স ন্ত্রা স : গৈরিক সন্ত্রাসবাদ! সন্ত্রাসবাদীদের কোনও ধর্ম হয় না, ভোটের দিকে তাকিয়ে এই কান্ডজ্ঞানটুকু হারিয়ে ফেলেছেন নেতারা
সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত সন্ত্রাস, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো আলোচনা হলে কেবল ইসলাম ও মুসলমানের কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোলা হয়। দক্ষিণ এশিয় সন্ত্রাস দমন টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগের কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে কোনো উদ্যোগ ও পদক্ষেপে যে সর্বদলীয় ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা লালন করা প্রয়োজন তা কি হচ্ছে? সবদিক ও ঘটনাকে কি সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে? সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত সব মহল, গোষ্ঠী সম্পর্কে নির্লিপ্ত একটি দৃষ্টিকোণের প্রয়োজন আসলে প্রশ্নাতীত। সেজন্যই গত ২ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক দেশ-এর একটি লেখা ওই পত্রিকার সৌজন্যে এখানে পুনমুদ্রণ করা হল।–বি.স.
হিন্দু সন্ত্রাসবাদ’ বা সন্ত্রাসবাদী হিন্দু’। শব্দগুলি অচেনা মনে হচ্ছে কি? সেটাই স্বাভাবিক। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে হিন্দুরা যে জড়িত থাকতে পারে, একথা আমরা কস্মিনকালেও ভাবতে পারি না। কারণ, সন্ত্রাস শব্দটা শুনলেই আমাদের অভিযোগের আঙুল সর্বদা সংখ্যালঘুদের (পড়ুন মুসলিমদের) দিকেই ওঠে। বিশ্বের যেখানেই সন্ত্রাসবাদের আক্রমণ ঘটে, কাঠগড়ায় তোলা হয় নন্দঘোষ’ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদেরই! অথচ আমাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সবার অলক্ষে সযত্নে লালিত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের আর এক বিভীষিকাময় রূপ: হিন্দু সন্ত্রাসবাদ। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি সংগঠন এবং তাদের সদস্য-সমর্থকরা লিপ্ত হচ্ছেন ধ্বংসলীলায়। জঙ্গি হিন্দুত্বের তান্ডবের এই তালিকার নবতম সংযোজন মালেগাঁও বিস্ফোরণ। ২৯ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ের মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলে যে-বিস্ফোরণ ঘটে, তার পেছনে হাত ছিল হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি তথা সাধ্বী-সন্ত-মহারাজদের। অভিযুক্তরা সকলেই ‘অভিনব ভারত’ নামক পুনের একটি উগ্রপন্থী হিন্দু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তদন্তে উঠে এসেছে এমনই বিস্ফোরক (অস্বস্তিকরও বটে) তথ্য। আর তার ফলেই নড়েচড়ে বসেছে দেশের রাজনৈতিক মহল। মালেগাঁও বিস্ফোরণকে ঘিরে ধর্মনিরপেক্ষ ও হিন্দুত্ববাদী, দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে চাপানউতোর।
সামনেই লোকসভা নির্বাচন। দুই শিবিরের নির্বাচনী প্রচারে তাই প্রাধান্য পাচ্ছে একটিই বিষয়-সন্ত্রাসের সাম্প্রদায়িকীকরণ। আসলে ইতিহাস বলছে, সন্ত্রাসের গল্প ভোটের বাজারে ভাল চলে। আর এমন একটি ‘জাতীয়’ বিষয়কে হারাতে কে-ই বা চায়!
সাধ্বী প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর, স্বামী অমৃতানন্দ, স্বামী অসীমানন্দ-অভিযুক্তদের তালিকায় উঠে আসা এই নামগুলি বিড়ম্বনায় ফেলেছে বিজেপি ও তার দোসর সঙ্ঘ পরিবারকে। কংগ্রেস তথা ইউপিএ সরকার সন্ত্রাসদমনে যথেষ্ট কঠোর নয়, কারণ তারা সংখ্যালঘুদের তোষণেই ব্যস্ত, একের পর এক সাধু-সন্তদের গ্রেফতারে বিজেপির এই অস্ত্র অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। সুযোগ বুঝে কংগ্রেসও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার সামরিকীকরণ এবং জঙ্গি হিন্দুদের বাড়বাড়ন্তের অভিযোগ নিয়ে আসরে অবতীর্ণ। হিন্দু সন্ত্রাসবাদের আবির্ভাব ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে একটি অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা। তবে মালেগাঁওয়ের ঘটনার মাধ্যমেই এর সূত্রপাত, এমনটা ভাবলে আংশিক চিত্রটা প্রকাশ হয় মাত্র। বস্ত্তত, সন্ত্রাসবাদী হিন্দুদের বীজ বপন হয়েছিল অনেক আগেই, যা ক্রমশ একটি মহীরুহে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি শিব সংগ্রাম সমিতি নামক একটি হিন্দু সংগঠন মহারাষ্ট্রের একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের বাড়িতে হামলা চালায়। সম্পাদক মশাইয়ের দোষ, তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের দ্বারা শিবাজীর একটি মূর্তি তৈরির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন! দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি)
সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আপত্তি তোলে, কারণ সেখানে রামায়ণ-বিষয়ক কিছু মন্তব্য ছিল, যা ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ কে আঘাত করে। বারোদার এম এস বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা একটি ছবির প্রদর্শনীতে ভাঙচুর চালায়। কারণ সেই একই। ছবিগুলির বিষয়বস্ত্ত ‘হিন্দু’-বিরোধী! বৃহত্তর প্রেক্ষিতে উক্ত ঘটনাগুলি হয়তো সামান্য, কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ব কীভাবে হিংসায় পর্যবসিত হয়, তার নৃশংস উদাহরণ আমরা ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ২০০২-এ গুজরাত দাঙ্গার সময়ে পেয়েছি।
সুতরাং শুধুমাত্র ভোটের ইস্যু হিসেবে নয়, হিন্দু সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে সচেষ্ট হতে হবে সরকার, বিরোধী, দু’পক্ষকেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘মাথা’রা নিশ্চয়ই হিন্দুত্বের জঙ্গি বীভৎসতাকে ধিক্কারযোগ্য মনে করেন। তাহলে কেন বিস্ফোরণে জড়িত সাধু-সাধ্বীদের হিন্দু-বিরোধী বলে নিন্দা করতে শোনা যায়নি সঙ্ঘ পরিবারের কথায়?
অন্যদিকে বিজেপি শিবিরে তো হইহই রব-‘নিরীহ সাধুদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার এ এক কংগ্রেসি চক্রান্ত’। আসলে সন্ত্রাসবাদীদের কোনও ধর্ম হয় না। সন্ত্রাসবাদই তার ধর্ম। মুসলিম সন্ত্রাসবাদীর মতোই হিন্দু সন্ত্রাসবাদীও সমান ঘৃণ্য। জন্মসূত্রে একজন হিন্দু, মুসলিম, শিখ বা খ্রিস্টান হতে পারে, কিন্তু কোনও ধর্মই সন্ত্রাসবাদকে বৈধতা বা আশ্রয় দেয় না, নিরীহ মানুষের প্রাণনাশ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাশকতা অনুমোদনও করে না। আমাদের দুর্ভাগ্য এটাই যে, এ দেশের ‘প্রাজ্ঞ’ রাজনীতিকরা ভোটার ধরতে গিয়ে এই কান্ডজ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে কোনও কিছু ভাবতে তারা নারাজ।
সম্প্রতি ছ’হাজার মৌলবী-উলেমা-ইমাম জানিয়েছেন, ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে গ্রহণযোগ্যতা দেয় না এবং জেহাদের সঙ্গে সন্ত্রাসের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই সন্ত্রাসবাদীরা বস্ত্তত ইসলাম-বিরোধী।
মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের বোধোদয় হয়েছে, হিন্দুত্বের পথিকৃতদের এবার আত্মসমীক্ষার সময় এসেছে। নাহলে হয়তো একদিন সত্যি হয়ে যাবে বাইবেলের সেই বাণীটি, ‘অল দে দ্যাট টেক দ্য সোর্ড শ্যাল পেরিশ উইদ দ্য সোর্ড।