বাইতুল্লাহর মুসাফির-১৬
তখন এ নির্জনতারও প্রয়োজন হবে না; কোন কিছুরই প্রয়োজন হবে না। তখন এই চাঁদকে যেমন দেখতে পাই তেমনি দেখতে পাবে বান্দা আল্লাহকে; দেখতে পাবে তাঁর জালাল ও জামাল এবং তাঁর মহিমা ও সৌন্দর্য। এই চাঁদ যেমন আমার উপর বর্ষণ করছে স্নিগ্ধ জোসনার শিশির, তেমনি তখন বর্ষিত হবে বান্দার উপর আল্লাহর জালাল ও জামাল এবং মহিমা ও সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ শিশির। তাতে জান্নাতি বান্দা হতে থাকবে সুন্দর থেকে সুন্দর, হতেই থাকবে!
আশ্চর্য! আজকের এ রাতের আগে, এই গভীর নির্জনতার পূর্বে কোথায় কিসের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো আমার হৃদয়ের এ অনুভব-অনুভূতি! আমি যদি হারিয়ে না যেতাম তাহলে তো মিনাপ্রান্তরের এ নির্জন রাত হারিয়ে যেতো আমার জীবন থেকে এবং হারিয়ে যেতো হৃদয়ের এই পবিত্র অনুভব-অনুভূতিও! সুতরাং নিজেকে হারিয়ে আমি যেন নিজেকেই খুঁজে পেলাম আজ।
চাঁদ অস্ত গেলো, ফজর উদিত হলো। ছোট্ট এক জামাতে বিরাট উপলব্ধির অপূর্ব এক নামায আদায় হলো। নির্জন রাতের বিনিদ্র মুহূর্তগুলোর পর আমার দু’চোখ ভরে নেমে এলো
প্রশান্তির ঘুম। এ ঘুম চোখের, এ ঘুম দেহের; এ ঘুম নয় হৃদয়ের এবং আত্মার!
যখন জেগে উঠলাম, তখন আমি যেন অন্য এক মানুষ! নবজন্মের নবজাগ্রত এক মানুষ! আমি এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নিজেকে, আমার চারপাশের সবকিছুকে। শোকর আলহামদুলিল্লাহ!
তখন আলোকিত দুপুর। সূর্য প্রখর উত্তাপ বর্ষণ করছিলো এবং মরুভূমি উত্তপ্ত ছিলো। কিন্তু হৃদয়ের শীতলতা ও প্রশান্তি সবকিছুকে এমন ছাপিয়ে উঠলো যে, বাইরের সবকিছুকে মনে হলো শান্ত-শীতল। তাই সতেজ দেহে, সজীব হৃদয়ে এবং সবল পদক্ষেপে আমি রওয়ানা হলাম জামারার উদ্দেশ্যে। আজকের জামারামুখী এ পথের পূর্ণ প্রশস্ততা ও দৈর্ঘ্য, মনে হলো আমার একার। এ পথ যেন সোজা চলে গিয়েছে জান্নাতের দুয়ার পর্যন্ত! শয়তানকে যদি তুমি পরাস্ত করতে পারো তাহলে জান্নাতে প্রবেশের পথে তোমার আর বাধা কোথায়! আজ এ পথের শেষ মাথায় আমাকে নামতে হবে সেই চেষ্টায়! কংকরের আঘাতে শয়তানকে পরাস্ত করার শেষ চেষ্টায়!
এমন কিছু অনুভব-অনুভূতিতে আমি আচ্ছন্ন ছিলাম জামরা-অভিমুখী এই নির্জন পথে চলতে গিয়ে। কালকের জামারায় তো ছিলো না এ অনুভূতি! নির্জনতা ছাড়া এমন অনুভূতি সম্ভবত আসে না অন্তরে। ‘খালওয়াত দর আন্জুমান’ (জনতার মাঝে নির্জনতা)-এর স্বাদ যারা অনুভব করতে পারেন তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন।
অন্যদিনের চেয়ে অনেক কম সময়ে আজ পৌঁছে গেলাম জামারায়। সুবহানাল্লাহ! জামারার দৃশ্য দেখে সত্যি অভিভূত হলাম! মন খুশিতে বাগবাগ হয়ে গেলো! এমন কেন হচ্ছে আজ! কেমন অনুভূতি এ! যেদিকে তাকাই মনে হয়, সবকিছু আমার জন্য! মাওলার পক্ষ হতে বান্দার ইকরামের জন্য! তোমার শোকর হে আল্লাহ! তুমি বড় মেহেরবান হে আল্লাহ!
তোমার বান্দারা দেখো হে আল্লাহ, যে যার পাত্র পূর্ণ করে খুশি-খুশি বিদায় নিয়ে গেছে মিনাপ্রান্তর থেকে; কিন্তু আমি রয়ে গেছি নির্জনতার মাঝে তোমার নৈকট্য লাভের আশায়! তোমার এককত্বের কাছে হে আল্লাহ! আমার একাকিত্বের শুধু এই মিনতি, আমাকে তুমি কবুল করো হে আল্লাহ!
জামারায় তখন খুব বেশী হলে পঞ্চাশ ষাটজন। বলা যায়, প্রায় নির্জন। তাই প্রথম জামারার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় হৃদয় অন্যরকম এ আবেগে উদ্বেলিত হলো। আমার চারপাশে আজ কোন জনতরঙ্গ নেই; আছে শুধু আমার হৃদয়ে আবেগের তরঙ্গ। আমি এগিয়ে গেলাম ধীর শান্তভাবে, হৃদয়ের গভীরে সেই তরঙ্গদোলা অনুভব করে করে। আমি এগিয়ে গেলাম সুদৃঢ় পদক্ষেপে আমার চিরশত্রুর দিকে। এখন সময় শত্রুর প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করার নয়। এখন সময় অবিচল প্রতিজ্ঞা অর্জন করার। শয়তান জানে, ক্রোধের উন্মত্ততা হলো ক্ষণিকের। তাই ছুঁড়ে দেয়া জুতা-ছাতায় শয়তান শুধু কৌতুক বোধ করে। তার ভয় হলো মানুষের দৃঢ় পদক্ষেপ এবং তার অবিচল প্রতিজ্ঞা।
বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে প্রথম কংকরটি নিক্ষেপ করলাম। আজ নয় কোন তাড়াহুড়া ও বিচলতা। শয়তানকে প্রথম কংকরের যন্ত্রণা ভোগের সময় দিয়ে ধীরে সুস্থে আমি প্রস্ত্তত হলাম দ্বিতীয় কংকরটি নিক্ষেপ করার জন্য এবং নিক্ষেপ করলাম। অপূর্ব এক পুলক ও আনন্দশিহরণ যেন আমার সর্বসত্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। আমার দুশমন নিশ্চয় ঘায়েল হয়েছে দ্বিতীয় কংকরের আঘাতে! হে আল্লাহ, জীবনের বাকি দিনগুলোতে শয়তান যেন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না পারে আমার সামনে।
এভাবে তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তির সাথে প্রথম জামারার রামী সম্পন্ন হলো। এবার যতক্ষণ ইচ্ছা দু‘আ করো দ্বিতীয় জামারা শুরু করার আগে। ভিক্ষার পাত্র হাতে প্রাণভরে ভিক্ষা চাও তোমার মাওলার দরবারে। কেউ বাধা দেবে না তোমাকে। কারণ তুমি ছাড়া কেউ নেই সেখানে। একই রকম শান্তি ও প্রশান্তির সাথে, একই রকম দৃঢ়তা ও দৃপ্ততার সাথে দ্বিতীয় জামারা সমাপ্ত করলাম। হৃদয় তখন উন্মুক্ত ছিলো এবং আশা ও প্রত্যাশার সীমাহীন উচ্ছ্বাস ছিলো। তাই হৃদয়ের সবটুকু আকুতি ও মিনতি নিবেদন করে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করলাম-
হে আল্লাহ, তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই, তুমি ছাড়া কারো আমার প্রয়োজনও নেই।
হে আল্লাহ, জীবনের সর্বক্ষেত্রে শয়তানকে পরাস্ত করার এবং নফসকে দমন করার তাওফীক দান করো।
হে আল্লাহ, তুমি আমাকে ভালোবাসো এবং তোমাকে ভালোবাসার তাওফীক দান করো।
হে আল্লাহ, মৃত্যুর সময় তুমি আমাকে সঙ্গ দান করো এবং তোমার সঙ্গ গ্রহণ করার তাওফীক দান করো।
হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকো এবং তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দান করো।
হে আল্লাহ, দুই জামারার মধ্যবর্তী স্থানে তোমার পেয়ারা হাবীব যা যা দু‘আ করেছেন তার কিছু বরকত এই অধম উম্মতিকেও দান করো। আমীন।
আমার মৃত্যুর পর কে ভাই তুমি এ সফরনামা পড়ছো! কালের ঘড়িতে এখন কত সময় পার হয়েছে! একশ বছর! দু’শ, তিনশ বছর!
তুমি আমাকে দেখোনি, আমিও তোমাকে দেখিনি! কিন্তু এ লেখা যখন লিখছি, তোমাকে আমি অনুভব করছি। তুমিও যেন আমাকে অনুভব করো এবং আমার দু‘আর সঙ্গে আমীন বলো, আর দয়া করে আমার জন্য একটু দু‘আ করো।
মুনাজাত থেকে ফারিগ হয়ে তৃতীয় ও শেষ জামারার দিকে এগিয়ে গেলাম এবং একটি, দু’টি করে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে শেষ কংকরটিও নিক্ষেপ করলাম। এভাবে জীবনের প্রথম হজ্বের সর্বশেষ আমলটিও সমাপ্ত হয়ে গেলো। শোকর আলহামদু লিল্লাহ!
কী শান্তি ও প্রশান্তি! কী তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তি!!
দশ তারিখে যখন ইহরাম থেকে মুক্ত হলাম তখন হৃদয়ের যে অনুভূতি ছিলো তা কোন ভাষায়, কোন উপমায় প্রকাশ করা যায়! মরুভূমির যাত্রী যেন ছায়াঘেরা মরুদ্যানে প্রবেশ করলো! কিংবা আরো সুন্দর কোন উপমা, যা আমার জানা নেই!
তারপর যখন তাওয়াফে যিয়ারাত শেষ হলো তখনকার অনুভূতি! পিপাসার্ত মুসাফির যেন মরুদ্যানের ছায়ায় বসে সুশীতল পানি পান করলো! কিংবা আরো সুন্দর কোন উপমা, যা কারো জানা নেই!
আর এখন শেষ জামারার শেষ কংকরটি নিক্ষেপ করার পর! বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে মুসাফির যেন পৌঁছে গেলো তার মানযিলে মাকছূদে পরম পিয়তমের সান্নিধ্যে!
স্বপ্ন যিনি দান করেছিলেন, স্বপ্ন তিনি পূর্ণ করেছেন; সুতরাং আশা করি, সমস্ত ত্রুটি ও বিচ্যুতি এবং দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও তিনি তা কবুল করে নিয়েছেন। আমি তো আমার আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণাই পোষণ করবো! আমি তো আমার আল্লাহর কাছে কল্যাণই আশা করবো! আমার অন্যায়-অপরাধ যত গুরুতরই হোক, আল্লাহর রহমতের চেয়ে তো বেশী নয়! আল্লাহর মাগফিরাতের উপর তো তা ভারী নয়!
মিনা থেকে বের হয়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘মুহাছ্ছাব’-এ অবস্থান করেছিলেন। এটা অবশ্য হজ্বের অংশ নয়, কিন্তু ছাহাবা কেরামের নবীপ্রেম ছিলো এমনই অতুলনীয় যে, মুহাছ্ছাবের অবস্থানকেও তাঁরা বিস্মৃত হননি। পরবর্তী যুগে আল্লাহর পেয়ারা বান্দারাও তা অনুসরণ করেছেন। এমনকি নিকট অতীতের বুযুর্গানে দ্বীন ও আশিকানে রাসূলগণ স্পর্কেও জানা যায় যে, তারা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন মুহাছ্ছাবে অবস্থান করে তারপর মক্কায় প্রবেশ করতে। কিন্তু সউদী সরকারের অব্যাহত অবহেলায় এখন তো স্থানটি চেনারও সুযোগ নেই। আফসোস, যদি চিনতে পারতাম তাহলে পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতি ম্মরণ করে অবশ্যই মুহাছ্ছাবে কিছুক্ষণ অবস্থান করতাম।
শেষ জামারা থেকে কিছু দূর আগে বাড়লে মক্কা-অভিমুখী দু’টি সুড়ংপথ। একটি যানবাহনের জন্য, অন্যটি পথচারীদের জন্য। আধুনিক প্রযুক্তি এ অসম্ভবকেও সম্ভব করেছে। পাহাড় এখন আর পথরোধ করে দাঁড়ায় না। মানুষ পাহাড় ছিদ্র করে তার চলার পথ করে নিয়েছে। মিনা ও মক্কার পথ এখন অনেক সহজ ও সংক্ষিপ্ত!
আলহামদুলিল্লাহ, হজ্বের সফরকে আরামদায়ক করার জন্য আধুনিক উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা মোটেই দোষের কিছু নয়। শরীর ও স্বাস্থ্যে এবং সাহস ও মনোবলে মানুষ দিন দিন যেভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে তাতে তো একথা সুনিশ্চয় যে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলো এযুগের মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলার বিরাট নেয়ামত। এ যুগের সুযোগ-সুবিধা না হলে এবং সে যুগের কষ্টগুলো বহাল থাকলে খুব কম মানুষই এখন হজ্বের সফরের সাহস করতে পারতো।
কিন্তু আফসোস! আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও আরাম-আয়েস যতই আমাদের আয়ত্তে আসছে ততই যেন আমরা অতীত থেকে দূরে সরে যাচ্ছি; হৃদয়ে এবং অনুভব-অনুভূতিতে ততই যেন আমরা দরিদ্র ও নিঃস্ব হয়ে পড়ছি। আমাদের হজ্ব ও ইবাদত যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। হজ্বের মূল প্রাণ যে প্রেম ও ভালোবাসা এবং ইশক ও মুহাববাত, তার প্রকাশ কোথায় এখন আমাদের মাঝে!
যোহরের আযানের সময় প্রায় হয়ে গেছে। এখান থেকে মসজিদুল খায়ফ খুব নিকটে; ঐ তো দেখা যায়! অনিবার্য অপারগতার কারণে এ ক’দিন এক ওয়াক্ত নামাযও আদায় করা সম্ভব হয়নি মসজিদুল খায়ফে। না, একটি ওয়াক্ত অবশ্য পড়া হয়েছিলো মসজিদের বাইরে অনেক দূরের কাতারে দাঁড়িয়ে।
মিনার তাঁবুতে বসে হযরত হাফেজ্জী হুযূর আমাকে বলেছিলেন মসজিদুল খায়ফে তাঁর জীবনের প্রথম প্রবেশের অনুভূতির কথা। এখন থেকে অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে, তখন মসজিদের বাহ্যিক অবস্থা ছিলো ‘জীর্ণ-শীর্ণ’। হযরত বলেছিলেন, ‘আব তো সবকুছ খাবো খায়াল মা‘লুম হোতা হায়’ (এখন তো সবকিছু মনে হয় স্বপ্ন আর কল্পনা)।
মুখে মৃদু হাসির স্নিগ্ধতা মেখে কত সুন্দর করে হযরত বলেছিলেন, ‘মিয়াঁ, তখন তো জোয়ান ছিলাম, তোমাদের চেয়ে বেশী জোয়ান। তখন মিনার প্রায় সব ওয়াক্তের নামায মসজিদুল খায়ফে আদায় করেছিলাম এবং একটি রাত মসজিদেই ছিলাম। মসজিদে বিজলী বাতি ছিলো না। তবে দিলে বড় শান্তি এবং রূহানী সুকূন হাছিল করেছিলাম। এমন সুকূন যার ‘ঠান্ডক’ এখনো অনুভব করি!’
যুগে যুগে আল্লাহর বহু বান্দা তাঁদের সফরনামায় মসজিদুল খায়ফে দাখেল হওয়ার পর আত্মিক প্রশান্তি ও রূহানী সকূন হাছিল হওয়ার কথা লিখেছেন, যা খুবই স্বাভাবিক। এখানে যে রয়েছে বহু নবীর কবর! বিদায় হজ্বে এখানে যে কিয়াম করেছেন আল্লাহর পেয়ারা হাবীব! সুতরাং এখানের সবকিছুতেই তো নূর ও নূরানিয়াত!
যোহরের আযানের সময় আমিও জীবনে প্রথম প্রবেশ করলাম মসজিদুল খায়ফে! হযরতের কথাগুলো তখন বারবার মনে পড়ছিলো।
এ ক’দিন মানুষের ভিড়ে এমনকি মসজিদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হয়নি, কিন্তু তের তারিখের এমনই বরকত যে, চারদিক থেকে যেন শুধু শুনতে পেলাম, এসো হে আল্লাহর মেহমান! সবকিছু এখন তোমার জন্য!
আগুনঝরা রোদ থেকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মসজিদে প্রবেশ করে দেহ যেমন জুড়িয়ে গেলো শীতল বাতাসের স্পর্শে, হৃদয় ও আত্মাও তেমনি শীতলতা লাভ করলো এক অদৃশ্য স্পর্শ থেকে, যা শুধু অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না।
বিশাল মসজিদ, জামাত হলো মাত্র এক দু’কাতারের। কিন্তু আমার মনে হলো, মসজিদ যেন জমজমাট। চারদিকে কেমন যেন এক শুভ্রতা! কেমন যেন এক নূরানিয়াত! অদৃশ্যে কাদের যেন আনাগোনা! কাদের যেন ইবাদতের, তিলাওয়াত-মুনাজাতের মৃদুমধুর গুঞ্জন! জানি না, এ গুঞ্জন কি যারা এখানে আছে তাদের, না সুদূর অতীতে যারা এখানে ছিলেন তাদের! জানি না, আমি কিছু জানি না; আমি শুধু মিষ্টিমধুর অনুভবের জগতে তন্ময় হয়ে থাকতে চাই।
আযান হলো। আরবের আযান তুমি যেখানেই শোনবে, মনে হবে সুমধুর; কিন্তু এত যুগ এবং এত শতাব্দীর ব্যবধানেও মসজিদে খায়ফের আযানে তুমি শুনতে পাবে, বেলালী আযানের সুর! বিদায় হজ্বে এখানে আল্লাহর পেয়ারা নবীর অবস্থানকালে হযরত বেলাল (রা) যে আযান দিতেন, সময়ের প্রাচীর অতিক্রম করে যদি তা এখনো প্রতিধ্বনিত হয় তাহলে অবাক হওয়ার কী আছে বন্ধু! তুমিও কান পেতে শোনো আজকের আযান, তুমিও শুনতে পাবে দূরের সেই আযানের সুমধুর সুর!
নামাযের পর মসজিদ থেকে বের হতে কিছুতেই মন সরে না। দাখেল হয়েছি ই‘তিকাফের নিয়তে, কিছুক্ষণ না হয় ঘুমিয়ে থাকি! আল্লাহ তো তাঁর মেহমানদের ঘুমকেও কবুল করবেন ইবাদতরূপে! সুবহানাল্লাহ, কত মেহেরবান আমাদের আল্লাহ!
আবার ভাবলাম, হযরত হয়ত পেরেশান হচ্ছেন। গতকাল রামী করার পর হযরতের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো মক্কায়, কিন্তু ভিড়ের তোড়ে সেই যে হারিয়ে গেলাম, সে হারিয়ে যাওয়া এখনো চলছে আমার। হারিয়ে গেলে মানুষ পেরেশান হয়, জানতাম; কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার শান্তি ও তৃপ্তি যে এতো তা আমার জানা ছিলো না।
মন যেন চাইছিলো, আরো দীর্ঘ হোক এ হারিয়ে যাওয়া, কিন্তু হযরত যে পেরেশান হবেন! সুতরাং আর তো দেরী করা চলে না!
বের হলাম মসজিদে খায়ফ থেকে মেহরাব, ছাদ, দেয়াল সবকিছুর উপর বিদায়ের করুণ দৃষ্টি বুলিয়ে বুলিয়ে। আর কি আসা হবে এখানে, সত্তরজন নবীর মাযার- ধন্য মসজিদে খায়ফ? পেয়ারা হাবীবের অবস্থানে সুরভিত মসজিদুল খায়ফ? হে আল্লাহ, তোমার যদি কৃপা ও করুণা হয় তাহলে তো অসম্ভব কিছুই নয়!
কিছু দূর হাঁটার পর সুড়ংপথের প্রবেশমুখে পৌঁছলাম এবং বিসমিল্লাহ বলে প্রবেশ করলাম। বিরাট সুড়ং, কম করে একশ হাত প্রশস্ত। উঁচু হবে পাঁচ মানুষের সমান। আলোর ব্যবস্থা প্রচুর। জেটবিমানের আওয়াযে বিরাট বিরাট পাখা চলছে। বাতাস যেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশী। প্রবল জনস্রোতে এখানে নাকি দুর্ঘটনাও ঘটে। সেই সুড়ংপথ আজ প্রায় নির্জন! খুব বেশী হলে বিশ-পঁচিশজন। বড় আনন্দ হলো একা একা পথ চলতে।
এখন আমি চলছি মিনা থেকে মক্কার পথে। আবার আমি দেখবো হারাম! আবার আমার চোখ জুড়োবে, মন জুড়োবে আল্লাহর ঘরের যিয়ারাতে, বাইতুল্লাহর তাওয়াফে! আবার আমার প্রাণ শীতল হবে চাহে যামযামের সুমিষ্ট পানিতে! সামনে যখন হতছানি থাকে নতুন আনন্দের, নতুন তৃপ্তির এবং নতুন প্রাপ্তির তখন পিছনের বিচ্ছেদবেদনা মনকে বিষণ্ণ করলেও হৃদয়কে কাতর করে না। তাই তো মদীনাকে বিদায় জানিয়ে মক্কার পথে চলতে গিয়ে হৃদয়ে সেদিন বিচ্ছেদের বেদনা যেমন ছিলো তেমনি ছিলো আনন্দের উচ্ছ্বাস। হৃদয়রাজ্যে আনন্দ-বেদনার সে এক অপূর্ব লুকোচুরি, যার তুলনা তুমি খুঁজে পাবে না জগতের আর কোন আনন্দ-বেদনার অনুভূতিতে। একদিকে মনের জ্বালা-পোড়া, হায়, মদীনার মিনার দেখা যায় না! হায়, মসজিদে নববীর আযান আর শোনা যায় না!
অন্যদিকে মনে ভিতর জাগে অপূর্ব এক পুলক-দোলা, ঐ যে দূরে দেখা যায় মক্কার জনবসতির আলোর ইশারা! আমি তো এখন দেখতে পাবো হারামের আলো এবং কালো গিলাফের সৌন্দর্য!
মদীনা থেকে মক্কার পথে সেদিন যেমন আমি অবগাহন করেছি আনন্দ-বেদনার মিলনমোহনায়, তেমনি মসজিদে খায়ফ থেকে মসজিদুল হারামের অভিমুখে চলতে গিয়ে একই সঙ্গে অনুভব করলাম কিছু রেখে আসা ব্যথা এবং ফিরে পাওয়া অনেক আনন্দ।
ধারণার চেয়ে অনেক কম সময়ে পৌঁছে গেলাম হারাম শরীফে। তখনো আছরের আযান হয়নি। কষ্টের বিষয়, হারাম শরীফের আগে আমাকে যেতে হলো ‘আবুজেহেলের বাড়ী’ এবং সেখানে থাকতে হলো যথেষ্ট সময়।
নামাযের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে হারাম শরীফে প্রবেশ করলাম। বুকটা দুরু দুরু করলো; এই দেখবো, এই দেখবো! এবং দেখতে পেলাম আমার আল্লাহর ঘর! এ ঘরকে বলা হয় ‘আলবাইতুল আতীক’ (প্রাচীন গৃহ), কিন্তু এ যে চিরনতুন! চিরসুন্দর! যখন দেখি যতক্ষণ দেখি, আলো যেন ততই উদ্ভাসিত হয়! সৌন্দর্য যেন ততই বিকশিত হয়! হৃদয়ের আনন্দ যেন ততই পল্লবিত হয়! আত্মার প্রশান্তি যেন ততই গভীর হয়! এ তো শুধু গিলাফের সৌন্দর্য! গিলাফের আড়ালে! কবিহৃদয়ের আকুতি এখন আমি বুঝতে পারি নিজের হৃদয় দিয়ে-
রোখসার সে বোরকা’ কা যেরা পারদা হাটা দো/ লিল্লাহ মুঝে হুসনে খোদা-দাদ দেখা দো!
(মুখমন্ডল থেকে বোরকার পরদা সরাও না একটু! আল্লাহর দেয়া সৌন্দর্য আমাকে দেখাও না একটু!)
আল্লাহর ঘরের প্রতি প্রথম দৃষ্টিপাতকালে যে দু‘আ পড়তে হয় তা পড়লাম। তারপর উম্মেহানিতে উপস্থিত হলাম। আশা ছিলো, এখানেই হযরতকে পাবো এবং পেলাম, তবে দূর থেকে শুধু দেখলাম। নামাযের আগে কাছে যাওয়া সম্ভব হবে না।
হযরত সম্পর্কে একটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলতে ইচ্ছে হয়। আমার অনুভূতির সময় থেকে হযরতকে আমি দেখছি। আববাকে আল্লাহ জান্নাত নছীব করুন; শৈশব থেকে আমাদেরকে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ছায়ায় রাখার চেষ্টা করেছেন। তখন থেকে বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন ঘটনায়, দুর্ঘটনায়, বিভিন্ন যোগে-দুর্যোগে ও আনন্দ-বেদনায় হযরতকে দেখেছি, কাছ থেকে এবং দূর থেকে। আমি বলবো না, সবসময় একজন ফিরেশতাকে দেখেছি! মানুষ ফিরেশতা হবে কেন! মুানুষের সৌন্দর্য তো বাইরে-ভিতরে একজন মানুষ হওয়ার মাঝেই! তবে একথা অবশ্যই বলবো যে, হযরতকে শুধু অবলোকন করে এবং হযরতের বিভিন্ন অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে আমি অনেক কিছু শিখেছি; অন্তত শেখার অনেক সুযোগ পেয়েছি। বিশেষ করে হজ্বের সফরে হযরতের ছোহবত ও সংস্পর্শ থেকে, বিভিন্ন অবস্থায় তাঁকে অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষার এত খোরাক পেয়েছি যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শিক্ষা পেয়েছি কথা বলার এবং কথা শোনার, শিক্ষা পেয়েছি চিন্তা করার এবং অনুভব করার, শিক্ষা পেয়েছি মুহাববাত করার এবং মুহাববাতের আদব রক্ষা করার, শিক্ষা পেয়েছি অনেক কিছুর। তবে পাহাড় থেকে নদীতে পানি তো গড়িয়ে নামে বিপুল পরিমাণে, কিন্তু নদী তার কতটা আর ধরে রাখতে পারে! সব পানি তো গিয়ে মিশে যায় সাগরের নোনা পানিতে! তবু নদীর কিছু না কিছু প্রাপ্তি তো অবশ্যই আছে।
ফিরে আসি আগের কথায়। হযরতকে দূর থেকে দেখছি। তিনি দেখছেন আল্লাহর ঘরকে, আমি দেখছি আল্লাহর বান্দাকে!
একদিন একজন আমাকে বলেছিলেন, তুমি ‘হুযূরের’ দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন! বাইতুল্লাহর দিকে তাকাও!
আমি জানতাম, তিনি যা বলছেন তা যুক্তিসঙ্গত, তবু বিনয়ের সাথে বললাম, বাইতুল্লাহর দিকে কিভাবে তাকাতে হয়? বাইতুল্লাহর জামাল ও সৌন্দর্য কিভাবে অনুভব করতে হয়? বাইতুল্লা্হর আনওয়ার ও বারকাত এবং ফায়য ও ফায়যান কিভাবে হাছিল করতে হয়? এসব আমি জানবো কিভাবে, বোঝবো কিভাবে এবং শিখবো কিভাবে যদি এমন কাউকে না দেখি যিনি বাইতুল্লাহকে দেখতে জানেন, বাইতুল্লাহর সৌন্দর্য অনুভব করতে পারেন, সর্বোপরি যিনি বাইতুল্লাহর ফায়য ও ফায়যানে অবগাহন করতে পারেন?! হযরতকে দেখা তো প্রকৃতপক্ষে বাইতুল্লাহকে দেখার এবং বাইতুল্লাহর সৌন্দর্য অনুভবের যোগ্যতা অর্জন করারই জন্য!
তো বাইতুল্লাহর অবলোকনে আত্মসমাহিত হযরতকে দূর থেকে দেখে আমার সামনে যেন আজ এক নতুন সত্য উদ্ভাসিত হলো। আমার মনে হলো, তিনি বাইতুল্লাহকে অবলোকন করছেন এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে, তাঁর অবলোকন আরো অনেক গভীরে, হয়ত একেবারে তলদেশে গিয়ে উপনীত হয়েছে। হয়ত তিনি সৌন্দর্যের পর্দায় ‘সৌন্দর্য’ অবলোকন করছেন।
নামাযের পর হযরতের কাছে গেলাম এবং সে সময়টি আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলো। ভেবেছিলাম, তিনি গতকালের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন এবং হয়ত সস্নেহ তিরস্কার করবেন। কিন্তু না, তিনি বরং এমনভাবে কথা বললেন যেন এতক্ষণ তাঁর সঙ্গেই রয়েছি আমি!
হযরত যা বললেন তাতে আমি অনাস্বাদিতপূর্ব এক পুলক অনুভব করলাম। কারণ আমার বিশ্বাস হলো, দূর থেকে তাঁর বাইতুল্লাহ অবলোকন, অবলোকন করে আমি তার অন্তর্লোকের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম। ভাব নেই, আবেগ নেই, তরঙ্গ নেই, এমনি সহজ স্বাভাবিক স্বরে তিনি বললেন, ‘মিয়াঁ আবু তাহের! বাইতুল্লাহর দিকে শুধু নযর করা একটি ইবাদত। তবে এই নযরের বিভিন্ন মারহালা
(ও স্তর) রয়েছে। মযা তো তখনই আসে যখন জামালে বাইতের মাঝে জামালে হক নযরে আসে।’
লেখকের লেখায় একজন পাঠক কী পেতে চায়? সবকিছুর আগে নিজেকে খুঁজে পেতে চায়। লেখার আয়নায় একজন পাঠক সবার আগে নিজের ছবি দেখতে চায়। যে লেখায় শুধু লেখকের ছবি থাকে সে লেখায় পাঠকের আগ্রহ থাকে না। বিশেষ করে ভ্রমণকাহিনীর ক্ষেত্রে একথা খুবই সত্য, আর হজ্বের সফরনামায় তা আরো সত্য। কিন্তু যত সংযমই অবলম্বন করা হোক, লেখায় লেখকের ছবি ও ছাপ তো এসেই যায়! এটা তো স্বভাব ও প্রকৃতির অনিবার্য এক দুর্বলতা! শুধু দেখতে হয়, দুর্বলতা যেন দোষের পর্যায়ে না চলে যায়। অবশ্য দোষ ও দুর্বলতার মাঝে ব্যবধান রক্ষা করাও কঠিন।
তো এখন আমি যা বলতে চাই তা যদি শুধু আমার নিজের কথা হয়ে যায়, হে পাঠক, তাতে তুমি যদি নিজেকে কিছুমাত্র খুঁজে না পাও তাহলে হয় আমাকে ক্ষমা করো, না হয় এ অংশটাতে চোখ না বুলিয়ে চলে যেয়ো; আমি কিছু মনে করবো না। চৌদ্দ তারিখে দুপুরের পর অনেক কষ্ট করে উম্মেহানিতে বসে আছি। চেষ্টা করছি বাইতুল্লাহকে দেখতে; দেখে
সান্ত্বনা লাভ করতে। সকাল থেকে যমযমের পানি খেয়েছি কয়েকবার এবং পেট ভরে ভরে। কিন্তু হায়, এ পাকস্থলী তো ঐ রকম নয় যা শুধু নূরানিয়াত থেকে ‘গিযা’ লাভ করতে পারে! অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। বাইতুল্লাহর কালো গিলাফের দিকে তাকিয়ে আছি, আর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এ অশ্রুজল কতটা হৃদয়ের, কতটা উদরের তা বলা কঠিন।
আল্লাহর নেক বান্দাদের কত শত মোজাহাদার ঘটনা পড়েছি কিতাবে এবং শুনেছি হযরত হাফেজ্জী হুযুরের মুখে। তিনি দূর অতীতের ঘটনা বেশী বলতেন না, বলতেন নিকট অতীতের ঘটনা। হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী (রহ), গাঙ্গোহী (রহ), হযরত থানবী (রহ), সৈয়দ হোসায়ন আহমদ মাদানী (রহ) ও অন্যান্যের ঘটনা। এসব ঘটনা শুনতাম, আর নিজের অবস্থা চিন্তা করে লজ্জিত হতাম; হায়, কত দুর্বল আমরা! মুহাববাতের জাযবা, ভালোবাসার অনুভূতি এবং হৃদয়ের মিনতি সবই লোপ পেয়ে যায় দেহের স্থূল চাহিদা যখন মুখ হা করে গিলে খেতে চায়।
তবু সান্ত্বনা এই যে, চোখের পানি আল্লহর ঘরকেই নিবেদন করেছি এবং দীনতা ও মিনতি আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করেছি-
আর তো পারি না হে আল্লাহ! হে মেহেরবান! হে দয়াল মেযবান! কাকে বলবো তুমি ছাড়া! কার কাছে যাবো তুমি ছাড়া! কে শোনবে আমার ডাক তুমি ছাড়া! কেউ না, শুধু তুমি!
আর আল্লাহ ডাক শুনলেন এবং আশ্চর্যভাবে শুনলেন। আল্লাহ অবশ্যই শোনেন, যদি আমরা ডাকি ভরসা ও নির্ভরতার সঙ্গে এবং অপেক্ষা করি একটু ছবরের সঙ্গে।
তখন যদি মানুষের বেশে কোন ফিরেশতাকে আমার সামনে দেখতে পেতাম হয়ত এতটা চমৎকৃত হতাম না, যতটা হয়েছিলাম আমার ভাই সাঈদ মিছবাহকে দেখে। সে তো এখন রিয়াদে তার কর্মস্থলে! তার তো রয়েছে চাকুরির বাধ্যবাধকতা! এসময় তাকে এখানে আশা করবো কী, কল্পনাও করতে পারিনি। বান্দা যা কল্পনা করতে পারে না, আল্লাহ তা বাস্তব করে দেন যখন ইচ্ছা করেন। তাঁর ইচ্ছায় তো অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়!
ইহরামের শুভ্র লেবাসে ফিরেশতার মতই মাতাফের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম আমার ভাইকে, আমার পাশ দিয়ে। আমাকে সে দেখতে পায়নি। পাবে কিভাবে?! তার প্রেমমুগ্ধ দৃষ্টি তো তখন সামনে কালো গিলাফের দিকে! এসময় তো পরিপার্শ্ব মুছে যায় দৃষ্টি থেকে এবং চিন্তা থেকে! এসময় তো মানুষ ভাবের তরঙ্গদোলায় দুলতে থাকে!
ডাক দেয়া আমার উচিত হয়নি বাইতুল্লাহর দিকে এগিয়ে যাওয়া, আমার ভাইটিকে; কিন্তু আমি আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম আবেগে, আনন্দে এবং অভিন্ন রক্তের গন্ধে!
সাঈদ! সাঈদ!!
আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম ডাকতে ডাকতে এবং কাঁপতে কাঁপতে।
শুভ্র লেবাসে সে তো ফিরেশতা ছিলো না, মানুষ ছিলো এবং আমার ভাই ছিলো! তাই সে চমকে উঠলো এবং তার গতি থেমে গেলো। এ অনুশোচনা এখনো আমার অন্তরে বিঁধে যে, আমার ডাকে বাইতুল্লাহর দিকে তার চলার গতি থেমে গিয়েছিলো। সে ফিরে তাকালো; তাকিয়েই থাকলো কয়েক মুহূর্ত।
চোখ দু’টি তার শৈশব থেকেই সুন্দর। কিছু মানুষ আছে, যাদের চোখের চাহনি থেকে কখনো কখনো শিশির ঝরে। আমার ভাইয়ের চাহনি থেকে তখন শিশির ঝরতে দেখেছিলাম এবং সেই শিশিরে আমি সিক্ত হয়েছিলাম।
চলমান চিত্রকে ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে শুনতে পাই। সেই পবিত্র সময়ের শুভ্র-সুন্দর চিত্রটি যদি আমরা দু’ভাই ধরে রাখতে পারতাম আমাদের জীবনে তাহলে খুব ভালো হতো! তাহলে অনেক কিছু হতো এবং অনেক কিছু হতো না।
আমার ভাই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ভাইয়ের বুকে ভাইয়ের ঝাঁপিয়ে পড়া- এটি পৃথিবীর তৃতীয় সুন্দরতম দৃশ্য। এর চেয়ে সুন্দর হতে পারে শুধু মায়ের অাঁচল দিয়ে সন্তানের মুখ মুছে দেয়া এবং সন্তানের মাথায় বাবার স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়া। সময় যত গতি লাভ করছে এবং জীবন যত এগিয়ে চলেছে জীবনের এ দৃশ্য ততই দুর্লভ হয়ে পড়ছে। সংসারে এখন ভাই আছে, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ভাইয়ের বুক নেই। তুমি হে পাঠক, যদি পারো তোমার বুকটিকে উন্মুক্ত রেখো তোমার ভাইয়ের ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।
আমার ভাই আমার দিকে তাকালো এবং তাকিয়েই চমকে উঠলো। এমনই হয়! নাড়ির টানে এবং রক্তের বন্ধনে এমনই হয়! যাকে যত আপন তুমি ভাবতে চাও ভাবতে পারো, কিন্তু তোমার ভাইয়ের চোখের তারায় তোমার মুখের যে ছবি দেখা যাবে, অন্য কারো চোখে তা দেখা যাবে না। আমি অবশ্য সেই চোখের কথা বলছি না যা স্বার্থের ঘোলায় কখনো কখনো ঘোলাটে হয়ে যায়। আমার বাবার চোখের তারায় তাঁর ভাইয়ের এমনই ছবি দেখেছি আমি সারা জীবন!
আমার ভাই অস্থির হয়ে আমার হাত ধরে বললো, চলুন আগে কিছু.. আমি বাধা দিয়ে বললাম, আগে তাওয়াফ সাঈ শেষ করো।
সে কিছুতেই শোনবে না; তখন একটু শাসনের সুরে বললাম, আমার কথা তো শোনো! আগে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করো।
অগত্যা আমাকে সেখানেই বসিয়ে রেখে সে মাতাফে নেমে গেলো। আমি আবার তাকালাম কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘরের দিকে। আবার আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। তবে মনে হয়, এবার তা ছিলো শুধু শোকর ও কৃতজ্ঞতার জন্য।
আমার ভাই সেদিন আমার ক্ষুধার যন্ত্রণা দূর করেছিলো। আর কেউ বুঝতে পারেনি, আমার ভাই বুঝতে পেরেছিলো, আমি কত ক্ষুধার্ত ছিলাম!
কেউ যদি বলে, আমাকে সে ভালোবাসে, আমি বিশ্বাস করবো; যদি বলে, আমাকে সে আমার ভাইয়ের মত ভালোবাসে, আমি নীরব থাকবো; আর যদি বলে, আমাকে সে আমার ভাইয়ের চেয়ে বেশী ভালোবাসে, আমি বিরক্ত হবো। কারণ স্বার্থের মোহ যদি বিভ্রান্ত না করে তাহলে ভাইয়ের চেয়ে ভাইকে কেউ বেশী ভালোবাসতে পারে না।
আমার ভাই ওমরার অনুমতি নিয়ে এসেছিলো এবং দু’দিন ছিলো। এ দু’দিন আল্লাহর ঘরের ছায়ায় আমরা দুই ভাই যে সময়গুলো যাপন করেছিলাম, তা ছিলো আমাদের দু’জনেরই জীবনের অন্যতম মধুর সময়। দু’দিন পর আমার ভাই আপন কর্মস্থলে চলে গেলো তার অনেক কিছু আমার কাছে রেখে এবং আমার অনেক কিছু নিজের সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সে আজ দীর্ঘ পঁচিশ বছর আগের কথা।
অতীতকে সবসময় আমার শুভ্র-সুন্দর মনে হয় এবং অতীতের হাতছানি সবসময় আমাকে ব্যাকুল করে। ইচ্ছে হয় চিরকাল অতীতের কোলেই বাস করি। জীবনের বর্তমান ও ভবিষ্যতের চেয়ে জীবনের অতীতকে আমার অনেক বেশী আপন মনে হয়। ভিতর থেকে কে যেন বারবার আকুল হয়ে ডাকে, হে সুন্দর অতীত! ফিরে এসো এবং তোমার কোলে আমাকে আশ্রয় দাও।
অধৈর্য হয়ে পড়েছো হে পাঠক! থাক তাহলে, চলো ফিরে যাই আমাদের আগ্রহের বিষয়ে।
হজ্ব শেষ হলো, আর আমাদের ‘জোয়ান’ হযরত হঠাৎ করেই যেন বার্ধক্যের কবলে পড়ে গেলেন; অর্থাৎ তিনি এমন গুরুতর অসুস্থ হলেন যে, আমরা সবাই শংকিত হয়ে পড়লাম। হাসপাতালে নেয়ার চিন্তা করা হলো, কিন্তু তিনি রাযি নন। সুতরাং ব্যক্তিগত চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এবং
অচিন্তনীয়ভাবেই তার সুব্যবস্থা হয়ে গেলো। মক্কা শরীফে বাস করতেন মধ্যবয়সের এক বাঙ্গালী ডাক্তার, সম্ভবত জনাব আখতার ফারূক ছাহেবের পরিচিত। নামটা ভুলে গেছি, তবে তিনি তার পেশাগত ভীষণ ব্যস্ততার মাঝেও যে মহাববাতের পরিচয় দিয়েছেন তা ভোলার মত নয়। খবর পেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন এবং হযরতের রুচি, ইচ্ছা ও তবিয়তের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রেখে চিকিৎসা করলেন। চিকিৎসা ও আন্তরিকতা দু’টোয় মিলে দু’দিনেই হযরত মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেন, তবে দুর্বলতা ছিলো এরপর পুরো সফরেই।
শেষ পর্যন্ত হযরতের জন্য হুইল চেয়ার কেনা হলো। ‘যুক্তির’ পথ ত্যাগ করে হাজী সিরাজুদ্দৌলা ছাহেব ভক্তির পথ গ্রহণ করলেন। অর্থাৎ ‘অমুকের দায়িত্ব’ -এর পরিবর্তে ‘আমার সৌভাগ্য’-এ চিন্তা গ্রহণ করলেন। তবে অনেক বিলম্বে। আরো আগে হলে অনেক ভালো হতো!
মক্কা শরীফের অবশিষ্ট দিনগুলো হযরত হুইল চেয়ারে হারাম শরীফে আসা-যাওয়া করেছেন, তাহাজ্জুদে এবং অন্যান্য নামাযে। মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব এবং আমি আনা-নেয়ার খেদমত আঞ্জাম দিতাম। এ সৌভাগ্যের জন্য আমি সবসময় আল্লাহর শোকর আদায় করি। আমার খুবই আনন্দ হতো যখন তাহাজ্জুদের সময় হযরত হুইল চেয়ারে বসে আমাকে ডাক দিতেন, আর আমি দৌড়ে এসে হুইল চেয়ারের হাতল ধরতাম। হযরত প্রথমে আমাকে ডাকতেন, না পেলে মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেবকে ডাকতেন। রাত্রে আমি হারাম শরীফে থাকতাম এবং হযরতকে আনার জন্য তাহাজ্জুদের কিছু আগে বাসায় যেতাম। একদিন আমার পৌঁছতে বিলম্ব হলো। পথে দেখি, হযরত হুইল চেয়ারে আসছেন। মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব কোন প্রয়োজনে হযরতকে আমার ‘হাওয়ালা’ করে বাসায় ফিরে গেলেন।
সেদিনটির কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে এজন্য যে, সেদিন হারামে যাওয়ার পথে হযরত আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমরা এখন জোয়ান। এখনই তোমাদের ইবাদত করার আসল সময়। এই দেখো না, আমাদের মত বুড়োদেরকে তো ঠেলে ঠেলে নিতে হয়। এখন তো দিলে অনেক শওক পয়দা হয়, কিন্তু মাযুরির জন্য পারি না। জোয়ানির সময় তো ত্রিশ চল্লিশটি পর্যন্ত তাওয়াফ করেছি। এখন তোমরা বেশী বেশী তাওয়াফ করবা। হযরত আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আজ কয়টি তাওয়াফ করেছি। উত্তর শুনে তিনি উপরের কথাগুলো বলেছিলেন।
হাজী মীযানের বাড়ী থেকে বের হওয়ার পর কিছু দূর যেতেই একটি বড় ‘বাক্কালা’ ছিলো। বাক্কালা মানে তরিতরকারি বিক্রেতা। এ দোকানগুলোতে কোমল পানীয় এবং প্রয়োজনীয় সবকিছু পাওয়া যায়। বাক্কালার কাছে আসার পর হযরত বলতেন, ‘মুশাক্কাল আছেনি?’
আমি দৌড়ে গিয়ে মুশাক্কাল আনতাম। তিনি খেয়ে কিছু অংশ আমাকে দিতেন। এটা তাঁর এত প্রিয় ছিলো যে, চেহারায় তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠতো।
একদিন বাসায় যাওয়ার পথে আমি মুশাক্কাল নিয়ে গিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট স্থানে আসার পর হযরত কিছু বলার আগেই মুশাক্কাল সামনে বাড়িয়ে দিলাম। হযরত খুব খুশী হলেন এবং অনেক দু‘আ দিলেন।
হযরত পছন্দ করতেন বলে মুশাক্কাল আমারও খুব প্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তী সফরগুলোতে দোকানে দোকানে অনেক তালাশ করেছি, কত রকমের পানীয় ছিলো, হযরতের প্রিয় সেই মুশাক্কাল আর ছিলো না। কীভাবে যে এটা বাজার থেকে এমন উধাও হলো, আল্লাহ জানেন!
মক্কা শরীফের বালাদিয়ার প্রধান শায়খ আব্দুল আজীজ অত্যন্ত শরীফ ও মেহমান নেওয়ায ব্যক্তি। মক্কায় আমরা তার বেশ সুনাম শুনেছি। হযরতকে তিনি তার বাড়ীতে আড়ম্বরপূর্ণ এক নৈশভোজে আপ্যায়িত করলেন। মক্কার উপকণ্ঠে বিরাট এলাকা জুড়ে তার ছিমছাম দোতালা বাড়ী। যে পথ দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো তার দু’পাশে এবং ‘আইল্যান্ড’-এ সবুজ গাছের সারিগুলো ছিলো দেখার মত। বাড়ীটা ছিলো বাগানঘেরা। ছোট বড় বিভিন্ন গাছ সুন্দর করে ছেঁটে রাখা, যেন শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া পেয়ে আকর্ষণীয় বিভিন্ন নকশা ফুটে উঠেছে। যমিন সবুজ ঘাসের চাদরে আচ্ছাদিত। এই সবুজায়নের জন্য যে কী পরিমাণ অর্থ ও যত্ন ব্যয় করতে হয়েছে তা না দেখলে বোঝা যাবে না। তবে একথা সত্য যে, মরুপরিবেশে এমন সবুজবেষ্টিত বাড়ী আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। মক্কার উপকণ্ঠে নিজের জন্য এমন একটি মনোরম বাড়ীর, বলতে সংকোচ নেই, মনে আকাঙ্ক্ষা জেগেছিলো।
খাবারের আয়োজন ছিলো বিপুল এবং পরিবেশন ছিলো আন্তরিক। অবশ্য কোন আরব-দস্তরখানেই এ জিনিসটির অভাব হয় না; যদিও মাত্রায় তারতম্য হয়। অপচয় এখানেও ছিলো। খাবারের অপচয় এখন আরবসমাজে সর্বত্র। এমনকি বাংলাদেশী (এবং পাকিস্তানী ও ভারতীয়) প্রবাসীরাও এ অপচয়ব্যাধিতে কমবেশী আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সবাই নিজ নিজ সচ্ছলতা অনুপাতে অপচয় করে থাকে। পুরো সফরে এ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য, বিশেষত হযরতের জন্য ছিলো অত্যন্ত মর্মপীড়ার কারণ। কোন কোন বাঙ্গালী ও পাকিস্তানী মেযবানকে হযরত এ বিষয়ে সতর্কও করেছেন।
এখানে সত্যের খাতিরে বলতে হয়, হযরত ও তার সফরসঙ্গীদের কাছে ইরানের অভিজ্ঞতা শুনেছি অন্য রকম। সেখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও নাকি কোন প্রকার অপচয় দেখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট খামেনিকে তারা দেখেছেন,
দস্তরখানে পড়ে থাকা অন্যের খাওয়া রুটি তিনি স্বচ্ছন্দে খেয়ে যাচ্ছেন।
শায়খ আব্দুল আযীযের বাড়ীতেও ভোজসভা শেষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এবং হযরতের কথিত ইরান-ইরাক সন্ধিপ্রচেষ্টার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো। ঐ আলোচনায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, শায়খ আব্দুল আযীয যেমন কঠোর শিয়াবিরোধী মনোভাব পোষণ করছেন তার পরিবারের তরুণ প্রজন্ম ঠিক তার বিপরীত। মুখে তারা কিছু বলেনি, কিন্তু তাদের অভিব্যক্তি পরিষ্কার বলছিলো, শিয়াদের আধ্যাত্মিক নেত খোমেইনীর ব্যক্তিত্বের জাদু তাদের মাঝে যথেষ্ট কাজ করছে। সউদী রাজতন্ত্রের প্রতি তারা সন্তুষ্ট নয়। আমার মনে হয়েছে, এ প্রবণতা শুধু শেখ আব্দুল আযীযের পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। একটা সময় হয়ত আসবে যখন রাজতন্ত্রের ভিত্তিমূলে নাড়া পড়বে। ভিতরে ভিতরে একটা ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে এবং বিক্ষোভের উপাদান সঞ্চিত হচ্ছে। আজ হোক, কাল হোক সউদী রাজতন্ত্রের অবসান অনিবার্য। পতন শব্দটি এখানে আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেলাম।
বাইতুশ্শরফের পীর মাওলানা আবদুল জাববার এবং জামাতে ইসলামীর (তখন ইত্তেহাদুল উম্মাহর আড়াল ব্যবহার করা হতো) দেলোয়ার হোসায়ন সাঈদী হযরতের আস্তানায় হাযির হলেন। তারা হযরতের কাছে এভাবে প্রস্তাব পেশ করলেন যে, আপনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশে আমরা ইসলামী আন্দোলন করতে চাই।
প্রস্তাবটির প্রতি অন্যরা যথেষ্ট উৎসাহ দেখালেও হযরত ছিলেন নিস্পৃহ। কারণ এসব ‘ঐক্যের ডাক’-এর প্রকৃতি তাঁর অজানা ছিলো না। এ বিষয়ে অতীতের ওলামায়ে কেরামের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তিনি খুব জানতেন। তিনি একটি মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন; অর্থাৎ আকীদা ও বিশ্বাসের প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে শুধু আন্দোলনের ঐক্য নিয়ে কথা বলা অর্থহীন। তাই তিনি মৃদু হেসে এই বলে আলোচনার ইতি টেনে দিলেন-
‘ইসলামী আন্দোলন তো অনেক করেছেন। আমি তাওবার ডাক দিয়েছি, এখন আসেন অতীতের সকল ভুলভ্রান্তির জন্য তাওবা করে ‘খিলাফত আলা
মিনহাজিন-নবুয়ত (নবুয়তের তরীকায় খিলাফাত) প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করি।
সেদিন একটি মজার ঘটনা হলো। বাইতুশ্শরফের পীর সাহেব বললেন, ‘হুযূরের জন্য আমি ডিনারের ব্যবস্থা করতে চাই।’
হযরত তাজ্জব হয়ে জানতে চাইলেন, ‘ডিনার কেয়া চীজ হায়?!’
আমি বললাম, হযরত এটি ইংরেজি শব্দ। ইংরেজরা রাতের খাবারকে ডিনার বলে। পীর সাহেব আপনাকে রাতের খাবারের দাওয়াত দিচ্ছেন। শব্দটা যে হযরতের পছন্দ হয়নি, চেহারার অভিব্যক্তি থেকেই তা বোঝা গেলো। পরে তিনি বলেছিলেন, ‘এ সমস্ত লোকেরাও ইংরেজি আলফাযের বিমারিতে মোবতালা হয়ে পড়েছে।’
পীর সাহেবের ‘ডিনার’ অবশ্য হযরত কবুল করলেন। আকৃতি ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই সেটা ছিলো সত্যিকারের ‘ডিনার’। শুধু চেয়ার-টেবিল ছিলো না। নচেৎ কাঁটা চামচও সগৌরবে বিরাজমান ছিলো।
ইসলামী আন্দোলনওয়ালা
দস্তরখানেরও একই দশা। এখানেও খাদ্যের অপচয় হলো। সব খাবার একসাথে জড়ো করে পলিথিনে ভরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সত্যি মর্মপীড়ার কারণ হয়েছিলো। আসলে মেহমানের সংখ্যা অনুপাতে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হলেই আর অপচয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না। কেন যে এটা খেয়াল রাখা হয় না কে বলবে!
হজ্বের তিন চার দিন পর শায়খ বিন বাযের পক্ষ হতে পুনরায় যোগাযোগ করা হলো। বিন বাজ তাঁর মিনাস্থ বাড়ীতে হযরতকে দাওয়াত করলেন। সেখানে হজ্ব উপলক্ষে আগত বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশিষ্ট আলিমদেরও দাওয়াত করা হয়েছিলো। পৃথিবীর প্রায় সবদেশের আলিম ওলামাদের এই সম্মানিত মজলিসটি অত্যন্ত ভাবগম্ভীর ও মর্যাদামন্ডিত ছিলো। শায়খ বিন বায হযরতকে তাঁর পাশে বসিয়ে আলাদা সম্মান জানালেন। পুরো মজলিসে হযরতকে মনেও হচ্ছিলো স্বমহিমায় ভাস্বর ও জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। একে একে মজলিসের সকলে খুব তা‘যীমের সাথে তাঁর সঙ্গে মুছাফাহ করলেন। পূর্ব পরিচয় ছাড়া প্রথম দর্শনেই হযরতের নূরানী চেহারা ও জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্ব সবার অন্তরে শ্রদ্ধার আসন তৈরী করে নিয়েছিলো এবং তারা হযরতের আধ্যাত্মিক মাকাম ও মর্তবা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানের মেহমান ছিলেন দু’জন, মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব এবং (সম্ভবত) মাওলানা সামীয়ুল হক ছাহেব। তারা হযরতের সঙ্গে এমন বিনীত আচরণ করলেন যে, আমি সত্যি অভিভূত হলাম। মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব তো পাকিস্তানের মুরুববী আলিম। তাঁর আখলাক ও শারাফাতের পরিচয় তো গত রামাযানেই পেয়েছি। এখন পাকিস্তানের তরুণ আলিম সামীয়ুল হক ছাহেবের আখলাক ও শারাফাত দেখার সুযোগ হলো এবং আমার মনে আবার সেই প্রশ্নটি কাঁটার মত বিঁধতে লাগলো; মাটি ও রক্তের প্রশ্ন, পূর্ব-পশ্চিমের স্বভাব ও চরিত্র এবং চিন্তা ও চেতনার আশ্চর্য পার্থক্যের প্রশ্ন। একবার দেখেছিলাম মাওলানা তাকী ওছমানী ছাহেবকে নূরিয়া মাদরাসার মসজিদে। হযরতের ‘অনুরোধে’ তালিবে ইলমদের উদ্দেশ্যে তিনি বয়ান করলেন, কিন্তু হযরতের সামনে চেয়ারে বসতে কিছুতেই রাজি হলেন না। হযরতের হুকুম পালন করার জন্য কিছু কথা অবশ্যই আরয করবো, কিন্তু এই গোস্তাখি তো আমি করতে পারবো না।’
শেষে হযরত এক প্রকার আদেশ করেই তাঁকে চেয়ারে বসালেন।
কেন এমন হয়? তারা পারে, আমরা পারি না?! কেন?! কেন?!
সেদিন শায়খ বিন বাযের
দস্তরখানে পাকিস্তানের তরুণ মাওলানাকে হযরতের প্রতি যে পরম ভক্তিপূর্ণ আচরণ করতে দেখেছি তা আমার সারা জীবনে তাঁর স্নেহধন্য অনেক ছাত্রকেও খুব কমই করতে দেখেছি। আর শেষ জীবনে তো ...।
অনেক কষ্টের তাড়নায় লিখে ফেলা কথাগুলো আর মুছলাম না। হয়ত ভালোই হলো, কিংবা হয়ত মুছে ফেলাই ভালো ছিলো। কিন্তু হযরতের বেদনাদগ্ধ বুক থেকে বারবার যে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হতো সেগুলো মোছবো কিভাবে!
আচ্ছা, চেষ্টা করেও কি আমরা আমাদের মাটি থেকে কিছু উপরে এবং আমাদের রক্ত থেকে কিছু উর্ধ্বে উঠতে পারি না!
যাক, ফিরে আসি মজলিস-
প্রসঙ্গে। শায়খ বিন বায সমবেত মেহমানদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। তাতে তিনি উম্মাহকে সঠিক পথপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে আলিমদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্মরণ করালেন। অবশেষে সকলের জন্য হজ্বে মাবরূর কামনা করে বক্তব্য সমাপ্ত করলেন।
‘উদ’-এর সুগন্ধি আরবদের খুব প্রিয়, শুনেছি; এই প্রথম তার ব্যবহার দেখলাম। মজলিসের শুরুতে মেহমানদেরকে উদের সুগন্ধি দ্বারা সুবাসিত করা হলো। আমাদের দেশে যেভাবে ধুপ জ্বালানো হয় উদের ব্যবহার মোটামুটি সেরকম। একজন সেবক মেহমানের সামনে গিয়ে উদজ্বালানো পাত্রটি ধরেন আর মেহমান মাথার রুমালের দুই প্রান্ত নাড়া দিয়ে উদের ধোঁয়া নিজের দিকে গ্রহণ করেন। প্রায় সকলেই দেখলাম বেশ অভ্যস্ত। সেবক যখন শায়খ বিন বাযের সামনে পাত্রটা ধরলো ঠিক তখনই তিনি রুমালের দুই প্রান্ত দ্বারা ধোঁয়া গ্রহণ করলেন। তাঁর নৈপুণ্য ও সময়বোধ আমাকে সত্যি মুগ্ধ করলো। উদের ধোঁয়া গ্রহণের দৃশ্যটা হয়ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না, তবে আমার কাছে তা বেশ চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে।
আরেকটা জিনিস দেখলাম, শায়খ বিন বাযের আহার গ্রহণ ছিলো অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। একটি খাদ্যকণাও এদিক সেদিক পড়েনি।
আরবদের গাহওয়া আরো দু’এক মজলিসে খেয়েছি, কিন্তু শায়খ বিন বাযের দাওয়াতে পরিবেশিত গাহওয়া ছিলো সত্যি অতুলনীয়।
এবং সেই অতুলনীয় গাহওয়াই ছিলো মজলিসের সমাপ্তিপর্ব। তার পর মেহমানগণ বিদায় গ্রহণ করলেন। আমাদের বলা হলো, শায়খ হযরতের সঙ্গে কিছুক্ষণ একান্তে বসতে চান।
শায়খ নিজেই হযরতের কাছে জানতে চাইলেন, হজ্ব সম্পর্কে সউদী কর্তৃপক্ষের প্রতি তাঁর কোন পরামর্শ বা উপদেশ আছে কি না।
হযরত বললেন, আমি তো অন্য কাউকে চিনি না, আপনার সাথেও এ সফরেই প্রথম পরিচয়। আপনি আমার পরামর্শ জানতে চেয়েছেন, এজন্য আমি খুশী হয়েছি। আপনার কাছেই আমি কিছু পরামর্শ রেখে যাচ্ছি। যদি গ্রহণযোগ্য মনে হয় তাহলে এগুলো কার্যকর করার চেষ্টা করবেন, আশা করি।
হযরতের পরামর্শগুলো ছিলো এরকম-
(ক) বিভিন্ন দেশ থেকে যারা হজ্ব করতে আসে তারা অধিকাংশই হজ্বের হাকীকত ও রূহানিয়াত এবং আহকাম ও মাসায়েল সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে হজ্ব ঠিক মত আদায় করতে পারে না। অনেকের তো হজ্ব ফাসিদ হয়ে যায়; খবরও থাকে না, আর অনেকে হজ্ব আদায় করলেও হজ্বের মাকছাদ থেকে মাহরূম থেকে যায়।
হাজীদের মাঝে সালাফিয়াতের যে সমস্ত কিতাব তাকসীম করা হয় তাতে বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের মাঝে আরো ইনতিশার (ও বিশৃঙ্খলা) পয়দা হয়। ফলে আলিমদের দ্বীনী কাজ করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। চার মাযহাবই যেহেতু হক মাযহাব সেহেতু প্রত্যেক দেশের হাজীদের মাঝে তাদের মাযহাব অনুযায়ী কিতাব তাকসীম করা উচিত, যাতে ইনতিশার না হয়।
আর প্রতি বছর প্রত্যেক দেশ থেকে আহলে হক আলিমদের একটি জামাতকে আপনাদের খরচে হজ্বে আনার ব্যবস্থা করা দরকার, যারা নিজ নিজ দেশের হাজীদের উপর মেহনত করবে, যাতে সকলের হজ্ব ছহীহ হয় এবং হজ্বের আসল মাকছূদ হাছিল হয়।
(খ) হারাম শরীফের এলাকায় গানবাজনার আওয়ায কানে আসে। এমনকি মসজিদে নববীর খুব কাছে গানের দোকান দেখা যায়। এ সমস্ত ‘মুনকারাত’ থেকে হারামাইন শরীফাইনকে পাক ছাফ রাখা লাযিম। পাঁচসাত বছর আগেও এরূপ অবস্থা আমার নযরে পড়েনি। খুবই আফসোসের কথা যে, এখানকার দ্বীনী হালাত দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।
একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান হারামাইনের বাসিন্দাদেরকে অন্য নযরে দেখে থাকে। এখানকার সবকিছুকে তারা জায়েয এবং অনুসরণযোগ্য মনে করে। হারামাইন শরীফাইনে ক্যামেরা দ্বারা ছবি তোলার বিদ‘আতও চালু হয়ে গেছে। খুব কঠিনভাবে এর ‘রোকথাম’ হওয়া দরকার।
(গ) হজ্বের যাবতীয় বিষয় সুষ্ঠুভাবে এবং শরী‘আতের ছহীহ নাহ্জ (ও তারীকার) উপর আঞ্জাম দেয়ার জন্য মুসলিম জাহানের নির্বাচিত আলিম এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দ্বীনদার লোকদের একটি মজলিস গঠন করা খুব দরকার।
এ পর্যায়ে হযরত মৃদু হেসে বললেন, আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এটা আমার বিলকুল মুখলিছানা মশওয়ারা। সিয়াসাতের সাথে এর কোন তা‘আল্লুক নাই। বরং ‘আদ্দীনু আন-নাছীহাহ্’-এই হাদীছে নববীর উপর আমলের জাযবা থেকেই আমি আমার পরামর্শ দিয়েছি। শায়খ বিন বায পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে বললেন, ‘আপনার ইখলাছ ও হিতাকাঙ্ক্ষার উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে এবং আপনার পরামর্শগুলো গঠনমূলক ও যুক্তিসঙ্গত। তবে আপনি তো নিশ্চয় বর্তমান মুসলিম জাহানের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন, আর শেষ পর্যন্ত সউদী আরবও মুসলিম জাহানেরই অংশ। এখানেও আলিমদেরকে বহু প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মাঝেই কাজ করতে হয়। তারপরো আপনার পরামর্শগুলো আমি গভীরভাবে চিন্তা করবো এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবো।
গান-বাজনা ও ছবি তোলার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এ বিষয়ে ইনশাআল্লাহ আমি ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
মিনা-আরাফায় হাজীদের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কেও হযরত কিছু পরামর্শ দিলেন।
অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে প্রায় ত্রিশ মিনিটের এই একান্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো।
আমি খুব আশ্চর্য হলাম যে, এত ব্যস্ততা ও দায়-দায়িত্বের মাঝেও শায়খ বিন বায প্রথম মজলিসের কথা মনে রেখেছেন। মাদরাসার পক্ষ হতে যে দরখাস্ত পেশ করার কথা ছিলো তা তিনি নিজেই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন।
শায়খ তাঁর নামের একটি বিশেষ কার্ড দিয়ে বললেন, রাবেতার দফতরে এই কার্ড দেখিয়ে যোগাযোগ করা আপনাদের জন্য সহজ হবে।
হযরতের নায়েব হিসাবে মাওলানা আতাউল্লাহ হলেন মাদরাসার যিম্মাদার । এর পূর্বে যিম্মাদার ছিলেন মাওলানা হামীদুল্লাহ। তো মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব আমাকে খুব জোর দিলেন যেন রাতের মধ্যেই দরখাস্ত তৈরী করে ফেলি। আমি বললাম, হযরতের ইজাযত ছাড়া কিভাবে কাজ শুরু করা যায়! আগে আপনি ইজাযত হাছিল করুন, তারপরই না আমার কাজ।
এবং সেখানেই দেখা দিলো জটিলতা। সউদী আরব সরকারের কাছে হযরতের পক্ষ হতে, হোক তা মাদরাসার নামে, কোন দরখাস্ত পেশ করা ঠিক হবে কি না, এ প্রশ্ন তুললেন সফরসঙ্গীদের কেউ কেউ। প্রশ্নটা তুললেন বটে, কিন্তু অসুবিধাটা কী তা আর খোলাসা করে বললেন না। মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব একাই মাদরাসার পক্ষে কথা বলে গেলেন এবং আমার নীরবতায় কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব বাধা অতিক্রম করে তিনি অনুমতি আদায় করে নিলেন এবং ঐ রাত্রেই দরখাস্ত তৈরী করে ফারূক ভাইয়ের হাতে দেয়া হলো।
রামাযান থেকে হজ্ব পর্যন্ত ফারূক ভাই একা একা যদ্দুর পেরেছেন মাদরাসার জন্য কাজ করেছেন, আর দীর্ঘ দিন হারামাইনের প্রতিবেশী হয়ে যত পেরেছেন সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এজন্য তার প্রতি আমার ঈর্ষা হয়। এ সৌভাগ্য অর্জনের পথ আমারও জন্য তো খোলা ছিলো! কিন্তু কী করা যাবে- ঈঁ সা‘আদাত বাযোরে বাযূ নিস্ত... এ সৌভাগ্য তো বাহুবলে অর্জন করা যায় না, যদি না দান করেন স্বয়ং ভান্ডারের মালিক। হারামাইন শরীফাইনের দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশীরূপে আল্লাহ যে তাকেই কবুল করেছিলেন।
এর মধ্যে দেখা দিলো আরেকটি বিষয়। রাবেতার বাঙ্গালী কর্মকর্তা, যিনি হযরতের দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত ছিলেন এবং মিনা-আরাফায় রাবেতার গাড়ীতে হযরতের সঙ্গে ছিলেন, তিনি জানালেন, শায়খ বিন বায আমার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চান।
আমি তো অবাক এবং সত্যি অবাক! বললাম, হযরতের অনুমতি ছাড়া তো আমি যেতে পারি না। সুতরাং আগে বিষয়টি তাঁকে জানাই।
জানালাম, হযরত এই বলে অনুমতি দিলেন-
মাদরাসার বিষয় হলে, পথম মজলিসে যে আলোচনা হয়েছে, তুমি সেই আন্দাযে কথা বলবা। আর সিয়াসী মুআমালা হলে বলবা, আমি তো এই ময়দানের মানুষ না। সুতরাং এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।
আর যদি রাবেতায় চাকুরির কথা বলেন (মৃদু হেসে) তাহলে সেটা তোমার এখতিয়ার।
আমি কিছুটা অভিমান করে বললাম, হযরত তো জানেন আমার জবাব কী হবে, তারপর এভাবে বলছেন কেন!
হযরত তাঁর মধুর হাসিটুকু অটুট রেখে বললেন, তোমার উপর হুকুমত চালানের তো দরকার নাই।
হযরত আরেকটা কথা বললেন, কোন মেহমানদারি বা হাদিয়ার মুআমালা আসলে মুনাসিব ওযর পেশ করে দিবা’।
এই হলেন আমাদের হযরত হাফেজ্জী হুযূর! এমনই ছিলো তাঁর বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টি! তিনি যখন নিজের থেকে বলতেন, তখন জটিল থেকে জটিল প্রশ্নের জবাব শুনে সবাই হয়রান হতো! বোঝা যেতো, তিনি বলছেন না, তাঁর ভিতর থেকে অন্য কেউ বলছে। আর যখন ‘মশওয়ারা’ শামিল হতো তখনো বোঝা যেতো, তিনি বলছেন না, বাহির থেকে অন্য কেউ বলছে। হযরতের দুর্বলতা ছিলো শুধু এই যে, একান্ত আপন যারা তাদের কথা তিনি খুব কমই এড়াতে পারতেন। শরী‘আতের সীমার ভিতরে হলে তিনি তা রক্ষা করতে চাইতেন, এমনকি নিজের ইচ্ছা ও মতের বিপরীত হলেও। এটা তাঁকে অনেক ভুগিয়েছে। বিশেষ করে জীবনসায়াহ্নে, ? যখন তিনি জাতীয় দায় ও দায়িত্বের এক জটিল অধ্যায় অতিক্রম করছিলেন। আপন জনেরা যদি হস্তক্ষেপহীন থাকতেন এবং শুধু আনুগত্য করে যেতেন তাহলে এদেশে ইসলামী রাজনীতির ইতিহাস আজ অন্য রকম হতো। কিন্তু সারা জীবন হযরত আর যাই পেয়েছেন, আপনজনদের পূর্ণ আনুগত্য ও আত্মনিবেদন পাননি। সবাই হযরতকে ভালোবেসেছেন, সত্য এবং তার অনুগত থেকেছেন, এটাও সত্য, তবে তা ছিলো নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির উপর। সম্মানজনক ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলো, কিন্তু পরিস্থিতির সামনে তারাও ছিলেন অসহায়।
কোত্থেকে কোথায় চলে এলাম!
যাক, ঐ ভদ্রলোক আমাকে শায়খ বিন বাযের দফতরে নিয়ে গেলেন। দাওয়া ওয়াল ইরশাদ-এর দফতর আলিশান এক ইমারতে। এটা আঞ্চলিক দফতর। সদর দফতর হলো রিয়াদে। আঞ্চলিক দফতরের শানশওকত দেখেই আমি অবাক। করিডোরেও মূল্যবান গালিচা বিছানো। আমার খুব ভালো লাগলো এটা দেখে যে, শায়খের নিজস্ব কক্ষটির সাজসজ্জা ছিলো যথেষ্ট স্বাভাবিক। নাস্তা ও গাহওয়া পেশ করা হলো। আমি বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করলাম।
আমাকে চমকে দিয়ে শায়খ বিন বায প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তা হলো, শায়খের সঙ্গে তুমি শুধু ইরাকে যাচ্ছো যে? ইরান সফরে যাওনি কেন?
বললাম, আমি আসলে মাদরাসার তালিবে ইলম; আরবী ভাষার খেদমতই হচ্ছে আমার মূল মাশগালা। ইরান বা ইরাক কোন সফরেই আমার থাকার কথা নয়। আমাদের মাদরাসা থেকে আমার সম্পাদনায় ছোটদের আরবী শিক্ষার জন্য ‘ইকরা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই সুবাদে বাংলাদেশস্থ ইরাকী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি আমার বাগদাদ সফরের ব্যবস্থা করেছেন।
শায়খ বললেন, আমি যদ্দুর জেনেছি এবং বুঝেছি তা এই যে, তোমাদের শায়খ তাকওয়া ও ইখলাছের অতি উচ্চ স্তরের মানুষ। বাংলাদেশের মুসলমানদের দিলে তাঁর বিরাট মাকাম রয়েছে। আমি চাই শায়খকে তাঁর দ্বীনী কাজে সহয়োগিতা করতে। কিন্তু আমার আশংকা, শায়খ দেশে ফিরে যাওয়ার পর এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যাতে তাঁর উপর শিয়াদের প্রতি সমর্থনের ‘ধাববা’ এসে যাবে। তখন অনেক সদিচ্ছা সত্ত্বেও কোন সহযোগিতা করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
তোমাকে আমার বিচক্ষণ যুবক মনে হয়েছে; আমি চাই, এ বিষয়ে শায়খকে তুমি ‘আদ্দীনু আন-নাছীহাহ’ হিসাবে সঠিক পরামর্শ দেবে।
আমি বললাম, আমাদের শায়খ তাঁর দ্বীনী দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। আমি আপনার কথা মনে রাখার চেষ্টা করবো।
বিদায় মুছাফাহার সময় আমি বললাম, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি নিজের ব্যবস্থায় হারামে ফিরে যেতে পারবো, গাড়ীর বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হবে না।
তিনি যথেষ্ট অনুরোধ করা সত্ত্বেও আমি নিজের ব্যবস্থায় অর্থাৎ পায়ে হেঁটে হারাম শরীফে ফিরে এসেছিলাম। অনেক সময় লেগেছিলো, তবে অনেক ভালো লেগেছিলো।
হযরত তাঁর অন্তর্দৃষ্টি থেকে হাদিয়ার যে কথাটা বলেছিলেন সেটারও সম্মুখীন আমাকে হতে হয়েছিলো। অর্থাৎ দাওয়া বিভাগ থেকে বিভিন্ন দেশে অযিফাভুক্ত দাঈ নিযুক্ত করার একটি নিয়ম আছে। তো আমার সামনে কাগজপত্র পেশ করা হয়েছিলো দাঈর দায়িত্ব গ্রহণ করে স্বাক্ষর করার জন্য। আমি হযরতের আদেশ অনুযায়ী বিনয়ের সাথে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছিলাম। এতে ওখানকার কর্মকর্তারা বেশ অবাক হয়েছিলেন। সম্ভবত এটাই ছিলো তাদের এধরনের প্রথম অভিজ্ঞতা।
ফিরে আসার পর হযরত আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। আমি নিজে থেকে যখন বলতে চাইলাম তখন তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, থাক এ বিষয়ে জানার প্রয়োজন নেই।
আমি কিছু বুঝতে না পেরে কিছুটা পেরেশান হলাম। হযরতকে আর কিছু বলা হলো না। #