মুহাররম ১৪৩০   ||   জানুয়ারী ২০০৯

মেহরে নবুওয়ত

কাযী মুহাম্মাদ সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী রাহ.

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হিজরী ১ম বর্ষ

১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় পৌঁছে প্রথমেই আল্লাহর ইবাদতের জন্য মসজিদ নির্মাণ করলেন। দেয়াল ছিল কাঁচা ইটের এবং ছাদ খেজুর শাখার।

২. মদীনার ইয়াহুদী ও বিভিন্ন প্রতিবেশী গোত্রের সঙ্গে মিত্রতার চুক্তি সাক্ষরিত হল।

৩. যে মুসলিমগণ মক্কা থেকে এসেছেন অর্থাৎ মুহাজির তাদের ও মদীনার অধিবাসী মুসলিম অর্থাৎ আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্বন্ধ (মুয়াখাত) প্রতিষ্ঠা করলেন। এই দ্বীনী ভাইয়েরা আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি আপন ছিলেন এবং সহায়সম্পদ ভাগাভাগি করে নিতেন।

হিজরী ২য় বর্ষ

১. নামাযের জন্য আযান দেওয়া আরম্ভ হল

২. আল্লাহ তাআলার আদেশে কাবার দিকে মুখ করে নামায পড়া আরম্ভ হল। এতদিন পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়া হত।

৩. রমযান মাসের রোযা ফরয হল।

হিজরী ৩য় বর্ষ

যাকাত ফরয হল। অর্থাৎ বিত্তবান মুসলিমদের ওপর বছর শেষে নির্দিষ্ট  সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ গরীবদেরকে দান করা অপরিহার্য হল।

হিজরী ৪র্থ বর্ষ

মদ পান হারাম হয়ে গেল।

হিজরী ৫ম বর্ষ

মহিলাদের পর্দা করা ফরয হল।

হিজরী ৬ষ্ঠ বর্ষ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার যিয়ারতের জন্য মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। মক্কা থেকে সাত ক্রোশ দূরে থাকা অবস্থায় কুরাইশের লোকেরা বাধা দিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ যাত্রাবিরতি করতে বাধ্য হলেন। তবে এর সুফল এই হল যে, কুরাইশের সঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়ে সন্ধিচুক্তি সাক্ষরিত হল:

১. দশ বছর পর্যন্ত এই সন্ধি বহাল থাকবে। এ সময় পরস্পর আসা-যাওয়া, লেনদেন অব্যাহত থাকবে। আরবের অন্যান্য গোত্র যারা মুসলমানদের মিত্র হতে চায় তারা মুসলমানদের মিত্র হতে পারবে আর যারা কুরাইশের মিত্র হতে চায় তারাও তা পারবে।

২. মুসলিমগণ আগামী বছর এসে কাবা শরীফে নামায আদায় করতে পারবে।

৩. যদি কুরাইশ গোত্রের কেউ মুসলমান হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পৌঁছে যায় তবে তাকে কুরাইশদের নিকট ফিরিয়ে দিতে হবে। আর কোনো মুসলিম যদি ইসলাম ত্যাগ করে কুরাইশের কাছে চলে যায় তবে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।

এ শর্ত শুনে মুসলিমগণ বিচলিত হলেন, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে তা মঞ্জুর করলেন। কুরাইশের ধারণা ছিল এই শর্তের কারণে ভীত হয়ে কেউ ইসলাম গ্রহণ করবে না কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীত হল।

সন্ধিচুক্তি তখনও সমাপ্ত হয়নি সময় সুহাইলের পুত্র আবু জান্দাল সেখানে উপস্থিত হলেন। সুহাইল মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন করতে এসেছিল। এদিকে তার পুত্র আবু জান্দাল রা. মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। গোত্রের লোকেরা তাকে বন্দী করে রেখেছিল। সুযোগ পেয়ে তিনি পালিয়ে এখানে এসে পৌঁছেন। তার পায়ে ছিল লোহার শিকল।

সুহাইল বলল, সন্ধির শর্ত অনুযায়ী একে ফিরিয়ে দাও। মুসলিমগণ বললেন, এখনও আলোচনা সমাপ্ত হয়নি এবং চুক্তি সাক্ষরিত হয়নি। অতএব এখনই তা বাস্তবায়িত করতে আমরা বাধ্য নই। সুহাইল জেদ ধরে বলল, তাহলে সন্ধিই হবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু জান্দাল রা.কে তাদের সোপর্দ করে দিলেন। তারা পুনরায় তাকে বন্দী করল। আবু জান্দাল রা. কয়েদখানাতেই ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। এক বছরের মধ্যেই মক্কার তিনশ মানুষ মুসলমান হয়ে গেল।

সামান্য চিন্তা করলেই অনুভব করা যাবে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যবাদিতা এবং ইসলামের সৌন্দর্য কীভাবে মানুষকে মুগ্ধ করছিল। তারা মাতৃভূমি ত্যাগ, প্রিয়জনদের বিচ্ছেদ, এবং জেল-জুলুমেরও পরোয়া না করে ইসলাম গ্রহণ করছিলেন।

৭ম হিজরী বর্ষ

শাহী দরবারসমূহে ইসলামের দাওয়াত

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সময়ের বড় বড় বাদশাহর দরবারে প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। যথা :

১. হাবশার বাদশা ছিলেন আছহাম নাজাসী। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পত্র পেয়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। (এটা এক বর্ণনায় পাওয়া যায়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি ইসলাম গ্রহণ না করলেও নবীজীর দূতের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেছেন।)

২) বাহরাইনের বাদশাহ ছিলেন মুনযির। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার অনেক প্রজাও মুসলমান হয়ে গেল।

৩. ওমানের বাদশাহ জীফার। তিনি ও তার ভাই মুসলমান হলেন।

৪. কিসরা ইরানের সম্রাটের উপাধী। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পত্র ছিড়ে ফেলল এবং ইয়ামানের শাসককে পত্র লিখল, সে যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গ্রেফতার করে তার কাছে পাঠায়। ওই প্রশাসকের নাম ছিল বাযান। (তিনি মদীনায় লোক পাঠালেন। ইতিমধ্যে কিসরা নিজ পুত্রের হাতে নিহত হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এই সংবাদ দিয়ে দেশে ফিরে যেতে বললেন। তারা ফিরে গেল। এরপর বাযান) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চরিত্র সুষমা ও তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে  তথ্য সংগ্রহ করলেন এবং মুসলমান হয়ে গেলেন। তার সঙ্গে ইয়ামানের অধিবাসীরাও মুসলমান হয়ে গেল।

৫. ইসকান্দারিয়ার বাদশাহর নাম মুকাওকিছ। মুসলমান হননি, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য মূল্যবান উপহার পাঠালেন।

৬. শামের শাসনকর্তা হারিছ। মুসলমান হয়নি।

৭. ইয়ামামার বাদশাহ হাওযা। মুসলমান হয়নি।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement