তালেবানে ইলমে নবুওয়তের প্রতি কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশনা
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ১৪২৪ হিজরীতে একবার মারকাযুদ দাওয়াহ থেকে শিক্ষা সমাপনকারী সকল তালিবে ইলমকে মারকাযে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল,তাদের কর্মজীবনের ব্যস্ততা সম্পর্কে অবগতি লাভ করা এবং তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। এ সময় মারকাযের আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু প্রয়োজনীয় কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। বিষয়টি জানার পর কিছু বন্ধু আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় তা প্রকাশ করার অনুরোধ করেন যেন মাদরাসার নেসাববদ্ধ পড়াশোনা সমাপ্ত করে কর্মজীবনে পদার্পণকারী তালাবায়ে কেরামের সামনে কথাগুলো থাকে। এ পরামর্শ আমাদের কাছেও মুনাসিব বলে মনে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে, সকল তালিবে ইলমকে এই বিষয়গুলোর ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আমীনুত তা’লীম
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
যাদের কুতুবখানা আছে এবং সাথে সাথে তাহকীকী কাজেরও রুচি আছে তাদের জন্য কাজের কোনো সীমা নেই। হযরত শায়খ আবদুল ফাত্তাহ রাহ.-এর স্মৃতিতে ও খাতায় প্রয়োজনীয় কাজের দীর্ঘ তালিকা ছিল। শায়খ নুমানী রাহ.-এর স্মৃতিতেও বড়সড় একটি তালিকা ছিল। এখানকার একজন উস্তাদের ডায়েরীতে ষাটটিরও বেশি মৌলিক বিষয়বস্ত্ত সংরক্ষিত রয়েছে এবং চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে সেগুলোর শত শত প্রাসঙ্গিক শিরোনাম। অন্যান্য উস্তাদ ও অন্যান্য আহলে ইলমের কথা তো বাদই রইল।
আইম্মায়ে হানাফিয়্যাহর তবাকাত, নকদে আখবার ও ফাহমে আখবার বিষয়ে আইম্মায়ে হানাফিয়্যার মূলনীতি, হাদীস ও উলূমুল হাদীসে হানাফী আলেমগণের অবদান ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের দাবীদার। এসব বিষয়ে তথ্যসংগ্রহের কাজ তো অবশ্যই শুরু করা উচিত।
‘মাবসূত’ ‘বাদায়ে’ ‘হেদায়া’ ‘ফাতহুল কাদীর’ তদ্রূপ তহাবী ও জাসসাস-এর রচনাবলি থেকে কাওয়ায়িদে ফিকহ, কাওয়ায়িদে শরীয়ত, উসূলে হাদীস, কাওয়ায়িদে শরহে হাদীস ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ করা যেতে পারে।
‘গায়রে মুকাল্লিদ’ ও ‘বেরেলভী’ ইত্যাদি মতবাদের ‘রদ’ এর ব্যাপারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক কাজ আপনারা প্রত্যেকেই করতে পারেন। ইখতিলাফী মাসাইলের সুস্পষ্ট দলিলসমূহ একত্র করে অনুবাদ করে দিন। এটাও বর্তমান সময়ের জন্য অনেক বড় কাজ। নসবুর রায়া ও ইলাউস সুনান না থাকলেও শুধু ফিকহুস সুনান ওয়াল আছার ও আছারুস সুনান এ কাজের জন্য যথেষ্ট।
বেরেলভীদের শিরকী আকীদাসমূহ এবং বিদআতের বিপক্ষে যেসব আয়াত ও হাদীস রয়েছে তা অনুবাদ করে দিন এবং মিরকাতুল মাফাতীহ ও মিশকাত ইত্যাদির হাশিয়া থেকে আসলাফের কিছু্ ইবারত উল্লেখ করে দিন। যার কাছে আলমাদখাল লিবনিল হাজ বা আলইতিসাম লিশশাতিবী রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, এই দুই কিতাব থেকে বিদআতের পরিচয় ও লক্ষণ এবং বিভিন্ন বিদআতের স্বরূপ পেশ করা।
মোটকথা, ফিকির ও হিম্মত অনেক বড় জিনিস। যাহিজ সত্যই বলেছেন-
إذا نكح الفكر الحفظ ولد العجائب
আর জনৈক আরাবীর একটি উক্তি তো স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত-
إذا ثبتت الأصول في القلوب نطقت الألسن بالفروع.
৩. তাসনীফের জন্য শুদ্ধ ও সুন্দর রচনাশৈলী আয়ত্ব করা জরুরি। এর জন্য হিম্মত করে পথ বের করতে হবে। হযরত মাওলানা তকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সম্পর্কে আপনারা সবাই জেনে থাকবেন যে, তিনি কত কষ্ট করে ইংরেজি শিখেছেন।
৪. তাসনীফের জন্য ‘ইতক্বান’ অপরিহার্য। অনুশীলনের পর্যায় অতিক্রম করার পর পরিমাণের চেয়ে মানের দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এটা খুবই জরুরি। তবে মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর কথা অনুযায়ী-
الاستقصاء شوم
এ দিকেও লক্ষ রাখা কর্তব্য।
৫. তাসনীফের সাধারণ নীতিমালা ও আদাব এবং বিভিন্ন ধরনের তাসনীফের বিশেষ নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। এজন্য বিভিন্ন রচনা রয়েছে। সেগুলো মুতালাআ করা উচিত। যোগ্য ও পরিণত লেখকদের সাহচর্য গ্রহণ করা এবং তাদের সাথে মতবিনিময় ও চিঠিপত্র আদান প্রদান করা এ বিষয়ে উন্নতির একটি মৌলিক পন্থা।
৬. তাসনীফের ব্যাপারে একটি প্রশ্ন হয় যে, ছাপানোর ব্যবস্থা নেই। আর ছাপানোই যদি না হয় তবে লিখে ফায়েদা কী? এটা ভুল মানসিকতা। কিতাব যদি মুদ্রিত না হয় তবে তা অপ্রকাশিত ‘মাখতূতা’ বা পান্ডুলিপির মর্যাদা লাভ করে। দ্বিতীয়ত প্রকাশিত না হলে রচনাটি পাঠকের কাছে গেল না, অন্যরা ব্যাপকভাবে এর দ্বারা উপকৃত হল না,কিন্তু রচনাকার নিজে রচনার সকল সুফল লাভ করবেন। আর ব্যাপকভাবে না হলেও সীমিত পর্যায়ে অন্যরাও এর থেকে উপকৃত হবেন।
একটি স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি হল, অসম্ভব কাজের বাহানায় সম্ভব কাজ পরিত্যাগ করা উচিত নয়। ‘মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া’তে ছাপানোর উপযোগী অনেক রচনা রয়েছে, কিন্তু ছাপানোর ব্যবস্থা হচ্ছে না। তাই বলে কি এখানকার লোকেরা তাসনীফ ছেড়ে দিয়েছেন?
এছাড়া তাসনীফ যদি চলনসই মানের হয় এবং সাধারণ পাঠকের রুচির অনুকূল হয় তবে আজকাল বহু প্রতিষ্ঠান তা ছাপার জন্য প্রস্ত্তত থাকে। প্রথম অবস্থায় গ্রন্থস্বত্ব নিজে সংরক্ষণের চিন্তা না করলে কিতাব ছাপানো আজকাল তেমন মুশকিল নয়।
৭. এ ব্যাপারে আরো একটি মানসিকতা রয়েছে যে, আগে রচনার সকল তথ্য একত্র হোক তারপর লেখা আরম্ভ হবে। এটাও ভুল। কাজের নিয়ম হল প্রথমে অনেকগুলো রচনার সূচি প্রস্ত্তত করা এবং যখনই কোথাও কোনো বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে সঙ্গে সঙ্গে তা নোট করে রাখা বা ভিন্ন কাগজে নোট করে নির্ধারিত ফাইলে সংরক্ষণ করা। যখন যে বিষয়ের যে পরিমাণ তথ্য সংগৃহীত হয় সে বিষয়ের উপর সেই পরিমাণ কাজ করে রাখবে। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা তাদের সংগৃহীত তথ্যাবলি ও সূচিপত্র নিয়ে অবসর সময়ে বা ছুটির সময়ে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে বা ব্যক্তির কাছে চলে যান যেখানে অনেক বেশি কিতাব পাওয়া যায়। এভাবেই তারা তাদের কাজ পূর্ণ করেন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
১. নিজের -ذوقيات এবং নিজের আকাবিরের وجدانيت অন্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করা খুবই অসঙ্গত।
২. যা হবার নয় তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা উচিত নয়।
৩. তাহকীক ছাড়া কোনো কথা বলা উচিত নয়; অন্যের পিছনে পড়া তো দূরের কথা ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার পেছনে পড়ো না’। এই নির্দেশনা সর্বদা সামনে থাকা উচিত।
৪. ‘লা-আদরী’ বলতে লজ্জা না করা উচিত।
৫. সত্য স্বীকার ও ভুল স্বীকারে সংকোচ করা উচিত নয়। কেননা, এটাই বিনয়ের দলিল। হাদীস শরীফে এসেছে-
البكر غمط الناس وبطر الحق
আমর বিন উবাইদ মু’তাযেলীর উক্তি ‘সত্যের প্রতি আমার কোনো বিদ্ধেষ নেই’। অপর একজন সুন্নী আলেম উবায়দুল্লাহ বিন হাসান আলআনবারী রাহ. বলেছেন-
إذا أرجع وأنا صغير، لأن أكون ذنبا في الحق أحب إلي من أن أكون رأسا في الباطل
৬. মুরববী ও সহকর্মীদের প্রতি কটাক্ষ করা থেকে সতর্কতার সাথে বেঁচে থাকা উচিত। তাদের গুণাবলি স্মরণ রাখবেন এবং তাদের ভুল ভ্রান্তি অন্বেষণ থেকে বিরত থাকবেন। প্রথাগত তাখাসসুসের কারণে নিজের ব্যাপারে উচ্চ ধারণা পোষণ করা এবং আচার-আচরণে তা প্রকাশ করা খুবই নিন্দনীয়।
৭. কোনো অবস্থাতেই মাদরাসায় রাজনীতি প্রবেশ করাবেন না। তালিব ইলমকে এর সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত করবেন না। এর কুফল সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
৮. অনেক কিতাব সংগ্রহ করার সামর্থ্য না থাকলে বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সাথে নির্বাচন করে প্রত্যেক ফনের সবচেয়ে তথ্যপূর্ণ, সবচেয়ে উপযোগী, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কিতাব সংগ্রহ করবেন। ইলমের উন্নতি, মুতালাআ, তাহকীক, তাসনীফ ও তালীফ সহজ ও ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য উত্তম নির্বাচন খুবই সহায়ক হয়ে থাকে।
৯. একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, যাদের বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে তাদের জন্য সময়সূচি প্রস্ত্তত করা এবং অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তার অনুসরণ করা ইনতিজামী ফরয। ইশারাতুন নুসূস, আমলে মুতাওয়ারাস এবং আকাবিরের বক্তব্যের মাধ্যমে এর গুরুত্ব প্রমাণিত। হযরত মাওলানা তকী উছমানী দা.বা. এ বিষয় সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী আকাবির ছাড়াও হাকীমুল উম্মত রাহ. ও শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রাহ.-এর সীরাত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
১০. ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হাদীস ও ফিকহের ব্যক্তিগণ নিজ নিজ বিষয়ে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে যেমন-বর্তমানে ফিরাক ও মিলাল একটি প্রয়োজনীয় বিষয়, সাপ্তাহিক দরস ও ‘মুহাজারা’ আরম্ভ করতে পারেন। এটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও হতে পারে বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশেষ পরিমন্ডলেও হতে পারে। এতে জ্ঞান ও অধ্যয়নের পরিধি বৃদ্ধি পাবে এবং ইলমী বিষয়ে আলোচনার যোগ্যতা তৈরি হবে। একই সঙ্গে তাসনীফের জন্যও তথ্য সংগ্রহ হবে। এছাড়া শ্রোতাদের উপকারের দিকটি তো রয়েছেই। প্রাথমিক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একটি কিতাব থাকাই যথেষ্ট। বরং অনেক বিষয়ের জন্য শুধু কুরআনে কারীম ও মিশকাত ছাড়া অন্য কোনো কিতাবের প্রয়োজন নেই।
১১. প্রত্যেকের জন্য নিজস্ব ফনের অবশিষ্ট মুতালাআ এবং অন্যান্য জরুরি ফনের প্রয়োজনীয় মুতালাআ সমাপ্ত করা অপরিহার্য। আসাতিযায়ে কেরামের সামনে নিজের অবস্থা পেশ করে কর্মসূচি প্রস্ত্তত করে নেওয়া উচিত।
১২. অনেকের এই ধারণা আছে যে, পাঠদানের সঙ্গে অন্য কাজ করা অসম্ভব বা কঠিন। এটা ভুল। সময়সূচি অনুযায়ী চললে সকল প্রয়োজনীয় কাজই কিছু না কিছু হতে পারে।
১৩. কোন দ্বীনী খিদমতকেই ছোট মনে করা ঠিক নয়। আল্লাহ তাআলা যাকে যে খিদমতের জন্য কবুল করেন তাই গনীমত মনে করা উচিত। দ্বীনী খিদমতকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত যে, এটি একটি দ্বীনী খিদমত এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যই তা করা হচ্ছে।
১৪. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি দৃষ্টি রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, কাপড়-চোপড়, কামরা ইত্যাদি পরিষ্কার রাখা এবং পুরো পরিবেশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পূর্ণ ইহতিমাম করা উচিত। বিশেষত যেসব জায়গায় পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অবহেলা করা হয় যথা- গোসলখানা, বাথরুম, পেশাবখানা, ওযুখানা ইত্যাদি, এসব স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেওয়া উচিত। যদি নিজেও এ কাজে শরীক হওয়া যায় তবে তো অতি উত্তম। তা না হলে অন্তত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে কাজ উসূল করে নেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে যিকর ও ফিকর-এ মাওলানা তাকী উছমানী দা.বা.-এর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি অবশ্যই পড়বেন।
১৫. তাসহীহে নিয়ত এবং তাজদীদে নিয়তের ব্যাপারে হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী রাহ.-এর হিদায়াত হয়তো সকলেরই মনে আছে। তাই তা আর উল্লেখ করা হল না।
১৬. পরিশেষে আপনাদের সবার সম্পর্কে আমরা আশাবাদী যে, অন্তত প্রতি দুই মাস অন্তর চিঠিপত্র বা সরাসরি দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে ‘মারকাযুদ দাওয়াহ’-এর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবেন। #