দুআ কী ও কেন
কথিত আছে যে, হযরত মুসা আ.-এর সময়ে একবার অনাবৃষ্টি দেখা দিল। বহুদিন থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল না। পশুপাখি পর্যন্ত অনাহারে ছটফট করছিল। এমতাবস্থায় হযরত মুসা আ. বনী ইসরাইলদের নিয়ে মাঠে বৃষ্টির নামায পড়ে দুআ করতে গেলেন। আল্লাহ বললেন, আপনাদের দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এই মজলিস থেকে এক ব্যক্তি উঠে না যাবে। সে আমার সাথে নাফরমানী করে যাচ্ছে এবং আমার সামনে নতি স্বীকার করছে না। হযরত মুসা আ. মজলিসে ঘোষণা দিলেন, হে ভাই! কে সে নাফরমান? যার কারণে এতগুলো মানুষের দুআ কবুল করা হবে না? দয়া করে তুমি মজলিস থেকে উঠে যাও। তোমার কারণে পশু-পাখিসহ এতা মানুষ অনাবৃষ্টিতে কষ্ট পাবে এ হয় না। ঘোষণার পর মজলিস থেকে কেউ উঠল না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নেমে এল। মুসা আ. লজ্জায় আল্লাহকে বললেন, ইয়া আল্লাহ, সে লোক তো উঠল না। তারপরও বৃষ্টি হল। উম্মতের সামনে আমি ছোট হয়ে গেলাম। উম্মত আমাকে মিথ্যুক মনে করতে পারে। আল্লাহ বললেন, যার কারণে বৃষ্টি বন্ধ ছিল তার কারণেই এখন বৃষ্টি দিলাম। কারণ, আমার সাথে সে সন্ধি করে ফেলেছে। সে তাওবা করে নতি স্বীকার করে নিয়েছে।
আসলে ঘটনা ছিল এ রকম, মুসা আ.-এর ঘোষণার পর ঐ গোনাহগার ব্যক্তি লজ্জায় আল্লাহর কাছে নত হয়ে প্রার্থনা করল, হে মনিব! এই মজলিস থেকে এখন যদি আমি উঠে যাই তাহলে সবাই আমাকে নাফরমান বলে চিনে ফেলবে। আমাকে এতগুলো মানুষের সামনে লজ্জা দিও না। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আর নাফরমানী করব না। তার মনের অবস্থা দেখে আল্লাহর দয়া হল। তিনি তার গোনাহগার বান্দাকে অন্যদের সামনে বে-ইযযযত না করে বৃষ্টি দিয়ে দিলেন।
হাদীস শরীফে এসেছে, ‘আদদুআউ হুয়াল ইবাদাহ’। দুআই ইবাদত। আরেক হাদীসে এসেছে-‘আদদুআউ মুখখুল ইবাদাহ’। অর্থাৎ দুআ ইবাদতের মগজ বা সারবস্ত্ত।
সমস্ত এবাদতের সারবস্ত্ত হচ্ছে, আল্লাহর কাছে বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করা। আর প্রয়োজনের সময় বান্দা যখন আল্লাহর কাছে দুআ করে তখন সে আল্লাহকে খুব কাছে অনুভব করে থাকে। আল্লাহ আমার ভাত নেই, আল্লাহ আমার টাকা নেই, আল্লাহ আমার অসুখটা ভালো করে দাও। তুমি ছাড়া আর কে-ই বা আমাকে সাহায্য করবে? ইত্যাদি শব্দে দুআর সময় বান্দা আল্লাহকে অত্যন্ত কাছে অনুভব করে। আল্লাহকে এভাবে স্মরণ করতে পারা হল ইবাদত। আল্লাহ তো সব সময় বান্দাকে দেখেন, তাঁর প্রয়োজন সম্পর্কে জানেন। কিন্তু বান্দার এ বিষয়ে অনুভূতি থাকে না।
আল্লাহর স্মরণ যার যত বেশি হবে তিনি ততই কামেল বা বুযুর্গ হবেন। আর এই অনুভূতি দুআর মধ্যে যেভাবে প্রকাশ পায় অন্য ইবাদতে সেভাবে প্রকাশ পায় না। তাই দুআকেই ইবাদত বলা হয়েছে এবং দুআকে ইবাদতের সারবস্ত্ত বা মগজ বলা হয়েছে।
আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় ব্যতীত দুনিয়া ও আখেরাতের যে কোন বস্ত্তই দুআর বিষয় হতে পারে। হাদীস শরীফে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ বস্ত্তও আল্লাহর কাছে চাওয়ার কথা এসেছে। এমনকি জুতার ফিতার প্রয়োজন হলে তাও আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর এই চাওয়াকেই দুআ বলা হয়। এটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয়।
হালাল খাদ্যভক্ষণসহ দুআ কবুল হওয়ার জন্য অনেক শর্ত-শারায়েতের মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে, বিনয় ও অক্ষমতা প্রকাশ করা। আমি অক্ষম, তুমি সক্ষম। আমি অধম, তুমি উত্তম। আমি কিছুই পারি না, তুমি সব পার। নিজের হীনতা ও দীনতাকে যে যত বেশি প্রকাশ করতে পারবে তার দুআ তত বেশি কবুল হবে। তাই দেখা যায়, অনেক মূর্খ লোকের দোয়াও কবুল হয়ে যায়। মজলুমের দুআ কবুল হওয়ার নিগুঢ় রহস্যও এখানেই। মজলুম ব্যক্তি মনের কষ্টে যখন দুআ করতে উদ্যত হয় তখন তার সামনে আর কোনো গায়রুল্লাহ বা মাধ্যম থাকে না। সরাসরি আল্লাহকে সে এমনভাবে বলতে থাকে যে, তার অনুভূতিতে আল্লাহ তখন একেবারে নিকটে থাকেন। তার মনের এই অবস্থার কারণে আল্লাহ তাআলা তার দুআ সাথে সাথে কবুল করে নেন।
তাসাওউফের ভাষায় বান্দার মাকামে ইহসান তথা সব সময় আল্লাহর স্মরণ অর্জিত হওয়াকে শেষ মাকাম মনে করা হয়। আর তা হাসিলের জন্য কত রিয়াযত-মোজাহাদা করতে হয় তার কোনো হিসাব নেই। অথচ একজন হাজতমন্দ দুআর সময়ে যথার্থ কাতরতা ও বিনয় প্রকাশ করলে এই মাকামে উপনীত হতে পারে। তাই হাদীসে ‘দুআই ইবাদত’ এই শব্দের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঐ বান্দা কতই না উত্তম, যার প্রতিটি মুহূর্ত দুআয় পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দুআর হাকীকত ও দুআর মজা উপভোগ করার তাওফীক দান করুন। আমীন। #