্মাকে দেখেছি, বিদায়ের সময় শরীর টেনে টেনে বহু কষ্টে দরজা পর্যন্ত চলে আসতেন। যখন বিছানায় পড়ে গেলেন, তখন বহু কষ্টে মাথা তুলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন।
***সন্তানের জীবন শুরু হয় মায়ের শিক্ষা দিয়ে। মায়ের শিক্ষাই সন্তান আজীবন আঁকড়ে থাকে। সন্তানের জন্মগত ফিতরাতের সাথে মায়ের তরবিয়ত যদি মিলিত হয় তাহলে সন্তানের যিন্দেগী ফুলের মতো সুন্দর হয়। আমার নানী ছিলেন ঠিক এমনই একজন মা। আমার মা-খালাদের দেখে আমার এমনই মনে হয়েছে। সন্তানের ফিতরতকে নষ্ট হতে না দেওয়া এবং ফিতরাতের মহা আমানতকে যত্নের সাথে সংরক্ষণ করার বিস্ময়কর যোগ্যতা ছিল আমার নানীর মাঝে। বিবাহের আগ পর্যন্ত আম্মা নানীর সযত্ন তরবিয়ত লাভ করেছিলেন। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা, অনর্থক কথাবার্তা ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক প্রবণতা আম্মার মাঝে ছিল না। যে তরবিয়তের সুফল আলহামদুলিল্লাহ, আমরা এখনো ভোগ করছি। আম্মার বিবাহ হল। এখন উঠিয়ে দেওয়ার পালা। আমার নানীর কাছে গৃহস্থালি কাজকর্মের জন্য একটি দা থাকত। আম্মাকে শ্বশুরালয়ে পাঠানোর আগে নানী এক অদ্ভুত আচরণ করলেন। দা’টা দেখিয়ে বললেন, জুবায়দা! শোন্, যদি শ্বশুর বাড়ি থেকে তোর নামে কোনো অভিযোগ আসে তাহলে এই দা’টা দেখেছিস, এক কোপ দিয়ে দুই টুকরা করে দেব।
আম্মাতো আগেই তরবিয়ত পেয়েছেন। তার উপর এখন এ মুহূর্তে নানীর এমন তাম্বীহ আম্মার জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। আম্মা এ তাম্বীহ আজীবন মনে রেখেছেন। আম্মা আব্বার সংসারে এলেন। পদে পদে নানীর সেই তাম্বীহকে ইয়াদ করতে থাকলেন। ধীরে ধীরে এক জান্নাতী পরিবেশ তৈরি হল। আম্মার সেই বাগানে যতগুলো ফুল ফুটেছিল সেই ফুলগুলো সুবাস ছড়িয়েছে বিভিন্ন দিকে। আমার পাঁচ বোন। পাঁচ বোন যে যেখানে আছে তাদের ঘিরে গড়ে উঠেছে দ্বীন শিক্ষার একেকটি নূরানী পরিবেশ। সবাই তাদের যিন্দেগীর একটি সম্পদ বানিয়ে নিয়েছে কুরআন শিক্ষাদান। সবার ঘরেই এক বা একাধিক মক্তব। ঘরে ঘরে গিয়ে দ্বীনের তালীম। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে আম্মার আজীবনের সেই সাধনা ও দুআর বরকতে, যার বীজ তিনি গ্রহণ করেছিলেন নানীজানের কাছ থেকে।
***আম্মা সব সময় বলতেন, আমার বাড়িতে যেন দাঁড়ি-টুপি ছাড়া কোনো মানুষ না আসে। নিজের মেয়েদের বেলায় যেমন, নাতীদের বেলায়ও আম্মার এ নীতি অনঢ় ছিল। দাড়ি-টুপি ছাড়া কেউ আম্মার বাড়িতে ঢুকতে পারেনি। এক নাতিন জামাইয়ের দাড়ি ছিল না। আম্মার সাথে দেখা করতে এসেছিল। আম্মা ঘরে ঢুকতে দেননি। দাড়ি রেখে, সুন্নতী লেবাস পরে তারপর আসতে হবে। অনেক দিন পর সেই নাতিন জামাই আবার উপস্থিত। মুখে দাড়ি, গায়ে জামা, মাথায় টুপি। আম্মা সুযোগ দিলেন। সে দেখা করল এবং দাড়ি ও লেবাস স্থায়ীভাবেই ধারণ করল। আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে এমন কোনো কাজের ব্যাপারেই আম্মা কাউকে কোনোদিন ছাড় দেননি। আলহামদুলিল্লাহ, আম্মার এই কঠোর নীতির সুফল আমরা এখন ভোগ করতে পারছি। এমন মা যারা পায় তাদের যিন্দেগী বড় ইতমেনানের হয়।
***তারগীব ও তারহীব একজন আদর্শ মুরব্বীর তরবিয়তের প্রধান উপকরণ। তরবিয়তের ক্ষেত্রে কোনোটার প্রভাবই কম না। আমি আমার আম্মার প্রথম সন্তান। আমাকে দিয়েই শুরু হয়েছে আম্মার তরবিয়তী যিন্দেগীর সুদীর্ঘ পথ। কায়দার ‘আলিফ-বা’ এবং যিন্দেগীর ‘আলিফ-বা’ দুটোই আম্মার কাছ থেকে অর্জন করেছি। এখান থেকেই আমার শুরু। এরপর ধীরে ধীরে চলতে থাকলাম। মক্তব, কিতাবখানা। গ্রাম, শহর অবশেষে হাফেজ্জী হুজুর রাহ.। আম্মার সযত্ন নেগরানিতে এতদিন যা শিখেছি, এতকাল যে তরবিয়ত হাসিল করেছি, হাফেজ্জী হুজুর রাহ. সব দেখলেন এবং নীরব ভাষায় সমর্থন জানালেন। মায়ের মক্তব থেকে শিখে আসা এই তালিবুল ইলমকে হাফেজ্জী হুজুর রাহ. সাদরে গ্রহণ করলেন (এবং আল্লাহ ভালো জানেন, হয়ত তখনই তিনি একটি সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন, যার প্রকাশ অনেক দিন পর ঘটেছিল।)
হাফেজ্জী হুজুর রাহ. আমাকে শেখালেন অনেক কিছু। তারপর একদিন গেলাম আম্মার কাছে। আম্মা আমাকে দেখলেন এবং প্রাণভরে দুআ দিলেন। আমার যিন্দেগীর প্রাপ্তিতে আরো অনেক কিছু যোগ হল। গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি জাগলাম। যিকির করলাম। একলা ঘরে। হাফেজ্জী হুজুরের দেওয়া ১২ তাসবীহের অযিফা আদায় করলাম। গুণ গুণ শব্দ হয়ত হয়েছিল। আমিতো ভেবেছিলাম, আমি একাই জেগে আছি। আমি না জানলে কি হবে, আল্লাহ জানতেন, পাশের ঘরে আরো একজন জাগ্রত মানুষ চুপচাপ বসে আছেন। আমার আম্মা। যিকির করা থেকে তাঁর কাছে ভালো লাগছিল সন্তানের যিকিরের গুণগুণ শুনতে। তিনি শুনছিলেন। আর উপর থেকে একজন দেখছিলেন এ দৃশ্য, যাকে দেখানোর জন্যই এত কিছু। সকালে আম্মা বললেন, আমি ভোররাতের যিকির শুনেছি। আমার ভালো লেগেছে। আমি উৎসাহিত হলাম। আম্মার সামান্য কথায় আমি এক অসামান্য শক্তি অর্জন করলাম। একেই বলে তারগীব। জীবনের এই সময়টাতেও আম্মা আমাকে সেই আগের মতোই নযরে নযরে রেখেছেন। সেই শৈশব-কৈশোরের মতো এখনো আম্মা আমাকে তারগীব দিলেন, উৎসাহ দিলেন। এর চেয়ে বড় সা‘আদাত আর কী হতে পারে!
***আকাবির ওলামার প্রতি আম্মার মনে গভীর শ্রদ্ধা ও আযমত ছিল। আম্মা সব সময় সুযোগ তালাশ করতেন কোনো অলী-বুযুর্গের মেহমানদারি করা যায় কীভাবে। আম্মা সুযোগও পেয়েছেন। বড় বড় অনেক আলেমের মেহমানদারি করার। আমাদের বাড়িতে আম্মার হাতে রান্না খেয়েছেন মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ.-এর পীর, মুহাদ্দিস সাঈদ আহমদ রাহ., হাফেজ্জী হুজুর রাহ., শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব (দা.বা.) সহ আকাবির আলেমদের অনেকেই।
***আম্মা আমাদের মাঝে মাঝে উৎসাহ দিতেন অন্যভাবে। সরাসরি আমলের কথা না বলে কোনো আমলকারীর গল্প শোনাতেন। আমি উৎসাহিত হতাম। আমলের প্রতি মনের গভীরে মজবুত আকাঙ্খা সৃষ্টি হত। একদিন আম্মা আমাকে বললেন, বাবা আবদুল হাই! আমি ঘড়ি না দেখেই বলতে পারি রাত দু’টা কখন বাজে। আমি অবাক হলাম! আম্মা ঘড়ি না দেখে কীভাবে বলতে পারেন? আম্মা বললেন, তোর আব্বা যখন ঘুম থেকে উঠে তখন আমি বুঝে ফেলি এখন দুটা বাজে।’ আব্বার সারা যিন্দেগীর অভ্যাস এটা। এখনো আব্বার এ অভ্যাস। রাতে দু’ঘণ্টা ঘুমাতেন। রাত দুইটায় ঘুম থেকে উঠতেন। নামায পড়বেন, এরপর সিজদায় পড়ে দুআ করতে থাকবেন। আজ থেকে কত বছর আগে আম্মার মুখে এই কথা শুনেছি। আম্মা আমাকে উৎসাহ দিলেন দু’টি আমলের। এক তাহাজ্জুদ, আরেক হল ইসতেকামাত।
***আল্লাহ, আপনি আম্মাকে জান্নাতের উঁচা মকাম দান করুন। আম্মার কবরকে বেহেশতের বাগানে পরিণত করুন এবং যতদিন বেঁচে থাকি আম্মার নেকসন্তান হয়ে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুম-এর কাছ থেকে শুনে লেখাটি তৈরি করেছেন তাঁর পুত্র মাওলানা আবরারুয যামান