যিলহজ্ব ১৪২৯   ||   ডিসেম্বর ২০০৮

নির্বাচন ও ভোট : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

 

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। দুবছর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হওয়ার পর জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আবার তা পরিচালনা করবে নির্বাচিত সরকার। ১৯৯১ সনে আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি অপরিহার্য  বিষয়। রাষ্ট্রে্র নাগরিকগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বাছাই করার সুযোগ পায়। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল ও প্রার্থীদের জন্য ভোট হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার। ভিআইপি মর্যাদা হাসিল করা, আধিপত্য অর্জন করা, জনগণকে শোষণ করার একটি মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা  করা হয় নির্বাচনকে। আর অনেক ভোটারের দৃষ্টিতেই ভোটের গুরুত্ব থাকে খুবই সামান্য। এলাকার উন্নয়ন কাজ-কর্ম যার দ্বারা বেশি হবে বলে মনে করে সাধারণত তাকেই মানুষ ভোট দিয়ে থাকে। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও রাস্তা-ঘাট ও ব্রীজ ইত্যাদি বিষয়ও মুখ্য হয়ে উঠে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এ ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামে কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ খুবই ব্যাপক এবং সুদূর প্রসারী।

সে আলোচনার আগে প্রচলিত গণতান্ত্রিক সমাজের নির্বাচন পরিস্থিতির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। বর্তমানে প্রায় সকল দেশেই ভোট হচ্ছে আধিপত্যকামী, পুঁজিপতি, বংশগত রাজনীতিক, গডফাদার ও ক্ষমতালোভীদের  একটি খেলা। এটি এমন একটি খেলা, যেখানে প্রতারণা ও মিথ্যা  হচ্ছে বড় উপাদান। যেমন :   

পারিবারিক রাজনীতি, অন্যকে গালমন্দ করা, গীবত-শেকায়েত করা, নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া, নেতা-নেত্রীর অন্ধ আনুগত্য, একে-অন্যের কোনো ভালই স্বীকার করতে না চাওয়া, নিজের অবাস্তব ও মিথ্যা অবদানের প্রচারণা, মিথ্যা অপবাদ-মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে আদর্শিক কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও জোটবদ্ধ হওয়া ও আদর্শিক শত্রুকেও জোটে নেওয়া, মনোনয়ন না পেলে রাতারাতি এত দিনের শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে দলবদল করা, মনোনয়ন বাণিজ্য, অর্থ, পদবী ও রাষ্ট্রীয় সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে ভোট কেনা-বেচা এবং ভোটের পর হর্সট্রেডিং ইত্যাদি বিষয় যে প্রচলিত গণতন্ত্রের সমার্থক তা সম্ভবত ব্যাখ্যা করে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। অবশ্য  এত কিছুর পরে ভোট পেলেও আমাদের মতো দেশে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণই নির্ভর করে বিদেশী প্রভূদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর। বেশি ভোট পাওয়া দল যদি তাদের অপছন্দের হয় তবে যে কোনো সামান্য অজুহাতেই সে দলকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা বা নামিয়ে দেওয়া অনেকটা সুনিশ্চিত।  

প্রিয় পাঠক! এটাই গণতন্ত্রের একটি সামান্য খোলামেলা পরিচয়। এই গণতন্ত্রই হয়ে গেছে এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তা যেন ঈমান-আকীদার মতো অপরিহার্য এবং এর যেন কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র নিয়ে অনেক কিছুই বলার মতো আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্রের বিশ্লেষণ এবং ইসলামের খেলাফত ও শুরাপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এবং এ দুটির তুলনামূলক উপস্থাপনের বিষয়টি অন্যদিনের জন্য থাক। আজ সংক্ষেপে শুধু এতটুকু বলা জরুরি মনে হচ্ছে যে, প্রচলিত গণতন্ত্র ও ইসলামের খেলাফত পদ্ধতি মৌলিক নীতিমালা ও আদর্শ-উদ্দেশ্যের দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি ব্যবস্থা। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা কখনও মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, আর ক্ষমতাশীলদের যাচ্ছেতাই করার কোনোই সুযোগ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মনগড়া যে কোনো আইন তৈরি করা, বিরোধীদের দমন-পীড়ন, জনগণকে নিজেদের গোলামের মতো ভেবে যে কোনো আইন অথবা করের বোঝা তাদের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ ইসলামে নেই।

অন্যদিকে বর্তমান পদ্ধতির মতো চিহ্নিত সন্ত্রাসী, গডফাদার, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী, মিথ্যাবাদী, ধর্মের প্রতি উদাসীন, খোদাদ্রোহী ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়া বা ক্ষমতায় বসার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভালো লোকদের প্রার্থী হওয়া বা নির্বাচিত হওয়ার আইনগত বাধা নেই, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হাতে গোনা সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বর্তমানে নির্বাচন হচ্ছে টাকার বিনিময়ে আধিপত্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির খেলা। সুতরাং এ ব্যবস্থায় যে শান্তি বা কল্যাণের আশা করা যায় না এবং এ পদ্ধতিতে সৎ, যোগ্য, নিষ্ঠাবান লোকজনের সরকার গঠিত হওয়া যে অনেকটা অসম্ভব তা বুঝিয়ে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তবুও পশ্চিমা গণতন্ত্র ও নির্বাচনই বর্তমানে আমাদের কাছে তিক্ত বাস্তবতা। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আমরা এখন সে পদ্ধতির অনুসারী। আমাদের গুনাহ-অপকর্ম, দ্বীন-শরীয়তের প্রতি উদাসীনতা, সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের অনুপস্থিতি এবং তাদের কাছে দ্বীন পৌঁছে দেওয়া ও সহীহ মানসিকতা তৈরি করার ব্যাপারে আমাদের আলেমসমাজ ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের ব্যর্থতা আমাদেরকে এ অধঃপতনে নামিয়েছে। যে পর্যন্ত সাধারণ লোকজনের একটি বিশাল অংশকে দ্বীনি শিক্ষা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতার সৃষ্টি না করা যাবে এবং চিন্তা ও বুদ্ধি বিকাশের মাধ্যমে গণজারণ ও বিপ্লবের সূচনা না করা যাবে সে পর্যন্ত আমাদেরকে গণতন্ত্রের এই তেতো শরবত পান করেই যেতে হবে। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনের দিন ভোট দেওয়ার আগে ইসলামের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব ও হাকীকত জেনে নেওয়া দরকার।

ভোট কী?

হযরত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. এ সংক্রান্ত একটি পুস্তিকায় লিখেছেন যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি। ১. সাক্ষ্য প্রদান ২. সুপারিশ ও ৩. প্রতিনিধিত্বের অথরিটি প্রদান।

কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল সকলেরই জানা রয়েছে যে, শরীয়তে উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তৈরির এবং রাষ্ট্র্পরিচালনার জন্য প্রতিনিধিত্বের সনদ দেওয়ার মানে হচ্ছে প্রতিনিধিত্ব দানকারী (ভোটার) তার ভবিষ্যত সকল কার্যকলাপের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিচ্ছে। এমনিভাবে সুপারিশের বিষয়টিও       প্রনিধানযোগ্য। কুরআনুল কারীমের ভাষায় যে ভালো সুপারিশ করবে সে তার নেকীর ভাগী হবে। আর যে মন্দ সুপারিশ করবে সেও মন্দের হিস্যা পাবে। -সূরা নিসা, আয়াত ৮৫

ভোট ও সাক্ষ্য

ভোটের মধ্যে যে তিনটি (সাক্ষ্য প্রদান, সুপারিশ, প্রতিনিধিত্বের সনদপ্রদান) বিষয় রয়েছে এর মধ্যে শাহাদত বা সাক্ষ্যের বিষয়টি মৌলিক। অর্থাৎ কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ হল, তার ব্যাপারে এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, লোকটি ভালো এবং যোগ্য। এখন যদি যথাযথ জায়গায় সীল দিয়ে এ সাক্ষ্য প্রদান করা হয় তবে সে হবে সত্য সাক্ষী অন্যথায় হবে মিথ্যা সাক্ষী। আর মিথ্যা সাক্ষ্য যে কত বড় কবীরা গুনাহ ও হারাম কাজ তা কি কারো অজানা রয়েছে? অবশ্য বর্তমান বে-দ্বীনি ও বস্ত্তবাদিতার যুগে অনেকের কাছেই মিথ্যা কোনো বিষয়ই নয়। কথায়, লিখায়, ক্ষমতায়, আদালতে, বই-মিডিয়ায়, বক্তৃতা-ভাষণে সব জায়গাতেই মিথ্যার সয়লাব। অথচ মানবতার মুক্তির দূত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠিন ভাষায় মিথ্যা ও মিথ্যা সাক্ষ্যের নিন্দা করেছেন। সহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় হযরত আবু বকর রা. বলেন যে, রাসূলুল্লাহ একদা এক জায়গায় হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় তিন তিনবার সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি তোমাদেরকে কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে বড় কবীরা গুনাহের কথা বলব? সাহাবীগণ হ্যাঁ সূচক উত্তর দেওয়ার পর তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা (এ দুটি কথা বলার পর তিনি সোজা হয়ে বসলেন) এবং বললেন, শুনে নাও! মিথ্যা সাক্ষ্য অনেক বড় কবীরা গুনাহ।

সুনানে তিরমিযীর একটি হাদীসে মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরকের সমান অপরাধ বলা হয়েছে।  সু-বিখ্যাত হাদীস বিশারদ শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. মিথ্যা সাক্ষ্যকে চারটি বড় গুনাহের সমষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে : নিজে মিথ্যা ও অপবাদ আরোপ করছে ২) যার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিচ্ছে তার উপর যুলুম করছে ৩) যার পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে তার উপরও প্রকৃতপক্ষে যুলুম করছে কারণ, সে যা কিছু পাওয়ার যোগ্য ছিল না এ ব্যক্তি মিথ্যা সাÿÿ্যর মাধ্যমে তাকে এর অধিকারী করে তুলছে এবং এভাবে তাকে করছে জাহান্নামী ৪) মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার একটি হালাল কাজকে হারাম বানিয়ে নেওয়া।

মিথ্যা ও অবাস্তব সাক্ষ্যের ক্ষতি ও খেসারত বলে শেষ করার মতো নয়। হকদার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, অযোগ্য ও অপদার্থের উত্থান, দুর্নীতিবাজ ও শোষকশ্রেণীর লোকদের ক্ষমতায়ন- এসবই মিথ্যা সাক্ষ্যের ক্ষতি। এর কারণে ইনসাফপছন্দ এবং যোগ্য ও সৎ-আমানতদার ব্যক্তিগণ নিরবতা পালন করে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে বাধ্য হন।

ভোট অবশ্যই দিতে হবে

উপরোক্ত আলোচনা পড়ে প্রশ্ন আসতে পারে যে, তা হলে তো বর্তমান সমাজে অধিকাংশ আসনের লোকদের ভোট দেওয়াই সম্ভব হবে না। কারণ, এমন লোক তো পাওয়া যাবে না, যার সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করা যায় এবং এ কারণে অনেকে ভোট দেওয়া থেকে বিরতও থাকেন, এমনকি বহু লোক ভোটার হতেও আগ্রহী হন না। সাধারণ বিবেচনায় এ চিন্তা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এক্ষেত্রে কিন্তু মুদ্রার ভিন্ন পিঠও রয়েছে। তা হচ্ছে, মন্দের ভালো বা তুলনামূলক কম ক্ষতিকে বেছে নেওয়া এবং অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করা। বর্তমানে ভোটকে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনায় আনতে হবে এবং ভোটের মাধ্যমে অধিক ÿতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। কোনো আসনে একজন লোককেও যদি সাক্ষ্য ও ভোট দেওয়ার উপযুক্ত মনে না হয় তবে তাদের মধ্যে যে জন নীতি-নৈতিকতা, চিন্তা-চেতনা ও কাজে-কর্মে অন্য প্রার্থীর তুলনায় কম খারাপ তাকেই ভোট দিতে হবে। কারো ব্যাপারে যদি খোদাদ্রোহিতা, ইসলাম-দুশমনী, রাষ্ট্র্ ও জনগণের স্বার্থ-বিরোধী হওয়ার সুস্পষ্ট আলামত থাকে তবে ঐ অসৎ ব্যক্তির বিজয় ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে ভোটারাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে।

মোটকথা, গণতন্ত্র ও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির যতই ত্রুটি থাকুক এর কারণে ভোট দানে বিরত থাকা সমীচীন হবে না; বরং বুদ্ধি-বিবেচনা খরচ করে, ভেবে-চিন্তে ভোটারাধিকার প্রয়োগ করতে হবে ভাল-মন্দের ভালো অথবা অন্তত কম মন্দের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে শরীয়তের দৃষ্টিতে কাউকে ভোটদানের অর্থ হবে, এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, লোকটি তার প্রতিদ্বন্দ্বিদের তুলনায় কিছুটা হলেও ভালো। #

 

 

 

advertisement