দি ন যা প ন : নো টেনশন
নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘটনা পরম্পরায় সাম্প্রতিক কালের জীবন ও তারুণ্যে অস্থিরতার যে তরঙ্গ ভেসে উঠেছে, তার একটি প্রতিচিত্র ফুটে উঠেছে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় মুদ্রিত একটি লেখায়। নতুন সরকার, নতুন বছর চিন্তাভাবনার এ ক্ষণটিতে এদিকে মনোযোগ দানের প্রয়োজন বিবেচনা করে লেখাটি এখানে মুদ্রিত হল।–বি.স.
চারদিকে উত্তেজনা। নাগরিক তারুণ্যে টেনশন প্রবল হচ্ছে। তার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে শহরতলি ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যন্ত। পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বে কেবলই উর্ধ্বমূখী হচ্ছে উত্তেজনার পারদ। সামনে যাওয়ার উত্তেজনা, অন্যকে পেছনে টানার উত্তেজনা, অপচয়ের উত্তেজনা, উদ্দামতায় ফেটে পড়ার উত্তেজনা। উত্তেজনা নেই কোথায়? জনসভা, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্র। জয়-জিন্দাবাদ, সঙ্গীত-সাহিত্য-সিনেমা, পার্টি-ফাংশন এখন যেন উত্তেজনার বারুদে ঠাসা। বেশিরভাগ মানুষের মেজাজে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আঙুল উঁচিয়ে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায় নিজের মতামত। সে এক অশান্ত ধাক্কাধাক্কি। কোথাও কোনো 'কিউ'’ নেই। এ ওকে শাসাচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে সামনা সামনি, টেলিফোনে এমনকি লোক মারফত। একটু অনুসন্ধানী চোখে দেখলেই আঁচ করা যায়, টগবগিয়ে ফুটছে তারুণ্যের রক্ত। শীতল হলে পিছিয়ে পড়ার ভয়, পঁচে মরার ভয়, সাধারণ পাবলিকের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয়। অতএব উত্তেজিত থাকতে হবে, টেনশন বাড়াতে হবে। এটি এখন আধুনিক তারুণ্যের লক্ষণ। সমাজবিদ ম্যালার্মের মতে, আধুনিক মানুষের লক্ষণ হচ্ছে সংবাদপত্র পাঠ আজ রমণ তারুণ্যের উচ্ছাস প্রকাশ। তিনি বাংলাদেশে এলে এর সঙ্গে যুক্ত করতেন উত্তেজনা এবং উদ্বেগ।
যাই হোক, এই অশান্ত উত্তেজনার জয়-পরাজয়, বঞ্চনা-প্রাপ্তি, আশা-হতাশা, আপসকামিতা-দ্রোহ সবই আছে, শুধু নেই শৃঙ্খলা। ফলাফল মারাত্মক। সবাইকে নিয়ে বাঁচার সামাজিক দায় কমছে। ক্ষেত্রবিশেষে নেই বললেই চলে। সবকিছুতেই প্রবল এবং প্রকট হচ্ছে আমিত্ব। এদিকে নগরে সীমিত আয়তনে ভিড় বাড়ছে। পাশাপাশি শহরতলি গড়ে উঠার পরও এই ভিড় কমানো সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি
বাড়ছে সব ধরনের জট। যানজট, অট্টালিকার জট, বাজার-বস্তির জট। এত সব ভিড়ে ও জটে মানুষে মানুষে সংহতি এবং সহঅবস্থানের চেতনা বাড়ার কথা। অন্তত মনুষ্যত্বের দাবি সেরকমই। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। সবাই উত্তোজিত গলায় বলছে-মানুষের জন্য ফুটপাতে পা ফেলা যায় না, বাজারে ঢোকা যায় না,বাসে চড়া যায় না, জায়গা হয় না লিফটে। অথচ কেউ বলছে না-আমার জন্য লোকজনের কষ্ট হচ্ছে, অসুবিধা হচ্ছে। আসলে জনারণ্যে মানুষ যেন আরো একা হচ্ছে। নিঃসঙ্গতার অনুভবে লিপ্ত হচ্ছে। মুখে গণতন্ত্র, মনে একনায়কত্ব। শুরু হয়েছে অনেক আগেই আড়াল-আবডালে। এখন তা দৃশ্যমান। খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে একান্নবর্তী পরিবার। লক্ষ্য একটাই -পানাহার, নিদ্রা আর উপভোগের অবারিত অবকাশ। এই মানসিক বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে জন্ম নিচ্ছে নিউক্লিয়াস পরিবার’। পৃথিবীরর প্রথম জৈব সংগঠনের হাল দেখে প্রমাদ গুনছেন সমাজবিদরা। অন্যদিকে তীরের বেগে ভায়োলেন্স থ্রিল ঢুকছে তারুণ্যে। উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং টেনশনে বুঁদ হয়ে থাকার জন্য এগুলোর ক্রিয়া ধন্বন্তরীর মতো। খুন-খারাবি, হাইজ্যাকিং, ধর্ষণ এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদাবাজি, হাকিস্টিক নিমমিছিল ঠ্যাঙানো, খৈয়ের মতো বোমা ফাটিয়ে ত্রাস সৃষ্টি এখন আর আকস্মিক ঘটনা নয়। যুব সমাজের যে অংশ এখন পর্যন্ত ভোগবৈচিত্র্যের সরল রাস্তা পায়নি, তারা আবার পাড়া-মহল্লায় গোপনে-প্রকাশ্যে তৈরি করছে নানাধাচের কথিত সংগঠন অর্থাৎ গ্যাং। প্রবীণ তথা অভিজ্ঞ গডফাদারদের দোয়া নিয়ে গ্যাংলিডাররা এলাকা কাঁপাচ্ছে, টাকা কামাচ্ছে। মূল পুঁজি উত্তেজনা। এ থেকে বেরিয়ে আসছে কুড়াল পার্টি, তাফালিং পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ইত্যাদি
ইত্যাদি সব উদ্ভট নামের অপরাধী দল। ঠিক এর উল্টো দিকে অবস্থান করছে যারা তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিচিত্র উপদ্রব। হালে পশ্চিমা পপ কালচার’ নাগুরিক তারুণ্যে ঈর্ষণীয়ভাবে পপুলার হয়েছে। বিনোদন মানে তান্ডব। স্নায়ুছেঁড়া উৎকট শব্দ, লয়হীন চিৎকার, প্রায় দিগম্বর লাফালাফি বিষফোঁড়ার মতো দেখা দিয়েছে সংস্কৃতির সর্বাঙ্গে। যুব সমাজের একাংশ ঝুঁকে পড়ছে মাদকে। কেউ ব্যবসা করছে মাদকের, কেউ খেয়ে উত্তেজনাহীন হয়ে পড়ছে। কেউ পালাতে চাইছে সংকটাকীর্ণ জীবন থেকে, কেউ আবার অভাবনীয় প্রাপ্তি উদযাপন করছে বিকৃতপথে। ফ্রি মিক্সিং’ নগর-তারুণ্যে আরেক উন্মাদনা। কিন্তু সহজ হওয়া আর উত্তেজনানির্ভর সাহস দেখানো তো এক কথা নয়। অবাধ আর অবাধ্যতা সমার্থক নয় কোনো হিসেবেই। স্বর্গীয়’ প্রেম এখন অনেকটাই পানসে বিষয়। ভালোবাসা হৃদয় ও মনের অতীত। পাশাপাশি প্রদর্শনের বাতিক বেড়েছে। জীবন্ত বিজ্ঞাপনের মতো ছুটছে অনেকে। এর সঙ্গে মানবিক অধিকার কিংবা উইমেন লিভের কোনোই সংশ্রব নেই। অকূল সাগরেও বাতিঘর থাকে। কিন্তু তারুণ্যের সামনে তেমন কোনো আলোক নেই, নেই কোনো দিকচিহ্ন। রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সর্বত্র বিশৃঙ্খলা। স্বভাবতই এই অবস্থার ফাঁক দিয়ে ভোগবাদ প্রবল হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে লাগাতার প্রতারণা এর গোড়ায় ঢালছে পানি। অর্থনীতিবিদরা সেমনিারে-নিবন্ধে জাতির অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া পোক্ত করার কথা বলছেন। রাজনীতিকদের অনেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমৃদ্ধির স্বর্ণদুয়ারে পৌঁছে দিতে মিছা স্বপ্নজাল বিস্তার করছেন। অস্বাভাবিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যালট পাওয়ার তদবির করছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্ণধাররা সস্তা জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে পুস্তকে রাবিশ, নাটকে স্থুলতা, সঙ্গীত-সিনেমায় উত্তেজনা মশলাদি ঠেসে দিচ্ছেন। ফলে তারুণ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। বাড়ছে টেনশন। আশার কথা, এর মধ্যেও একটি সংখ্যালঘু দল অবস্থার তীব্র চাপ সয়ে ভিন্ন ছাউনিতে জড়ো হচ্ছে। তাদের অনড় উদ্যম দেখে বলার ভরসা হচ্ছে-নো টেনশন’।#